শুক্রবার, ১২ জানুয়ারি, ২০১৮ ০০:০০ টা

অপেরা কাহিনী

আবদুল কাদের

পাশ্চাত্যের জনপ্রিয় গীতিনাট্য অপেরা। ইতালিতে উত্থান হলেও ধীরে ধীরে তা ছড়িয়ে পড়ে সমগ্র ইউরোপে। মূলত মঞ্চনাটক ঘরানার মঞ্চ, অভিনয়, পোশাকসজ্জা এবং কখনো নৃত্য সহকারে এই গীতিনাট্য পরিবেশিত হয়। অপেরায় থাকে একক, দ্বৈত ও সম্মেলক গানসহ নানা শ্রেণির গান। অপেরায় থাকে কবিতা আবৃত্তি ও সংলাপ, অর্কেস্ট্রাসহ নানা ধরনের যন্ত্রবাদন, অভিনয়, মূকাভিনয়, নৃত্য, দৃশ্যসজ্জা, অঙ্গসজ্জা প্রভৃতি বহুবিধ বিষয়ের বিপুল আয়োজন। আর এসব নিয়েই আমাদের আজকের অপেরা কাহিনী।

 

অপেরা সংগীতের সূচনা

১৬ শতাব্দীর একেবারে শেষ দিকে ইতালির ফ্লোরেন্সে অপেরার সূচনা হয়। ‘লা ক্যামেরাটা ফোরেন্টিয়া’ নামের একটি সংগীতশিল্পীর দল গান গেয়ে এবং অভিনয় করে নাটকে মুগ্ধ করেছিল সবাইকে। প্রাচীন গ্রিক সংস্কৃতি ও নাটক নিয়ে কৌতূহলের কমতি ছিল না গোটা ইউরোপে। শুধু নাটকে অভিনয়ের সঙ্গে সংযুক্ত হয়েছিল গান। যার ফলশ্রুতিতে অসাধারণ এই সংগীতের সূচনা। ফ্লোরেন্সের ‘লা ক্যামেরাটা’ নব চেতনায় উৎসাহিত প্রাচীন গ্রিক নাটকের পুনরুজ্জীবনের পরিবর্তে অপেরার জন্ম দেয়। সেই সংগীতই আজকের অপেরা নামে পরিচিত। ৪০০ বছর আগে মন্টেভার্টিতে প্রথম অপেরা সংগীত পরিচালনা করেছিলেন অরফিয়াস কিংবদন্তি লা ফাভলা ডি অর্ফো। সেই থেকে আজও ব্যাপক জনপ্রিয় সংগীত অপেরা। শুরু থেকে গ্রিকদের নাট্যকলার সঙ্গে সংগীতকলার মিলন ছিল অপেরার মূল বিষয়। আর জনপ্রিয় অপেরা সংগীতে ব্যবহৃত হতো ছোট ছোট বাদ্যযন্ত্র। পরবর্তীতে ফ্লোরেন্স এবং রোম হয়ে ওঠে অপেরা সংগীতের কেন্দ্রস্থল। ১৬৩৭ সালে বাণিজ্যিকভাবে ‘অপেরা’ চালু হয়। দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে গোটা ইউরোপে। ১৭ শতকে নেপলস, ভিয়েনা, প্যারিস এবং লন্ডন অপেরা শহর হয়ে ওঠে।

 

মধ্য যুগে অপেরা

অপেরা বেশ প্রাচীন গীতিনাট্য হলেও ১৭ শতকের দিকে অপেরা বেশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। এ সময় অপেরা চর্চার জন্য প্রাচীন গ্রিকের অনেক লেখা নাটক রচনা করা হতো। এই শতকের দিকে অপেরার ইতিহাসে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দুটি উন্নতি হয়। প্রথমটি, পারগোলেসের ১৭৩৩ বিধ্বংসী ন্যাশনাল কমেডি ‘লা সারভা প্যাডরোনা’। যেখানে মঞ্চস্থ হয় একজন দাসী সমাজের উচ্চপদস্থ কর্তার ভালোবাসা পরিণয়ের ঘটনা। দাসী এক শিক্ষককে বিয়ে করেছিলেন। এখানে বৈষম্যকে দূরে ঠেলে সংস্কৃতি আর আধুনিকতাকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছিল। এই নাটকে বোঝানো হয়েছিল কেউ বড় আর কেউ ছোট নয়। এ সময় কমেডিয়ান অপেরাও প্রদর্শিত হতে শুরু করে। দ্বিতীয়ত, অপেরায় গান ও আবৃত্তির মাধ্যমে যুক্তি আর বিচার বুদ্ধিকে উপস্থাপিত করা হতো। সাধারণ ও সাদামাটা কথার মাধ্যমে তুলে ধরা হতো সমাজের বাস্তবিক অবস্থা। অপেরার মাধ্যমে সত্য প্রকাশ করা শুরু হয়েছিল এ শতাব্দীতেই। তবে, ১৮ শতকে মোজার্ট কমেডি নতুন সম্ভাবনা তৈরি করে। ১৭৮১-১৭৯১ সালে অপেরা নতুনভাবে যাত্রা শুরু করে। ফলে ইতালীয় ভাষা ছাড়াও জার্মান ভাষায় অপেরা বিস্তার লাভ করতে থাকে।

 

রোমান্টিক যুগ

রুশ বিপ্লবের প্রভাব পড়েছিল অপেরাতেও। ইতালির লুইজি চরুবিনি তখন ব্যাপক জনপ্রিয় এবং সমসাময়িক গীতিনাট্য হিসেবে সর্বাধিক প্রশংসিত হয়। ১৯ শতক পর্যন্ত ইতালির বিখ্যাত সুরকার রোসিনি, ডনিজেটি ও বেলিনি তাদের ভিন্নধর্মী সংগীত চর্চা চলতে থাকে। তাদের লেখা গানগুলো ব্যাপক প্রশংসিত হতে থাকে। শুধু তাই নয়, তাদের সুরেলা কণ্ঠের গুণে অপেরা এক রোমান্টিক যুগে আবর্তিত হয়। যা দর্শকদের কাছে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়। এই ধারা পরবর্তীতেও আধিপত্য বিস্তার লাভ করতে থাকে। তবে পরবর্তীতে বিখ্যাত সুরকার ভার্দি পাঁচ দশক পর্যন্ত তার আধিপত্য ধরে রেখেছিলেন। ১৮৫১ সালে ভার্দির নাটক ‘রগোলেটা’ বেশ জনপ্রিয়তা পায়। এর ঠিক ৪ বছরের মাথায় ১৮৫৫ সালে ‘ইলি তোভাতোর’ এবং ‘লা ট্রায়োত্তা’ প্রদর্শিত হয়। একই ধারাবাহিকতায় ১৮৮৭ সালের নাটক ‘অটেলো’ এবং ১৮৯৩ সালের ‘ফ্যালস্ট্যাফ’ গোটা ইউরোপে খ্যাতি অর্জন করে। এদিকে জার্মানিতে গোথিক-হরর অপেরা ভিন্নমাত্রা যোগ করে। একই ধারার আরেকটি নাটক মার্কসম্যান প্রদর্শিত হয় ১৮২১ সালে। রোমান্টিক ধারার নাটকগুলোর অভিনয়, নাচ ও গানে তুলে ধরা হয় সত্যিকারের গল্প।

 

আধুনিক যুগ

অপেরা আধুনিক আর উন্নত প্রযুক্তি লাভ করে বিংশ শতাব্দীর দোরগোড়ায় এসে। ঊনবিংশ শতাব্দীর শুরুতে জার্মানির রিচার্ড স্ট্রাউস প্রথবারের মতো ওয়াগনানের পথ অনুসরণ করেন এবং এলক্রা ফ্রয়েডের সঙ্গে সমসাময়িক ঘটনার ওপরে অপেরা মঞ্চস্থ করা শুরু করেন। যদিও স্ট্রাস নিজে ‘দের রোসেনক্যাভালিয়ের’ এবং ‘ক্যাপ্রিসিত্তোর’-এর জটিল নাটকীয় কাহিনী নিয়ে কমেডিতে পরিণত হন। এ ছাড়াও যুদ্ধোত্তর যুগে কার্লিন্ভ স্টকহোজেনকে অবাক করে দিয়েছিল ‘লাইট্ট’ নামের সাত পর্বের ধারাবাহিক অপেরা। এর আগে ধারাবাহিক অপেরার কথা চিন্তাই করতে পারত না। ফ্রান্সে পোলেনকে ও মেসিয়নের অসাধারণ ব্যতিক্রমধর্মী অপেরা ইতালি তো বটেই গোটা ইউরোপে প্রশংসিত হয়। ১৯৪৫ সালে ব্রিটেনে পিটার গ্রিম, মাইকেল টিপেট, উইলিয়াম ওয়ালটন এবং হ্যারিসন বিটারভিস্টের মতো অপেরা শিল্পীরা সমসাময়িক কাহিনীর নাটকে অভিনয় করেন এবং অপেরাকে পেশা হিসেবে বেছে নেন। ১৯৮৭ সালে চীনের জন অ্যাডামস নিক্সনের আগমন ঘটে, যাকে সংবাদ মাধ্যম ‘সিএনএন’ অপেরার আধুনিক কাল হিসেবে চিহ্নিত করে। পপ সুরকাররাও এ সময় অপেরায় পরিবর্তন আনেন।

 

অপেরায় বাংলাদেশি

মনিকা ইউনূস

বিশ্বখ্যাত অপেরার সুরে কণ্ঠ দিয়ে শ্রোতাদের মন জয় করা বাঙালি নারী মনিকা ইউনূস। তিনি গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা ড. ইউনূসের মেয়ে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জনপ্রিয় এই অপেরা গায়িকার জন্ম চট্টগ্রামে। জন্মের মাত্র ৪ মাস বয়সেই মায়ের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমান মনিকা। মনিকা ছেলেবেলা থেকেই ইংরেজি ও স্লোভিক ভাষায় পড়াশোনা করেন। শুধু তাই নয়, মনিকা ইতালিয়ান, স্প্যানিশ, জার্মান এবং ফ্রেঞ্চ ভাষাও রপ্ত করেন অল্প বয়সেই। সুরের জগতে উৎসাহিত করেন মনিকার রাশিয়ান দাদি। তার হাত ধরেই মনিকার গানের হাতেখড়ি। শৈশবে প্রথম মনিকা রাশিয়ার চার্চে ক্লাসিক্যাল সংগীত গাওয়ার সুযোগ পান। সেই থেকে শুরু। ডুব দেন অপেরা সাম্রাজ্যে। কিশোর বয়সে মেট্রোপলিটন অপেরা দলে সুযোগ পান। এরপর ম্যাসাচুসেটসের টেঙ্গলউড মিউজিক সেন্টারে অপেরা গায়িকা হিসেবে যোগ দেন। এখান থেকেই মনিকার পেশাদারিত্বের প্রতি আগ্রহ শুরু। কিশোরী মনিকা অ্যাসপেন মিউজিক ফেস্টিভ্যালে অংশ নিয়ে বেশ কয়েকজন অপেরা শিক্ষকের নজর কাড়েন। এখানে থাকাকালীন মনিকা প্রিমিয়ার অব কোপল্যান্ডে অপেরা পরিবেশন করেছিলেন। মনিকা ১৯৯৭ সালে লরেন্সভিল স্কুলে যোগ দেন। ঠিক তার চার বছর পর জুলিয়ার্ড স্কুল থেকে ভোকাল পারফর্মেন্সের ওপর ডিগ্রি অর্জন করেন। এর মধ্যে মনিকা কয়েকটি পেশাদারি অপেরার সংগীতানুষ্ঠানে পারফর্ম করেন। পাশাপাশি বার্কশায়ার অপেরা এবং ইয়াং আর্টিস্ট প্রোগ্রামের সদস্য হন। জুলিয়ার্ড অপেরা সেন্টারে বিখ্যাত সংগীত পরিচালক সুনানাহে্র অপেরায় মিসেস হায়েসের চরিত্রে পারফর্ম করেন। বর্তমানে মনিকা অপেরা গায়িকা হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের মঞ্চ কাঁপান।

 

 

অভিজাত লোকেরা অপেরার দর্শক

অপেরা কখনো কখনো পুরো বিশ্বকে এক করতে পারে। আবার অপেরায় রয়েছে ভিন্ন রকমের অভিজ্ঞতা। ভালো অপেরা মানেই আবেগ, হতাশা আর ভালোবাসা রোমান্টিকতায় পরিপূর্ণ।   কিন্তু এই অপেরার দর্শক কিন্তু আবার সাধারণ মানুষ নয়। এই অপেরা সংগীতের মাঝেই রয়েছে বড়লোকি ব্যাপার। তাই তো এর দর্শকও হয়ে থাকে অভিজাত পরিবারের সদস্য এবং ধনকুবের সব ব্যক্তি। প্রতিটি অপেরার জমকালো আয়োজন দেখতে দর্শকরা এখানে হাজার হাজার ডলার খরচ করে থাকেন। প্রাচীন ও ঐতিহাসিক কাহিনী সংবলিত বিভিন্ন নাটক এবং রচনা এখানে নাচ, গান আর আবৃত্তিতে পরিবেশন করা হয়। বিখ্যাত সব লেখকের লেখা নাটিকাও এখানে প্রদর্শিত হয়ে থাকে দারুণ শৈলীতে। হ্যামলেট, হ্যামিলটন, গেম চেজার, ফেন্টম অব দ্য অপেরা, গোল্ডেন এজ এবং রোমান্ডার মতো বিখ্যাত অপেরা দেখতে এসব হাউসে হাজার হাজার দেশি এবং ভিনদেশি দর্শকের সমাগম ঘটে। অপেরার সংগীতগুলো নবীন এবং প্রবীণ সব ধরনের দর্শকের জন্য বোধগম্য করে পরিবেশিত হয়ে থাকে। অপেরার ভক্ত রয়েছেন যারা সমাজে রীতিমতো সেলিব্রেটি। রথ গিন্সবুর্গ, মরিল স্ট্রিপ, রীতা, লুসি অরল্যান, ক্রিস অ্যাডিসন, জেসিকা চ্যাস্টেইন, দ্য চিকাগো বুলসের মতো অনেক অপেরাপ্রেমী রয়েছেন যারা অপেরা দেখতে মরিয়া হয়ে থাকেন।

 

ব্যয়বহুল অপেরা

অপেরা সংগীত কেন এত ব্যবহুল? নিশ্চই কারণ রয়েছে! অপেরা সংগীত তথা ইংলিশ ন্যাশনাল অপেরা এবং ওয়েলস ন্যাশনাল অপেরার টিকিটের মূল্য যে কোনো প্রিমিয়ার ক্রিকেট লিগ এমনকি বিশ্বকাপ ক্রিকেটের টিকিটের মূল্যের চেয়েও অনেক বেশি। কারণ, প্রথমত- ক্রীড়া পরিষদগুলো তাদের নানা আয়োজনে আর্থিক ভর্তুকি দিয়ে থাকে। পক্ষান্তরে অপেরা সংগীতের ক্ষেত্রে এমনটি ঘটে না। দ্বিতীয়ত, অপেরা গায়ক-গায়িকারা অপেরা থেকে খুব বেশি উপার্জন করতে পারেন না। তা ছাড়া অপেরা গায়ক-গায়িকাদের ঠিক কী পরিমাণ সম্মানী দেওয়া হয় তা নিয়েও ধূম্রজাল রয়েছে বিস্তর। সূত্র মতে জানা যায়, নিউইয়র্কে অপেরার জনপ্রিয়তা অনুযায়ী সেখানকার প্রতিটি পারফর্মারকে প্রায় ১৩,৫০০ মার্কিন ডলার (১০,০০০ ব্রিটিশ পাউন্ড) সম্মানী দেওয়া হয়। সম্মানীর এই হার কমপক্ষে একদশকেও পরিবর্তন হয় না। বড় বড় সেলেব্রেটি ও কর্মকর্তারা বিশাল সম্মানী পেলেও ছোট ছোট কর্মীরা সম্মানী পায় একেবারেই কম। এর বাইরেও অপেরার প্রতিনিধিরা অনুষ্ঠানের প্রায় ১৫ শতাংশ লভ্যাংশ নেন। কিন্তু তারা অপেরার রিহার্সেল, ভ্রমণ ও হোটেল খরচ বাবদ কোনো অর্থ দেয় না। তা ছাড়া অপেরা সংগীতের বিশাল রাজকীয় হল রুম, মিউজিক ইন্সট্রুমেন্টাল খরচ তো আছেই। একবার ভাবুন তো! সম্পূর্ণ একটি অপেরা অনুষ্ঠানে ঠিক কী পরিমাণ খরচ হতে পারে? অনেক বেশি...

 

দৃষ্টিনন্দন অপেরা হাউস

অপেরা হাউস, অভিজাত লোকদের বিনোদনশালা। বড় একটা শহরের রত্ন মনে করা হয় অপেরা হাউসকে। এসব হাউস শুধু সংগীতের জন্যই বিখ্যাত নয়, বিখ্যাত এদের শিল্পের বিন্যাসের জন্য, স্থাপত্যশৈলীতেও।

সিডনি অপেরা হাউস, সিডনি

সারা বিশ্বে সবচেয়ে বিখ্যাত অপেরা হাউসটি রয়েছে সিডনিতে। অস্ট্রেলিয়ার রত্ন এটি। এটি শুধু সংগীতের ভবনই নয় এটি বিশ্ব ঐতিহ্যেরও একটি অংশ। ১৯৭৩-এর অক্টোবরে সিডনি হারবারে এটি খোলা হয়। এর নকশা একটি জাহাজের মতো। অপেরা হাউসটির ডিজাইন করেছেন জর্ন উটজন। ১০০০ জন মানুষের ধারণক্ষমতা সম্পন্ন দালানটি পর্যটকদের অন্যতম আকর্ষণ।

পালাইস গার্নিয়ার, প্যারিস

প্যারিসের প্রতীক। লুভ্যোর আর আইফেল টাওয়ারের মতো। প্যারিস অপেরার জন্য এটি খোলা হয় ১৮৭৫ সালে। এই হাউসটিতে প্রায় ২০০০ দর্শক এক সঙ্গে অপেরা দেখতে পারে। এর নকশা চার্লস গারনিয়রের করা। তৈরি করা হয়েছে বিয়ক্স-আর্ট স্টাইলে। এখানে বাড়তি পাওয়া হচ্ছে প্যারিস অপেরা লাইব্রেরি মিউজিয়াম।

রয়েল অপেরা হাউস, লন্ডন

ব্রিটেনের ওয়েস্ট মিনস্টারে অবস্থিত সবচেয়ে বড় অপেরা হাউস এটি। ১৭৩২ সালে এই হাউসটি তৈরি করা হয়। বিখ্যাত হাউসটি কয়েকবার ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পর সংস্কার করা হয়। এর প্রধান বিল্ডিংটিকে বলা হয় কনভেন্ট গার্ডেন, যেখানে ২৩০০ দর্শকের বসার ব্যবস্থা রয়েছে। পল হেমলিন হল এবং লিনবুরি স্টুডিও থিয়েটার জল এই অপেরা হাউসের অনন্য সংযোজন। অপেরার পাশাপাশি এখানে বিভিন্ন অ্যাওয়ার্ড অনুষ্ঠানের আয়োজন হয়ে থাকে।

বোলসোই থিয়েটার, মস্কো

রাশিয়ার অন্যতম সেরা অপেরা হাউস বোলসোই থিয়েটার। ১৭৯৪ সালে মাত্র ছোট্ট একটি দালান নিয়ে এর যাত্রা শুরু হয়েছিল। বর্তমান ভবনটির নকশা করেন আন্দ্রেই মিখালভ। ১৮২৫ সালে নতুন ভবনটি উন্মুক্ত করা হয়। ২০০৫ সালে অভ্যন্তরীণ নির্মাণের জন্য এটি বন্ধ করা হয়েছিল এবং ২০১১ সালে তা পুনরায় খুলে দেওয়া হয়। চারপাশের ব্যালকনি ও দৃষ্টিনন্দন চেয়ার দর্শকের দৃষ্টি আকর্ষণ করবেই।

মেট্রোপলিটন অপেরা হাউস, নিউইয়র্ক

নিউইয়র্কের লিংকন সেন্টারে অবস্থিত অপেরা হাউসটি ১৯৬৬ সালে খোলা হয়। এর নকশা অয়ালেন্স কে হ্যারিসনের তৈরি। অপেরা হাউসটিতে ৪০০০ দর্শক একসঙ্গে বসতে পারে। এখানে ক্লাসিকাল যেমন আছে তেমনি আছে আধুনিক সুরও।

লা স্কালা, ইতালি

মিলানের লা স্কালা অপেরা হাউসটি সম্ভবত বিশ্বের সবচেয়ে বিখ্যাত অপেরা হাউস। ১৭৭৮ সালে বিভিন্ন লজসহ হার স্তরের এই অপেরা হাউসটি নির্মাণ করা হয়েছিল। এটি রোসিনি, বেলিনি, পনিজেটি এবং ভার্দির বাড়ি নামেই সবচেয়ে পরিচিত। এই অপেরা হাউসের চমৎকার সুরের মূর্ছনা দর্শকদের আকর্ষিত করে। শুধু তাই নয়, এখানে সংগীতও শেখানো হয়।

 

কেমন খরচ করতে হয়?

অপেরা সংগীত, নামেই আঁচ করা যায় অনেকটা বড়লোকি ব্যাপার রয়েছে এই সংগীতে। এই অপেরা সঙ্গী একই সঙ্গে নেচেগেয়ে দর্শকের সামনে প্রদর্শন করা হয়। এখানে অভিনয় শিল্পীরা সংলাপের মাধ্যমে গান গেয়ে অভিনয় করে থাকেন। এখানে বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে নানা ধরনের সংগীতানুষ্ঠান হয়ে থাকে। অপেরায় থাকে একক, দ্বৈত ও সম্মেলক গানসহ নানা শ্রেণির গান। থাকে কবিতা আবৃত্তি ও সংলাপ, অর্কেস্ট্রাসহ নানা ধরনের যন্ত্রবাদন, অভিনয়, মূকাভিনয়, নৃত্য, দৃশ্যসজ্জা, অঙ্গসজ্জা প্রভৃতি বহুবিধ বিষয়ের বিপুল আয়োজন। তাই তো অভিজাত লোকদের এই সংগীতানুষ্ঠানের একটি টিকিটের মূল্যও বেশ চড়া দামে বিক্রি হয়। নাটক, সংগীতের ওপর নির্ভর করে এক একটি অপেরা টিকিটের মূল্য প্রায় ৫০ বা ৬০ ডলার হয়ে থাকে। আর সর্বোচ্চ মূল্য  দাঁড়ায় প্রায় ২০০ ডলার কিংবা তারও বেশি।  এ ছাড়াও অনেক সময় বিশেষ ছাড়ে দেওয়া টিকিটের মূল্য মাত্র ২৫ ডলার থেকে শুরু হয়ে প্রায় ১০০ ডলারের মধ্যে এসে ঠেকে। বিশ্বসেরা অপেরা দল এবং বিশেষ কোনো অপেরা সেলিব্রেটিদের পারফর্ম থাকলে সেই জমজমাট অনুষ্ঠানের টিকিটের মূল্য বেশ চড়া দামেই বিক্রি হয়ে থাকে।

 

বিশ্বসেরা অপেরা দল

[ জোহানস ভারমিয়ার ]

লন্ডনের কেলিসিয়াম, বিশাল অডিটরিয়ামে জমকালো এক আয়োজন। উপলক্ষ একটাই, বিশ্বসেরা অপেরা দলের নাম প্রকাশ। ৭ মে ২০১৭, দিনটি ছিল অপেরাপ্রেমীদের জন্য উৎসবমুখর দিন। এ দিনে বিখ্যাত ‘হিউস্টন গ্র্যান্ড অপেরা’, ‘অপার স্টটগার্ড’, ‘অপেরা ভ্যালেন্ডারেশন’, ‘রয়্যাল অপা হাউস’ এবং ‘টিটোরো অ্যালা স্কালা’কে পেছনে ফেলে বছরের সেরা অপেরা দলের খেতাব জিতে নেন ‘অপেরা ডি লায়ন’। ফ্রান্সের এই অপেরা দল এবং হাউসটির রয়েছে শত বছরের গৌরব গাথা ইতিহাস। এ ছাড়া একই দিনে অপেরার ৫০তম বার্ষিকী উপলক্ষে আন্না নেত্রবোকো বছরের সেরা পুরস্কার ‘লরেন্স ব্রাউনলি’ লাভ করেন। একই উৎসবে ক্রিস্টফ লয় জেতেন সেরা পরিচালকের পুরস্কার। জোয়ান ডিয়াগো ফ্লোরেজ জিতেন রিচার্ড অ্যাওয়ার্ড এবং কিংবদন্তি সোফারানা রেনাটা স্কটোক আজীবন সম্মাননা পুরস্কার লাভ করেন। সেরা নাচের খেতাব জেতেন ‘ওয়াসফি কানি’ এবং ‘নিল নরম্যান’। ক্লাসিক্যাল সংগীতের সেরা রেকর্ডিং পুরস্কারটি আসে ‘পিক ডেম’-এর হাতে। বিশ্বসেরার এমন আসর বসেছিল এর আগেও। সেবার ‘এল’ওরফেও’ বিশ্বসেরা অপেরা দলের খেতাব জিতেছিল।

 

 

সেরা অপেরা সংগীতশিল্পী

ডিট্রিফ ফিশার ডিস্কো

অপেরা গীতিনাট্যে সংগীতের মূর্ছনায় যারা স্টেজ মাতান তাদের মধ্যে প্রথমেই রাখা যায় ডিট্রিফ ফিশার ডিস্কোকে। ফিশারের গানে খুঁজে পাওয়া যেত বাস্তবতা। ফিশার ১৯২৫ সালে জার্মানির ব্রেগে নেন এবং তার হাত ধরেই জার্মানির শাস্ত্রীয় সংগীতের উত্থান ঘটে। ছেলেবেলা থেকেই ফিশার ১৮ শতকের গান দিয়ে সংগীত চর্চা করতেন।

মারিয়া কলাস

মারিয়ার সংগীত অনেকের পছন্দ না হলেও তার গানের প্রেমে পড়ে যাবে প্রজন্মের পর প্রজন্ম। মারিয়া কলাস একজন গ্রিক আমেরিকান এবং বিংশ শতাব্দীর প্রভাবশালী গায়িকাদের একজন। ১৯২৩ সালে এই সুরকারের জন্ম এবং ভক্তদের কাছে তিনি ভিওলেত্তা নামেই সর্বাধিক পরিচিত। সমালোচকরা তার  গাওয়ার কৌশল, বিস্তৃত কণ্ঠ ও অভিনয়ের ভূয়সী প্রশংসা করেন।

প্লেসিডো ডোমিংগো

অন্য যে কোনো সময়ের তুলনায়  ডোমিংগোর গাওয়া গানকে আধুনিক ধারার গান বলে আখ্যায়িত করা যায়। তার পুরো নাম জোসে প্লেসিডো ডোমিংগো এমিল। ১৯২১ সালে স্পেনে জন্ম নেন এই গায়ক। তার ভিন্ন দুটি পরিচয় রয়েছে। ডোমিংগো স্পেনের মেয়র এবং প্রভাবশালী প্রকৌশলী ছিলেন। ডোমিংগোর খোলামেলা গানে ফুটে উঠতো বাস্তবতা। 

জোয়ান সুথেরল্যান্ড

খ্যাতি কুড়িয়ে আনার জন্য জোয়ান ছিলেন অত্যন্ত দায়িত্বশীল। জোয়ান অস্ট্রেলিয়ার সিডনি শহরে ১৯২৬ সালে জন্ম নেন। তিনি অস্ট্রেলিয়ার অপেরা নাটকীয় উন্নতির অগ্রদূত ছিলেন। ১৯৮০ সালের শেষ দিকে ‘বেল ক্যান্টোকে’র রেকর্ডের মাধ্যমে জোয়ানের সুনাম ও জনপ্রিয়তা ছড়িয়ে পড়ে দ্রুত গতিতে। জোয়ান ইতালিয়ান এবং জার্মানির ভাষা খুব ভালো করে জানতেন।

লুসিয়ানো পাভারোতি

পাভারোতি সংগীতের সীমারেখা অতিক্রম করেছেন। শুধু তাই নয়, গোটা বিশ্বে সুপারস্টার বনে যান অপেরায় সুর করেই। লুসিয়ানো ১৯৩৫ সালে ইতালিতে জন্ম এবং সর্বকালের সেরা সংগীতশিল্পীদের একজন। লুসিয়ানোর কর্মজীবনের পুরোটাই ছিল অপেরাকে ঘিরে। রিচার্ড স্ট্রসের ‘দ্যানিজেটির বেল ক্যান্টো-স্টাইল্ড’-এর মতো অনেক আধুনিক কাজের সঙ্গে লুসিয়ানো সম্পৃক্ত ছিলেন এবং ফিফা বিশ্বকাপে তিনি উপস্থাপনা করেছিলেন।  

কারস্টেন ফ্ল্যাগস্টেড

ওয়াগনারের অপেরা ইতালীয় এবং ফরাসি ঐতিহ্য থেকে অনেক দূরে সরে যায়। একইভাবে ফ্ল্যাগস্টেড নিজেকে গায়িকা দাবি করে চমক দেখান। ১৮৯৫ সালে বিখ্যাত এই গায়কের জন্ম এবং তিনি নরওয়েজীয় অপেরা গায়িকা ছিলেন। সমালোচকরা তাকে ‘শতাব্দীর সেরা কণ্ঠস্বর’ হিসেবে আখ্যায়িত করেন।

ফ্রিটস ওয়ডারলাইট

ফ্রিটস ওয়ডারলাইট সম্ভবত টাকার জন্য অপেরা গাইতেন। কিন্তু পরবর্তীতে তার কণ্ঠস্বর তাকে অপেরা সুপারস্টার বানিয়ে দেয়। ফ্রিটস ছিলেন জার্মানির গীতিকার এবং কমেডি গানের জন্য বিখ্যাত। তার বেশির ভাগ কাজের রেকর্ড ছিল জার্মান ভাষায় অনুবাদ।

লাওন্টিন প্রাইস

আফ্রো-আমেরিকানদের মধ্যে প্রাইস একজন সফল অপেরা গায়িকা হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেন। দুর্ভাগ্যবশত প্রাইস এখনো বিতর্কিত গায়িকা হিসেবেই পরিচিত। আমেরিকার মিসিসিপিতে ১৯২৭ সালে এই গায়িকার জন্ম। ১৯৫০ থেকে ১৯৬০ দশকের মধ্যে প্রাইস আন্তর্জাতিক সম্মাননা পান এবং মেট্রোপলিটন অপেরাতে শীর্ষস্থানীয় শিল্পীর মর্যাদা পান।

নিকোলাই গদ্দা

‘মুসোগস্কির বরিস গডনভে’তে অভিনয়ের পর গদ্দার খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে অপেরা প্রাঙ্গণে। নিকোলাই গদ্দা একজন সুইডিশ নাগরিক এবং জন্ম ১৯২৫ সালে। ভাষা দক্ষতায় গদ্দা ছিলেন তুখোড়। ফ্রেঞ্চ, রাশিয়ান, ইতালিয়ান, জার্মান, ইংলিশ, চেক এবং সুইডিশ ভাষায় তিনি অপেরা পরিচালনা করতেন।

ডেম এলিজাবেথ শোয়ার্জকফ

বেঁচে থাকাকালীন অসাধারণ অপেরায় মানুষের হৃদয় স্পর্শ করতেন। তিনি ডেম এলিজাবেথ শোয়ার্জকফ। ১৯১৮ সালের ডিসেম্বরে জার্মানির প্রাসিয়ায় জন্ম গ্রহণ করেন। ১৯২৮ সালে জার্মানির এই অপেরাশিল্পী স্টেজ মাতিয়ে ছিলেন। তখন তার বয়স ছিল মাত্র ১৩ বছর। বার্লিন বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই তার গানের চর্চা শুরু।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর