শিরোনাম
শনিবার, ৮ জানুয়ারি, ২০২২ ০০:০০ টা

ধ্বংসের পথে কুমারখালীর তাঁত

কুষ্টিয়া প্রতিনিধি

ধ্বংসের পথে কুমারখালীর তাঁত

কুমারখালীর তাঁত শিল্প এখন ধ্বংসের পথে। একদিকে করোনা মহামারির প্রাদুর্ভাব, অন্যদিকে তাঁত মালিকদের চরম অর্থনৈতিক সংকট, দফায় দফায় সুতার দাম বৃদ্ধি, কাঁচামালের অভাবসহ নানা প্রতিকূলতার কারণে এক সময়ের প্রসিদ্ধ এ তাঁতশিল্প এখন অস্তিত্ব সংকটে ভুগছে। ফলে এ শিল্পের সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত প্রায় লক্ষাধিক শ্রমিক এখন বেকার হয়ে পড়েছেন। সুতা, রংসহ প্রয়োজনীয় কাঁচামালের দাম বাড়ার কারণে এমনিতেই ধুঁকে ধুঁকে চলছিল কুমারখালীর তাঁতশিল্প। তার ওপর মহামারি করোনার প্রভাবে এককালের কুমারখালীর ঐতিহ্যবাহী তাঁতশিল্প এখন ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মহামারীর প্রভাবে বেচা-বিক্রি না থাকায় গত বছর এ খাতে বার্ষিক লোকসানের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ১৪০ কোটি টাকা। একের পর এক বন্ধ হচ্ছে কারখানা। আর এ শিল্পের সঙ্গে জড়িত প্রায় ৫০ ভাগ লোক কাজ হারিয়ে বেকার হয়ে পড়েছেন। কুষ্টিয়া তাঁত বোর্ডের তথ্য মতে, জেলায় এক সময় ৮০ হাজারেরও বেশি তাঁতি পরিবার ছিল। এর মধ্যে খটখটি তাঁত ১৫ হাজার, হস্তচালিত প্যাডেলিং তাঁত ৪৫ হাজার ও বিদ্যুৎচালিত ২০ হাজার। জানা যায়, ৯০ দশক পর্যন্ত এ কুমারখালী উপজেলা থেকেই দেশের মোটা কাপড়ের চাহিদার ৬৩ ভাগ পূরণ হতো। ২০২০ সালে করোনা মহামারি শুরু হওয়ার আগ পর্যন্ত চাহিদার ৩৫ ভাগ পর্যন্ত পূরণ হতো এ উপজেলা থেকে। বর্তমানে তা প্রায় ২০ ভাগে নেমে এসেছে। কুমারখালী ফ্যাক্টারি সমিতির তথ্য মতে, বর্তমানে প্রায় ১ হাজার তাঁত কারখানার মধ্যে প্রায় অর্ধেক কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে এ খাতের সঙ্গে জড়িত প্রায় দেড় লাখ শ্রমিকের মধ্যে প্রায় ৭০-৮০ হাজার শ্রমিক করোনা মহামারীর সময় থেকে বেকার হয়ে পড়েছেন। স্বাভাবিক সময়ে এ উপজেলা থেকে প্রতি বছর ২ কোটি ৯০ লাখ পিস লুঙ্গি, ১৫ লাখ পিস বেড কভার, ৭০ লাখ পিস গামছা-তোয়ালে উৎপাদন হতো। কিন্তু করোনা মহামারির প্রভাব, অন্যদিকে তাঁত মালিকদের অর্থনৈতিক সংকট, দফায় দফায় সুতার দাম বৃদ্ধি, কাঁচামালের অভাবসহ নানা প্রতিকূলতার কারণে বর্তমানে প্রায় ৫০ শতাংশ উৎপাদন কমে গেছে।

বার্ষিক আয় ৩০০ কোটি টাকার জায়গায় গত বছরে হয়েছে মাত্র ১৬০ কোটি টাকা। কুমারখালীর পুরাতন সুতা ব্যবসায়ী আকমল হোসেন জানান, করোনা মহামারির পর থেকে বস্ত্র খাতের প্রধান উপকরণ সুতার দাম দফায় দফায় বাড়ছে। করোনা শুরু হওয়ার আগে যে সুতা প্রতি পাউন্ড ছিল ১৫০ টাকা এখন তা পাউন্ডে ৭০ টাকা বেড়ে ২২০ টাকায় গিয়ে ঠেকেছে। অনুরূপভাবে রঙের দামও বেড়ে গেছে। প্রান্তিক তাঁতিদের নিয়ে কাজ করা কুমারখালী তাঁত বোর্ডের ব্যবস্থাপক মেহেদী হাসান জানান, করোনা মহামারির আগে তাঁত বোর্ডের আওতায় এ উপজেলায় প্রান্তিক তাঁতির সংখ্যা ছিল প্রায় ৮ হাজার। বর্তমানে তাঁতির সংখ্যা কমে প্রায় ৫০ ভাগে এসে দাঁড়িয়েছে। তাঁর মতে, সুতা, রংসহ প্রয়োজনীয় কাঁচামালের দাম দফায় দফায় বৃদ্ধির কারণে কুমারখালী উপজেলার তাঁতিদের এখন চরম দুর্দিন চলছে। উপায়ান্তর না পেয়ে জীবন এবং জীবিকার তাগিদে বাপ-দাদার বহুদিনের এ পুরনো পেশা ছেড়ে হাজার হাজার তাঁতি এখন পেশা বদল করতে বাধ্য হচ্ছেন।  কুমারখালী টেক্সটাইল অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মাসুদ রানা জানান, প্রায় ২০০ বছরের পুরনো কুমারখালীর এ তাঁত শিল্পের সঙ্গে প্রায় লক্ষাধিক মানুষ জড়িত। দফায় দফায় সুতা, রংসহ এ খাতের প্রয়োজনীয় কাঁচামালের দাম বৃদ্ধির কারণে ঐতিহ্যবাহী এ তাঁতশিল্প আজ চরম অস্তিত্ব সংকটে ভুগছে। তিনি ঐতিহ্যবাহী এ শিল্পকে টিকিয়ে রাখার জন্য আর্থিক প্রণোদনার পাশাপাশি সরকারি সব রকমের পৃষ্টপোষকতাসহ সুতা, রংসহ প্রয়োজনীয় কাঁচামালের দাম সহনীয় রাখার তাগিদ দেন।   বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশনের (বিসিক) সূত্রে জানা যায়, সম্প্রতি কুমারখালীতে বিসিকের উদ্যোগে ৫০০ একর জায়গা নিয়ে নতুন এক শিল্পনগরী গড়ে তোলার পরিকল্পনা হাতে নেওয়া হয়েছে। নতুন এই শিল্পনগরীতে তাঁতশিল্পের জন্য প্রায় ১০০ একর জমি বরাদ্দ রাখা হবে বলে জানা গেছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এ শিল্পকে রক্ষার জন্য এখনই প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা না হলে কুমারখালীর ঐতিহ্যবাহী এ খাতটি যে কোনো সময় ধ্বংস হয়ে যেতে পারে।

 

সর্বশেষ খবর