রবিবার, ৭ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ ০০:০০ টা

অমিত সম্ভাবনার ঝিনাইদহ

ঝিনাইদহের রয়েছে গৌরবগাথা ইতিহাস। জেলার নামকরণের ইতিহাসটাও মজার। কথিত রয়েছে ঝিনুক থেকে চুন ও বোতাম তৈরি হওয়ায় ব্যবসায়ীরা এখানে ঝিনুক কুড়াতে শ্রমিক পাঠাতেন। ঝিনুকপ্রাপ্তির স্থানকে তারা বলতেন ঝিনুকদাহ। ঝিনুক ও দহ (বড় জলাশয়) মিলিয়ে হয় ঝিনুকদহ বা ঝিনেইদাহ যা রুপান্তরিত হয়ে আজকের ঝিনাইদহ হয়েছে। অর্থনীতি ও পর্যটনে এ জেলার রয়েছে অমিত সম্ভাবনা। এখানে উৎপাদিত বিভিন্ন সবজি, মিষ্টি পান ও ফুল দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশে রপ্তানি হচ্ছে। এলাকার উন্নয়ন ও বিভিন্ন সম্ভাবনা নিয়ে বিশিষ্টজনদের সঙ্গে কথা বলেছেন জেলা প্রতিনিধি শেখ রুহুল আমিন—

 

কৃষিপণ্য প্রক্রিয়াকরণের আদর্শ অঞ্চল হতে পারে

—তাহজীব আলম সিদ্দিকী সমি এমপি

ঝিনাইদহ হতে পারে কৃষিপণ্য প্রক্রিয়াকরণের বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল। এ জেলার মাটি ঊর্বর। বন্যা, খরাসহ অন্যান্য প্রাকৃতিক

বৈরিতা থেকে মুক্ত। জিকে ক্যানেলের বিশেষ আশীর্বাদে এখানে সেচ সুবিধাও অবারিত। সবমিলে ঝিনাইদহ ধান এবং বিভিন্ন অর্থকরী ফসল উৎপাদনের প্রাণকেন্দ । বিপুল ফসল প্রক্রিয়াকরণের মাধ্যমে ঝিনাইদহের যে ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে, তা আমরা কাজে লাগাতে পারিনি। ঝিনাইদহের উন্নয়ন ও বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে বাংলাদেশ প্রতিদিনকে এসব কথা বলেন ঝািনইদহ-২ আসনের স্বতন্ত্র এমপি ও বিশিষ্ট শিল্পপতি তাহজীব আলম সিদ্দিকী সমি। এমপি বলেন, বিসিকের আওতায় এখানে গড়ে উঠা শিল্পাঞ্চলে নেই গ্যাসসুবিধা। সফল শিল্পনগরী গড়ে ওঠার জন্য যে অবকাঠামোগত সুবিধা প্রয়োজন, তাও অনুপস্থিত। তাই উৎপাদিত ফসল কোনোরূপ মূল্য সংযোজন ছাড়াই চলে যাচ্ছে ঝিনাইদহ থেকে। যথাযথ প্রক্রিয়াকরণ করে এখানে গড়ে তোলা যেত ব্যাপক শিল্প। যা থেকে কর্মসংস্থান হতো বিপুল জনগোষ্ঠীর। স্থানীয়ভাবে কৃষিপণ্যের সম্ভারকে পুঁজি করে উদ্যোক্তাগোষ্ঠী গড়ে ওঠার কথা ছিল। কিন্তু প্রাতিষ্ঠানিক পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে সেটিও হয়নি। সরকার যায়, সরকার আসে, আলোচনাও হয়। কিন্তু ঝিনাইদহের অমিত সম্ভাবনা আলোর মুখ দেখে না।

 

সত্যিকারের শিল্প এলাকায় পরিণত করতে হবে

—ড. এম. হারুন অর রশীদ

বহুকাল থেকে কৃষিপণ্য উৎপাদনে প্রসিদ্ধ ঝিনাইদহ। কিন্তু শিল্প-কারখানা স্থাপনে এই জেলা অনেক পিছিয়ে।

এখানে ১৯৯৮ সালে ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন (বিসিক) প্রতিষ্ঠিত হয়। বর্তমানে বিসিক এলাকায় ৩৮টি শিল্প কারখানা চালু রয়েছে। সুযোগ-সুবিধার অভাবে নতুন কারখানা স্থাপনে কেউ উৎসাহ পাচ্ছেন না। যেগুলো চালু রয়েছে তারাও ভুগছে নানা সংকটে। এই অচলাবস্থার মূল কারণ অপর্যাপ্ত বিদ্যুৎ সরবরাহ। প্রতিদিন প্রায় ১২ ঘণ্টা লোডশেডিং থাকে। জেলার অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে এমনটাই জানান, সৃজনী বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা নির্বাহী পরিচালক ও ব্যবসায়ী ড. এম হারুন অর রশীদ।

তিনি বলেন, ঝিনাইদহবাসীর অনেক দিনের লালিত স্বপ্ন গ্যাস সংযোগ। এ জেলার উপর দিয়ে গ্যাস খুলনায় যাচ্ছে অথচ এখানকার জনগণ বঞ্চিত। তাছাড়া যে কোনো শিল্প এলাকায় অন্যতম প্রধান শর্ত নিষ্কাশন ব্যবস্থা। অথচ বিসিক এলাকায় নিষ্কাশন ব্যবস্থা নেই। ফলে শিল্প ও অন্যান্য বর্জ্য যেখানে সেখানে ফেলা হয়। যা পরিবেশ ও স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। বর্তমান ঝিনাইদহ বিসিকের সার্বিক চিত্র এতটাই ভয়াবহ যে, অনেক উদ্যোক্তা তাদের শিল্প কারখানা গুটিয়ে নেওয়ার কথা ভাবছেন।

 

রেল লাইন হলে উন্নয়নে ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে

—অধ্যক্ষ বাদশা আলম

নবগঙ্গার অববাহিকায় প্রায় দুশ বছর আগে ব্রিটিশ শাসনের শুরুতেই গড়ে উঠে ঝিনাইদহ শহর। ১৯৮৪ সালে হয় স্বতন্ত্র জেলা। জাতীয়

পর্যায়ে এ জেলার আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক, ভৌগোলিক ও শিক্ষা-সাংস্কৃতিক গুরুত্ব অপরিসীম। ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে ঝিনাইদহে উৎপাদিত প্রচুর গাছপালা ও ফুল-ফসল। বিশেষ করে খেজুর গুড়, কলা, মাছজাতীয় অর্থনীতিতে সহায়তাদানসহ সামাজিক সমৃদ্ধি সাধনে অবদান রেখে চলেছে। জেলার বিভিন্ন উন্নয়ন ও সম্ভাবনা নিয়ে ঝিনাইদহ কলেজের অধ্যক্ষ বাদশা আলম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে কথাগুলো বলেন। তিনি আরো বলেন, ঝিনাইদহের কৃতী সন্তান বীরশ্রেষ্ঠ হামিদুর রহমান, জে.কে.এম.এ আজিজ, গোলাম মজিদ, কাজী খাদেমুল ইসলাম, মইনুদ্দীন মিয়াজী, হবিবর রহমান সিদ্দিকী, অধ্যাপক কামরুজ্জামান, অ্যাড. আয়ুব হোসেন। জাতীয়, রাজনীতি ও মুক্তিযুদ্ধে যারা অনন্য অবদান রেখে গেছেন। ব্রিটিশবিরোধী ও তেভাগা আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন অত্র এলাকারই  সন্তান বাঘাযতীন ও ইলামিত্র। শিক্ষা সংস্কৃতি ও জ্ঞান-বিজ্ঞানে এ অঞ্চলের ভূমিকা অধিক। প্রসঙ্গক্রমে চলে আসে রেল যোগাযোগের কথা। এ বিষয়ে বাদশা আলম বলেন, জেলা শহরে রেল লাইন পুনরায় স্থাপিত হলে ঝিনাইদহ ব্যবসা-বাণিজ্য ও পর্যটন শিল্পে সম্পৃক্ত হবে।

 

পর্যটন কেন্দ্র হতে পারে ঝিনাইদহ

—কনককান্তি দাস

বেগমতি, ইছামতি, কোদলা, কপোতাক্ষ, নবগঙ্গা, চিত্রা আর কুমারসহ-সাত সাতটি নদ-নদীর অববাহিকায় অবস্থা ঝিনাইদহের। কবি পাগলা কানাই, বিপ্লবী বীর বাঘা যতীন, শ্রীকান্ত ক্ষ্যাপা,  খ্যাতিসম্পন্ন বীজগনিত প্রণেতা কেপি বসু, প্রখ্যাত কবি গোলাম মোস্তফাসহ বহু মনীষী ছাড়াও রয়েছে মুরাদগড়, গাজীকালু চম্পাবর্তী, জঙ্গলপীরের দরগা, ভাইবোনের পুকুর, বলু দেওয়ানের কবর, এশিয়া মহাদেশের বৃহত্তম সুইতলা মল্লিকপুরের বটগাছ, রাজবাড়ীর মন্দির, সেলিম চৌধুরী বাড়ি, ঢোল সমুদ্র দিঘি এবং শাহী মসজিদ। ঝিনাইদহের অপার সম্ভাবনা ও অর্থনীতি কিভাবে সমৃদ্ধ করা যায় তা নিয়ে বাংলাদেশ প্রতিদিনের সঙ্গে কথা বলেন সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান, সমাজসেবক কনককান্তি দাস। তিনি বলেন, শিক্ষা-দীক্ষা, জ্ঞান-বিজ্ঞান, ব্যবসা-বাণিজ্য, কল-কারখানা ও সুস্থ সংস্কৃতি চর্চার অপার সম্ভাবনাময় ঝিনাইদহ। এখানকার মানুষ সদালাপী, মিষ্টভাষী ও পরিশ্রমী। আর জমিতেও সহজেই ফলে সোনার ফসল। যদি বিশ্বকবির ভাষায় বলি ‘অবারিত মাঠ গগন ললাট চুমে তব পদধূলি ছায়া সুনিবিড় শান্তির নীড় ছোট ছোট গ্রামগুলি।’ রাজনৈতিক সদিচ্ছা, দীর্ঘ মেয়াদী সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা সর্বোপরি আমাদের সম্মানিত প্রয়াস ঝিনাইদকে সমৃদ্ধি ও সভ্যতার পথে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর