জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) চেয়ারম্যান মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া বলেছেন, রপ্তানিমুখী তৈরি পোশাক, প্রিন্টিং ও প্যাকেজিং শিল্পে বন্ডেড ওয়্যারহাউস সুবিধায় আমদানি হওয়া কাগজ-জাতীয় পণ্য বাজারে বিক্রি হওয়ায় এ খাতের দেশীয় শিল্প ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এভাবে বন্ডের কাগজ আমদানি হলে দেশি কাগজশিল্পের ক্ষতি রোধ করা যাবে না। তাই বন্ডসুবিধার অপব্যবহার বন্ধে নীতিমালা করা হবে। গতকাল রাজধানীর সেগুনবাগিচার রাজস্ব ভবনে আয়োজিত প্রাক-বাজেট আলোচনা সভায় তিনি এসব কথা বলেন। অনুষ্ঠানে অন্যান্যের মধ্যে বক্তৃতা করেন এনবিআর সদস্য কানন কুমার রায়, রেজাউল হাসান ও ফিরোজ শাহ আলম, ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো কোম্পানি লিমিটেডের চেয়ারম্যান গোলাম মাঈনউদ্দিন, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব চার্টার্ড অ্যাকাউন্টসের সাবেক সভাপতি হুমায়ুন কবির, বাংলাদেশ মুদ্রণ শিল্প মালিক সমিতির চেয়ারম্যান তোফায়েল খান, ভাইস-চেয়ারম্যান হাসিনা নেওয়াজ, সাধারণ সম্পাদক জহুরুল ইসলাম প্রমুখ। প্রাক-বাজেট সভায় এনবিআর চেয়ারম্যান মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া বলেন, কাগজ আমদানির ফলে দেশি কাগজশিল্প ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। তৈরি পোশাকশিল্পের যেসব প্রতিষ্ঠান বন্ডসুবিধায় কাগজ আমদানি করে, তা তো রপ্তানির প্যাকেজিংয়ের জন্য আনছে। সে সুবিধা তারা পাচ্ছেন। এতে কোনো অসুবিধা নেই। কিন্তু বাজারে বিক্রি করতে পারবেন না।
বিশেষ করে প্রিন্টিং ও প্যাকেজিং শিল্পে বন্ডেড ওয়্যারহাউস সুবিধার অপব্যবহার বন্ধে এনবিআর নীতিমালা করার চেষ্ট করবে। মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির প্যাকেজিংয়ে বন্ডসুবিধার কাগজের অপব্যবহার বন্ধ করা হবে জানিয়ে তিনি বলেন, যারা রপ্তানির জন্য বন্ডসুবিধায় কাগজ-কালি আমদানি করছেন, তাদের মূল ব্যবসা তো অন্য। কাগজ-কালি তাদের ব্যবসা নয়। কিন্তু এটার জন্য রপ্তানিকারকরা বন্ডসুবিধা নিচ্ছেন। বন্ডের নামে তারা এমন পরিমাণ কাগজপণ্য আমদানি করছেন, যেটা বাজারে বিক্রি করা যায়। ফলে দেশি কাগজ ও প্যাকেজিং শিল্প ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। চোরাচালান প্রতিরোধ প্রসঙ্গে মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া বলেন, ‘এনবিআরকে চোরাচালান প্রতিরোধ করতে হবে। কারণ একটার সঙ্গে আরেকটা পণ্য চোরাচালান হয়। সিগারেটের সঙ্গে ইয়াবা চোরাচালান হয়। ইয়াবা ছাড়াও আরও অনেক বিষয় আছে। সেগুলো আমরা কঠোরভাবে দমন করব।’ এর আগে তামাক কোম্পানিগুলোর বাজেট প্রস্তাবের ওপর আলোচনা করতে গিয়ে এনবিআর চেয়ারম্যান বলেন, ‘সিগারেট উৎপাদন বন্ধ হলে চোরাচালানের মাধ্যমে আসবে। এই চোরাচালান বন্ধ করা কঠিন। সিগারেট বন্ধ হয়ে ইয়াবা আসবে। ইয়াবা সিগারেটের চেয়েও খারাপ। যদিও প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ২০৪০ সালের পর সিগারেট থাকবে না। এটা নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা এনবিআরের থাকবে। একই সঙ্গে চোরাচালান বন্ধে কঠিন পদক্ষেপ নেবে এনবিআর।’ এ সময় তিনি উড়োজাহাজের যাত্রীদের বিনা শুল্কে সিগারেট আনার কোনো যৌক্তিকতা নেই বলেও মন্তব্য করেন।
প্রাক-বাজেট সভায় বাংলাদেশ মুদ্রণ শিল্প মালিক সমিতির চেয়ারম্যান তোফায়েল খান বন্ডসুবিধার কাগজ কালোবাজারে বিক্রি হওয়ার অভিযোগ তুলে ধরে বলেন, ‘আমরা চাই দেশি কাগজশিল্পকে সুরক্ষা দেওয়া হোক। দেশে ২৩০ থেকে ৩০০ গ্রামের আর্ট কার্ড আমদানি হয় না। সব বন্ডসুবিধায় আসছে এবং বাজারে বিক্রি হচ্ছে। এতে সরকার রাজস্ববঞ্চিত হচ্ছে। আমরা বন্ডসুবিধাধারী প্রতিষ্ঠানগুলোর কালোবাজারি বন্ধ হোক এটা চাই।’ দেশে সাত হাজার মুদ্রণ শিল্প প্রতিষ্ঠান আছে উল্লেখ করে তোফায়েল খান বলেন, ‘মাত্র ১ হাজার ২০০-এর মতো প্রতিষ্ঠান ভ্যাট ও কর দেয়। বাকি প্রতিষ্ঠানগুলো ভ্যাট ও কর দেয় না। এটা আমাদের জন্য একটা বৈষম্য। তাদের সঙ্গে আমরা প্রতিযোগিতায় টিকতে পারছি না।’ মুদ্রণ শিল্প মালিক সমিতির ভাইস চেয়ারম্যান হাসিনা নেওয়াজ বলেন, বন্ডের কাগজ নিয়ে প্রিন্টিংয়ের মতো প্যাকেজিং শিল্পেও একটা বড় ফাঁকি আছে। সাম্প্রতিককালে মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিগুলো যাদের কাজ দিচ্ছে, তাদের জন্য আমদানির ব্যবস্থা রাখে না তারা। ফলে বন্ডসুবিধায় আমদানি হওয়া কাগজ প্যাকেজিং শিল্পে ব্যবহার হচ্ছে। বাজার থেকে বন্ডের কাগজ অল্প দামে কিনে ব্যবহার করা হচ্ছে। এতে এনবিআর প্রতিটি প্যাকেট তৈরিতে এক থেকে দেড় টাকা রাজস্ববঞ্চিত হচ্ছে। এমন হাজার হাজার কোটি প্যাকেট তৈরি হয় এবং সরকার রাজস্ববঞ্চিত হয়। দেশের প্রিন্টিং শিল্প অত্যন্ত অত্যাধুনিক উল্লেখ করে হাসিনা নেওয়াজ বলেন, ‘যে পরিমাণ তৈরি পোশাকপণ্য রপ্তানি হয়, এর ৯ শতাংশ মুদ্রণ খাতের। আমাদের পরবর্তী লক্ষ্য রপ্তানি করা। সেখানে বন্ডের কাগজে এই শিল্প ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।’ এর আগে তামাক কোম্পানিগুলোর বাজেট প্রস্তাব উত্থাপন করে ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো কোম্পানি লিমিটেডের চেয়ারম্যান গোলাম মাঈনউদ্দিন বলেন, ‘চোরাচালানের মাধ্যমে সিগারেট আসার প্রবণতা বাড়ছে। এটা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। কারণ বিশ্বের যে কোনো মানের সিগারেট বাংলাদেশে তৈরি করা সম্ভব। তাহলে কেন সিগারেট আমদানি হবে!’ বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব চার্টার্ড অ্যাকাউন্টসের সাবেক সভাপতি হুমায়ুন কবির বলেন, ‘রাজস্ব আয়ের অধিক টার্গেট করদাতাদের হয়রানির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। আয়কর আইনের ১২০ ধারার অপপ্রয়োগ করা হচ্ছে। নতুন আয়কর আইনে এ নিয়ে চিন্তাভাবনা করা প্রয়োজন। একই সঙ্গে বিভিন্ন কোম্পানির অডিটের ভুয়া প্রতিবেদন জাতীয়ভাবে আমাদের জন্য লজ্জাজনক।’ সংগঠনের পক্ষ থেকে বিদেশি ঠিকাদারদের করদাতা শনাক্তকরণ নম্বর— টিআইএনের আওতায় আনার দাবি জানান তিনি।