শনিবার, ৭ মে, ২০১৬ ০০:০০ টা

কৃষিভিত্তিক শিল্প প্রতিষ্ঠার সম্ভাবনা নাটোরে

‘বিলচলন গ্রাম কলম, কাঁচাগোল্লার খ্যাতি/অর্ধবঙ্গেশ্বরী রানীভবানীর ধাম/কাব্য ইতিহাসে নাটোরের নাম।’ উত্তরের রাজধানী-খ্যাত নাটোর শিল্প প্রতিষ্ঠার সম্ভাবনাময় এক জেলার নাম। উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা, জমি ও শ্রমের মূল্য কম এবং কাঁচামালের সহজপ্রাপ্যতাকে কেন্দ্র করে এখানে গড়ে উঠতে পারে কৃষিভিত্তিক শিল্পপ্রতিষ্ঠান। বিশিষ্টজনদের সঙ্গে কথা বলে এ নিয়ে প্রতিবেদন তৈরি করেছেন জেলা প্রতিনিধি নাসিম উদ্দীন নাসিম

 

শিল্প প্রতিষ্ঠার প্রধান অন্তরায়  বিদ্যুৎ-গ্যাসের দুষ্প্রাপ্যতা

—রুহুল কুদ্দুস দুলু

বিএনপি কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক ও জেলা বিএনপির সভাপতি সাবেক মন্ত্রী অ্যাড. রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলু জানান, নাটোরে

শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠার যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে। এখানে আম, আলু, ডাল, রসুন, মরিচ, হলুদসহ নানা মসলা, সবজি, গম উৎপাদন হয়ে থাকে। কিন্তু এসব শস্য সংরক্ষণের ব্যবস্থা নেই। প্রক্রিয়াজাতকরণ ও সংরক্ষণের জন্য গড়ে উঠতে পারে শিল্পপ্রতিষ্ঠান ও কোল্ড স্টোরেজ। তিনি বলেন— এ জেলায় আছে প্রচুর পুকুর। বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে রয়েছে চলনবিল ও হালতিবিল। এখানে সনাতন পদ্ধতিতে মাছ শুঁটকি করা হয়। আধুনিক পদ্ধতিতে শুঁটকি ও সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা হলে বিদেশে রপ্তানি করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন সম্ভব। উৎপাদিত গম থেকে আটা, বিস্কুট, পাউরুটি তৈরির জন্য গড়ে উঠতে পারে কল-কারখানা। এখানকার ধান স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে চলে যায় জেলার বাইরে। চাল উৎপাদনের জন্য নেই পর্যাপ্ত অটোরাইস মিল। বন বেলঘড়িয়াতে রয়েছে বৃহত্তম চামড়া বাজার। প্রক্রিয়াজাত বা পাকা করার জন্য গড়ে তোলা যায় ট্যানারিশিল্প। জেলায় শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠার পেছনে বড় অন্তরায় গ্যাস সমস্যা। নাটোরের ওপর দিয়ে গ্যাস লাইন রাজশাহীতে গেলেও সরবরাহ নেই নাটোরে।

 

পদ্মার  চরে গড়ে উঠবে অর্থনৈতিক অঞ্চল

—আবুল কালাম আজাদ

নাটোরের বাগাতিপাড়া-লালপুরের সংসদ সদস্য ও জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি অ্যাড. আবুল কালাম আজাদ জানান, প্রস্তাবিত নাটোর

অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার সম্ভাবনাময় এলাকা লালপুরের পদ্মার চরাঞ্চল। যোগাযোগ ব্যবস্থা, বিপুল খাস জমি, বিদ্যুতের সহজলভ্যতা, গ্যাস-পানি সরবরাহ ও বণ্টন, বর্জ্য সংগ্রহ, শোধন ও অপসারণ, বাসস্থান, চিকিৎসাসেবা, সহজে কাঁচামাল প্রাপ্তিসহ অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার সব রকম সুবিধাই রয়েছে এখানে। এমপি জানান, এই অর্থনৈতিক অঞ্চলে গড়ে তোলা হবে কৃষিভিত্তিক শিল্পপ্রতিষ্ঠান। ইলেকট্রনিক্স কারাখানাসহ অন্য প্রতিষ্ঠানও গড়ে তোলা যাবে। দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ-কারীদের কল-কারখানা স্থাপনের আহ্বান জানানো হবে। জিটুজি (গভর্নর টু গভর্নর) পদ্ধতিতে অর্থনৈতিক অঞ্চলে বিনিয়োগ হবে। প্রাথমিক পর্যায়ে শতাধিক শিল্পপ্রতিষ্ঠান হবে এখানে। কর্মসংস্থান হবে তিন লক্ষাধিক মানুষের। আবুল কালাম আজাদ বলেন, ইপিজেড ও অর্থনৈতিক অঞ্চলের মধ্যে পার্থক্য হলো ইপিজেডে উৎপাদিত পণ্যের ৮০ ভাগ দেশের বাইরে রপ্তানি হয়। আর অর্থনৈতিক অঞ্চলে উৎপাদিত পণ্যের সিংহ ভাগ সরবরাহ করা হবে দেশের অভ্যন্তরীণ বাজারে। ভূমি জরিপ কার্যক্রম শেষেই এ অঞ্চলে বিদ্যুৎ সংযোগ প্রদানের কাজ শুরু হবে।

 

 

সিংড়া গ্যাসকূপ পুনঃখননই পাল্টে দিতে পারে দৃশ্যপট

—মো. মাহফুজ আলম মুনী

নাটোর প্রেসক্লাবের সভাপতি মাহফুজ আলম মুনী জানান, প্রায় তিন যুগ ধরে পরিত্যক্ত পড়ে থাকা সিংড়া গ্যাস কূপটির পুনঃখনন পাল্টে

দিতে পারে উত্তরাঞ্চলসহ সারা দেশের দৃশ্যপট। পেট্রোবাংলা ১৯৭৯ সালে সিংড়ায় গ্যাসের সন্ধান চালায়। জার্মানির একটি বিশেষজ্ঞ দল সিংড়া শহর থেকে প্রায় চার কিলোমিটার দূরে বিলে কয়রাবাড়ী-কান্তনগর এলাকায় সিসমিক সার্ভে করে সন্ধান পায় তেল-গ্যাসের। কূপ খননের জন্য পোল্যান্ডের আর উত্তোলনের জন্য রোমানিয়ার কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি করে সরকার। মাহফুজ আলম বলেন, তখন পেট্রোবাংলা জেলা পরিষদ ডাকবাংলা চত্বরে একটি ক্যাম্প অফিস বসায়। সিংড়া বাজারের দক্ষিণে প্রায় ৩০ বিঘা জমির ওপর তৈরি করে পেট্রোবাংলার সাইট অফিস। খনন কাজের জন্য বালুয়াবাসুয়া এলাকা হয়ে নাটোর-বগুড়া মহাসড়ক থেকে বিলের মধ্যে মাটি ফেলে কয়রাবাড়ী-কান্তনগর পর্যন্ত তৈরি করা হয় তিন কিলোমিটার নতুন রাস্তা। প্রায় একশ’ বিঘা জমি হুকুম দখল করা হয়। ড্রিলিংয়ের জন্য বিদেশ থেকে রিগসহ ভারী মেশিনপত্র আনা হয়। সময়মতো কূপ খননের কাজও শুরু হয় পুরোদমে। ১৯৮১ সালে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান নিহত হলে সিংড়া গ্যাস ফিল্ডটি পরিত্যক্ত ঘোষণা করা হয়।

 

নাটোর বিসিকের জায়গার  অভাব দূর করতে হবে

—শরিফুল ইসলাম রমজান

সদর উপজেলা চেয়ারম্যান শিল্পপতি শরিফুল ইসলাম রমজান জানান, এখানে কৃষিভিত্তিক শিল্প প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ব্যাপক

কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা যেতে পারে। জমি ও শ্রমের কম মূল্য, উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা, কাঁচামালে সহজপ্রাপ্যতাসহ শিল্প প্রতিষ্ঠার গুরুত্বপূর্ণ সব উপাদানই এখানে রয়েছে। ইতিমধ্যে নাটোর বিসিক এলাকায় প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে বহু কল-কারখানা। কিন্তু শিল্পউদ্যোক্তা থাকা সত্ত্বেও স্থান সঙ্কুলান না হওয়ায় গড়ে উঠছে না নতুন শিল্পপ্রতিষ্ঠান। বিসিকে কারখানা স্থাপনে আগ্রহ বাড়ছে। জায়গার অভাবে পুরাতন কারখানার কলেবর বাড়ছে না। প্রধানমন্ত্রী ২০১১ সালের ১১ ডিসেম্বর নাটোরে এক জনসভায় ঘোষণা দিয়েছিলেন এখানে একটি বিদ্যুকেন্দ্র স্থাপন ও দ্রুত গ্যাস সরবরাহ করা হবে। ঘোষণা মতে ৫০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন রাজলংকা বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি নির্মাণ শেষে উৎপাদন শুরু করেছে। কিন্তু নাটোরে আজও দেওয়া হয়নি গ্যাস সংযোগ। ১৯৮৭ সালে ১৫ একর জমি নিয়ে বড়হরিশপুর ইউনিয়নের দত্তপাড়ায় স্থাপন করা হয় বিসিক শিল্পনগরী। ২০০০ সালের মধ্যেই গড়ে ওঠে ৪৭টি কারখানা। উল্লেখযোগ্য হারে উৎপাদনে থাকা পাটকল, প্লাস্টিক ও এ্যালুমিনিয়াম কারখানার মালিকরাও কারখানার উৎপাদন বাড়াতে পারছেন না জায়গার অভাবে।

সর্বশেষ খবর