শনিবার, ১৮ নভেম্বর, ২০২৩ ০০:০০ টা
আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল

জান্নাতের মুখে বিষ ঢেলে পালিয়ে যান স্বামী জাহিদ

আলী আজম

২০১০ সালে মো. জসিম ওরফে জাহিদের সঙ্গে জান্নাতুল ফেরদৌস ওরফে জান্নাতের বিয়ে হয়। তারা ঢাকার যাত্রাবাড়ী থানার কোনাপাড়ায় থাকতেন। বিয়ের পর দিনকাল ভালোই কাটছিল এ দম্পতির। কিন্তু ধীরে ধীরে জান্নাতের সঙ্গে খারাপ আচরণ এবং শারীরিক নির্যাতন শুরু করেন জাহিদ। এভাবে নির্যাতন সহ্য করে জান্নাত সাত বছর কাটিয়ে দেন। তার পরও স্বামীর মন জয় করতে পারেননি। স্বামী তার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেন। ২০১৭ সালের ২৪ ডিসেম্বর পরিকল্পিতভাবে তাকে হত্যা করেন। কিন্তু আত্মহত্যার নাটক প্রচার করেন। জাহিদের সার্বিক কর্মকান্ড এবং পুলিশের তদন্তে হত্যায় জড়িত থাকার বিষয়টি উঠে আসে। এর পরই গা ঢাকা দেন জাহিদ। জানা গেছে, ২০১৭ সালের ২৫ ডিসেম্বর দুপুর সাড়ে ১২টায় জান্নাতের ছোটভাই মো. মঞ্জুকে ফোন পূরণ জাহিদ। বলেন, তোমার বড়বোন বিষ খেয়ে মারা গেছে এবং মৃতদেহ ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে আছে। সেখান থেকে মঞ্জুকে মৃতদেহ নিয়ে আসতে বলেন জাহিদ। তখন জাহিদকে ঢামেক হাসপাতালে তার সঙ্গে যেতে বলেন মঞ্জু। কিন্তু জাহিদ যেতে অস্বীকার করেন। বলেন, এ বিষয়ে তিনি কিছুই জানেন না। মঞ্জু বিষয়টি যাত্রাবাড়ী থানা পুলিশকে জানান। তখন পুলিশ ঢামেক মর্গ থেকে জান্নাতের লাশ উদ্ধার করে। মঞ্জু ঢামেক হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে জানতে পারেন, ২৪ ডিসেম্বর রাত ১টার দিকে জাহিদসহ তিন-চার জন জান্নাতকে ঢামেক হাসপাতালে নিয়ে আসেন। জান্নাতকে বোন বলে পরিচয় দেন জাহিদ। তারা জান্নাতকে হাসপাতালে রেখে পালিয়ে যান। যাত্রাবাড়ী থানা পুলিশ মৃতদেহের সুরতহাল রিপোর্ট ও ময়নাতদন্তের ব্যবস্থা করে। এ ঘটনায় ২৫ ডিসেম্বর তিনজনের নাম উল্লেখসহ অজ্ঞাত তিন-চার জনের বিরুদ্ধে মঞ্জু যাত্রাবাড়ী থানায় হত্যা মামলা করেন। আসামি হলেন জসিম ওরফে জাহিদ, তার বন্ধু ওয়াসিম শিকদার ও জুয়েল। পুলিশ ওয়াসিম ও জুয়েলকে গ্রেফতার করলেও জাহিদ পলাতক থাকেন।

তদন্তে জাহিদের জড়িত থাকার তথ্য পাওয়া গেলেও ওয়াসিম ও জুয়েলের জড়িত থাকার তথ্য পাওয়া যায়নি। ২০১৯ সালের ১০ সেপ্টেম্বর আদালতে অভিযোগপত্র দেয় পুলিশ।

প্রাথমিক তদন্ত, সাক্ষ্য-প্রমাণ ও ঘটনার পারিপার্শ্বিকতা, মামলার বাদী, সাক্ষী ও ঘটনাস্থলের আশপাশের লোকজনকে জিজ্ঞাসাবাদ এবং ময়নাতদন্ত ও ভিসেরা রিপোর্ট পর্যালোচনা করে জাহিদকে অভিযুক্ত করে পুলিশ। আর ওয়াসিম ও জুয়েলের জড়িত থাকার প্রমাণ না পাওয়ায় তাদের অব্যাহতি চাওয়া হয়। এ ছাড়া অজ্ঞাত আসামিদের অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি বলে অভিযোগপত্রে উল্লেখ করা হয়। মামলাটি তদন্ত করে আদালতে অভিযোগপত্র দেন যাত্রাবাড়ী থানার এসআই মো. ওমর ফারুক। কিন্তু বাদীর নারাজির পরিপ্রেক্ষিতে ২০২২ সালের ৯ জানুয়ারি আদালত মামলাটির অধিকতর তদন্তের জন্য পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) ঢাকা মেট্রো দক্ষিণকে দায়িত্ব দেন।

মামলাটি তদন্তে করেন পিবিআই ঢাকা মেট্রো দক্ষিণের পরিদর্শক মার্জিনা আকতার। তার তদন্তও পুলিশের দেওয়া অভিযোগপত্রের সঙ্গে মিলে যায়। তিনি জাহিদকে অভিযুক্ত করে ওয়াসিম ও জুয়েলের অব্যাহতি চান। এরই মধ্যে তিনি বদলি হয়ে গেলে ২০২২ সালের ১৩ নভেম্বর মামলাটি তদন্তের দায়িত্ব পান পিবিআই ঢাকা মেট্রো দক্ষিণের পরিদর্শক মোহাম্মদ শাহীনুজ্জামান। তিনি তদন্তে জানতে পারেন ২০১২ সালে নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁ থানায় অস্ত্র মামলায় গ্রেফতার হন জাহিদ। ২০১৩ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি জামিনে বেরিয়ে আত্মগোপনে চলে যান। সংস্কৃতিমনা ছিলেন জান্নাত। কিন্তু এটা মেনে নিতে পারেননি জাহিদ। এ কারণে তাকে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করতেন।

ঘটনার দিন ২০১৭ সালের ২৪ ডিসেম্বর রাত সাড়ে ১০টায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে যাওয়া নিয়ে জান্নাতের সঙ্গে জাহিদের কথা কাটাকাটি ও ঝগড়া হয়। একপর্যায়ে জান্নাতকে বেধড়ক মারধর করেন জাহিদ। এতে জান্নাতের মৃত্যু হয়। পরে ঘটনাটি আত্মহত্যা বলে চালানোর উদ্দেশ্যে জান্নাতের মুখে বিষ ঢেলে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যান। সেখানে জান্নাতের ভাই বলে পরিচয় দিয়ে লাশ ফেলে পালিয়ে যান। তিনিও মামলাটির সার্বিক তদন্তে পূর্ববর্তী তদন্ত কর্মকর্তার তদন্ত সঠিক বলে প্রমাণ পেয়েছেন। পরে চলতি বছর জাহিদকে একমাত্র আসামি করে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেন পিবিআই ঢাকা মেট্রো দক্ষিণের পরিদর্শক মোহাম্মদ শাহীনুজ্জামান।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর