সোমবার, ১৪ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ ০০:০০ টা

করোনা বাড়াচ্ছে সামাজিক সংকট

মানসিকভাবে হতাশাগ্রস্ত ও বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে বহু মানুষ

মানিক মুনতাসির

করোনাভাইরাস মহামারি বিপর্যস্ত বিশ্ববাসীর মাঝে সৃষ্টি করছে চরম মানসিক ও সামাজিক সংকট। একাধিক গবেষণার তথ্য ঘেঁটে দেখা গেছে, আর্থিক ও পারিবারিক সংকট থেকেই মূলত এ মানসিক ও সামাজিক অস্থিরতা বর্তমানে এক নতুন আতঙ্ক হিসেবে দেখা দিয়েছে। করোনা আক্রান্ত হওয়ার পর সেরে উঠলেও দীর্ঘদিন এক ধরনের মেন্টাল ট্রমার মধ্য দিয়ে দিন কাটে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। অনেকেই আর্থিক ক্ষতি কাটাতে না পেরে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছেন। করোনা মহামারি দীর্ঘায়িত হওয়ার সঙ্গে পারিপার্শ্বিকভাবে বৈরী আচরণের শিকার হওয়ায় মানুষ এমন অনাকাক্সিক্ষত মৃত্যুর পথ বেছে নিচ্ছে বলে তারা মনে করেন। এ অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে সমস্যাগ্রস্তদের মাঝে সরকারের আর্থিক সহায়তা বাড়ানো এবং পারিবারিক ও সামাজিক বন্ধন আরও সক্রিয় করার সঙ্গে সামগ্রিকভাবে কিছু উদ্যোগ নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন বিশ্লেষকরা।

বেসরকারি সংস্থা ব্র্র্যাক ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড গভর্নেন্স (বিআইজিডি) ও পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টারের (পিপিআরসি) এক গবেষণায় দেখা যায়, করোনা মহামারির শুরুতেই প্রথম দফা লকডাউনে দেশের অন্তত ৭০ ভাগ মানুষের আয় কমে যায়। পাশাপাশি সে সময় বিপুলসংখ্যক জনগোষ্ঠী কাজ হারায়। যার অনেকেই এখনো আগের অবস্থানে ফিরতে পারেনি। সে সময় দারিদ্র্যের হারও দিগুণ হয়ে যায়। ফলে সমাজে সৃষ্টি হয়েছে নানা ধরনের অস্থিরতা ও সামাজিক সংকট আর মানুষের মধ্যে প্রকট আকার ধারণ করেছে মানসিক সমস্যা।

দেশি-বিদেশি সংস্থার একাধিক গবেষণায় দেখা গেছে, করোনায় সংক্রমিত মানুষের প্রতি পাঁচজনের একজনের মধ্যে করোনার সঙ্গে মানসিক সমস্যা (বিষণ্ণতা, উদ্বিগ্নতা, সাইকোসিস ইত্যাদি) দেখা দেয়। আবার কভিড-১৯ সংক্রমিত নন এমন ব্যক্তি ও স্বাস্থ্যকর্মীর মধ্যে স্ট্রেস উদ্বিগ্নতা, বিষণ্ণতা, প্যানিক অ্যাটাকের হার সাধারণ সময়ের চেয়ে বহুগুণ বেড়ে যায় বলে প্রমাণিত। এমনকি করোনা থেকে সেরে উঠলেও মানসিক সমস্যার ঝুঁকি কিন্তু থেকেই যায়। যা শেষ পর্যন্ত মানুষকে অকালমৃত্যুর দিকেই ঠেলে দিচ্ছে। করোনা সংক্রমণের আতঙ্ক, চিকিৎসা পাওয়া নিয়ে অনিশ্চয়তা, মরে যাওয়ার ভয়, অর্থনৈতিক বিপর্যস্ততা, বেকারত্ব- করোনা নিয়ে এমন ভ্রান্ত-নেতিবাচক সামাজিক বৈষম্যের কারণে বাড়ছে মানসিক সংকট। আর করোনা চিকিৎসায় নিয়োজিত সকল পর্যায়ের স্বাস্থ্যকর্মীর মধ্যে স্ট্রেস বার্নআউট হচ্ছে যা তাদের মানসিক স্বাস্থ্য ক্ষতিগ্রস্ত করছে। এমনকি করোনাকালে বিশ্বজুড়ে বেড়ে গেছে পারিবারিক ও লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতা। বাংলাদেশ উন্নয়ন সমীক্ষার এক গবেষণায় দেখা গেছে, করোনাভাইরাস মহামারিটি বিশ্বজুড়ে মানব জীবনের সব দিক প্রভাবিত করেছে। এটি অর্থনীতি, সমাজ ও মানুষের পারিবারিক জীবনে ব্যাপক পরিবর্তন এনেছে। জাতিসংঘের মতে, গত ৭৫ বছরে বিশ্ব এ ধরনের পরিবর্তনের সম্মুখীন হয়নি। কভিড-১৯ মহামারি বিশ্ব অর্থনীতিতে ধ্বংসাত্মক প্রভাব ফেলেছে। আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিল (আইএমএফ) বর্তমান পরিস্থিতিকে একটি নতুন মন্দা হিসেবে আখ্যা দিয়ে ২০০৯ সালে ইউরোপের আর্থিক সংকটের সঙ্গে তুলনা করেছে। বৈশি^ক অর্থনীতিকে ক্ষতিগ্রস্ত করার সঙ্গে সঙ্গে মহামারিটি উন্নয়ন, সুরক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, খাদ্য এবং রাজনৈতিক ক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে।

কভিড-১৯ মহামারির কারণে ২০২০ সাল থেকে গোটা পৃথিবী শতাব্দীর সবচেয়ে ভয়াবহতম সময় পার করেছে; যা এখনো চলমান। গত বছর প্রকাশ করা ওই গবেষণায় উল্লেখ করা হয়, বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়।

এদিকে মহামারির লকডাউন চলাকালে মানুষকে বাসাবাড়িতেই বন্দি থাকতে হয়েছে। এজন্য একদিকে যেমন বংশবৃদ্ধি বেড়েছে, অন্যদিকে বেড়েছে পারিবারিক কলহ। এমনকি এ পারিবারিক কলহের আগুনে ঘি ঢেলেছে ডিভোর্সের মাত্রাও। ফলে ২০২০-২১ সালে বেড়েছে বিবাহবিচ্ছেদও। সামগ্রিকভাবে করোনা মহামারি মানুষের মধ্যে মানসিক অবসাদ ও বিষণ্ণতা বৃদ্ধির নিয়ামক হিসেবেও কাজ করেছে বলে মনে করেন বারডেম জেনারেল হাসপাতালের সহযোগী অধ্যাপক ডা. নাসিম জাহান। তিনি বলেন, করোনা মহামারি একদিকে মানুষকে আর্থিকভাবে ব্যাপক ক্ষতির মুখে ফেলেছে, অন্যদিকে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করেছে। যার ফলে তৈরি হচ্ছে নতুন নতুন সামাজিক সংকট।

কভিডকালে বাংলাদেশে পরিচালিত কিছু গবেষণায় অংশগ্রহণকারীর প্রায় ৩৩ শতাংশের মধ্যে অ্যাংজাইটি আর ৪৬ শতাংশের মধ্যে বিষণ্ণতার লক্ষণ পাওয়া গেছে। অর্থাৎ সাধারণ সময়ের চেয়ে কভিডকালে মানসিক সমস্যা বাংলাদেশেও বেড়ে যাচ্ছে। বিগত এক বছরে বাংলাদেশে আত্মহত্যা ঘটেছে প্রায় ১৪ হাজার, যা এর আগের বছরের চেয়ে বেশি। এ ছাড়া সুনির্দিষ্টভাবে কভিড ইস্যুতেই (কভিড নিয়ে কুসংস্কার, স্টিগমা, ভীতি) প্রায় পাঁচজনের আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে। ২০১৯-২০ ও ২০২১ সালে এটা আরও বেড়েছে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর