সোমবার, ১১ এপ্রিল, ২০১৬ ০০:০০ টা

আম কাঁসা রেশম শিল্পে সমৃদ্ধ চাঁপাইনবাবগঞ্জ

চাঁপাইনবাবগঞ্জে রয়েছে ইতিহাস— ঐতিহ্যের অনেক নিদর্শন। বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদেদৗলার নর্তকি চম্পা বাই বাস করতেন এ জেলার চাঁপাই গ্রামে। সেই গ্রামের ডাকঘরটি স্থানান্তরিত হয় নবাবগঞ্জে। জনশ্রুতি আছে এই ডাকঘরকে কেন্দ্র করেই চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার নামকরণ হয়েছে। শাহ নেয়ামতুল্লাহর পুণ্যভূমি, আম কাঁসা রেশম শিল্পে সমৃদ্ধ চাঁপাইনবাবগঞ্জের নানা দিক নিয়ে বিশিষ্টজনদের সঙ্গে কথা বলেছেন জেলা প্রতিনিধি মো. রফিকুল আলম—

 

আমনির্ভর শিল্প কারখানা চাই

—আবদুল ওয়াহেদ

দেশের সিংহভাগ আম চাঁপাই নবাবগঞ্জে উৎপাদিত হলেও এখানে গড়ে উঠেনি আমনির্ভর কোনো শিল্প-কারখানা। এ জন্য উদ্যোক্তাদের ব্যাংকগুলো সঠিক অর্থ সহায়তা না করাকেই দায়ী করলেন জেলা চেম্বার অব কমার্সের সভাপতি মো. আবদুল ওয়াহেদ।

তিনি বলেন, ব্যাংকগুলো জেলার উদ্যোক্তা-ব্যবসায়ীদের প্রয়োজনীয় অর্থ সহায়তা দিলে নতুন নতুন কল-কারখানা গড়ে উঠবে এখানে। এতে সৃষ্টি হবে কর্মসংস্থানের। এ ব্যবসায়ী নেতার অভিযোগ, জেলার একমাত্র অর্থকরী ফসল আম হলেও, প্রশাসন রাসায়নিক ব্যবহারের দোহাই দিয়ে আম বাজারে সরবরাহ করার সময় বেঁধে দিচ্ছে। ফলে মারাত্মক ক্ষতির শিকার হচ্ছেন আম চাষি ও ব্যবসায়ীরা। কারণ আম প্রকৃতির খেয়ালেই পেকে থাকে। যদি কেউ এতে রাসায়নিক দ্রব্য মেশায় তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে। জেলার সোনামসজিদ স্থলবন্দর পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠান পানামা পোর্ট লিংক লিমিটেডের বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতা দূর করতে হবে। বন্দরের ব্যবসায়ীদের মালামাল রাখার জন্য প্রয়োজনীয় ওয়ারহাউস নির্মাণের দাবি জানিয়ে আবদুল ওয়াদেহ বলেন, মালামালের নিরাপত্তা না পাওয়া এবং কাস্টমস কর্তৃপক্ষের ট্যারিফ তিন গুণ আদায়সহ অহেতুক হয়রানির কারণে অনেকে এই বন্দর ছেড়ে অন্যত্র চলে যাচ্ছেন। রহনপুর রেলবন্দরকে পূর্ণাঙ্গ বন্দর ঘোষণারও দাবি জানান তিনি।

 

হারিয়ে যাচ্ছে রেশম কাঁসার ঐতিহ্য

—গোলাম মোস্তফা মন্টু

সঠিক উদ্যোগ গ্রহণ ও পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে হারিয়ে যাচ্ছে রেশম, লাক্ষ্মা ও কাঁসা শিল্পের ঐতিহ্য।

সমন্বিত উদ্যোগ বিলুপ্তপ্রায় এই শিল্পের ঐতিহ্য আবার ফিরিয়ে আনতে পারে বলে মনে করেন, জেলা প্রেসক্লাবের সভাপতি ও অবসরপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক মো. গোলাম মোস্তফা মন্টু।

তিনি বলেন, এক সময় চাঁপাইনবাবগঞ্জের কাঁসা, রেশম ও লাক্ষ্মা শিল্পের সুনাম ছিল বিশ্বব্যাপী। কালের আবর্তে তা আজ হারিয়ে যেতে বসছে। এই শিল্পের ধ্বংসের          জন্য কতিপয় মুনাফাখোর ও কালোবাজারী দায়ী।

তিনি জানান, কাঁসার কারিগররা পেশা পরিবর্তন করে অন্য কাজ করতে বাধ্য হচ্ছেন। সঠিক উদ্যোগের অভাবে রেশম শিল্পও বিলুপ্তির পথে। অতীতে রেশম সুতার তৈরি মসলিন শাড়ি ছিল জগৎ বিখ্যাত। এই শিল্পকে ঘিরে ভোলাহাট ও শিবগঞ্জে গড়ে উঠেছিল তাঁতপল্লী। কিন্তু যথাযথ পদক্ষেপের অভাবে এই শিল্পও আজ তার ঐতিহ্য হারিয়েছে। যে কয়েকটি তাঁতে রেশমের কাপড় তৈরি হয় তাও নানা কারণে আজ খুরিয়ে চলছে। স্বর্ণ শিল্পসহ বিভিন্ন কাজে ব্যবহৃত লাক্ষ্মা এক সময় চাঁপাইনবাবগঞ্জের বিভিন্ন এলাকায় তৈরি হত। তিন্তু অবৈধ পথে তা ভারত থেকে আসা লাক্ষ্মা দেশের বিভিন্ন স্থানে সরবরাহ করায় প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে পারেনি এ শিল্পটিও।

 

দরকার মানসম্মত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান

—এনামুল হক

বীরশ্রেষ্ঠ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা এনামুল হক ফিটু মনে করেন, চাঁপাইনবাবগঞ্জে শিক্ষার হার ভালো হলেও জেলায় মানসম্মত তেমন কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নেই। এ জন্য তিনি রাজনৈতিক তদবির বা ডোনেশন পদ্ধতিতে শিক্ষক নিয়োগ করাকে দায়ী করেছেন। তার মতে, রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত হয়ে মানসম্মত শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া গেলেই কেবল প্রতিষ্ঠানগুলো শিক্ষার মান উন্নয়ন করতে পারবে। প্রায় প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষকরা প্রাইভেট বা কোচিং ব্যবসায় জড়িত। তারা ক্লাসে সঠিক পাঠদান না দিয়ে শিক্ষার্থীদের তাদের কাছে পড়তে বাধ্য করেন। এতে ভালো লেখাপড়া থেকে বঞ্চিত হয় দরিদ্র ছাত্র-ছাত্রীরা। এই শিক্ষাবিদের মতে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মাঠ ও খেলার ব্যবস্থা করতে পারলে শিক্ষার্থীরা খেলাধুলার পাশাপাশি লেখাপড়ায় অধিক মনোযোগী হবে। এজন্য শিক্ষকদের পাশাপাশি এগিয়ে আসতে হবে অভিভাবকদেরও। জেলার বিভিন্ন স্কুল-কলেজে ভর্তি বাণিজ্যের অসুস্থ প্রতিযোগিতা শুরু হওয়ায় সেখানে মেধাহীন ছাত্র-ছাত্রী ভর্তি হচ্ছে। এতে একদিকে যেমন প্রতিষ্ঠানগুলো ধরে রাখতে পারছে না শিক্ষার মান, অন্যদিকে বঞ্চিত হচ্ছে প্রকৃত মেধাবীরা। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের অধীন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো মনিটরিং করা হলে শিক্ষার মান বাড়তে পারে বলে মনে করেন এনামুল হক।

 

সাংস্কৃতিক চর্চা থমকে গেছে

—শাহ্জাহান প্রামাণিক

সবক্ষেত্রে স্বজনপ্রীতি আর অযোগ্য ব্যক্তিদের মূল্যায়ন করায় চাঁপাই নবাবগঞ্জে সাংস্কৃতিক চর্চা থমকে গেছে বলে জানান,নাট্য ব্যক্তিত্ব ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ থিয়েটারের সভাপতি শাহ্জাহান প্রামাণিক। তিনি বলেন, আগে এই জেলা সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে মুখরিত হয়ে থাকত। গ্রামে পাঠাগার ছিল, ছিল সংগীত গোষ্ঠীও। স্থানীয় ক্লাবগুলো জাতীয় দিবস, ঈদ-পূজা, গরিবদের সেবা, বিচার-আচার, বিয়ে, উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডসহ নানা অনুষ্ঠানের আয়োজন করত। সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতায় বিজয়ীদের প্রদান করা হতো পুরস্কার। কিন্তু একটা পর্যায়ে মৌলবাদ মাথাচাড়া দেওয়ায় প্রায় বন্ধ হয়ে যায় জেলায় এসব কর্মকাণ্ড। নষ্ট রাজনীতি গ্রামপর্যায়ে ঢুকে পড়ায় স্থানীয় ক্লাবগুলো পরিণত হয় রাজনৈতিক নেতাদের পকেটক্লাবে। এখন জাতীয় দিবসে নাটক-যাত্রা হয় না। শহর থেকে হট বাদ্যযন্ত্র ও শিল্পীদের নিয়ে এসে হয় অশ্লীল অনুষ্ঠান। শহর পর্যায়ে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড নিয়ন্ত্রণ করেন প্রশাসন ও জনপ্রতিনিধিদের আজ্ঞাবহ কিছু লোক। তারা আবার নিজেদের লোক দিয়ে দায়সারা গোছের অনুষ্ঠান, ভুয়া ব্যক্তিদের সম্মাননা, অসচ্ছল শিল্পীদের পরিবর্তে সচ্ছলদের আর্থিক অনুদানসহ নানা অপকাণ্ড করে থাকেন। প্রকৃত গুণীরা সম্মান পান না। সব সাংস্কৃতিক দলের সমন্বয় ঘটিয়ে অনুষ্ঠানও হয় না। মৌলবাদ-জঙ্গিবাদ নির্মূলের লক্ষ্যে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড ফিরিয়ে আনার প্রতি গুরুত্বারোপ করেন তিনি।

সর্বশেষ খবর