শনিবার, ২১ এপ্রিল, ২০১৮ ০০:০০ টা

জাবির ‘কঠিন ব্যাধি’ শিক্ষকদের নিজেদের কলহ, মারামারি

শরিফুল ইসলাম সীমান্ত

জাবির ‘কঠিন ব্যাধি’ শিক্ষকদের নিজেদের কলহ, মারামারি

দেশের একমাত্র আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় (জাবি) শিক্ষা, গবেষণা, সংস্কৃতি, খেলাধুলাসহ নানা বিষয়ে করেছে সোনালি অর্জন। কিন্তু গৌরবের চেয়ে তার রোগব্যাধির কথাই এখন বেশি প্রচার পায়। বলা হচ্ছে, জাবির ‘কঠিন ব্যাধি’ শিক্ষকদের নিজেদের মধ্যে কলহ-বিবাদ আর মারামারি। ১৯৭০ সালে প্রতিষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয়টির ৪৮ বছরের ইতিহাসে উপাচার্য পদে আসেন ১৮ জন শিক্ষক। প্রতিবারই জাবির উপাচার্য পদ পাওয়া নিয়ে শিক্ষকদের মধ্যে চলে নানা টানাপোড়েন আর দলাদলি। দিন দিন এটা আরও তীব্রতা পাচ্ছে। ফলে এক শিক্ষক আরেক শিক্ষককে ‘সন্ত্রাসী’ আখ্যা দেন। এমনকি নিজেদের মধ্যে মারামারিতেও লিপ্ত হচ্ছেন। গত ছয় বছরে শিক্ষকদের মধ্যে বেশ কয়েকবার মারামারি হয়েছে। উপাচার্য পদ লাভ আর উপাচার্য পতন আন্দোলনকে কেন্দ্র করে নিজেদের এই মারামারি দিন দিন জাবি শিক্ষকদের নিরাময়ের অযোগ্য এক রোগে পরিণত হচ্ছে! ২০১৩ সালে উপাচার্য পতন আন্দোলনে উপাচার্য আনোয়ার হোসেনের সঙ্গে দুই শিক্ষকের মারামারির ঘটনার চার বছর পর গত মঙ্গলবার শিক্ষকদের মধ্যে আবারও এমন ঘটনা ঘটে। দ্বিতীয় মেয়াদে দায়িত্ব পাওয়া উপাচার্য ফারজানা ইসলামের প্রশাসনিক রদবদলকে কেন্দ্র করে তার প্রতিদ্বন্দ্বী শরীফ এনামুল কবিরপন্থি শিক্ষকরা এদিন অবরোধ পালন করেন। অবরোধ কর্মসূচি পালনকালে পরিবহন ডিপোর ফটকে তালা লাগানোকে কেন্দ্র করে উপাচার্যপন্থি ও উপাচার্যবিরোধী শিক্ষকদের দুই গ্রুপের মধ্যে হাতাহাতি হয়। এরপর দুপুরে প্রশাসনিক ভবনের ফটকে গণমাধ্যমের সামনেই উত্তপ্ত বাক্যবিনিময়ে জড়িয়ে পড়েন গ্রুপ দুটির শিক্ষকরা। এ সময় শিক্ষকদের আক্রমণাত্মক ভঙ্গিতে কথা বলতে দেখা যায়। এসব ঘটনার ভিডিও ফুটেজ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ইউটিউব ও ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়লে সেখানে নিন্দার ঝড় ওঠে। শিক্ষকরা বলছেন, আওয়ামীপন্থি হওয়া সত্ত্বেও মূলত উপাচার্য পদের ক্ষমতা কাজে লাগিয়ে নানারকম আর্থিক ও প্রশাসনিক সুযোগ-সুবিধা পেতেই শিক্ষকদের মধ্যে বিভাজন তৈরি হয়েছে; যার ফলে শিক্ষকরা নিজেদের মধ্যে মারামারির মতো ঘটনাও ঘটাচ্ছেন। অনুসন্ধানে জানা যায়, ইতিপূর্বে উপাচার্য অধ্যাপক শরীফ এনামুল কবির ও আনোয়ার হোসেনের সময়ও উপাচার্য পক্ষ-বিপক্ষ দ্বন্দ্বকে কেন্দ্র করে শিক্ষকদের মধ্যে মারামারির ঘটনা ঘটে।

কান্নার ছবি : উপাচার্য শরীফ এনামুল কবিরের সময় ২০১২ সালে ছাত্রলীগের অন্তঃকোন্দলে উপাচার্যপন্থি ছাত্রলীগ কর্মীদের হাতে খুন হন বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের ছাত্র জুবায়ের। এ ঘটনায় শিক্ষকদের করণীয় নিয়ে ১২ জানুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয়ের জহির রায়হান মিলনায়তনে সভা আহ্বান করে শিক্ষক সমিতি। এ সভাতেই উপাচার্যপন্থি ১৫-২০ জন শিক্ষক ও প্রক্টরের হাতে উপাচার্যবিরোধী শিক্ষকদের শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত হওয়ার অভিযোগ ওঠে। শিক্ষক সমিতির তৎকালীন সভাপতি অধ্যাপক এ এ মামুনকেও লাঞ্ছিত করার অভিযোগ ওঠে উপাচার্যপন্থি প্রক্টর আরজু মিয়ার বিরুদ্ধে। জুবায়ের হত্যা ও শিক্ষক লাঞ্ছনার এ ঘটনায় অস্থিতিশীল হয়ে ওঠে ক্যাম্পাস। বিক্ষোভে ফেটে পড়ে সাধারণ ছাত্র ও শিক্ষক সমাজ। সর্বাত্মক আন্দোলনের মুখে অবশেষে পদত্যাগ করতে বাধ্য হন প্রক্টর। এর কিছুদিন পর উপাচার্যের পদ থেকে পদত্যাগ করেন শরীফ এনামুল কবিরও। শিক্ষকের হাতে শিক্ষক লাঞ্ছনার সেই ঘটনায় আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন পদার্থবিজ্ঞানী অধ্যাপক এ এ মামুনের কান্নারত একটি ছবি সে সময় গণমাধ্যমে প্রকাশ পেলে জনগণের মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। গণমাধ্যমে এক সাক্ষাৎকারে এ এ মামুন তখন বলেন, ‘বাইরের দেশের বিশ্বসেরা বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরির অফার ফিরিয়ে দিয়ে এ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে আছি মাটির মায়ায়। শিক্ষক সমিতির নির্বাচিত সভাপতি হয়েও আজ আমাকে প্রক্টরের হাতে লাঞ্ছিত হতে হলো।’

হামলা-ভাঙচুর : উপাচার্য আনোয়ার হোসেন ক্ষমতায় থাকাকালেও শিক্ষকদের মধ্যে বিভাজন ও মারামারির ঘটনা ঘটে। ২০১৩ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিকেল সেন্টারে মারা যান পরিসংখ্যান বিভাগের ছাত্র আবদুল মালেক। মালেককে হাসপাতালে নেওয়ার জন্য সময়মতো অ্যাম্বুলেন্স না পাওয়ায় বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা উপাচার্যের বাসভবন, মেডিকেল সেন্টারসহ বেশ কয়েকটি ভবনে ব্যাপক ভাঙচুর চালান।

হামলা ও ভাঙচুরের ঘটনায় আনোয়ার হোসেন দায়ী করেন জামায়াত-শিবিরকে। এমনকি আওয়ামীপন্থি শিক্ষক ও ছাত্রলীগ নেতাদেরও তিনি জামায়াত-শিবির বলে আখ্যা দেন। তার এমন বক্তব্যে উপাচার্য পতনের আন্দোলনে নামে শিক্ষক সমিতি। গড়ে ওঠে উপাচার্যপন্থি ও বিরোধী শিক্ষক গ্রুপ।

আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় ২০১৩ সালের ৯ অক্টোবর বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনিক ভবনের সামনে অবরোধ পালন করছিলেন উপাচার্যবিরোধী শিক্ষকরা। ওইদিন পূর্বনির্ধারিত সিন্ডিকেট সভায় যোগ দিতে এলে অবরোধকারী শিক্ষকরা উপাচার্যকে ভবনে প্রবেশে বাধা দেন। বাধা পেয়ে উপাচার্য আনোয়ার হোসেন পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক জামাল উদ্দিন রুনু এবং ফার্মেসি বিভাগের শিক্ষক ফখরুল ইসলামকে শারীরিক লাঞ্ছিত করেন বলে অভিযোগ ওঠে। পরে উপাচার্যের অনুগত ছাত্রলীগ নেতারা এসে প্রশাসনিক ভবনের সামনে অবস্থানরত শিক্ষকদের চেয়ার-টেবিল ভাঙচুর করেন। এ সময় মাইক্রোবায়োলজি বিভাগের শিক্ষক আনোয়ার খসরু পারভেজকে উপাচার্যপন্থি প্রক্টর মজিবুর রহমান মারতে উদ্যত হন বলে অভিযোগ পাওয়া যায়।

জাবির এক অধ্যাপক বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘ভিন্নমত, ভিন্নপথের খাতিরে মানুষে মানুষে তর্ক থাকতেই পারে। তবে তর্কের ভাষা কখনই আক্রমণাত্মক কিংবা সহিংস হওয়া শোভনীয় নয়। শিক্ষকরা সমাজের অত্যন্ত সম্মানীয় ব্যক্তি। তাদের অবশ্যই সম্মান দিতে জানতে হবে। তবেই অন্যের সম্মান পাওয়া যাবে। শিক্ষকরা ছাত্রদের জন্য আদর্শ। তাদের এমন কিছু করা উচিত নয় যা শিক্ষকদের সম্পর্কে ছাত্রদের মনে বিরূপ মনোভাবের জন্ম দেয়।’

 

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর