শিরোনাম
শুক্রবার, ২৫ অক্টোবর, ২০১৯ ০০:০০ টা

শিক্ষার আলোয় আলোকিত কুষ্টিয়া কারাগার

জহুরুল ইসলাম, কুষ্টিয়া

শিক্ষার আলোয় আলোকিত কুষ্টিয়া কারাগার

‘মা আমি বন্দী কারাগারে, আছি গো মা বিপদে, বাইরের আলো চোখে পড়ে না।’ জনপ্রিয় এই গানটিতে কারাগার জীবনের চালচিত্র উঠে এসেছে। নানা অপরাধে গ্রেফতার হয়ে অথবা দ-িত হয়ে প্রতিনিয়ত কারাগারে যান অসংখ্য মানুষ। এসব মানুষের একটি বড় অংশ অশিক্ষিত বা অক্ষরজ্ঞানহীন। এদের মধ্যে শিক্ষার আলো জ্বালানোর উদ্যোগ নিয়েছে কুষ্টিয়া জেলা কারাগার কর্তৃপক্ষ। এখন এই কারাগারে কোনো বন্দী গেলে নিবন্ধন খাতায় টিপসই দেওয়ার সুযোগ নেই। এ জন্য নামসই বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।

আগে কারাগারে বন্দী নিবন্ধন খাতায় নিরক্ষররা নিজের স্বাক্ষরের ঘরে টিপসই দিতেন। ২০১৭ সালে বর্তমান জেল সুপার জাকের হোসেন কুষ্টিয়া কারাগারে যোগদানের পর এ ধারা বদলে ফেলার উদ্যোগ নেন। তিনি কয়েকজন শিক্ষিত বন্দীর সঙ্গে আলোচনা করে অনুরোধ করেন, যাতে তারা এই কারাগারে আসা নিরক্ষর বন্দীদের কমপক্ষে স্বাক্ষর শেখানোর দায়িত্ব নেন। সে অনুযায়ী একজন বন্দী অধ্যক্ষের নেতৃত্বে একটি শিক্ষক প্যানেল গঠন করা হয়। তারা প্রতিদিন সকাল ৮টা থেকে ১০টা পর্যন্ত নিরক্ষর বন্দীদের ক্লাস নেন। এর মধ্যে আধা ঘণ্টা মোটিভেশন ও নৈতিকতার শিক্ষাও দেওয়া হয়। এখানে প্রথমে নিরক্ষরদের অক্ষরজ্ঞান শেখানো হয়। পরে তাদের দেওয়া হয় প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা। জেল সুপার জাকের হোসেন জানান, এই কার্যক্রম শুরুর বছর, অর্থাৎ ২০১৭ সালে এ কারাগারে বন্দী ৪২০ জনকে অক্ষরজ্ঞান ও প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা দেওয়া হয়। ২০১৮ সালে এ সংখ্যা ছিল ১ হাজার ৪৬৩ জন।  আর চলতি বছরে এ পর্যন্ত ৭৮৫ জন বন্দী এখান থেকে পাঠ নিয়েছেন।

তবে কেবল প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা নয়, পাশাপাশি এখানে বন্দীদের পবিত্র কোরআন ও ধর্মীয় শিক্ষারও ব্যবস্থা করেছে কর্তৃপক্ষ। জেলা ইসলামিক ফাউন্ডেশনের দুজন প্রশিক্ষক বন্দীদের এই শিক্ষা দেন। এছাড়া কয়েকজন বন্দী ওই প্রশিক্ষকদের সহযোগিতা করেন। ২০১৭ থেকে চলতি বছর সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এখানকার ২ হাজার ১৫৬ জন বন্দী আরবি শিক্ষা নিয়েছেন।

কারাগারে কথা হয় বন্দী বাবর আলীর (৫৬) সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘কারাগারের জীবন খুব কষ্টের। তবে এখানে পড়ালেখার সুযোগ পেয়ে সেই কষ্ট আর নেই। এখন আমি লিখতে পারি, পড়তে পারি। এবার জেল থেকে ছাড়া পেলে আর কোনো অপরাধে জড়াব না।’ আরেক বন্দী মরুদ আলী (৬৫) বলেন, ‘পড়ালেখা কিছুই জানতাম না। এখন শেষ বয়সে এসে সেই সুযোগ পেয়ে খুব ভালো লাগছে।’ নজু নামের এক হাজতি জানান, লেখাপড়া জানতেন না তিনি। একটি মামলায় টিপসই দিয়ে জেলখানায় ঢুকেছেন। বর্তমানে তিনি স্বাক্ষর করতে পারেন। নিজের নাম, বাবার নাম এবং নিজের ঠিকানা তিনি লিখতে পারেন। এতেই তার আনন্দ।

এছাড়া এই কারাগারে বন্দীদের বিভিন্ন কারিগরি প্রশিক্ষণও দেওয়া হয়। এর মধ্যে রয়েছে তিন মাস মেয়াদি ইলেকট্রিক ওয়্যারিং, ছয় মাস মেয়াদি টিভি-ফ্রিজ মেরামত ও তাঁত প্রশিক্ষণ। এখানকার তাঁত বিভাগে দুটি যান্ত্রিক তাঁত রয়েছে। এখান থেকে উৎপাদিত হয় কয়েদিদের পোশাক, তোয়ালে ও লুঙ্গি। এর প্রসার ঘটাতে আরও পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে বলে জানালেন জেল সুপার জাকের হোসেন। তিনি জানান, এখানে প্রশিক্ষিত বন্দীদের মধ্যে যারা জামিনে ছাড়া পান, তাদের অনেকেই নিজে দোকান দিয়ে ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতি মেরামত করে বেকারত্ব ঘোচাচ্ছেন। আবার কেউ অন্যের দোকানে চাকরি নিয়ে দক্ষতার সঙ্গে কাজ করছেন।

জানা গেছে, বই-খাতা, চক-পেনসিলসহ প্রয়োজনীয় শিক্ষা উপকরণ ও কারিগরি প্রশিক্ষণের যন্ত্রপাতি কারা কর্তৃপক্ষ নিজেদের তহবিল থেকে দিয়ে থাকে। জেলগেটের পাশে বন্দীদের উৎপাদিত পণ্যের শোরুম রয়েছে। এখানে বিক্রি হওয়া পণ্যের ৫০% বন্দীদের দেওয়া হয়।

কারাগারের সুপার জাকের হোসেন জানান, কারা মহাপরিদর্শক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এ কে এম মোস্তফা কামাল পাশা জেলখানাকে বন্দীদের হাতকে কর্মীর হাতে রূপান্তরিত করতে নানা উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন। এ উদ্যোগ বাস্তবায়ন করতেই তিনি নানামুখী চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর