একসময় সিলেট জেলাজুড়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে ছিল পাহাড় ও টিলা। কিন্তু ভূমিখেকোদের দৌরাত্ম্যে দিন দিন এসব পাহাড়-টিলা অস্তিত্ব হারিয়েছে। নানা কৌশলে মাটি কেটে সমতল করে ফেলা হয়েছে পাহাড়-টিলা। টিলার মাটি কেটে ঝুঁকিপূর্ণভাবে তৈরি করা হয়েছে আবাসন। অনেক স্থানে প্রভাবশালীরা দখলদারি ও টিলা কাটা অব্যাহত রাখতে পাদদেশে কাঁচা ঘরবাড়ি করে দিয়েছেন বাস্তুহারা লোকজনদের। প্রশাসনের নিষ্ক্রিয়তার কারণে দিন দিন এসব ঝুঁকিপূর্ণ বসতির সংখ্যা বেড়েই চলেছে। সরকারি হিসাবে ঝুঁকিতে বসবাসকারীদের এসব পরিবারের কোনো তালিকা বা সংখ্যা না থাকলেও এটি ১০ হাজারের ওপরে বলে জানা গেছে। সারা বছর টিলার পাদদেশে বসবাসকারী এসব পরিবারকে নিয়ে কারও কোনো মাথাব্যথা না থাকলেও বর্ষা এলেই বেড়ে যায় আতঙ্ক। বিশেষ করে টিলা ধসে প্রাণহানির পর টনক নড়ে প্রশাসনের। এ বছর বর্ষা মৌসুমের আগেই ভারী বৃষ্টিপাত শুরু হওয়ায় জেলার বিভিন্ন উপজেলায় টিলাধস শুরু হয়েছে। গত এক মাসে জৈন্তাপুর ও গোলাপগঞ্জে টিলা ধসে পাঁচজনের প্রাণহানি ঘটেছে। এ ছাড়া বিভিন্ন উপজেলায় টিলা ধসে বাড়িঘর ভেঙে লোকজন আহত হওয়ারও খবর পাওয়া গেছে। প্রতি বছর বর্ষা মৌসুম শুরু হলেই সিলেটের পাহাড়-টিলার পাদদেশে বসবাসকারীদের মধ্যে বাড়ে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা। অতিবর্ষণে টিলা ও পাহাড় ধসে প্রাণহানি ঘটে। এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। গত তিন সপ্তাহের মধ্যে সিলেটের সদর, গোলাপগঞ্জ, জৈন্তাপুর, গোয়াইনঘাট ও ফেঞ্চুগঞ্জে টিলাধস ঘটেছে। টিলা ধসে মাটিচাপা পড়ে ১৪ মে গোলাপগঞ্জে একজন ও গতকাল জৈন্তাপুরে চারজন মারা গেছেন। গত ১০ বছরে সিলেটে পাহাড় ধসে এভাবে মারা গেছেন ২১ জন। আহত হয়েছেন আরও অনেকে। দুর্ঘটনার আগে প্রশাসনের কর্মকর্তারাও থাকেন ঘুমে। কোথাও টিলাধস বা প্রাণহানি ঘটলে সেখানে প্রশাসনের পক্ষ থেকে মাইকিং করে স্থানীয় লোকজনকে সতর্ক করা কিংবা ঝুঁকিপূর্ণ বাসস্থান ছেড়ে নিরাপদ আশ্রয়ে যাওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়। প্রশাসনের এ নির্দেশে কেউই কর্ণপাত করে না। নিরাপদ আশ্রয় না থাকায় ঝুঁকিপূর্ণভাবে আতঙ্ক নিয়েই তারা থেকে যান টিলার নিচের বসতিতে। সূত্র জানান, সিলেট মহানগর, সদর উপজেলাসহ জেলার গোলাপগঞ্জ, ফেঞ্চুগঞ্জ, জৈন্তাপুর ও গোয়াইনঘাট উপজেলায় প্রায় ৪০০ পাহাড়-টিলা রয়েছে। যদিও এ-সংক্রান্ত কোনো পরিসংখ্যান জেলা প্রশাসনের কাছে নেই। কয়েক বছর আগে বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা) সিলেট মহানগর ও বিভিন্ন উপজেলায় টিলার একটি পরিসংখ্যান প্রকাশ করে। বেলার সিলেটের বিভাগীয় সমন্বয়ক শাহ শাহেদা আখতার জানান, সিলেট মহানগর ও সদর উপজেলায় ২০০ টিলা রয়েছে। বিভিন্ন উপজেলায় আরও ২০০-এর ওপরে টিলা আছে। এসব টিলার কোনোটি সম্পূর্ণ, কোনোটি আংশিকভাবে কেটে ফেলা হয়েছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রভাবশালীরা টিলা কেটে মাটি বিক্রি করেন। টিলা সমতল করে প্লট বানিয়ে বিক্রি করেন। এতে জায়গার মূল্য কয়েক গুণ বেশি পাওয়া যায়। টিলার দখলদারি ও টিলা কাটা অব্যাহত রাখতে টিলার মালিকরা টিলার নিচে ও ওপরে ছোট ছোট ঘর তৈরি করে বাস্তুহারা লোকজনদের সেখানে আশ্রয় দেন। দখল ধরে রাখতে অনেক টিলার মালিক তাদের কাছ থেকে ভাড়াও আদায় করেন না। এসব বসতির আড়ালে সারা বছর চলে টিলা কর্তন। খবর পেয়ে মাঝেমধ্যে পরিবেশ অধিদফতর ও টাস্কফোর্স অভিযান চালিয়ে টিলার মালিকদের বিরুদ্ধে মামলা কিংবা জরিমানা করে। কিন্তু এতেও থামে না টিলা কাটা।
টিলার পাদদেশে দিন দিন বসতি বাড়লেও প্রশাসন এ ব্যাপারে নিষ্ক্রিয় ভূমিকা পালন করে। পরিবেশবাদী সংগঠন সেভ দ্য হেরিটেজের প্রধান সমন্বয়ক আবদুল হাই আল হাদী জানান, পাহাড় ও টিলা সিলেটের ঐতিহ্যের অংশ। কিন্তু নির্বিচারে কর্তনের ফলে টিলা ও পাহাড় ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। ঝুঁকিপূর্ণ টিলার ওপর সেভ দ্য হেরিটেজের পক্ষ থেকে একটি জরিপ চালানো হয়েছিল। এতে দেখা গেছে, সিলেট শহরতলি ও বিভিন্ন উপজেলায় টিলা কেটে এর পাদদেশে অন্তত ১০ হাজার পরিবার ঝুঁকিপূর্ণভাবে বাস করছে। এসব টিলার অনেকাংশ কেটে ফেলায় টিলাগুলোও দুর্বল হয়ে পড়েছে। বর্ষা মৌসুমে এগুলো ধসে পড়ে প্রাণহানি ঘটায়।