শনিবার, ৯ জুন, ২০১৮ ০০:০০ টা

সৌন্দর্য পুঁজি করে বেপরোয়া পারলার ব্যবসা

লাগামহীন সেবামূল্য নিম্নমানের পণ্য ব্যবহার নেই কোনো নীতিমালা

জিন্নাতুন নূর

শাহরিন হাসান ঢাকার ধানমন্ডির ফারজানা শাকিল মেকওভার সেলুনে যান চুলের প্রোটিন ট্রিটমেন্ট করাতে। পারলারের কর্মীরা প্রথমে তাকে জানান যে, এ সেবার মূল্য ৮০০ টাকা। কিন্তু তিনি সেবা গ্রহণের পর বিল দিতে গিয়ে জানতে পারেন, তার বিল হয়েছে ১৬০০ টাকা। পারলারের কর্মীদের হয়তো কোনো ভুল হয়েছে এমনটি ভাবলেও পারলারের কর্মীরা শাহরিনকে জানান, তার চুলের দৈর্ঘ্য কিছুটা বড় হওয়ায় অতিরিক্ত আরও ৮০০ টাকা তার সেবামূল্যের সঙ্গে যোগ করা হয়েছে, যা সেবা গ্রহণের আগে শাহরিনকে জানানো হয়নি। তিনি বলেন, এভাবে গ্রাহকদের ঠকিয়ে অতিরিক্ত পয়সা আদায় করার জন্য তিনি সেই পারলারে যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছেন। রামিনা কবিরা নামের আরেক সেবাগ্রহীতা জানান, দুই বছর ধরে ফারজানা শাকিলে গিয়ে তাদের কথামতো নিয়মিত ফেসিয়াল করান। কিন্তু এ জন্য রামিনার ত্বকের বেশ ক্ষতি হয়েছে। তার ত্বক এখন জ্বালাপোড়া করছে এবং তিনি চর্মরোগে আক্রান্ত। রামিনা বলেন, ‘ঢাকার প্রথম শ্রেণির একটি পারলারে সেবা নেওয়ার পর এ ধরনের কিছু আশা করিনি। সেবা দেওয়ার জন্য তারা গ্রাহকদের কাছ থেকে যে পরিমাণ চার্জ নেন, সে হিসেবে তাদের একজন বিশেষজ্ঞ কর্মী দিয়ে সেবা প্রদানের কথা থাকলেও তা করা হয়নি।’ রাজধানীর আরেকটি পরিচিত পারলার পারসোনায় এন এম মেশকাতুল আনোয়ার সম্প্রতি তার ছোট দুই মেয়েকে নিয়ে চুল কাটাতে যান। তিনি বলেন, ‘পাড়ার নাপিতের দোকান থেকে যে বাটিকাট চুল ৫০ টাকা দিয়ে কাটাই, একই কাটের জন্য পারলারটির কর্মীরা একজনের জন্য ৪০০ টাকা করে রাখল!’ নারীদের সৌন্দর্যচর্চাকে পুঁজি করে নগরীর বিভিন্ন পাড়া-মহল্লা থেকে শুরু করে মফস্বল ও গ্রামাঞ্চলে এখন বিউটি পারলার গড়ে উঠেছে। আর হবে না-ই বা কেন, সৌন্দর্যচর্চার ক্ষেত্রে আপস করতে রাজি নয় শিশু থেকে শুরু করে বয়স্ক নারী কেউই। এই সেবা দিতে গিয়ে বিউটি পারলারগুলো গ্রাহকদের কাছ থেকে আদায় করছে মাত্রাতিরিক্ত অর্থ। যদিও সৌন্দর্যসেবা দিতে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত নারীদের এসব পারলারে সেবা প্রদানের কথা, কিন্তু বাস্তব ঘটনা ভিন্ন। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, নির্দিষ্ট কোনো নীতিমালা না থাকায় ঢাকার প্রথম সারির পারলারগুলো গ্রাহকদের কাছ থেকে গলাকাটা সেবামূল্য আদায় করছে। কিন্তু সে হিসেবে দিচ্ছে না আশানুরূপ সেবা। আর নগরীর প্রথম শ্রেণির পারলারগুলোর যখন এই অবস্থা, তখন দ্বিতীয় শ্রেণি ও পাড়া-মহল্লায় যত্রতত্র গড়ে ওঠা অন্য পারলারগুলোর অবস্থা কতটা শোচনীয় হতে পারে তা সহজেই অনুমেয়। নব্বইয়ের দশক থেকে ঢাকায় পারলার ব্যবসার প্রসার শুরু হয়। বর্তমানে ঢাকাসহ সারা দেশে দুই হাজারের বেশি পারলার আছে। আর নারীর সৌন্দর্যকে পুঁজি করে এ ব্যবসার বাজার এখন ১০০ কোটি টাকার ওপরে। পারলার ব্যবসাকে কেন্দ্র করে অনেক নারী হয়ে উঠছেন স্বাবলম্বী। কিন্তু স্বল্প বিনিয়োগে অতি লাভজনক এবং প্রায় তিন দশক ধরে চলে আসা এ ব্যবসা সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার  জন্য কোনো ব্যবসায়িক নীতিমালা বা আইন এখনো দেশে তৈরি হয়নি। আর পারলারে যে সেবা প্রদান করা হচ্ছে এর জন্য কোনো নির্দিষ্ট মানদণ্ড বা সেবামূল্য নির্ধারণ করা হয়নি। এ সুযোগে নারীদের কাছ থেকে ইচ্ছামতো গলাকাটা সেবামূল্য আদায় করছে নগরীর বিভিন্ন পারলারের কর্মীরা। নারীদের বিউটি পারলারে সাধারণত চুলকাটা, চুল রং করা, চুলের বিভিন্ন সেবা, ভ্রূ প্লাক, মেকআপ ও পারসোনাল কেয়ারসহ বিভিন্ন ধরনের সেবা দেওয়া হয়। এসব পারলারের বিরুদ্ধে সেবাগ্রহীতাদের অন্যতম অভিযোগ হচ্ছে, অধিকাংশ পারলারই গ্রাহকদের কাছ থেকে গলাকাটা সেবামূল্য আদায় করলেও কাঙ্ক্ষিত সেবা প্রদান করছে না। এ ছাড়া পারলারের কর্মীদের রূঢ় আচরণ নিয়েও অনেক গ্রাহক অভিযোগ করেন। প্রথমে একজন সেবাগ্রহীতাকে এক ধরনের সেবামূল্যের কথা বলা হলেও পরে তার কাছ থেকে বাড়তি মূল্য আদায় করা হয়। অভিযোগ আছে, ঢাকার প্রথম সারির কিছু পারলার ছাড়া বাকিগুলোতে সৌন্দর্যসেবার জন্য যে পণ্য বা রাসায়নিক সামগ্রী ব্যবহার করা হচ্ছে, তা অত্যন্ত নিম্নমানের। ‘হেয়ার কেয়ার সার্ভে অন পারলারস অ্যান্ড স্যালন ইন ঢাকা’ শীর্ষক এক জরিপ থেকে জানা যায়, ঢাকার প্রথম সারির পারলারগুলো ভালো ব্র্যান্ডের প্রসাধনী, যেমন শ্যাম্পু, কন্ডিশনার, চুলের রং ও ফেসিয়াল সামগ্রী ব্যবহার করলেও বেশির ভাগ পারলার চীন, থাইল্যান্ড ও ভারতের কম দামি প্রসাধনী ব্যবহার করছে। আবার কিছু পারলার কর্তৃপক্ষের সেবাদাতাদের কাছে ব্যবহূত পণ্যের ব্র্যান্ড বা নাম জানতে চাইলে তারা সেটিও বলতে চান না। সাধারণ পারলারগুলো নিউমার্কেট থেকে তিন লিটারের কম দামি হারবাল শ্যাম্পু কিনে তা ব্যবহার করছে। হারবাল এই পণ্য সম্পর্কে জানতে চাইলে নিজেদের তৈরি পণ্য বলে জানায় পারলার কর্তৃপক্ষ। আর ক্ষতিকর এই রাসায়নিক ব্যবহারে প্রায়ই গ্রাহকদের কাছ থেকে চর্মরোগে আক্রান্ত হওয়াসহ চুলের ক্ষতি হওয়ার অভিযোগ পাওয়া যায়। জরিপে আরও উল্লেখ করা হয়, নগরীর পারলারগুলোতে নিয়ম অনুযায়ী দক্ষ ও প্রশিক্ষিত কর্মী থাকার কথা থাকলেও ৫৭ শতাংশ পারলারেই প্রশিক্ষিত কর্মী নেই।

এর আগে ২০১১ সালের অক্টোবরে পারসোনার বনানী আউটলেটে বারডেম হাসপাতালের এক নারী চিকিৎসক স্পা করাতে গিয়ে চেঞ্জিং রুমে পোশাক বদলাতে গেলে সেখানে একটি সিসিটিভি ক্যামেরা দেখে সন্দেহ প্রকাশ করেন। এ নিয়ে পরে সেই নারী চিকিৎসকের স্বামীর সঙ্গে পারলারের লোকদের বাকবিতণ্ডা হয়। একপর্যায়ে ঘটনাটি তদারক করতে সেখানে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা উপস্থিত হন। তবে পারসোনার স্বত্বাধিকারী কানিজ আলমাস খান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে জানান, পারসোনার সঙ্গে জড়িত রয়েছে সাড়ে তিন হাজার নারী কর্মী। এ ঘটনার সঙ্গে এই কর্মীদের মানসম্মান এবং নিরাপত্তাও জড়িত। তিনি বলেন, গ্রাহকদের চাহিদা মোতাবেক তাদের মূল্যবান সামগ্রী নিরাপদে রাখতে এবং কর্মীদের কাজ তদারক করার জন্যই তাদের পারলারে সিসিটিভি ক্যামেরা চালু করা হয়েছে।

সর্বশেষ খবর