মঙ্গলবার, ১০ এপ্রিল, ২০১৮ ০০:০০ টা

হাত বাড়ালেই হেরোইন

ব্যবসায়ীদের হাতে আলাদিনের চেরাগ ♦ দুই যুবকের নিয়ন্ত্রণে কারবার

কাজী শাহেদ, রাজশাহী

রাজশাহীর সীমান্তঘেঁষা উপজেলা গোদাগাড়ী। উপজেলাটির পরিচিতি এখন মাদকের স্বর্গরাজ্য হিসেবে। এখানকার একেকজন মাদক ব্যবসায়ীর উত্থানের কাহিনী যেন কল্পনাকেও হার মানায়। পুলিশের সঙ্গে সখ্য গড়ে এখানে একেকজন মাদক ব্যবসায়ী যেন হাতে ‘আলাদিনের চেরাগ’ পেয়ে কোটিপতি বনে গেছেন। কেউ বাসের সুপারভাইজার থেকে মাত্র আট-নয় বছরের ব্যবধানে কোটিপতি, কেউ ডিম বিক্রেতা থেকে হয়েছেন কোটিপতি। আবার দিনমজুর বা দোকানের কর্মচারী থেকেও হয়েছেন কোটিপতি। মালিক হয়েছেন গাড়ি, বাড়ি ও অগাধ টাকা-পয়সার। সম্প্রতি অতিরিক্ত পুলিশ সুপার সুমিত চৌধুরীর নেতৃত্বে ওই এলাকায় শুরু হয়েছে মাদকবিরোধী অভিযান। তবু থানা পুলিশকে ম্যানেজ করে গডফাদাররা দিব্বি আছেন এলাকায়। অভিযোগ আছে, অভিযান শুরুর আগেই গডফাদারদের কাছে থানা থেকে খবর পৌঁছে দেওয়া হয়।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, গোদাগাড়ীর মাদকসম্রাট মাটিকাটা এলাকার সোহেল রানা। মাদক       কারবার করেই সোহেল বাসের সুপারভাইজার থেকে এখন কোটিপতি। গত বছরের ৫ মে সোহেলকে মাদক ব্যবসার অভিযোগে গ্রেফতার করে পুলিশ। তবে একটি নাশকতার মামলায় গ্রেফতার দেখিয়ে কারাগারে পাঠানো হয়। এখন জামিনে বেরিয়ে আবার নেমেছেন ব্যবসায়। গোদাগাড়ী থানার পরিদর্শক (তদন্ত) আলতাফ হোসেন বলেন, ‘সোহেল গোদাগাড়ীর শীর্ষ মাদক ব্যবসায়ী এ নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। তিনি মাদক ব্যবসা করেই কোটি কোটি টাকা আয় করেছেন। আর সেই টাকা এখন দেশবিরোধী ষড়যন্ত্রের পেছনে ব্যয় করছেন বলে পুলিশের কাছে তথ্য আছে। স্থানীয় কয়েকজন নেতার সঙ্গে মিশে গিয়ে নিজের অপকর্ম আড়ালের চেষ্টা করে যাচ্ছিলেন এই মাদকসম্রাট।’ গোদাগাড়ী থানা পুলিশের সূত্রমতে, আষাঢ়িয়াদহ ইউনিয়নের ৩ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য জহুরুল ইসলামের বিরুদ্ধে আছে হেরোইন ব্যবসার অভিযোগ। থানায় তিনি নিয়মিত যাতায়াত করেন। কিন্তু পুলিশ তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না। গোদাগাড়ীর আরেক শীর্ষ মাদক ব্যবসায়ী সিঅ্যান্ডবি গড়ের মাঠ এলাকার মালা বক্সের ছেলে হযরত আলী (৩৫)। এলাকায় তিনি জামায়াতের কর্মী হিসেবে পরিচিত। কিন্তু তার নেপথ্যের কারবার হলো হেরোইন ও ইয়াবা চোরাচালান। তিনি পাইকারি মাদক ব্যবসায়ী বলে মাদকসাম্রাজ্যে পরিচিত নাম। আর এভাবেই হযরত এখন কোটিপতি। তিনি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তালিকাভুক্ত মাদকসম্রাট। আগে অন্যের জমিতে শ্রমিকের কাজ করতেন। এখন প্রায় ৭০ বিঘা আবাদি জমিসহ রাজশাহী নিউমার্কেটে গার্মেন্টের মালিক ও গড়ের মাঠে বিশাল বাড়িসহ গাড়ির মালিক।

তবে হযরত সম্প্রতি পলাতক আছেন বলে দাবি করেছে গোদাগাড়ী থানা পুলিশ।

 

এ ছাড়া গোদাগাড়ীর শহিদুল ইসলাম ভোদল, আরিজপুর গ্রামের তারেক ইকবাল, মাদারপুরের সবজি ব্যবসায়ী সেলিম তোফাজ্জল হোসেন, চর আষাঢ়িয়াদহ ইউনিয়নের মানিকচক গ্রামের শরিফুল ইসলাম, কোদালকাটি গ্রামের আবদুল জব্বার, মহিশালবাড়ী গ্রামের আজিজুল মায়ারী, মাদারপুরের নাজিবুর, ইব্রাহিম, চর আলাতুলি গ্রামের একাধিক মাদক মামলার আসামি খুয়াজ, তার ভাই হুমায়ুন; গোদাগাড়ীর হলের মোড় চাইপাড়ার লোকমান, মহিশালবাড়ী গ্রামের রাজমিস্ত্রি হেলাল, একই এলাকার টেম্পোচালক বাবু, মেকাইল, বিস্কুট ফ্যাক্টরির কর্মচারী বনি ইসরাইল, রাজমিস্ত্রি দেলাবুর পুলিশের তালিকাভুক্ত মাদকসম্রাট। যারা এলাকায় একেকজন কোটিপতি হিসেবে পরিচিত। শুধু মাদকের সংস্পর্শে এসেই তাদের কপাল খুলে গেছে। অতিরিক্ত পুলিশ সুপার সুমিত চৌধুরী বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘মাদকের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতিতে কাজ শুরু হয়েছে। অধিকাংশ মাদক ব্যবসায়ী এলাকা ছেড়েছেন। এসব মাদক ব্যবসায়ীকে ছাড় দেওয়া হবে না।’

দুই যুবকের নিয়ন্ত্রণে হেরোইন ব্যবসা : ‘একসময় গোদাগাড়ীতে দেড় শতাধিক হেরোইন ব্যবসায়ী ছিল। এখনো তারা আছে। কিন্তু তাদের হাত থেকে ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ চলে গেছে। এখন রাজশাহীর হেরোইন ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ মাদারপুরের ইব্রাহিম ও রেলগেটের শহিদুলের হাতে। এ দুই যুবক এখন হেরোইন ব্যবসার নিয়ন্ত্রক।’ কথাগুলো বলছিলেন রেলগেট এলাকার জাহাঙ্গীর। এই জাহাঙ্গীরও একসময় হেরোইন ব্যবসার সঙ্গে জড়িত ছিলেন। পুলিশের তালিকায় শীর্ষে তার নাম ছিল। এখন হেরোইন ব্যবসা ছেড়ে ইয়াবা ব্যবসায় জড়িয়েছেন জাহাঙ্গীর। দেশের হেরোইনের চালানের একটি বড় অংশ নিয়ন্ত্রিত হয় রাজশাহীর গোদাগাড়ীকে কেন্দ্র করে। মূলত ভারত থেকে সীমান্তপথে আসা হেরোইনের ওপর নির্ভর করে গড়ে উঠেছে চক্রটি। চক্রের কয়েকজন সদস্য রাজশাহী ও দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে নিয়ন্ত্রণ করে মাদকের বড় বড় চালান। অভিযোগ আছে, পুলিশ, ও মাদকদব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের সদস্যদের সহায়তায় এসব মাদক ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে যাচ্ছে। অতিরিক্ত পুলিশ সুপার সুমিত চৌধুরী জানান, এ দুজন এখন হেরোইনের কারবার নিয়ন্ত্রণ করে। তাদের সন্ধানে পুলিশ অভিযান চালাচ্ছে। ইব্রাহিম এলাকা ছেড়ে দিনাজপুরে থাকে। আর শহিদুল এলাকায় থাকলেও পুলিশের উপস্থিতি টের পেয়ে পালিয়ে যায়।

এই রকম আরও টপিক

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর