মঙ্গলবার, ৯ মে, ২০১৭ ০০:০০ টা

বিতর্কিত সেই শিক্ষকই ফের রাবির উপাচার্য

কাজী শাহেদ, রাজশাহী

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০০৯ সালে গণহারে নিয়োগ দিয়ে আলোচনায় আসা অধ্যাপক আবদুস সোবহানকে আবারও উপাচার্য নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এর আগের মেয়াদে উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ পেয়ে এক মেয়াদে ৩৩০ জন শিক্ষক নিয়োগ দিয়েছিলেন। নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে প্রকাশিত পদসংখ্যার চেয়ে কয়েকগুণ বেশি শিক্ষক নিয়োগ দেন তিনি। এ নিয়ে ক্ষোভ ছিল শিক্ষকদের একাংশের মধ্যে। এসব নিয়োগের পেছনে প্রকাশ্যে বাণিজ্যের অভিযোগ উঠেছিল। শিক্ষক নিয়োগ নিয়ে সিন্ডিকেটের সভায় নোট অব ডিসেন্ট এসেছিল। রবিবার উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার পর স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাদের নিয়ে শ্রদ্ধা জানিয়েছেন শহীদ ড. শামসুজ্জোহা ও জেলখানায় নিহত জাতীয় নেতা এএইচএম কামরুজ্জামানের কবরে। এরপর থেকে আবারও আলোচনায় তিনি। বিশ্ববিদ্যালয় সূত্র জানায়, ২০০৯ সালে প্রথমবার উপাচার্যের দায়িত্ব দেওয়া হয় অধ্যাপক আবদুস সোবহানকে। দায়িত্বে এসেই নিয়োগ বাণিজ্যে মেতে ওঠেন তিনি। নিয়মের বাইরে গণহারে শিক্ষক নিয়োগ দিতে থাকেন। প্রথম মেয়াদে দায়িত্বে এসে চার বছরে ৩৩০ জন শিক্ষক নিয়োগ দেন। এদের মধ্যে অস্থায়ী ভিত্তিতেই নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল ৯৫ জন শিক্ষককে। আর অ্যাডহকে নিয়োগ     দেওয়া হয় ৭ জনকে। একজন উপাচার্যের আমলে এমন শিক্ষক নিয়োগের নজির কেবল বিএনপি আমলে ফাইসুল ইসলাম ফারুকী করেছিলেন। সেই থেকে এমন নিয়োগ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে গণনিয়োগ হিসেবে বিবেচিত। প্রতিজন শিক্ষক নিয়োগে গড়ে ১০ থেকে ১২ লাখ টাকার বাণিজ্য হয় বলে অভিযোগ আছে।

শুধু শিক্ষক নিয়োগেই নয়, কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগেও আবদুস সোবহান একতরফা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। সিন্ডিকেট থাকলেও ওই সময় সোবহানের কথার বাইরে যাওয়ার শক্তি বা সাহস কোনো সদস্যের ছিল না। সূত্র জানায়, উপাচার্য থাকাকালীন সোবহান ৩৪৪ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ দেন। প্রতিজন কর্মকর্তা-কর্মচারীকে ৭ থেকে ৮ লাখ টাকা দিতে হয়েছিল বলে অভিযোগ আছে। জানা গেছে, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের অনুমোদন না থাকলেও এই বিপুল সংখ্যক শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগের ঘটনায় চরম অর্থ সংকটে পড়েছিল বিশ্ববিদ্যালয়টি। এখনো বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন ফান্ড, ছাত্র কল্যাণ ফান্ড, গবেষণা খাত থেকে এসব অতিরিক্ত নিয়োগ পাওয়াদের বেতন মেটাতে হয়। ফলে বিশ্ববিদ্যালয় এবং শিক্ষার মান উন্নয়ন অনেকটাই থমকে গেছে। আগে যেসব কাজ করেছেন এবারও করবেন, এখনই এমন প্রশ্নের জবাব দেওয়ার সময় আসেনি বলে মনে করেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের হিসাব বিজ্ঞান ও তথ্য ব্যবস্থা বিভাগের অধ্যাপক তাজুল ইসলাম। তার এমন নিয়োগ বাণিজ্যের বিরুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪২৭তম সিন্ডিকেট সদস্যদের নোট অব ডিসেন্ট ছিল। সে নিয়োগে বিজ্ঞপ্তির চেয়ে অধিক শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয়। ওইদিন যেসব বিভাগে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল সেগুলোর মধ্যে আইন ও বিচার বিভাগে সহকারী অধ্যাপক/প্রভাষকের ৪টি ও প্রভাষকের ১টিসহ বিজ্ঞপ্তির মোট ৫টি পদের বিপরীতে ৮ জন, সমাজবিজ্ঞান বিভাগে সহকারী অধ্যাপক/প্রভাষকের ২টির বিপরীতে ৬ জন, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে সহকারী অধ্যাপক/প্রভাষকের ৩টি ও প্রভাষকের ১টিসহ ৪টির বিপরীতে ৭ জন, জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড বায়োটেকনোলজি বিভাগে সহকারী অধ্যাপক/প্রভাষকের ১টি ও প্রভাষকের ২টিসহ ৩টির বিপরীতে ৯ জন, ফোকলোর বিভাগে সহকারী অধ্যাপক/প্রভাষকের ৪টির বিপরীতে ৫ জন, চারুকলা বিভাগে সহকারী অধ্যাপক/প্রভাষকের ৩টির বিপরীতে ৪ জন, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগে ৪ জন, ইংরেজিতে ৩ জন, ইতিহাসে ৫ জন। এরপর ২০১০ সালের ১ জানুয়ারি ৪২৮তম সিন্ডিকেটে ১০টি বিভাগে বিজ্ঞপ্তির ৪৬টি পদের বিপরীতে ৭৪ জন শিক্ষক নিয়োগের সিদ্ধান্ত নেন অধ্যাপক সোবহান। এর মধ্যে প্রাণ রসায়ন ও অনুপ্রাণ বিজ্ঞান বিভাগে সহকারী অধ্যাপক/প্রভাষকের বিজ্ঞাপিত ৫টি পদের বিপরীতে ১২ জন, ভূগোল ও পরিবেশ বিদ্যা বিভাগে ২টি পদের বিপরীতে ৬ জন, অর্থনীতি বিভাগে ৬টি পদের বিপরীতে ৯ জন, ফার্মেসি বিভাগে ৫টি পদের বিপরীতে ৯ জন, নৃ-বিজ্ঞান বিভাগে ৬টি পদের বিপরীতে ৯ জন, দর্শন বিভাগে ৪টি পদের বিপরীতে ৭ জন, লোকপ্রশাসন বিভাগে ৫টি পদের বিপরীতে ৮ জন, উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগে ৪টি পদের বিপরীতে ৬ জন, ব্যবস্থাপনা বিভাগে ৪টি পদের বিপরীতে ৭ জন এবং রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে ৫টি পদের বিপরীতে ১ জনকে নিয়োগ দেওয়া হয়। এভাবেই বিজ্ঞপ্তির বিপরীতে কৌশলে দ্বিগুণ শিক্ষক নিয়োগ দেন। ২০১৩ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি প্রথম মেয়াদের দায়িত্ব হন্তান্তর করেন আবদুস সোবহান। দায়িত্ব হস্তান্তরের সময় আবদুস সোবহান ৩৪ কোটি ৬১ লাখ টাকা ঘাটতি রেখে যান। অতিরিক্ত নিয়োগকৃতদের বেতন-বোনাস দিতে গিয়ে রাকসুসহ বিভিন্ন ইনস্টিটিউটের ফান্ড থেকেও টাকা নেন তিনি। সোমবার দায়িত্ব নিয়ে অবশ্য নিজের আগের সময়ের কোনো বিষয় নিয়ে কথা বলতে চাননি উপাচার্য অধ্যাপক আবদুস সোবহান। তিনি বলেন, ‘শিক্ষা ও সংস্কৃতি চর্চার ওপর জোর দিয়ে কাজ করতে চাই। শিক্ষার মান উন্নয়নের জন্য যেসব পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন তা নেওয়া হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের যেসব সমস্যা রয়েছে সেগুলো শনাক্ত করে আমরা তা সমাধানের চেষ্টা করব।’ এদিকে মেয়াদ শেষ হওয়ার ৫৩ দিন আগেই উপাচার্য বরাবর পদত্যাগপত্র জমা দেন রেজিস্ট্রার অধ্যাপক মোহাম্মদ এন্তাজুল হক। স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করছেন বলে অধ্যাপক এন্তাজুল দাবি করলেও অন্য সূত্র বলছে, নতুন উপাচার্য আসার কারণেই তিনি পদত্যাগ করেছেন।

সর্বশেষ খবর