সুখী স্বদেশ গড়ার প্রয়াসে আয়কর আদায়ের স্বপ্ন পূরণের পথে বাংলাদেশ। রাজস্ব আয়কে উন্নয়নের অক্সিজেন আখ্যায়িত করে মুক্তিযুদ্ধের লক্ষ্য সমতাভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠার প্রয়াস সরকারের। ফলে দ্রুত বিকাশমান বাংলাদেশের অর্থনীতিতে রাজস্ব আয় বাড়ছে। আয়করের অবদানও বাড়ছে। চলতি ২০১৬-১৭ অর্থবছর সরকারের লক্ষ্য যেখানে করদাতার সংখ্যা ২৫ লাখে উন্নীতকরণ, সেখানে গতকাল পর্যন্ত দেশে করদাতা হয়েছেন প্রায় ২৪ লাখ।
আজ জাতীয় আয়কর দিবস-২০১৬। দেশের সব ব্যক্তি-শ্রেণির করদাতার আয়কর বিবরণী বা রিটার্ন দাখিলের শেষ দিন আজ। ঘোষণা অনুযায়ী, রিটার্ন দাখিলের সময় আর বাড়বে না। যারা আজ নির্ধারিত সময়ের মধ্যে রিটার্ন দাখিল করতে পারবেন না, তাদের গুনতে হবে জরিমানা। তাদের জন্য সুযোগ আছে সংশ্লিষ্ট আয়কর অফিসের উপ-কর কমিশনারের কাছে রিটার্ন দাখিলের জন্য সময় চেয়ে আবেদন করার। করদাতাদের সুবিধার্থে সব ব্যাংকের শাখা রাত ৮টা পর্যন্ত খোলা থাকবে। জাতীয় আয়কর দিবস-২০১৬ উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত, এনবিআর চেয়ারম্যান নজিবুর রহমান পৃথক বাণী দিয়েছেন। বাণীতে জাতীয় আয়কর দিবসের সাফল্য কামনা করে সামর্থ্যবান নাগরিকদের আয়কর প্রদানে এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়েছেন তারা। আজ এ দিবসটি উপলক্ষে রাজধানীর সেগুনবাগিচার রাজস্ব ভবন প্রাঙ্গণ থেকে সকাল ৭টায় বর্ণাঢ্য র্যালি বের হয়ে নগরীর বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সড়ক প্রদক্ষিণ করবে বলে জানিয়েছে এনবিআর। র্যালিতে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। অন্যান্যের মধ্যে উপস্থিত থাকবেন অর্থ ও পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী এম এ মান্নান, এনবিআর চেয়ারম্যান নজিবুর রহমানসহ দেশের বিশিষ্ট নাগরিকরা। এবার যখন দেশে জাতীয় আয়কর দিবস উদ্যাপন করা হচ্ছে, তখন চলতি ২০১৬-১৭ অর্থবছরে দুই লাখ তিন হাজার ১৫২ কোটি টাকার লক্ষ্যমাত্রা অর্জন শেষে আরও বাড়তি রাজস্ব আয়ের স্বপ্ন দেখছে এনবিআর। অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের চলতি অর্থবছরের বাজেট ঘোষণা অনুযায়ী, রাজস্ব জিডিপি অনুপাত ৮ দশমিক ৯৮ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ১৫ দশমিক ৩ শতাংশে উন্নীত করতে চায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন বর্তমান মহাজোট সরকার। এ সরকারের শেষ দিকে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে পাঁচ লাখ কোটি টাকার বাজেট প্রদানের ঘোষণাও ইতিমধ্যে দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী। মূলত সরকারের রাজস্ব আদায়কারী প্রতিষ্ঠান জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) তিন ধরনের রাজস্ব আদায় করে। এগুলো হলো আয়কর, মূল্য সংযোজন কর (মূসক) বা ভ্যাট ও আমদানি শুল্ক। এর বাইরে করবহির্ভূত রাজস্ব আদায় করে সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও সংস্থা।
চলতি ২০১৬-১৭ অর্থবছরে এনবিআরের কাঁধে দুই লাখ তিন হাজার ১৫২ কোটি টাকার রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা আছে। আর বাকি রাজস্ব আসবে এনবিআর-বহির্ভূত খাত থেকে। এনবিআর বা করবহির্ভূত রাজস্ব আয় মিলিয়ে নতুন অর্থবছরে মোট দুই লাখ ৪২ হাজার ৭৫২ কোটি টাকার রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে সরকার, যা মোট দেশজ উৎপাদন প্রবৃদ্ধির (জিডিপি) ১২ দশমিক ৪ শতাংশ। এনবিআরের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, দেশের মোট ইলেকট্রনিক করদাতা শনাক্তকরণ নম্বর বা ই-টিআইএনধারীর সংখ্যা প্রায় ২৪ লাখ।প্রসঙ্গত, বার্ষিক আয়ের ভিত্তিতে আদায়যোগ্য করের নাম আয়কর। নাগরিকের আয় ও সম্পদের ভিত্তিতে আদায় করা হয় সরকারের রাজস্ব। সব করের দায়ভার দেশের নাগরিককেই বহন করতে হয়। এর বিপরীতে রয়েছে পরোক্ষ কর। এটি পণ্য ও সেবা উৎপাদন, বিক্রয়, আমদানি-রপ্তানি ও অভ্যন্তরীণ ব্যবসা-বাণিজ্যের ওপর আরোপ করা হয়। প্রত্যক্ষ করের ক্ষেত্রে নাগরিক তার ওপর ধার্য করা সরাসরি কর সরকারি কোষাগারে জমা করেন। অর্থ মন্ত্রণালয়ের জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) এই কর আদায়ের দায়িত্বে নিয়োজিত সরকারের একমাত্র প্রতিষ্ঠান।
অন্যদিকে আয়কর কর্তৃপক্ষের কাছে একজন করদাতার বার্ষিক আয়ের সংক্ষিপ্ত বিবরণ উপস্থাপন করার মাধ্যম হচ্ছে আয়কর রিটার্ন। এ আয়কর রিটার্ন ফরমের কাঠামো আয়কর বিধি দ্বারা নির্দিষ্ট করা আছে। আয়কর আইন অনুযায়ী, এনবিআর কর্তৃক নির্ধারিত ফরমে আয়কর রিটার্ন দাখিল করতে হয়।
এনবিআর প্রকাশিত সর্বশেষ আয়কর পরিপত্রে বলা হয়, আয়কর রিটার্ন দাখিলের ক্ষেত্রে নতুন করদাতা হলে তার পাসপোর্ট সাইজের এক কপি ছবি সংযুক্ত করতে হবে। করদাতারা রিটার্ন দাখিলের আগে নিজেই এনবিআরের ওয়েবসাইটে (যঃঃঢ়://.িরহপড়সবঃধী.মড়া.নফ) ১২ ডিজিটের ই-টিআইএন সংগ্রহ করতে পারবেন। দেশে আয়কর আইনে বর্তমানে দুটি পদ্ধতিতে রিটার্ন দাখিল করা যায়। একটি হচ্ছে, সর্বজনীন স্ব্বনির্ধারণী পদ্ধতি এবং অপরটি সাধারণ পদ্ধতি। করদাতা যে কোনো একটি পদ্ধতির আওতায় রিটার্নটি দাখিল করতে পারবেন।
চলতি ২০১৬-১৭ করবর্ষে যারা রিটার্ন দাখিল করবেন— যেসব ব্যক্তির করদাতার আয় বছরে ২ লাখ ৫০ হাজার টাকার বেশি হবে, তাকে রিটার্ন দাখিল করতে হবে; মহিলা এবং ৬৫ বছর বা তদূর্ধ্ব বয়সের পুরুষ করদাতার আয় যদি বছরে ৩ লাখ টাকার বেশি, প্রতিবন্ধী করদাতার আয় যদি বছরে ৩ লাখ ৭৫ হাজার টাকার বেশি এবং গেজেটভুক্ত যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা করদাতার আয় যদি বছরে ৪ লাখ ২৫ হাজার টাকার বেশি হয়, তাহলে তাকে রিটার্ন দাখিল করতে হবে।
তবে আয়ের পরিমাণ যা-ই হোক না কেন, কতিপয় ব্যক্তির ক্ষেত্রে রিটার্ন দাখিল বাধ্যতামূলক। এ তালিকায় আছে— করবর্ষে করযোগ্য আয় থাকলে, করবর্ষের পূর্ববর্তী তিন বছরের যে কোনো বছর করযোগ্য আয় নিরূপিত হলে, সিটি করপোরেশন অথবা বিভাগীয় ও জেলা শহরের পৌরসভায় বসবাসকারীদের ব্যক্তি একটি গাড়ির মালিক হলে, মূল্য সংযোজন কর আইনে নিবন্ধিত কোনো ক্লাবের সদস্য হলে, সিটি করপোরেশন, পৌরসভা অথবা ইউনিয়ন পরিষদে ব্যবসা পরিচালনার জন্য ট্রেড লাইসেন্স এবং ব্যাংক অ্যাকাউন্ট থাকলে, ডাক্তার, দন্ত চিকিৎসক, আইনজীবী, আয়কর আইনজীবী, চার্টার্ড অ্যাকাউন্টেন্ট, কস্ট অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট অ্যাকাউন্টেন্ট, প্রকৌশলী, স্থপতি, সার্ভেয়ার অথবা সমজাতীয় পেশায় নিয়োজিত ব্যক্তিবর্গ, চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ অথবা কোনো বাণিজ্য সংগঠনের সদস্য, পৌরসভা, সিটি করপোরেশন অথবা জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সব পদপ্রার্থী, সরকারি, আধাসরকারি, স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা অথবা স্থানীয় কর্তৃপক্ষের ঠিকাদারি কাজে টেন্ডারে অংশগ্রহণকারী সব ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান।