শনিবার, ১ জুলাই, ২০১৭ ০০:০০ টা

রাবির সেই হত্যামামলাগুলো দেখছে না আলোর মুখ

মর্তুজা নুর, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

রাবির সেই হত্যামামলাগুলো দেখছে না আলোর মুখ

লিপু--শফিউল--রেজাউল

১৯৭৬ সালে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী নেহার বানু হত্যার মধ্য দিয়েই শুরু হয়েছিল রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে (রাবি) নারকীয় তাণ্ডব। সময় যত গড়িয়েছে লম্বা হয়েছে লাশের সারি। সর্বশেষ ২০১৬ সালের লিপু হত্যাসহ  খুুন হন ৬৪ জন শিক্ষক-শিক্ষার্থী। এসবের মধ্যে কয়েকটি হত্যাকাণ্ড নিয়ে সারা দেশে চাঞ্চল্যকর পরিস্থিতি তৈরি হলেও মামলা এখনো রয়েছে অন্ধকারে। খুনিরা রয়েছে ধরাছোঁয়ার বাইরে। ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে খুন হওয়া শিক্ষক-শিক্ষার্থীর স্বজনরা।  

‘কূল-কিনারা’ হচ্ছে না লিপু হত্যা মামলার : ২০১৬ সালের ২০ অক্টোবর বিশ্ববিদ্যালয়ের নবাব আবদুল লতিফ হলের ভিতরেই খুন হন গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষার্থী মোতালেব হোসেন লিপু। ঘটনার ৮ মাসেও জানা যায়নি হত্যারহস্য। মামলা তদন্তের দায়িত্ব দুজনের হাত বদল হয়ে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগে (সিআইডি) গেছে। তবে তারা এখনো কূল-কিনারা খুঁজে পাচ্ছে না। লাশ উদ্ধারের দিন লিপুর রুমমেট মনিরুল ইসলামকে আটক করেছিল পুলিশ। তিন দিন পর হত্যামামলায় মনিরুলকে গ্রেফতার দেখান হয়। কিন্তু ৮ নভেম্বর জজকোর্ট থেকে মনিরুল জামিন পান। এরপর আর কোনো অগ্রগতি হয়নি মামলাটির। মামলার তদন্তের দায়িত্বে থাকা সিআইডির তদন্ত কর্মকর্তা আসমাউল হক জানান, মামলাটির বলার মতো কোনো অগ্রগতি এখনো হয়নি। তবে দুজন শিক্ষার্থীকে আমরা সন্দেহ করছি। তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত এর বেশি কিছু বলা যাচ্ছে না।

অভিযোগ গঠন হয়নি শফিউল ও রেজাউল হত্যা মামলার : বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. এ কে এম শফিউল ইসলাম লিলন হত্যার আড়াই বছর এবং ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক ড. রেজাউল করিম সিদ্দিকী মুকুল হত্যার দেড় বছর পার হলেও এখনো আদালতে মামলার বিচারকাজ শুরু হয়নি। লিলন হত্যার এক বছরের মাথায় ২০১৫ সালের ২৫ নভেম্বর ১১ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেয় পুলিশ। ওই বছরের ১২ ডিসেম্বর রাজশাহী মেট্রোপলিটন আদালত অভিযোগপত্র গ্রহণ করে। পরে মামলাটি মহানগর দায়রা জজ আদালতে স্থানান্তর হয়। কিন্তু এখনো অভিযোগপত্র গ্রহণ করেনি আদালত।

অন্যদিকে রেজাউল করিম সিদ্দিকী হত্যা মামলারও একই অবস্থা। হত্যার মূল হোতা ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থী ও নব্য জেএমবির সদস্য শরিফুল ইসলামকে এখনো গ্রেফতার করতে পারেনি পুলিশ। গত বছর ৬ নভেম্বর রাজশাহী মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতে নব্য জেএমবির ৮ জনের নামে চার্জশিট দাখিল করে পুলিশ। এরপর আর কোনো অগ্রগতি নেই মামলাটির।

১১ বছরেও নিষ্পত্তি হয়নি তাহের হত্যা মামলার : ২০০৬ সালের ১ ফেব্রুয়ারি রাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক এলাকার পশ্চিম ২৩/বি বাসা থেকে নিখোঁজ হন ভূ-তত্ত্ব ও খনিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক এস তাহের। দুদিন পর নিজ বাসার পেছনের সেপটিক ট্যাংকি থেকে তার মরদেহ উদ্ধার করা হয়। মামলা সূত্রে জানা যায়, ২০০৭ সালের ১৮ মার্চ মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের তৎকালীন উপ-পরিদর্শক আহসানুল কবির জামায়াতপন্থি শিক্ষক মিয়া মহিউদ্দিন ও তৎকালীন শিবিরের রাবি সভাপতি মাহবুবুল আলম সালেহীসহ ৬ জনের বিরুদ্বে অভিযোগপত্র দেন। পরে ২০০৭ সালের ৩ জুলাই রাজশাহী দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে মামলার বিচার কাজ শুরু হয়। ২০০৮ সালের ২২ মে আদালত শিক্ষক মিয়া মোহাম্মদ মহিউদ্দিন, কেয়ারটেকার জাহাঙ্গীর আলম, জাহাঙ্গীরের ভাই শিবিরকর্মী আবদুস সালাম ও নাজমুল ইসলামকে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেন। রায়ের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে আপিল করেন আসামিরা। ৫ বছর পর ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে মামলার আপিল শুনানি শুরু হয়। এরপর থেকেই থমকে আছে বিচার প্রক্রিয়া।

হিমাগারে ফারুক হত্যা মামলা : ২০১০ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি রাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি আবাসিক হল দখলকে কেন্দ্র করে ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীদের ওপর বর্বরোচিত হামলা চালায় শিবিরের অস্ত্রধারী ক্যাডাররা। এতে খুন হন ছাত্রলীগ কর্মী ফারুক হোসেন। হত্যার সাত বছর পেরিয়ে গেলেও শাস্তি হয়নি ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের। চার্জশিট হলেও কেউ আর খোঁজ রাখেননি মামলার। হিমাগারে চলে গেছে মামলাটি।

ছাত্রলীগ নেতা খুন হয়, তদন্ত হয় না : ২০১৪ সালের ৪ এপ্রিল বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ সোহরাওয়ার্দী হলে গুলিতে নিহত হন ছাত্রলীগ নেতা রুস্তম আলী। ঘটনার ৩ বছর পার হলেও ক্লু উদ্ধার করতে পারেনি পুলিশ। চার্জশিট জমা না হওয়ায় শুরু হয়নি বিচার প্রক্রিয়া। এ ছাড়াও ২০১২ সালের ১৫ জুলাই ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হয়ে খুন হন ছাত্রলীগ নেতা আবদুল্লাহ আল হাসান সোহেল। ২০১০ সালের ১৫ আগস্ট অভ্যন্তরীণ কোন্দলে ছাত্রলীগ কর্মী নাসরুল্লাহ নাসিমকে ছাদ থেকে ফেলে দেয় দলীয় নেতা-কর্মীরা। চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান। এই তিন হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে দলীয় নেতা-কর্মীরা জড়িত থাকার কারণে মামলার তদন্ত সুষ্ঠুভাবে হয়নি। বিচার হয়নি কোনো হত্যাকাণ্ডের!

সর্বশেষ খবর