বুধবার, ২৪ জুলাই, ২০২৪ ০০:০০ টা

সেচে সেঁউতি-দোন এখনো প্রত্যন্ত অঞ্চলে

দিনাজপুর প্রতিনিধি

সেচে সেঁউতি-দোন এখনো প্রত্যন্ত অঞ্চলে

পরিবেশবান্ধব ও জ্বালানি সাশ্রয়ী এক সময়ের জনপ্রিয় কৃষিযন্ত্র দোন ও সেঁউতি বা জাত এখনো দেখা মিলছে প্রত্যন্ত গ্রামের খেতে।

প্রান্তিক কৃষকরাই শুধু নয়- পানি সংকট মোকাবিলায় বিত্তবান কৃষকরাও দোন, সেঁউতি বা জাত দিয়ে খেতে সেচ দিতেন। সেঁউতি দিয়ে জমিতে পানি সেচ দিতে খরচও কম। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উৎকর্ষতায় আধুনিকায়নে হারিয়ে যাচ্ছে প্রাচীন কৃষিযন্ত্র সেঁউতি, দোন, জাত ও ডোঙা। একসময় গ্রামবাংলার কৃষিক্ষেত্রে সেচযন্ত্র হিসেবে টিন বা বাঁশের তৈরি এই দোন ও সেঁউতি বা জাতের ব্যাপক চাহিদা এবং জনপ্রিয় ছিল। গ্রামবাংলার কৃষকের আদিকাল থেকেই চিন্তা-ভাবনার ফসল হিসেবে সেঁউতি, দোন, জাত ও ডোঙা আবিষ্কার হয়েছিল। মূলত কাঠ দিয়ে দোন তৈরি করা হয়। এর এক মুখ খোলা ও অন্য মুখটি বন্ধ থাকে। একটি লম্বা কাঠের মাঝখানে গর্ত করে একপাশে বাঁশের খুঁটির সঙ্গে বেঁধে নিতে হয়। শরীরের ওজন দিয়ে দোনের একপাশ পানিতে ডুবিয়ে পানি ভরে উঁচু করলেই পাথর দিয়ে বেঁধে রাখা অপরপাশ দিয়ে জমিতে পানি পড়ে। খানসামা ও চিরিরবন্দরের ওপর দিয়ে প্রবাহিত একসময়ের খরস্রোতা ইছামতি নদী। এখন নদীর বুকে কৃষক সমতল জমি তৈরি করে চাষ করছেন ইরি-বোরো ধান। খামার সাতনালা গ্রামে এখনো দেখা যায় দোন, সেঁউতি বা জাত দিয়ে ইছামতি নদী থেকে জমিতে পানি সেচ দিচ্ছেন কৃষক। কয়েকজন কৃষক জানায়, এর সুবিধা হলো-নদীর তীরে বা জমির ধারে খুব সহজেই পানি উত্তোলন করা যায়। শক্তি কম লাগে, খরচও কম এবং বেশি পরিমাণে পানি উত্তোলন করা সম্ভব। স্বল্প সময়ে জমিতে সেচ দেওয়া যায়। শ্যালো মেশিনের সাহায্যে পানি সেচ দিতে তেলসহ খরচও বেশি পড়ে। এ ছাড়া অল্প জমিতে পানি সেচ দিতে সময়মতো শ্যালোমেশিন ভাড়া পাওয়া যায় না। আমরা গরিব কৃষক শ্যালোমেশিন কেনা সম্ভব নয়। এ জাতের সাহায্যে সহজেই ঢ্যাক বাঁশ দিয়ে খুঁটিতে পানির ওপরে দাঁড়িয়ে জমিতে সেচ দেওয়া যায়। এটি সহজেই পরিবহন করা যায় এবং খরচ হয় না। খেতে সপ্তাহে একবার সেচ দিয়ে আবার কয়েক দিন পর সেচ দিতে হয়। খামার সাতনালা গ্রামের হেদলপাড়ার কৃষক মো. লুৎফর রহমান বলেন, তিনি ২০ বছর পূর্বে দিনাজপুরের দক্ষিণ কোতোয়ালির কমলপুর থেকে এ জাত সংগ্রহ করেন। তিনি প্রতি বছর এ মৌসুমে জাতের সাহায্যে ইছামতি নদী থেকে জমিতে সেচ দিয়ে চাষ করেন। সেঁউতি বা টিন দিয়ে জমিতে সেচ দিতে দুজন লোকের প্রয়োজন হয়। আর এই জাত দিয়ে জমিতে পানি সেচ দিতে একজন দিয়েই সম্ভব।

ওই গ্রামের হেদলাপাড়ার কৃষক মোবারক আলী বলেন, হামরা গরিব মানুষ। এখন পানি সেচের জন্য কত আধুনিক যন্ত্রপাতি বেরাইছে (বের হয়েছে)। শ্যালোমেশিন, ডিপমর্টার আরও কত কী। হামার অ্যাতো টাকা নাই, যা দিয়া হামরা ওইলা যন্ত্র কিনিবার পারি। এমনিতেই পানির দাম দিবার পারি না। মোর (আমার) কপাল ভালো যে, মোর ভুইর (জমি) পাশোত (পাশে) তাও (তারপর) পানি আছে। না হইলে যে মোর কী হইল হয়?

কৃষক আলতাব হোসেন ও মো. হবিবর রহমান বলেন, হামরা (আমরা) বাপ-দাদার ঘরক দোন ও সেঁউতি দিয়া জমি বাড়িত পানি দিবার দ্যাখিচি (দেখছি)। হামরা (আমরা) গরিব মানুষ। অত টাকা-পাইসাও নাই। ম্যাশিন কিনিমো (ক্রয় করা) কী দিয়া। তাই জাত দিয়া নদী থাকি পানি তুলি জমিত দিয়া ফসল ফলাই। এখন আধুনিক মেল্লা (অনেক) যন্ত্রপাতি বাজারত পাওয়া যাওয়ার কারণে অ্যাইলার (এগুলো) ব্যবহার তেমন হয় না। রানীরবন্দরের ইছামতি ডিগ্রি কলেজের জীববিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মো. আতাউর রহমান জানান, ছোটবেলায় দেখতাম কৃষকেরা সেঁউতি, দোন বা ডোঙা দিয়ে খাল হতে পানি উত্তোলন করে জমিতে দিত। এখন আর আগের মতো এসব চোখে পড়ে না।

রানীরবন্দর সচেতন নাগরিক কমিটির আহ্বায়ক মো. সফিকুল আলম (সফি) বলেন, যেসব জায়গায় সেচ পাম্প অপ্রতুল সেসব জায়গায় এখনো সেঁউতি, দোন, জাত ও ডোঙার ব্যবহার দেখা যায়। রবি মৌসুমে কৃষকেরা নদী-নালা, খাল-বিল ও পুকুর থেকে সেঁউতি, দোন, জাত ও ডোঙা দিয়ে জমিতে সেচ দিয়ে থাকে। পানির উৎসের নিকটবর্তী জমিতে দোন বা সেঁউতি দিয়ে সেচ দেওয়া অনেক সাশ্রয়ী।

 

সর্বশেষ খবর