মঙ্গলবার, ১ ডিসেম্বর, ২০১৫ ০০:০০ টা

রাজধানীতে বেপরোয়া লেগুনা

লাকমিনা জেসমিন সোমা

রাজধানীতে বেপরোয়া লেগুনা

রাত সাড়ে ৯টার দিকে মিরপুর-১০ থেকে যাত্রী বোঝাই করে  মোহাম্মদপুরের দিকে যাচ্ছিল একটি লেগুনা। লেগুনার  পেছনের পাদানিতে যথারীতি ঝুলে-ঝুলে যাচ্ছিলেন হেলপারসহ তিন-চারজন যাত্রী। মাঝে মধ্যে কড়া ব্রেকে বেসামাল হয়ে পড়ছেন তারা। কিছু দূর যেতেই যাত্রীদের কাছে ভাড়া চাইল  হেলপার। বয়স ১০-এর ওপরে হবে না। একজন যাত্রী তাকে ভাড়া দিতে গিয়ে ফিরিয়ে নিলেন। বললেন, ‘তোর হাত কাঁপে ক্যা রে? নেশা করছোস? যাহ, ভাড়া দিমু না’। শিশু হেলপার সবুজও (ছদ্মনাম) কোনো প্রতিবাদ না করে লেগুনার দরজার রডটিতে মাথা রেখে চোখ বুজে ঝিমুতে লাগল। এরপর লেগুনার অন্য যাত্রীরাও একেক করে তাকে নানাভাবে গালাগাল ও তিরস্কার করতে থাকল। পরে দেখা গেল, লেগুনার  বেপরোয়া চালকের অবস্থাও একই রকম; সেও মাদকাসক্ত। রাজধানীর গণপরিবহনে বিশেষ করে লেগুনাগুলোতে শিশুশ্রমিকের হার দিন দিন বেড়েইে চলেছে। আর এর সঙ্গে বেড়ে গেছে মাদক। এরই ফলশ্রূতিতে সম্প্রতিকালে আরও বেপরোয়া হয়ে উঠেছে লেগুনাগুলো। মাদকাসক্ত ও শিশু-কিশোররা চালক হওয়ায় দুর্ঘটনাও বাড়ছে দ্বিগুণ। নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করে রাজধানীর অন্তত সাত-আটটি রুটে চলাচল করা এই পরিবহনটি এখন সবার কাছেই ভীতিকর। এক কথায় বিপজ্জনক বটে। অথচ, মোড়ে মোড়ে চাঁদা দিয়ে ম্যানেজ হয়ে যাচ্ছে সব। মাসোহারার মাধ্যমে প্রশাসনকে ম্যানেজ করে সব অনিয়মকে নিয়মে পরিণত করছে লেগুনা ব্যবসায়ীরা। অভিযোগ রয়েছে, মালিক সমিতির তত্ত্বাবধায়নে স্থানীয় পুলিশ প্রশাসন ও ক্যাডারবাহিনীই এই চাঁবাজির সঙ্গে সম্পৃক্ত। এখানে কেউ চাঁদা দিচ্ছেন, আবার কেউ নিচ্ছেন।

বাংলাদেশ সড়ক ও পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) সূত্রে জানা গেছে, রাজধানীতে নিবন্ধিত লেগুনার সংখ্যা প্রায় ৪ হাজার। নগরীর মোহাম্মদপুর-মহাখালী-গুলশান-ফার্মগেট-মিরপুর, নিউমার্কেট-ফার্মগেট-ট্যানারি মোড়, গুলিস্তান-খিলগাঁও-লালবাগ-সদরঘাট-যাত্রবাড়ীসহ আরও বেশ কয়েকটি রুটে এগুলো চলাচল করছে। সরেজমিনে প্রতিটি রুটেই দেখা গেছে কিছু কমন চিত্র। সেখানে বেশিরভাগ লেগুনার ড্রাইভারই ১৪-১৫ বছরের কিশোর। আর হেলপার হিসেবে কাজ করছে ৭-৮ বছরের শিশু। অল্পবয়সী এই গাড়িচালকদের নেই কোনো প্রাতিষ্ঠানিক প্রশিক্ষণ। নেই লাইসেন্স। ‘ওস্তাদের’ কাছ থেকে শিক্ষা নিয়ে হেলপার থেকেই তারা ড্রাইভার হয়েছেন। আশপাশের গাড়ি-ঘোড়া ট্রাফিক আইন কোনো কিছুর তোয়াক্কা না করে সর্বোচ্চ গতিতে গাড়ি চালানোর চেষ্টা করে তারা। যত্রতত্র যাত্রী ওঠানামা করায় খানিক পরপরই দেখা যায় কড়া ব্রেক। ফের জোরে টান। এতে প্রায়ই যাত্রীদের সঙ্গে বাকবিতণ্ডা থেকে শুরু করে হাতাহাতি-মারামারিও লেগে যায়। প্রতিটি লেগুনা ১০ জন যাত্রীর জন্য উপযুক্ত হলেও বসানো হয় ১২ জন। পেছনে ঝুলতে থাকে আরও চার-পাঁচজন। চালকের পাশে অতিরিক্ত দুজন। অন্যদিকে বেশিরভাগ লেগুনাই আবার ফিটনেসহীন।

চাঁদার বিনিময়ে সব ম্যানেজ : লেগুনার বিরুদ্ধে অসংখ্য অভিযোগ থাকলেও টনক নড়ে না প্রশাসনের। অভিযোগ রয়েছে, স্থানীয় রাজনৈতিক ক্যাডার, প্রভাবশালী ব্যক্তি ও পুলিশ প্রশাসনের মুখ বন্ধ রাখতে লাখ লাখ টাকা চাঁদা দিয়ে ব্যবসা করছে লেগুনা মালিকরা। চাঁদা আদায়ে প্রতিটি রুটেই রয়েছে তাদের নিজস্ব লোক। অভিযোগের সত্যতা যাচাইয়ে মিরপুর-১০ টু মোহাম্মদপুর রুটে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, এখানে প্রায় ১১০টি লেগুনা চলে। প্রতিদিন একটি লেগুনা থেকে মালিক সমিতির নামে ৮০ টাকা এবং থানার জন্য ১০০ টাকা করে আদায় করা হয়। সে হিসেবে, এই রুটে মাসে অন্তত আড়াই লাখ টাকা যাচ্ছে মালিক সমিতির ফান্ডে। সেখান থেকে চাঁদা দেওয়া হচ্ছে প্রভাবশালীদের। অপরদিকে জমা হওয়া প্রায় সাড়ে তিন লাখ টাকা যাচ্ছে সংশ্লিষ্ট থানার নামে। রাজধানীর অন্য রুটগুলোতে খোঁজ নিয়েও একই তথ্য পাওয়া গেছে। অথচ, দিনরাত প্রায় ১৪-১৫ ঘণ্টা কাজ করে একজন হেলপার পাচ্ছে মাত্র ১০০ থেকে ১৫০ টাকা। আর ড্রাইভাররা পায় ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর