শুক্রবার, ২৮ মে, ২০২১ ০০:০০ টা

আমিরুল মুমিনিন হজরত ওমর

মেজর নাসির উদ্দিন আহাম্মেদ (অব.) পিএইচডি

আমিরুল মুমিনিন হজরত ওমর

এক নজরে হজরত ওমর (রা.)

ইসলামের ইতিহাসে মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর জাগতিক মৃত্যুর পর মুসলিম জাহানের দ্বিতীয় এবং পরম প্রতাপশালী খলিফা হিসেবে হজরত ওমর ইবনে খাত্তাব (রা.) এর আবির্ভাব ঘটে। আত্মীয়তার সূত্রে নিজ বিধবা কন্যা হাফসা বিনতে ওমরকে হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর কাছে বিবাহ প্রদানের মাধ্যমে হজরত ওমর (রা.) মহানবী (সা.)-এর শ্বশুরে পরিণত হন। তথাপি বিভিন্ন কারণে হজরত ওমর (রা.) মহানবী (সা.)-এর কাছে অত্যন্ত শ্রদ্ধেয় ব্যক্তি ছিলেন। হজরত ওমর (রা.) ইসলাম গ্রহণের পর ইসলামের প্রচার ও প্রসার নতুন মাত্রা লাভ করে। কথিত আছে, শত্রুদের ভয়ে প্রথম দিকে গোপনে নামাজের আজান দেওয়া হতো। কিন্তু হজরত ওমর (রা.) ইসলাম গ্রহণের পর প্রকাশ্যে আজানের প্রচলন ঘটে। এর ফলে তিনি ‘আল-ফারুক’ অর্থাৎ ‘সত্য ও মিথ্যা কিংবা ভুল ও শুদ্ধের মাঝে পার্থক্যকারী’ হিসেবে উপাধি লাভ করেন। সহি বোখারি শরিফের ৫ নং বইয়ের ৫৭ খন্ডের ৩৮ নং হাদিস মোতাবেক হজরত  মুহাম্মদ (সা.) তাঁর উম্মত ও সঙ্গীদের বলেছেন, ‘তোমাদের মধ্যে বিভিন্ন জাতিসত্তার কিছু মানুষ বিশেষভাবে অনুপ্রাণিত (মহিমান্বিত বা আশীর্বাদপ্রাপ্ত যদিও তারা নবী নন)। আমার অনুসারীদের মধ্যে যদি কেউ এমন নবী হতেন, তবে তিনি হতেন হজরত ওমর (রা.)।’ বিধর্মীরাও হজরত ওমর (রা.)-কে সমীহ করতেন। ১৯৭৮ সালে মার্কিন পদার্থবিজ্ঞানী, জ্যোতির্বিজ্ঞানী ও গবেষক মাইকেল এইচ হার্ট ‘দি হান্ড্রেড :  এ র‌্যাংকিং অব দ্য মোস্ট ইনফ্লুয়েনসিয়াল পারসন ইন হিস্ট্রি’ নামক গ্রন্থে পৃথিবীর সর্বকালের ইতিহাসে সবচেয়ে প্রভাবশীল যে ১০০ জন মানুষের জীবনী রচনা করেছেন সেখানে ৫২ নম্বরে হজরত ওমর (রা.) অন্তর্ভুক্ত হয়েছেন। উল্লেখ্য, এ তালিকায় সবার ওপরে রয়েছেন আমাদের প্রিয় নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)। এই বইয়ের প্রথম সংস্করণ ৫ লাখ কপি বিক্রি হয়েছিল। পৃথিবীর বহু ভাষায় বইটি অনুবাদ করা হয়।

মক্কার বানু আদি বংশে বাবা খাত্তাব ইবনে নৌফাল এবং মা হানতামা বিনতে হিশামের ঘরে হজরত ওমর (রা.)-এর জন্ম হয় ৫৮৪ সালে। বংশগতভাবে হজরত ওমর (রা.)-এর বাবা তার গোত্রের একজন গণ্যমান্য ব্যক্তি ছিলেন এবং বিভিন্ন গোত্রের মতপার্থক্য দূর করার বা সালিশ করার দায়িত্ব পালন করতেন। তবে পিতা পেশায় ব্যবসায়ী হলেও পিতার আদেশে হজরত ওমর (রা.) শিশুকালে উট চরাতেন। জ্ঞানার্জনের ক্ষেত্রে নানা প্রতিকূলতা কাটিয়ে হজরত ওমর (রা.) লেখা এবং পড়ার দক্ষতা অর্জন করেন। তিনি ছিলেন একাধারে সাহিত্যপ্রেমী, মল্লযোদ্ধা ও ঘোড়দৌড়বিদ। বলিষ্ঠ ও লম্বা দৈহিক গড়ন তাকে আকর্ষণীয় করে তুলেছিল। প্রাপ্ত বয়সে একজন ব্যবসায়ী হিসেবে তিনি রোম ও ইরানে (পারস্যে) গমন করেন। সেখানে তিনি বহু বিদ্বান ব্যক্তির সান্নিধ্য লাভ করলেও ব্যবসায়ে সাফল্য লাভ করতে পারেননি।

 

প্রথম জীবনে ইসলামের বিরোধিতা

হজরত মুহাম্মদ (সা.) ৪০ বছর বয়সে অর্থাৎ ৬১০ সালে নবুয়তপ্রাপ্ত হন এবং ইসলাম প্রচার শুরু করেন। তখন ছিল ‘আইয়ামে জাহিলিয়াত’ বা অন্ধকার যুগ। ইসলামের একাত্ববাদের স্থলে মক্কাবাসী তখন বিভিন্ন দেব-দেবীর পূজায় নিমগ্ন ছিল। হজরত ওমরও (রা.) এর ব্যতিক্রম ছিলেন না। বরং প্রভাবশালী পরিবারের সদস্য হিসেবে নিজ গোত্রের ধর্মবিশ্বাস তথা মূর্তিপূজা টিকিয়ে রাখতে অগ্রণী ভূমিকা রেখেছিলেন তৎকালীন অমুসলিম হজরত ওমর (রা.)। তিনি ছিলেন যে কোনো মূল্যে মূর্তিপূজা টিকিয়ে রাখার পক্ষে। এজন্য মূর্তিপূজার বিরুদ্ধে অবস্থানকারী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর মৃত্যুদন্ড প্রদান কিংবা আমাদের প্রিয় নবী (সা.)-কে হত্যা করার পক্ষে রায় দেন তৎকালীন হজরত ওমর (রা.)। সর্বোপরি মহানবী (সা.) এর পরামর্শ এবং অনুমোদন নিয়ে একদল মক্কাবাসী আবিসিনিয়ায় হিজরতে গমনে মক্কাবাসীদের মাঝে বিভক্তির সৃষ্টি হয়। হজরত ওমর (রা.) এই বিভক্তিতে তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন এবং তা প্রতিহত করতে হজরত মুহাম্মদ (সা.)-কে হত্যা করতে দৃঢ় সংকল্প ব্যক্ত করেন।

 

ইসলাম ধর্ম গ্রহণ

হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর জীবনে মহান আল্লাহর কৃপায় যে কয়েকটি অলৌকিক ঘটনা ঘটেছিল, হজরত ওমর (রা.)-এর ইসলাম গ্রহণ তার অন্যতম। যে নাটকীয় ঘটনার মধ্য দিয়ে  হজরত ওমর (রা.) ইসলাম গ্রহণ করেন, তার বর্ণনা বিভিন্ন গ্রন্থ, ডকুমেন্টারি, সোশ্যাল মিডিয়া ও আলেম সমাজের ওয়াজ বা বর্ণনায় পাওয়া যায়। তবে লন্ডন থেকে ১৯৯৫ সালে প্রকাশিত ও জালালুদ্দীন আবদুর রহমান আস সুয়াতি ও আবদুস সামাদ ফারুকী রচিত ‘দি হিস্ট্রি অব খলিফাস হু টুক দ্য রাইট ওয়ে’ গ্রন্থে বর্ণিত ঘটনাটিকে গ্রহণযোগ্য ধরা যায়। গ্রন্থ মতে, মক্কাবাসীর একটি দল ইসলাম গ্রহণপূর্বক আবিসিনিয়ায় হিজরতের এক বছরের মাথায় মক্কাবাসী দলে দলে ইসলাম গ্রহণ করলেও জীবন রক্ষার্থে অনেকেই তা গোপন রাখতেন। হজরত ওমর (রা.)-এর প্রিয় বন্ধু নাঈম বিন আবদুল্লাহ এমনকি হজরত ওমর (রা.)-এর আপন বোন ফাতিমা বিনতে খাত্তাব ও তাঁর স্বামী (চাচাতো ভাই) হানিফ সাঈদ ইবনে জায়িদও গোপনে ইসলাম গ্রহণ করেন, যা হজরত ওমর (রা.) জানতেন না। বিভিন্ন বর্ণনা মতে, হজরত ওমর (রা.) তাঁর গোত্রের ধর্ম বিশ্বাস তথা মূর্তিপূজার প্রতি মানুষের অনাগ্রহ তথা ইসলামের প্রতি এই আগ্রহ মেনে নিতে পারেননি। তাই যে কোনো মূল্যে ইসলাম ধর্মের মধ্যমণি ও প্রচারক হজরত মুহাম্মদ (সা.)-কে হত্যা তথা ইসলাম প্রচার বন্ধ করার শপথ নেন।

৬১৬ সালের ঘটনা, মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-কে হত্যার উদ্দেশ্যেই ঘর থেকে তলোয়ার হাতে বের হন তৎকালীন অমুসলিম হজরত ওমর (রা.)। পথে দেখা হয়, প্রিয় বন্ধু নাঈম বিন আবদুল্লাহর সঙ্গে। হজরত ওমর (রা.)-এর হত্যা পরিকল্পনা জানার পর বন্ধু নাঈম তাকে বাধা দেন এবং বলেন যে, হজরত মুহাম্মদ (সা.) কে হত্যা করা হলে তাঁর (প্রিয়নবী) গোত্রের লোকজন তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখাবে এবং হজরত ওমর (রা.) এর ওপর পাল্টা আক্রমণ করবে। তাই হজরত ওমর (রা.)-কে ঘরে ফিরে শান্ত ও ঠান্ডা মাথায় সিদ্ধান্ত নেওয়ার পরামর্শ দেন বন্ধু নাঈম। বন্ধুর পরামর্শে ঠিক ওই মুহূর্তে হত্যাচিন্তা থেকে বেরিয়ে আসেন এবং নিজ ঘরের দিকে যাত্রা করেন। সেই ফেরার পথেই ছিল হজরত ওমর (রা.)-এর আপন বোন ফাতিমা বিনতে আল খাত্তাবের বাসা। ফাতিমা ও তাঁর স্বামী সাঈদ বিন জায়িদ ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন এবং প্রাণভয়ে তা গোপন রেখেছিলেন। হজরত ওমর (রা.) যখন ফাতিমার ঘরে প্রবেশ করেন, তখন তিনি ও তাঁর স্বামী পবিত্র কোরআনের সুরা ‘ত্বা-হা’ পাঠ করছিলেন। হজরত ওমর (রা.)-এর উপস্থিতি টের পেয়ে তারা পবিত্র কোরআন লুকিয়ে ফেললেও হজরত ওমর (রা.) ঠিকই বুঝতে পারেন তাঁরা ইসলাম গ্রহণ করেছেন এবং গোপনে কিছু একটা (কোরআন) পাঠ করছেন। এরপর শুরু হয় ঝগড়া-বিবাদ এবং তর্কযুদ্ধ। একপর্যায়ে হজরত ওমর (রা.) নিজ ভগ্নিপতি সাঈদকে মারার উদ্যোগ নিলে এগিয়ে আসেন বোন ফাতিমা। হজরত ওমর (রা.) ক্ষিপ্ত হয়ে ফাতিমাকে চড় মারলে তিনি মাটিতে পড়ে যান এবং তাঁর গলা দিয়ে রক্ত বের হতে থাকে। হজরত ওমর (রা.) ফাতিমা যা পাঠ করছিলেন (পবিত্র কোরআন) তা দেখানোর হুকুম দেন। উত্তরে ফাতিমা জীবন গেলেও ইসলামের পথ থেকে বিচ্যুত না হওয়ার এবং কোনো অপবিত্র ব্যক্তির হাতে তথা হজরত ওমর (রা.)-এর হাতে পবিত্র কোরআন তুলে দিতে অস্বীকার করেন। এবার হজরত ওমর (রা.) নিজেকে পবিত্র করেন। বিভিন্ন সূত্র মতে, এ সময় তিনি কোরআন খুলে ২০ নং সুরা ত্বা-হার ১৪ নং আয়াত পাঠ করেন যেখানে উল্লিখিত, ‘আমিই আল্লাহ, আমি ছাড়া অন্য কোনো উপাস্য নেই। অতএব তুমি আমার উপাসনা কর এবং আমাকে স্মরণ করে নামাজ কায়েম কর।’ এই বাণী পাঠ করা মাত্র হজরত ওমর (রা.) অঝোরে কাঁদতে থাকেন এবং মেনে নেন এই বাণী নিঃসন্দেহে মহান আল্লাহ প্রেরিত এবং হজরত মুহাম্মদ (সা.) অবশ্যই আল্লাহর রসুল। সুনান আল তিরমিজি গ্রন্থের ৩৬৮১ নং হাদিস মোতাবেক ইবনে ওমর থেকে বর্ণিত, মহানবী (সা.) মহান আল্লাহর কাছে ফরিয়াদ করেন যে, ইসলামের শক্তি বৃদ্ধির জন্য হজরত ওমর (রা.) কিংবা আবু জাহেলের মধ্যে অন্তত একজন যেন ইসলাম গ্রহণ করেন। এ ঘটনার পরপরই হজরত ওমর (রা.) তাঁর বোন ফাতিমার ঘরে ওপরে বর্ণিত ঘটনার সম্মুখীন হন। এর ফলে তাঁর মন পাল্টে যায় এবং তিনি হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর কাছে গিয়ে ইসলাম গ্রহণ করেন। হজরত ওমর (রা.)-এর ইসলাম গ্রহণ মুসলমানদের মাঝে নতুন উদ্দীপনা সৃষ্টি করে এবং তাঁর নেতৃত্বে প্রকাশ্যে কাবাঘর প্রদক্ষিণ এবং অন্যান্য এবাদত শুরু হয়। ৬২২ সালে বিভিন্ন কারণে হজরত মুহাম্মদ (সা.) মুসলমানদের মক্কা ছেড়ে মদিনায় হিজরতের আদেশ দেন। কুরাইশদের ভয়ে অধিকাংশ মুসলমান রাতের আঁধারে মক্কা ত্যাগ করেন। তবে হজরত ওমর (রা.) ছিলেন এর ব্যতিক্রম। তিনি প্রকাশ্যে দিনের আলোতে মক্কা ত্যাগ করেন এবং বীরদর্পে ঘোষণা দেন যে, কেউ যদি তার স্ত্রীকে বিধবা কিংবা সন্তানদের এতিম করতে চায়, সে যেন সামনে আসে। বলা বাহুল্য এমন দুঃসাহস কেউই করেনি।

 

ফিলিস্তিনে গমন

হজরত ওমর (রা.)-এর ফিলিস্তিন গমন, ভ্রমণ, মসজিদ স্থাপন ও চুক্তি সম্পাদন নানা দৃষ্টিকোণ থেকে একটি তাৎপর্যময় অধ্যায়। একদা বাইজেনটাইন নামে পরিচিত রোমানদের আওতাধীন ছিল বর্তমান ফিলিস্তিন ও তৎসংলগ্ন অন্যান্য এলাকা। হজরত আবু বকর (রা.)-এর শাসনামলে মুসলমান বাহিনী পূর্বে ইরাক ও পশ্চিমে বাইজেনটাইনদের দখলে থাকা এলাকা নিজ আয়ত্তে আনে। তাঁর মৃত্যুর পর পরবর্তী খলিফা হিসেবে হজরত ওমর (রা.) এই বিজয়ের ধারা অব্যাহত রাখেন। ৬৩৬ সালে ইয়ারমুক যুদ্ধে মুসলমানদের হাতে বিধর্মীরা পরাজিত হয়। ফলে ওই অঞ্চলে মুসলমানদের আধিপত্য বৃদ্ধি পায়। হজরত ওমর (রা.)-এর আদেশে মুসলমান সেনাপতি আবু উবায়দা এবং খালিদ বিন ওয়ালিদ ফিলিস্তিনের জেরুজালেম দখলের জন্য যাত্রা করেন এবং ৬৩৬ সালের নভেম্বরে শহরটি অবরুদ্ধ করেন। এতে রোমান (বাইজেনট) সৈন্যরা পিছু হটে দুর্গে অবস্থান নেয়। চার মাস অবরুদ্ধ থাকার পর জেরুজালেমের ধর্মীয় নেতা সফরোনিয়াম আত্মসমর্পণে সম্মত হন এবং কর প্রদানের অঙ্গীকার করেন। তবে তাঁর আবেদন ছিল আমিরুল মোমিনিন হজরত ওমর (রা.) যেন স্বয়ং জেরুজালেম আগমন করেন এবং আত্মসমর্পণের দলিলে স্বাক্ষর করেন।

মুসলমান সেনাপতি আবু উবায়দার আমন্ত্রণে তখন হজরত ওমর (রা.) মদিনা ছেড়ে জেরুজালেমের উদ্দেশে যাত্রা করেন। এই যাত্রায় বিশাল মুসলিম জাহানের খলিফা হজরত ওমরের সঙ্গী ছিল একজন মাত্র সেবক এবং একটি মাত্র উট। বিভিন্ন সূত্র মতে পালাক্রমে একজন উটের পিঠে আর অন্যজন উটের রশি হাতে সামনে হাঁটতে হাঁটতে পথ চলছিলেন হজরত ওমর (রা.) ও তাঁর সেবক। তারা যখন জেরুজালেমের কাছে পৌঁছেন তখন উটের পিঠে ছিল তার সেবক ও নিচে ছিলেন হজরত ওমর (রা.)। এই দৃশ্য মুসলমান সেনাপতিদের কাছে অবিশ্বাস্য না হলেও বিধর্মীদের কাছে তা ছিল কল্পনাতীত। তদুপরি হজরত ওমর (রা.)-এর অতি সাধারণ বেশভুষাও বিস্ময়ের সৃষ্টি করে বিধর্মীদের। নির্দিষ্ট দিনে আত্মসমর্পণের দলিলে স্বাক্ষর করেন হজরত ওমর (রা.) এবং সফরোনিয়াস। বিভিন্ন গ্রন্থ মতে, এ সময় জোহর নামাজের সময় হলে হজরত ওমর (রা.) নামাজ আদায়ের ইচ্ছা প্রকাশ করেন। অন্য সূত্রমতে, ৫০০ বছর বিধর্মীদের দখলে থাকা ফিলিস্তিন ও জেরুজালেম মুসলমানদের দখলে আসায় হজরত ওমর (রা.) মহান আল্লাহর দরবারে শুকরিয়া আদায়ের জন্য নামাজ আদায় করতে চান। এই ইচ্ছার কথা জেনে বিধর্মীদের নেতা সফরোনিয়াস সেখানকারই একটি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন চার্চে নামাজ পড়তে আহ্বান জানান। উত্তরে হজরত ওমর (রা.) বলেন, এই চার্চে নামাজ পড়লে কোনো এক সময় আবেগপ্রবণ মুসলামনরা চার্চটিকে মসজিদে রূপান্তর করতে পারে, তাই বিধর্মীদের প্রতি শ্রদ্ধা ও সম্মান জানিয়ে তিনি চার্চের বদলে পার্শ্ববর্তী আরেকটি স্থানে নামাজ আদায় করেন, যেখানে পরবর্তীতে ‘মস্ক অব ওমর’ বা ‘হজরত ওমর মসজিদ’ গড়ে ওঠে।

 

মদিনার জীবন ও সংগ্রাম

মদিনায় আগমনের পর থেকে মহানবীর (সা.)-এর নির্দেশে হজরত ওমর (রা.) ইসলাম রক্ষা, প্রচার ও প্রসারে নিবেদিত ছিলেন। একজন বীর যোদ্ধা হিসেবে তিনি মহানবী (সা.)-এর অধীনে এবং স্বতন্ত্রভাবে জীবন বাজি রেখে বহু যুদ্ধে অংশ নেন এবং ইসলাম প্রচারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। এসব যুদ্ধের মধ্যে ছিল বদরের যুদ্ধ, ওহুদের যুদ্ধ, ধানুনাদিরের যুদ্ধ, খন্দকের যুদ্ধ, বানু কুরাইজার যুদ্ধ, খায়বারের যুদ্ধ, হুনায়নের যুদ্ধ, তায়েফের যুদ্ধ, তাবুকের যুদ্ধ প্রভৃতি। হজরত ওমর (রা.) ঐতিহাসিক হুদাইবিয়ার চুক্তির একজন সাক্ষী ছিলেন। মক্কা বিজয় এবং বিদায় হজের সময়ও তিনি মহানবী (সা.)-এর সঙ্গী ছিলেন। ৬২৫ সালে হজরত ওমর (রা.) তাঁর কন্যা হাফসাকে হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর সঙ্গে বিয়ে দেন। ৬৩২ সালে হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর জাগতিক মৃত্যুতে ভেঙে পড়েন হজরত ওমর (রা.)। এই মৃত্যুকে কিছুতেই মানতে পারছিলেন না তিনি। বিভিন্ন সূত্র মতে, হজরত ওমর (রা.) মহানবী (সা.)-এর প্রেমে উন্মত্ত হয়ে তলোয়ার হাতে ঘোষণা দেন, কেউ যদি বলে যে মহানবী (সা.)-এর মৃত্যু ঘটেছে তবে তার মাথা কাটা হবে। পরে হজরত আবু বকর (রা.) তাঁকে শান্ত করেন।

 

আমিরুল মুমিমিন

মুমিন মুসলমানদের নেতাকে সাধারণত আমিরুল মুমিনিন বলা হয়। তবে সমগ্র মুসলিম জাহানের নেতা হিসেবে হজরত ওমর (রা.)-এর নাম অধিক পরিচিতি পেয়েছিল। হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর জাগতিক মৃত্যুর পর যোগ্যতা বিবেচনায় মুসলমানদের পরবর্তী নেতা হিসেবে হজরত ওমর (রা.) এগিয়ে ছিলেন। কিন্তু মুসলমানদের মধ্যে বিভক্তি ঘটার আশঙ্কা থেকে হজরত ওমর (রা.) স্বেচ্ছায় দৃশ্যপট থেকে সরে যান এবং হজরত আবু বকর (রা.)-কে মুসলমানদের নেতা বা ইসলামের প্রথম খলিফা হিসেবে অভিষিক্ত হতে সাহায্য করেন। মাত্র দুই বছর শাসন পরিচালনার পর হজরত আবু বকর (রা.) জ্বরে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর জানাজা নামাজে ইমামতি করেন হজরত ওমর (রা.)। মৃত্যুর আগে হজরত আবু বকর (রা.) বিভিন্ন বিষয় বিবেচনা করে এবং নেতৃস্থানীয়দের সঙ্গে পরামর্শ করে হজরত ওসমান (রা.)-কে একটি উইল লিখতে বলেন। ওই উইলে হজরত আবু বকর (রা.) তাঁর উত্তরসূরি অর্থাৎ ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা হিসেবে হজরত ওমর (রা.)-এর নাম ঘোষণা করেন।

 

দক্ষ শাসক

হজরত ওমর (রা.) প্রথম জীবনে অতি মাত্রায় রাগ এবং পরবর্তীতে নীতি-নৈতিকতার প্রশ্নে আপসহীনতা বা কঠোরতার জন্য আলোচিত ছিলেন। এ কারণে খলিফা হিসেবে তাঁর নিযুক্তির বিষয়েও অনেকে সন্দিহান ছিলেন। ফলে ক্ষমতা গ্রহণের পরপরই হজরত ওমর (রা.)-এর প্রথম চ্যালেঞ্জ ছিল অধীনস্তদের মন জয় করা ও ভয় দূর করা। তিনি ছিলেন জ্ঞানী ও সুবক্তা। তাই তাঁর কথা ও আচরণে ধীরে ধীরে সেই ভয় দূর হতে থাকে। তাঁর পূর্বসূরির আমল থেকেই বিভিন্ন স্থানে ইসলামের খেলাফতের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ শুরু হয়। হজরত ওমর (রা.) এই বিদ্রোহের শান্তিপূর্ণ সমাধানে সচেষ্ট ছিলেন। নিজের কঠোরতার আবরণ ভেঙে তিনি বহু কয়েদিকে ক্ষমাপূর্বক মুক্তি দেন এবং ক্রীতদাসদের স্বাধীন করে দেন। প্রশাসন পরিচালনার সুবিধার্থে তিনি সমগ্র শাসন এলাকাকে প্রদেশে ভাগ করেন এবং কেন্দ্র ও প্রদেশে বিভিন্ন পর্যায়ে দক্ষ প্রশাসক নিযুক্ত করেন। তাঁর আমলে বিভিন্ন সরকারি অফিস-আদালতে নথিপত্র, সূত্র, চিঠিপত্র, সিল প্রভৃতি সংরক্ষণের আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয়। জনগণের মাঝে শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষায় পুলিশ বাহিনীর সংগঠন ও কার্যক্রমও শুরু হয় তাঁর আমলে। কৃষিকাজ এবং বিশুদ্ধ পানির জন্য তিনি মদিনা, বসরাসহ বিভিন্ন স্থানে খাল খনন করেন। ফলে কৃষি উৎপাদন বেড়ে যায় এবং সুপেয় পানির সংস্থান হয়। বিশেষ কিছু এলাকা বা শহরকে তিনি সামরিক দিক থেকে সুসজ্জিত করেন, যার ধারাবাহিকতায় সেনানিবাসের গোড়া পত্তন ঘটে।

মক্কার মসজিদ আল হারাম (কাবা) এবং মদিনার মসজিদ আন নববীকে তাঁর আমলে সংস্কার ও বর্ধিত করা হয়। ইসলামী বিচার ব্যবস্থা বা শরিয়া আইনের প্রতিষ্ঠানিক রূপকার ছিলেন হজরত ওমর (রা.)। ফিকাহ শাস্ত্র তাঁর আমলেই বেগবান হয়। ব্যক্তিজীবনে তিনি ছিলেন অতি সাধারণ। সাধারণ পোশাকেই তিনি চলাফেরা করতেন এবং নিজের বাড়িঘরের কাজ নিজের হাতেই করতেন।

 

কল্যাণ রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা

৬৩৮ সালে আরব জাহানে মারাত্মক খরা ও পানির অভাব দেখা দেয়। খেজুরসহ অন্যান্য ফসল উৎপাদন না হওয়ায় সেখানে দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। হজরত ওমর (রা.) তখন সিরিয়া ও ইরাকসহ বিভিন্ন অঞ্চল থেকে খাদ্যদ্রব্য আমদানি ও সুষ্ঠু বণ্টন নিশ্চিত করেন। মদিনায় এ সময় লঙ্গরখানা খোলা হয় এবং হাজার হাজার অসহায় মানুষকে খাবার সরবরাহ করা হয়। এই দুর্ভিক্ষের পরপরই সিরিয়া ও ফিলিস্তিনসহ বিভিন্ন এলাকায় মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়ে মরণব্যাধি প্লেগ। এই মহামারীও হজরত ওমর (রা.) দক্ষভাবে সামাল দেন। তিনি দরজা খোলা রেখে মাটির ঘরে থাকতেন। সন্ধ্যা বা রাতে গোপনে পায়ে হেঁটে মানুষের অবস্থা দেখতে বের হতেন। ‘বায়তুল মাল’ বা রাষ্ট্রীয় কোষাগার স্থাপন তাঁর অনন্য কৃতিত্ব। এই কোষাগার থেকে গরিব, এতিম, বৃদ্ধ, বিধবা, পঙ্গু, প্রতিবন্ধী বা অসহায় নাগরিককে সহায়তা করা হতো। উদারনীতির কারণে ব্যবসা-বাণিজ্যে ব্যাপক প্রসার ঘটে এ সময়ে।

 

সরকারি কর্মকর্তাদের প্রতি হজরত ওমর (রা.)-এর নির্দেশ

মনে রাখবেন, আমি আপনাদের জনগণের শাসক বা শোষক হিসেবে নিয়োগ দিইনি। বরং তাদের নেতা হিসেবে আপনাদের আমি প্রেরণ করেছি। যেন তারা আপনাদের অনুসরণ করতে পারে। মুসলমানদের তাদের প্রাপ্য সম্মান ও অধিকার প্রদান করুন। তাদের গায়ে হাত তুলবেন না; তারা যেন অপমানিত না হয়। কোনো গ্রহণযোগ্য কারণ ছাড়া তাদের গুণগান বা প্রশংসা করবেন না, তারা যেন আত্মতুষ্টি বা অহংকারে না  ভোগে। তাদের প্রয়োজনের সময় আপনার দরজা বন্ধ রাখবেন না; সবলরা দুর্বলদের ওপর যেন শোষণ করতে না পারে তাদের চেয়ে আপনি উচ্চ শ্রেণির, এমন আচরণ করবেন না, যা (এমন আচরণ) তাদের ওপর এক প্রকার অত্যাচার।  সূত্র : উইকিপিডিয়া

 

শয়তান ও জিন ভয় পেত

হজরত ওমর (রা.)-কে স্বয়ং শয়তান এবং দুষ্ট-পথভ্রষ্ট জিনেরা ভয় পেত বলে বহু বর্ণনা বিভিন্ন বইয়ে উল্লিখিত। তবে সহি বোখারির বিভিন্ন সংকলনের ১১৩ নং হাদিস, ৩২৯৪ নং হাদিস এবং ৩৬৮৩ নং হাদিস মোতাবেক এবং জামে আল তিরমিজির ৩৬৯১ নং হাদিস মোতাবেক মহানবী (সা.) মহান আল্লাহর নামে (যাঁর হাতে তাঁর জীবন) শপথপূর্বক বলেন যে, হজরত ওমর (রা.) যে পথে চলতেন শয়তান সে পথ ছেড়ে অন্য পথে চলত। দুষ্ট বা পথভ্রষ্ট জিনেরা হজরত ওমর (রা.)-কে দেখলে দৌড়ে পালাত।

 

অপ্রত্যাশিত মৃত্যু

হজরত ওমর (রা.) ৬৩৪ সাল থেকে ৬৪৪ সাল পর্যন্ত ১০ বছর আমিরুল মুমিনিন বা মুমিনদের নেতা হিসেবে মুসলিম জাহান শাসন করেন। মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) তাঁকে আল ফারুক উপাধি দেন, যার অর্থ সত্য ও মিথ্যা, ন্যায়-অন্যায়, ঠিক ও ভুল, উচিত ও অনুচিত হালাল-হারাম ইত্যাদির মধ্যে পার্থক্যকারী। ১০ বছরের গৌরবময় শাসনের মাথায় ৬৪৪ সালের সম্ভাব্য ৩১ অক্টোবর পিরুজ নাহাভাদি ছদ্মনাম আবু লুলু নামক পারস্য অঞ্চলের এক ক্রীতদাস মদিনার মসজিদুন নববীতে সকালে ফজর নামাজের ইমামতি করার সময় হজরত ওমর (রা.)-এর পেটে ধারালো ছুরি দিয়ে ছয়বার আঘাত করে। আঘাতের পর পালানোর সময় এই শত্রুকে ঘেরাও করা হয়। ঘেরাওকারীদের মধ্যে ১২ জন এ সময় তার ছুরির আঘাতের আহত হয়, যাদের মধ্যে ছয় মতান্তরে নয়জন পরবর্তীতে মৃত্যুবরণ করেন। সবশেষে আঘাতকারী নিজের শরীরে ছুরি চালিয়ে আত্মহত্যা করে। এ ঘটনার তিন দিন পর অর্থাৎ ৩ নভেম্বর ৬৪৪ তারিখে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ থেকে মৃত্যুবরণ করেন হজরত ওমর বিন খাত্তাব (রা.)। শেষ ইচ্ছা অনুযায়ী মসজিদ আন নববীতে মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) ও প্রথম খলিফা হজরত আবু বকর (রা.)-এর রওজার পাশে সমাহিত করা হয় কিংবদন্তিতুল্য ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা হজরত ওমর (রা.)-কে।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর