শুক্রবার, ১২ মে, ২০২৩ ০০:০০ টা

৩৩ বছরে পানির স্তর নেমেছে ৬০ ফুট

বরেন্দ্র অঞ্চল

নিজস্ব প্রতিবেদক, রাজশাহী

মাহালি সম্প্রদায়ের পাওলিনা মার্ডি। পেশায় গৃহিণী ও কৃষিশ্রমিক। সম্প্রতি তার এলাকায় পানির সংকট দেখা দিয়েছে। খাবার ও গৃহস্থালির জন্য পানি সংগ্রহ করতে তাকে প্রায় এক কিলোমিটার দূরে অন্য গ্রামে যেতে হচ্ছে। পাওলিনা বলেন, ‘গেরামের মাটিত থেকি পানি উটচে নাকো। পুকুররোত পানিও নুংরা। সংসার সামলাত বা বাইরে কাজ করবার থাকে কঠিন হচ্ছে দূর গ্রামে যায়ি অন্যের বাড়ি থেকি পানি আনা। দিনোত তিনবার করি পানি আনতে যাতি হয়। ওই বাড়িত টাকা দিয়ার পরও কথা শুনাচ্চে।’ শুধু পাওলিনা মার্ডিই নয়, বরেন্দ্র অঞ্চল রাজশাহী তানোর উপজেলার মু-ুমালা পৌরসভার পাঁচন্দর মাহালিপাড়া গ্রামের আদিবাসী প্রতিটি পরিবারের দুঃখ ও কষ্টের নাম পানি। প্রকৃতির নিষ্ঠুরতার কাছে তারা অসহায় হয়ে পড়েছে। এই গ্রামের বিভিন্ন স্থানে গভীর নলকূপ স্থাপন করেও পানি পাওয়া যায়নি। এমন অবস্থায় গ্রামে যারা আছেন তারা দূর গ্রাম থেকে পানি আনছেন। পরিবারের গর্ভবতী নারী দূর গ্রাম থেকে পানি আনতে গিয়ে গর্ভপাতের মতো ঘটনা পর্যন্ত ঘটেছে। এমন অবস্থায় অনেকে গ্রাম ছেড়ে শহরের দিকে পাড়ি জমিয়েছেন। গ্রামের অনেক আবাদি জমি সেচের পানির অভাবে অনাবাদি পড়ে আছে। চুনিয়াপাড়া হাইস্কুলের দশম শ্রেণির ছাত্রী মমতার মা অসুস্থ। প্রতিদিন মমতাকে প্রায় এক কিলোমিটার দূরে পাশের গ্রামের একটি বাড়ি থেকে দিনে তিনবার পানি আনতে যেতে হয়। মমতার সমবয়সী লুসি মর্ডিও বাড়ি থেকে প্রায় এক কিলোমিটার দূরে প্রধান সড়ক পেরিয়ে দিনে তিনবার মু-ুমালা কাছেমুল উলুম ইসলামিয়া ক্বওমি মাদরাসা থেকে পানি নিয়ে আসে। কৃষিশ্রমিক ও মাহালি সম্প্রদায়ের সদস্য আঞ্জলুস টুডু বলেন, গ্রামে দুটি পুকুর আছে। সেই পুকুরে মাছ চাষ করে স্থানীয় প্রভাবশালীরা। পানিতে মুরগির ময়লা ফেলা হয় মাছের খাবার হিসাবে। ওই পুকুরের পানি সবুজ হয়ে গেছে। পুকুরের পানি মানুষের ব্যবহারের অনুপযোগী। মাছের জন্য সেই পুকুরে নামতেও নিষেধ করা হয়। তারপরও উপায় না থাকায় মাহালি সম্প্রদায় ওই নোংরা পুকুরেই গোসল করে এবং থালাবাসন ধোয়ার কাজ করতে বাধ্য হয়। বিএমডিএর তানোর জোনের সহকারী প্রকৌশলী মাহফুজুর রহমান বলেন, তানোরে ৫২৯টি গভীর নলকূপের মধ্যে ৩০টিতে পানি উঠছে না। এখানকার গভীর নলকূপের অধীনে কৃষিজমির পরিমাণ ২১ হাজার হেক্টর। প্রতি বছরই ৪ থেকে ৫টি ডিপ টিউবওয়েল নষ্ট হচ্ছে। পানির লেয়ার নেমে যাওয়ায় ডিপ নষ্ট হয়। ১৯৯০ সালের দিকে ৬০ থেকে ৮০ ফুট গভীরে পানির স্তর মিললেও এখন কোথাও কোথাও ১২০ ফুট নিচেও পানি মিলছে না।

 আমেরিকার টেক্সাস বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডির শিক্ষার্থী আবদুল্লাহ আল কাফি। রাজশাহী মহানগর ও জেলার জলবায়ু ও প্রকৃতি নিয়ে তার একাধিক গবেষণা আছে। যা জার্নাল আকারে প্রকাশ হয়েছে। কাজ করেছেন একাধিক আন্তর্জাতিক এনজিও প্রতিষ্ঠানেও। পরিবেশ গবেষক আবদুল্লাহ আল কাফি জানান, রাজশাহী জেলায় ২০০০ সালে ১৭২ বর্গমিলোমিটার জায়গাজুড়ে নগরায়ণ ছিল, ২০২০ সালে তা ৩৮৭ বর্গ কিলোমিটার ছাড়িয়েছে। ২০০০ সালে ১ হাজার ২২৭ বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে সবুজায়ন ছিল, ২০২০ সালে যা কমে এখন ৯২৬ বর্গকিলোমিটারে এসেছে। ২০০০ সালে ২৯৮ বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে বিভিন্ন জলাধার ছিল, যা কমে ১৮০ বর্গকিলোমিটারে এসেছে। ২০০০ সালে গড় সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল ৩৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস, ২০২০ সালে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। প্রকৃতি নিজেই ঝুঁকির মধ্যে আছে। আসলে ক্ষতিগ্রস্ত প্রকৃতির আর আমাদের দেওয়ার কিছুই থাকবে না।’

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব ও খনিজবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক চৌধুরী সারোয়ার জাহান বলেন, প্রতিবছর বরেন্দ্র অঞ্চলের পানির স্তর এক থেকে দুই ফুট করে নিচে নেমে যাচ্ছে। গত বছর বৃষ্টিপাত কম হওয়ায় পানির স্তর নেমেছে দুই ফুট। এখন কোথাও কোথাও ১২০ ফুটেও পানি মিলছে না। অপরিকল্পিত উপায়ে পানি উত্তোলন এবং মাটির তলের পানি রিচার্জ না হওয়ার কারণে বরেন্দ্র অঞ্চলে পানির স্তর অস্বাভাবিক হারে নিচে নেমে যাচ্ছে।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর