শুক্রবার, ১১ মার্চ, ২০১৬ ০০:০০ টা

প্রাকৃতিক সম্পদের লীলাভূমি হবিগঞ্জ

মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সমৃদ্ধ প্রাকৃতিক সম্পদের লীলাভূমি হবিগঞ্জ জেলা। পাশাপাশি রয়েছে পর্যটনের অপার সম্ভাবনা। গ্যাস-বিদ্যুতের উৎপাদন স্থল থাকায় নতুন নতুন শিল্পকারখানা গড়ে উঠেছে। রয়েছে হাওর-বাঁওড়, পাহাড়-টিলা। গহিন বন, চা-বাগানে রিসোর্ট তৈরি হওয়ায় পর্যটনের দুয়ার খুলে গেছে। হবিগঞ্জের বিভিন্ন দিক নিয়ে বিশিষ্টজনদের সঙ্গে কথা বলেছেন জেলা প্রতিনিধি চৌধুরী মোহাম্মদ ফরিয়াদ

 

যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত করতে হবে

—ত্রিলোক কান্তি চৌধুরী বিজন

হবিগঞ্জ পরিবেশ আন্দোলন (হপা) সভাপতি ত্রিলোক কান্তি চৌধুরী বিজন বলেন, হবিগঞ্জে একসময় যোগাযোগের বড় মাধ্যম ছিল নৌপথ।

বর্তমানে নৌ যোগাযোগ নেই বললেই চলে। অপরদিকে সড়কপথে ভাটি বাংলার রাজধানী বলে খ্যাত আজমিরীগঞ্জের সঙ্গে জেলা সদরের যোগাযোগ ব্যবস্থা এখনো গড়ে উঠেনি।

হবিগঞ্জ লাখাই হয়ে ঢাকার সঙ্গে যোগাযোগের ক্ষেত্রে বলভদ্র নদীর ব্রিজ হয়েছে, কিন্তু বাকি কাজ এখনো হয়নি। বানিয়াচং সড়কে যে কয়টি ব্রিজ রয়েছে, সেগুলোও হুমকির মুখে। অপরদিকে হবিগঞ্জের বাহুবল উপজেলার পুটিজুড়িতে গড়ে উঠেছে বিশ্ব মানের দি প্যালেস রিসোর্ট অ্যান্ড স্পা নামের একটি রিসোর্ট। এটি তৈরি হওয়ায় পর্যটনে আলোচিত হচ্ছে হবিগঞ্জের নাম। ভারতের সীমান্তবর্তী চুনারুঘাটের কেদারাকোট এলাকায় বাল্লা স্থলবন্দরটিতে আমদানি-রপ্তানির বিপুল সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন হচ্ছে না। স্থলবন্দরটি পাশাপাশি ২৪টি চা বাগান সমৃদ্ধ জেলা।

সবচেয়ে বেশি গ্যাস উৎপাদনকারীও। চুনারুঘাটে ইকোনমিক জোন স্থাপিত হলে অবকাঠামো উন্নয়নসহ মানুষের জীবনযাত্রার মান একদিকে যেমন বাড়বে, তেমনি ওই এলাকার স্থানীয় বাসিন্দারা অর্থাৎ চা-শ্রমিকদের স্বার্থের ব্যাপারটিও মাথায় রাখতে হবে। অপরিকল্পিতভাবে ফসলি জমিতে মাধবপুর ও শাহজীবাজার অঞ্চলে প্রতিনিয়ত যেসব শিল্প কারখানা গড়ে উঠছে তা পরিবেশকে ভয়াবহ হুমকির মুখে ঠেলে দিচ্ছে। এর ফলে একদিকে যেমন দেশের অর্থনৈতিক সচ্ছলতা আসছে অন্যদিকে জীববৈচিত্র্য ও পরিবেশের ওপর মারাত্মকভাবে প্রভাব পড়ছে। আমরা চাই সুষ্ঠু, পরিকল্পিত শিল্পায়ন ও অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে উঠুক।

 

মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি সংরক্ষণের দাবি জানাই

—মোহাম্মদ আলী পাঠান

জেলা মুক্তিযোদ্ধা ইউনিট কমান্ডার মোহাম্মদ আলী পাঠান বলেন, হাওর, পাহাড়, চা-বাগান অধ্যুষিত মুক্তিযুদ্ধের চারণভূমি

হবিগঞ্জ। ১৯৭১ সালে মুজিবনগর সরকার গঠনের পূর্বে মুক্তিযুদ্ধের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা করা হয়েছিল ৪ এপ্রিল হবিগঞ্জের মাধবপুর থানার  তেলিয়াপাড়া চাবাগানের বড় বাংলো থেকে। তৎকালীন এমএনএ কর্নেল (অব.) এম এ জি ওসমানীর সভাপতিত্বে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ও সামরিক অফিসারদের এক সভায় মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনায় মুক্তিবাহিনী ও মুক্তিযুদ্ধের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল। তেলিয়াপাড়ার ওই সভা থেকেই মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনায় ৪টি সেক্টরে ভাগ করা হয়। বৃহত্তর সিলেটের কৃতী সন্তান প্রধান সেনাপতি কর্নেল এম এ জি ওসমানী এবং হবিগঞ্জের বানিয়াচংয়ের কৃতী সন্তান উপপ্রধান সেনাপতি পদে লে. কর্নেল এম এ রবকে নিয়োগ দেওয়া হয়। কিন্তু পাঠ্যপুস্তকে এই ইতিহাস সঠিকভাবে লিপিবদ্ধ হয়নি। মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত হবিগঞ্জের চা-বাগান অধ্যুষিত ঐতিহাসিক  তেলিয়াপাড়াতে প্রতিদিন দেশি-বিদেশি পর্যটকের আগমন ঘটে। কিন্তু অনুন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা ও বিশ্রামাগার না থাকায় অনেক সমস্যা সৃষ্টি হয়। এই স্থানটিকে সংরক্ষণ করে সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি করলে পর্যটন এলাকা হিসেবে গড়ে উঠতে পারে। তিনি হবিগঞ্জের লাখাই উপজেলার কৃষ্ণপুরে বধ্যভূমি, বানিয়াচংয়ের মাকালকান্দি, বাহুবলের ফয়েজাবাদ, শায়েস্তাগঞ্জ, লস্করপুর রেলওয়ে ব্রিজ সংলগ্ন বধ্যভূমি সংরক্ষণের মাধ্যমে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণের দাবি জানান।

 

চাই দূষণহীন পরিবেশ

—তাহমিনা বেগম গিনি

পরিবেশ কর্মী কবি তাহমিনা বেগম গিনি বলেন, ৯৯৯৯ বর্গ কিলোমিটার এলাকার ২২ লক্ষাধিক অধিবাসীর  জেলা হবিগঞ্জ। অপার

সম্ভাবনাময় হবিগঞ্জ ধর্মীয় সম্প্রীতির বাঁধনে বাঁধা। হবিগঞ্জকে যদি বলি মিনি বাংলাদেশেরই একটি সংস্করণ, তাহলে একটুও ভুল বলা হবে না। গ্যাস, বিদ্যুৎ, খনিজ সম্পদ, তেল, চা শিল্প, সিলিকনবালি, আনারস, লেবু, পাথর, চুনাপাথর, পর্যটন শিল্প, তার ওপর আছে প্রবাসীদের পাঠানো প্রচুর বিদেশি অর্থ। এসব বাংলাদেশের অর্থনীতির চাকাকে সচল রেখেছে। সংস্কৃতি, শিক্ষা, আধ্যাত্মবাদ ও সুফিবাদে এক সময় হবিগঞ্জ ছিল সুপরিচিত। সঠিক নেতৃত্বের অভাবে বর্তমানে কিছুটা ঝিমিয়ে পড়েছে। অলিপুর এলাকায় বিশ্বরোডের দুই পাশে নিকট অতীতে যে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য বিরাজমান ছিল, তা এখন বিরাট বিরাট কোম্পানির দালানে আটকে আছে। প্রচুর অর্থের লোভে সহজ-সরল জমির মালিকরা এসব জমি বিক্রি করেছেন। একটি এলাকার অর্থনৈতিক উন্নতি হওয়া প্রয়োজন। সরকারের কথা পরিবেশ রক্ষা করে শিল্প-কারখানা গড়ে উঠতে হবে। বর্জ্য নিষ্কাশনের জন্য শিল্প-কারখানায় ইটিপির ব্যবহার অনিবার্য হলেও বর্তমানে আমাদের এলাকার পরিবেশ মারাত্মক দূষণে আক্রান্ত। খাল, বিল, বড় বড় নদীর পানি দূষণময় হয়ে উঠেছে। আমার কথা, ওই এলাকা একটি পর্যটন এলাকা। নিকট দূরেই রয়েছে সাতছড়ি, রেমা-কালেঙ্গা গভীর অভয়ারণ্য। যেগুলো দেখতে প্রতিদিন হাজার হাজার ভ্রমণপিপাসুরা আসেন। অন্য কোনো এলাকায় এই শিল্পাঞ্চল গড়ে তোলার ব্যাপারে সরকার একবার ভেবে দেখা উচিত। শান্তিপ্রিয় হবিগঞ্জবাসীর দাবি, প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর হবিগঞ্জ যেন অর্থনীতিতে সমৃদ্ধ, দূষণহীন পরিবেশে, বেকারত্বের সমাধানে একটি সুন্দর জেলা হিসেবে গড়ে ওঠে।

 

অর্থনৈতিক সম্ভাবনাময় হবিগঞ্জ

—উপাধ্যক্ষ মুহম্মদ আব্দুজ জাহের

হবিগঞ্জ সরকারি মহিলা কলেজের সাবেক উপাধ্যক্ষ মুহম্মদ আবদুজ জাহের বলেন, প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ এবং মহান

মুক্তিযুদ্ধের সূতিকাভূমি হবিগঞ্জ একটি অর্থনৈতিক সম্ভাবনাময় জেলা হিসেবে বিবেচিত। ইতিমধ্যে জেলার মাধবপুর, হবিগঞ্জ সদর ও নবীগঞ্জ উপজেলা শিল্পাঞ্চল সে সম্ভাবনার প্রমাণ বহন করছে। আর চুনারুঘাটের প্রস্তাবিত ইকোনমিক জোন সেই সম্ভাবনাকে আরও এক ধাপ এগিয়ে নিয়েছে। কিন্তু আর্থসামাজিক ও যোগাযোগ ব্যবস্থার দিক থেকে হবিগঞ্জ ব্রিটিশ আমল থেকেই অনেক পিছিয়ে রয়েছে। শিক্ষাক্ষেত্রে জেলার ৮টি উপজেলার মধ্যে নবীগঞ্জ, আজমিরীগঞ্জ, বানিয়াচং ও লাখাই রয়েছে অনেক পিছিয়ে। বর্তমান সরকারের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা সম্প্রতি হবিগঞ্জ সফরের সময়ে জেলায় একটি উন্নত মানের মেডিকেল কলেজ ও একটি কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের নির্দেশনা দিয়েছেন। কিন্তু তা বাস্তবায়নে মন্থর গতি বিরাজ করছে। অর্থনৈতিক উন্নয়নের পাশাপাশি মাধবপুর উপজেলার শাহজি বাজারে অবস্থিত হবিগঞ্জ গ্যাস ফিল্ডে নির্মিত ফ্রুটস ভ্যালি এবং ১৯৭১ সালের ৪ এপ্রিল পাক হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ যুদ্ধকে মুক্তিযুদ্ধ নামে ও যুদ্ধে অংশ গ্রহণকারী সশস্ত্র সদস্য ও ছাত্র-জনতাকে মুক্তি বাহিনী নামে অভিহিত করা এবং কর্নেল এম এ জি ওসমানীকে প্রধান সেনাপতি হিসেবে নিয়োগস্থল তেলিয়াপাড়া চাবাগানে অবস্থিত স্বাধীনতা স্তম্ভকে আধুনিক পর্যটন কেন্দ্র করা প্রয়োজন।

সর্বশেষ খবর