বৃহস্পতিবার, ২৮ সেপ্টেম্বর, ২০১৭ ০০:০০ টা

পাহারায় ৬ বনকর্মী, নেই রেশন

লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান ৪

দীপংকর ভট্টাচার্য লিটন, শ্রীমঙ্গল

লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানের ১ হাজার ২৫০ হেক্টরের সংরক্ষিত বন পাহারায় রয়েছে মাত্র ছয়জন বনকর্মী। এদের মধ্যে একজন বিট কর্মকর্তা, চারজন এফজি (ফরেস্ট গার্ড) ও একজন বোটম্যান। কর্মকর্তাদের নেই কোনো আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র। তাদের থাকার নেই ভালো ব্যবস্থা। মান্ধাতা আমলের লাঠি, দেশীয় অস্ত্র দিয়ে চলে নিরাপত্তার কাজ। প্রয়োজনীয় অস্ত্রশস্ত্রের অভাবে পাহারাদাররা ঠিকমতো কাজ করতে পারেন না। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বনের মূল্যবান গাছ পাহারা দিলেও তাদের জন্য নেই ঝুঁকিভাতা।

জানা যায়, লাউয়াছড়া সংরক্ষিত বনের ভিতর একটি বিট অফিস ছাড়াও জানকিছড়া আর বাগমাড়ায় দুটি ক্যাম্প রয়েছে। এরমধ্যে বিট অফিসের দায়িত্বে রয়েছেন একজন বিট অফিসার ও সঙ্গে একজন এফজি। আর জানকিছড়া ক্যাম্পে একজন এফজি ও বাগমাড়া ক্যাম্পে দুজন এফজি দায়িত্ব পালন করছেন। আর বিশাল এই বনের ভিতর প্রবেশের জন্য শ্রীমঙ্গল- শমসেরনগর সড়কটি খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। এসড়ক দিয়ে গাছ চোরেরা কার-লাইট্রেক্স দিয়ে গাছ কেটে নিয়ে যায়। অল্প সংখ্যক জনবল দিয়ে এই বন রক্ষা খুবই কষ্টকর হয়ে পড়েছে। প্রতিনিয়ত জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বনকর্মীদের বনের মূল্যবান গাছ পাহারা দিলেও তাদের জন্য নেই কোনো ঝুঁকি ভাতা। বর্ষা মৌসুমে রেইনকোট, বুটের প্রয়োজন হলেও তা নেই। তাদের জন্য নেই থাকার কোনো সুব্যবস্থা। যে কক্ষটি রয়েছে বর্ষায় টিন দিয়ে ভিতরে পানি পড়ে। এমনকি নেই সরকারি রেশনও।

দেশীয় অস্ত্র নিয়ে আসা ৩০-৪০ জনের বনদস্যুদের মোকাবিলা করতে গিয়ে অনেক সময় পিছু হটতে হয় বনকর্মীদের। বনকর্মীদের থেকে অস্ত্র ছিনিয়ে নেওয়ার ঘটনাও ঘটেছে বনে। অনেক সময় হামলায় বনকর্মীরা আহত হয়েছেন। ২০১৫ সালে লাউয়াছড়া বনের পার্শ্ববর্তী কালাছড়া বন বিটে বনদস্যুদের হামলার বিট কর্মকর্তা মাহমুদের বাম হাতের রগ কেটে যায়। ১৯৯১ সালে বনদস্যুরা বিট কর্মকর্তা মনিরুজ্জামানকে কুপিয়ে গুরুতর আহত করেছিল। লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান রক্ষায় ভালো কোনো অস্ত্র নেই বললেই চলে। একটি চাইনিজ রাইফেল, দুটি ডিবিবিএল, তিনটি এসএলআর ও একটি থ্রিনটথিসহ মোট সাতটি আগ্নেয়াস্ত্র থাকলেও সচল রয়েছে মাত্র দুটি। নেই পর্যাপ্ত গোলাবারুদ। বর্তমানে বনকর্মীদের হাতে যে অস্ত্র আছে তা আদৌ ফুটবে কিনা এ নিয়েও তাদের থাকতে হয় টেনশনে। কারণ বনকর্মীদের হাতে অস্ত্র থাকলেও অধিকাংশ বনকর্মীর সেই অস্ত্র চালানোর প্রশিক্ষণ নেই। বনের এক প্রান্তে কোনো একটি ঘটনা ঘটলে বিট অফিস থেকে বনকর্মী ওই স্থানে যেতে যেতেই কাজ সাবার।

অনুসন্ধানে জানা যায়, লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানে কর্মকর্তা, বনপ্রহরী ও বোটম্যানদের পরিবার-পরিজন ছেড়ে গহিন বনের মধ্যে অবস্থান করতে হয়। তুলনামূলক কম ছুটি হওয়ায় বনকর্মীরা খুব কমই পরিবারের সঙ্গে থাকার সুযোগ পান। বনের ভিতর যাতায়াত ব্যবস্থাও ভালো নয়। মশাসহ নানা ধরনের পোকার অসহনীয় আক্রমণ সইতে হয় তাদের। কিন্তু এসব কীটপতঙ্গের হাত থেকে রক্ষা পেতে নেই কোনো ব্যবস্থা। ক্রিয়েটিভ কনজারভেশন অ্যালায়েন্স এর প্রধান নির্বাহী ও সরীসৃপ গবেষক শাহরিরায় সিজার রহমান বলেন, বন রক্ষা করার মতো পর্যাপ্ত সাপোর্ট আমাদের নেই। যে গাছ কাটতে আসবে তাকে তো লাঠি দিয়ে তাড়ানো যাবে না। বন্দুক, ইউনিফর্ম, স্যাটেলাইট ফোন এগুলো থাকতে হয়। নেপাল, থাইল্যান্ড, কম্বোডিয়ায় সেনাবাহিনীরা বন রক্ষা করে। আমাদের দেশের বন রক্ষা করার জন্যও সেনাবাহিনীকে দায়িত্ব দেওয়ার বিষয়টি চিন্তা করা যেতে পারে। লাউয়াছড়া বনের ফরেস্ট গার্ড (এফজি) মো. মুক্তার আলী বলেন, জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বনের গাছ পাহারা দেই। অনেক সময় বনদস্যুদের মার খেতে হয়। অন্যান্য বাহিনীর আট ঘণ্টা ডিউটি থাকলেও আমাদের ২৪ ঘণ্টা ডিউটি করতে হয়। আমাদের কোনো ওভার টাইম নেই, রেশন বা ঝুঁকিভাতাও নেই। লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানের সাবেক বিট কর্মকর্তা (বর্তমানে গাজীপুর ন্যাশনাল পার্কে কর্মরত) মো. মনিরুল ইসলাম বলেন, দেশের অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মতো বনপ্রহরীরাও অস্ত্র হাতে বন পাহারা দেন। কিন্তু অন্যান্য বাহিনীর মতো তাদের সুযোগ-সুবিধা নেই। সহকারী বন সংরক্ষক মো. তবিবুর রহমান বলেন, ছয়জন জনবল দিয়ে ১ হাজার ২৫০ হেক্টর লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানের বন, বনভূমি, বনজ সম্পদ এবং বন্যপ্রাণী রক্ষা করা দুরূহ কাজ। বনকর্মীরা ঝুঁকি নিয়েই বন পাহারা দিচ্ছে। তাদের জন্য রেশন বা ঝুঁকিভাতা নেই।

সর্বশেষ খবর