শুক্রবার, ১৮ আগস্ট, ২০১৭ ০০:০০ টা

কবি শামসুর রাহমান চলে যাওয়ার পরে

জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত

কবি শামসুর রাহমান চলে যাওয়ার পরে

শামসুর রাহমানের কবিতার অগণিত পাঠক। উভয় বাংলায়ই। বাংলা ভাষার অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি তিনি। তার পাঠক তো থাকবেই। প্রিয় কবি বাঙালি পাঠকের হৃদয়বাসী। অন্য ভাষার পাঠকের কাছেও তার কবিতা অমনি। পাঠকের কাছে পৌঁছে যান তার কথা নিয়ে, এ কারণে কবি যেমন ভালোবাসা পান, তেমনি নির্যাতনও। বাংলা ভাষায়ও। তবে নির্যাতন কী ভালোবাসা, দুটিই যে সর্বদা তার কবিতার জন্যই ঘটে এমন নাও হতে পারে।

 

‘ছেড়ে আসার সময়ে পেছনে তাকিয়ে সমস্ত ছবি সযত্নে হৃদয়ে তুলে রাখতে হয়, যেন কখনো ধূসর আলো ছায়া না ফেলে’— এ কথা সে নিজেই বলেছিল। সমস্ত দৃশ্যই ক্রমে এক ভিন্ন দৃশ্যে মিশে বিবর্ণ হয়ে যায়, এই ভয়ে সে আরও একবার আলোর উেস ফিরেছিল তাই। কিন্তু তখন কোথায়ও আলো নেই মনে হলে সে পুনরায় দূরবাসী। দীর্ঘ প্রবাস আবার দীর্ঘতর, না ফেরার কষ্ট আবার সর্বব্যাপী, দুর্বোধ্য গ্লানি আবার ভাসিয়ে নিয়ে যায়। এই কথাই কবিকে বলেছিল সে। ‘পাদপ্রদীপের আলো তার মুখে, শ্বেতকেশ উজ্জ্বল। পাঞ্জাবির কারুকাজ স্পষ্ট, তবুও সেখানে চুপি বিষাদের ছায়া, তার মনে হয়। ‘আপনারা যারা বিদেশে আছেন, ভালো আছেন; কেন দেশে ফিরে যাবেন—। সে স্তম্ভিত হয়ে কবির এই উক্তি শুনেছিল।’

 

দুই.

উপরোক্ত উদ্ধৃতি এই লেখকের প্রায় ষোলো বছর আগে রচিত একটি নিবন্ধের প্রথমাংশ। শামসুর রাহমান তখন নিউইয়র্কে। কিছুদিনের জন্যই সেখানে গিয়েছিলেন তিনি। শারীরিক খুব সুস্থ নন। ভ্রমণের বিভিন্ন উপলক্ষের মধ্যে চিকিৎসকের সঙ্গে পরামর্শ করাও উদ্দেশ্য। সে জন্যই তার কাছে গিয়েছিলাম সেদিন, আমার পরিচিত এক চিকিৎসকের বাড়িতে তাকে নিয়ে যাব বলে। শহরের উত্তরাঞ্চল ব্রংকসে তার কন্যার বাসায় ছিলেন তিনি সেদিন।

প্রায় আঠারো বছর বিদেশে কাটিয়ে ঢাকায় ফিরেছিলাম আমি সাতাশির নভেম্বরে। মাত্র এক বছর পরই ফিরে আসতে হয়। ইচ্ছা ছিল বছরদুয়েক আবার আমেরিকায় কাটিয়ে দেশে ফিরে যাব। ওই দুই বছরের শেষদিকেই নিউইয়র্কে এসেছিলেন তিনি। ঢাকায় দেখা হলেও ব্রংকসের এ বাসায়ই তার সামনে বসে আমার পরিকল্পনা জানাই তাকে। খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে ওই কথা বলেছিলেন তিনি আমাকে— ‘আপনারা যারা বিদেশে আছেন, ভালো আছেন; কেন ফিরে যাবেন—।’

সময়ের জ্ঞান ছিল আমার। স্বদেশের রাজনীতিরও। দৈনিক বাংলার প্রাক্তন সম্পাদক শামসুর রাহমান নানা প্রসঙ্গে আলোচিত হতেন তখন— কেবল কবিতার জন্যই নয়। শুনেছি, রাষ্ট্রপতির প্রিয় কবি ছিলেন তিনি। তাই ‘কেন ফিরে যাবেন’ শুনে নিঃসন্দেহে বিস্মিত হয়েছিলাম। কয়েক দিন পরে তাকে ঘিরে যে ঘরোয়া সাহিত্যসভার আয়োজন করেছিলাম আমাদের ম্যানহাটানের বাসায়, সেই সভায় তার সামনে আমার ওই বিস্ময়ে মেশানো পূর্বোক্ত রচনাটি পাঠ করেছিলাম। রচনাটি শোনার পরে ওই মুহূর্তে আমাকে কিছু বলেননি তিনি। পরে বলেছিলেন। এই রচনার শেষ অংশে তার উল্লেখ থাকবে।

সেদিনের ওই সাহিত্যসভার আরও একটি উদ্দেশ্য ছিল। শামসুর রাহমানের ষাট বছর পূর্ণ হয়েছে তখন। সে উপলক্ষে নিউইয়র্কের বাংলা সাপ্তাহিক প্রবাসী একটি বিশেষ সংখ্যা প্রকাশের আয়োজন করেছিল। স্থির ছিল ওই সাহিত্যসভায় পঠিত সব রচনাই প্রবাসীর ওই সংখ্যায় মুদ্রিত হবে। হয়েও ছিল। শামসুর রাহমানের জন্মদিন উপলক্ষে কোনো বাংলা সাময়িকীর বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ সম্ভবত সেই প্রথম এবং প্রবাসে।

ওই সময়েই শামসুর রাহমানের অসুস্থতার নানা সংবাদ প্রকাশিত হয়। তার দৃষ্টিশক্তিজনিত অসুস্থতার কথাও। সেসব খবর পড়ে প্রবাসীর এক শুভানুধ্যায়ী প্রবাসীতে প্রকাশের জন্য সম্পাদককে একটি চিঠি পাঠান। তাতে মূল কথা ছিল, শামসুর রাহমানের চোখে গ্লুকোমা হওয়ার ‘এই লজ্জা রাখি কোথায়?’ পত্রলেখকের সঙ্গে পরিচয় ছিল, এই কারণে তাকে বলেছিলাম, কবির দৃষ্টিজনিত অসুস্থতার জন্য আমরা দুঃখিত হতে পারি, কিন্তু লজ্জিত হব কেন? স্পষ্ট উত্তর পাওয়া যায়নি। লজ্জা পাওয়ার একটি কারণ অবশ্য হতে পারে এই যে, প্রবাসে আমরা কবির চিকিৎসার জন্য অর্থ সংগ্রহের ব্যবস্থা করেছিলাম, যদিও বিপুল পরিমাণ অর্থ সংগৃহীত হয়নি এবং অনুমান করি দেশেও অমন ঘটে থাকবে। সম্ভবত ওই অবহেলা ও ব্যর্থতার জন্যই পত্রলেখকের লজ্জা। তবে কি কবি তার প্রতি বাঙালির অবহেলার জন্যই অমন কথা বলেছিলেন— ‘কেন দেশে ফিরে যাবেন?’

শামসুর রাহমানের কবিতার অগণিত পাঠক। উভয় বাংলায়ই। বাংলা ভাষার অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি তিনি। তার পাঠক তো থাকবেই। প্রিয় কবি বাঙালি পাঠকের হৃদয়বাসী। অন্য ভাষার পাঠকের কাছেও তার কবিতা অমনি। পাঠকের কাছে পৌঁছে যান তার কথা নিয়ে, এ কারণে কবি যেমন ভালোবাসা পান, তেমনি নির্যাতনও। বাংলা ভাষায়ও। তবে নির্যাতন কী ভালোবাসা, দুটিই যে সর্বদা তার কবিতার জন্যই ঘটে এমন নাও হতে পারে। অন্তত প্রবাসীর ওই পত্রলেখকের বেলায় নয়। শামসুর রাহমানের কোনো কবিতাগ্রন্থ তার সংগ্রহে আছে বলে আমি মনে করি না। তবুও কবির অসুস্থতায় তিনি উদ্বিগ্ন এবং কিছু না করতে পারার বোধে তিনি লজ্জিত। তার এই বোধ সম্পূর্ণই শামসুর রাহমানের কবিতাসঞ্জাত নয়, কবিতা ও কবির শরীর ঘিরে থাকা ভিন্ন আর এক পরিচয়ে। যেটি বুঝি স্পষ্ট হয়েছে তার জীবনের শেষ পনেরো-কুড়ি বছরে।

শামসুর রাহমানের কবিতার সঙ্গে আমার পরিচয় সদ্য-অতিক্রান্ত কৈশোরে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশের শুরুতেই। লেখাপড়ার খরচ সংগ্রহের জন্য বার্ডস অ্যান্ড বুকস প্রকাশনার স্বত্বাধিকারী মহিউদ্দিন আহমদ (গল্পকার আহমদ মীর) আমাকে তার প্রকাশনার প্রুফ সংশোধনের কাজ দেন। শামসুর রাহমানের প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘প্রথম গান, দ্বিতীয় মৃত্যুর আগে’ বার্ডস অ্যান্ড বুকসেরও প্রথম প্রকাশনা বলে জানি। আর আমি ছিলাম সেই প্রথম প্রকাশনার প্রুফ-পাঠক। তাই যেন কোনো ভুল না থাকে এই কারণে বারবার প্রুফ ও পাণ্ডুলিপি মেলাতে মেলাতে শামসুর রাহমানের কবিতার ঘনিষ্ঠ সংস্পর্শে আসি বলা যায়। মফস্বল শহর থেকে আসা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষের ছাত্র, ‘বনলতা সেন’ ও ‘ছাড়পত্র’-র সঙ্গে নতুন পরিচয়, ‘প্রথম গান, দ্বিতীয় মৃত্যুর আগে’ এই নামই আমাকে বিভ্রান্ত করেছিল। বিস্মিতও। অমন কবিতা আগে পড়া ছিল না বলেই বুঝি।

পরের কয়েক বছরে তার ‘রৌদ্র করোটিতে’ কী ‘বিধ্বস্ত নীলিমা’ প্রকাশিত হলে আমি তার একটি অতি দীর্ঘ সাক্ষাত্কার নিয়েছিলাম। ইংরেজি সাপ্তাহিক হলিডেতে সেটি প্রকাশিত হয়েছিল। সাক্ষাত্কার নেওয়ার জন্য অনেকবার তার কাছে যেতে হয়েছিল আমাকে, তার আশেক লেনের বাড়িতে। ওই সময়ে তার সঙ্গে কথাবার্তায়, কী তার লেখায় এবং তার পরের অনেক বছরেও লেখায় ও কখনো কোনো গৃহত্যাগীকে ঘরে না ফেরার পরামর্শ তিনি দিতে পারেন, মনে হয়নি। তিনি নিজে তো কোথাও যাননি। ‘না, কোথাও যাবো না’ এমন কথা কখনো তাকে মুখে আনতে হয়নি। প্রয়োজন ছিল না। নিজের চারপাশে এত অসংখ্য চিহ্ন ছড়িয়ে দিয়েছিলেন তিনি যে, এমন কথা তার বলারও দরকার ছিল না। অথচ, তিনি তো ছিলেন না কৈশোরে ছাত্র-আন্দোলনের মিছিলে, ছিলেন না যৌবনে গণআন্দোলনের কাতারে, বৈভব চাইবার মতো সহস্র কারণ তো তারও ছিল, ভিন্ন দেশে সম্মান, মর্যাদাও অলভ্য ছিল না তার জন্য। তিনি তো কোথাও যাননি। আগুনের আভাই কেবল নয়, লেলিহান শিখাই তাকে ঘিরে ফেলেছিল, যে কোনো মুহূর্তে তাকে ছাই করে দিতে পারত। তবুও তিনি কোথাও যাননি। তাহলে এক গৃহত্যাগীকে ঘরে না ফেরার কথা বলবেন কেন তিনি!

কথাটি আমাকে ভাবিয়েছে অনেককাল। যারা তার কবিতা কী কর্ম কী জীবনের কথা লিখবেন, জানি তারা বলবেন, কবিতায় ও কবিতার বাইরে এসে মানুষের হাত ধরে হেঁটেছেন তিনি। এ জন্যই জনচিত্তে আসন তার। ঘর ছাড়েননি বলেই তো। তাহলে আমাকে ও কথা বলেছিলেন কেন তিনি! তাহলে কি ওই ষোলো বছর আগের সন্ধ্যায় তিনি এমন কিছু বুঝেছিলেন, যা আমি বুঝিনি!

 

তিন.

নিরাড়ম্বর বিছানায় কবি বসেছিলেন। কিছু অস্বাচ্ছন্দ্য তার চেহারায় স্পষ্ট। শ্বেত, অবিন্যস্ত চুলের রাশি, পরনের পোশাকে কোথাও বিন্দুমাত্র চিহ্ন নেই যশ, খ্যাতি, আকাঙ্ক্ষা, বৈভবের। দূরদেশে দুদিনের অতিথি তিনি, ফিরে তো যাবেনই, থাকার জন্য আসেননি। ‘কিন্তু পারলে ফিরে যেতাম না’, তাকে অপার বিস্ময়ে ভাসিয়ে তিনি বলেন। সে জিজ্ঞাসা করে, ‘কিন্তু কেন? আপনার তো কিছু চাইবার নেই, হারাবার নেই, তাহলে, তাহলে?’

কবি একটু চুপ করেছিলেন, ‘জীবনের জন্য ভয় করি হয়তো।’ তারপরে বলেছিলেন, ‘আর সইতে পারা যায় না।’

সে তখন স্পষ্ট বুঝতে পেরেছিল অসহ্য তার নিজের জীবন নয়। প্রায় অপরাহ্নে পৌঁছে নিজ জীবনের কথা অন্তত তার মনে প্রবল নয়, অন্য কারও কথা, অন্য কিছু তাকে আলোড়িত করে। সেটি কী?

আজ এতদিন পর, তার প্রায় এগারো মৃত্যুরকালে বাংলাদেশের দিকে তাকালে সেটি বোঝা যায়। যদি কয়েক বছর আগের তাকে মৃত্যু উপহার দিতে আসার সেই দিনটিকে তার প্রথম মৃত্যুর দিন ধরি।

সর্বশেষ খবর