শুক্রবার, ৪ মার্চ, ২০১৬ ০০:০০ টা

কাগজের পতাকা

মোজাম্মেল হক নিয়োগী

কাগজের পতাকা

১৯৭১ সাল। নভেম্বর মাসের পঁচিশ তারিখের রাত। গভীর রাত। রাতের অন্ধকারে শাহিনদের বাড়ি উঠোনে তিনজন মানুষ এসে দাঁড়ায়। তারা আর হাঁটতে পারছে না। শরীর নেতিয়ে পড়ছে। শক্তি বলতে আর কিছু নেই। একজন ডাক দিল, বাড়িতে কে আছেন?

শাহিনের বাবা ঘুম থেকে লাফিয়ে ওঠে। হতচকিত হয়ে বলল, কে? কে?

আমরা মুক্তিফৌজের লোক। একটা বাতি নিয়ে আসেন ভাই। আমাদের বড় বিপদ।

শাহিনের বাবা হ্যারিকেনের আলোটা বাড়িয়ে দিয়ে দরজা খুলে বাইরে এসে দাঁড়ায়। শাহিনের মা দরজা থেকে দেখছে তারা কে? এই সময় মানুষকে বিশ্বাস করা খুব কঠিন। কে রাজাকার আর কে মুক্তিযোদ্ধা বোঝা সহজ নয়। রাজাকাররাও অনেক বাড়িতে মুক্তিযোদ্ধার কথা বলে পরে ডাকাতি করে চলে যায়। কাউকে কাউকে ধরে নিয়ে মেরেও ফেলে।

শাহিনের ঘুমও ভেঙে যায়। সে ঘর থেকে বের হয়ে আসে। এতদিন মুক্তিবাহিনীর নাম শুনেছে। মুক্তিবাহিনীর কাউকে দেখতে পারেনি এখনো। আজকে সে সুযোগটা হাত ছাড়া করতে পারে না।

উঠোনে দৌড়ে এসেই তার চোখ বন্ধ হয়ে আসে। বুকের ভেতরটায় ধক করে ওঠে। একি! তিনজন মুক্তিযোদ্ধার শরীর কাদামাটিতে মাখামাখি। একজন মাটিতে পড়ে আছে। তার চোখ বন্ধ। পা থেকে রক্ত ঝরছে। অন্য দুজন মুক্তিযোদ্ধাও মাটিতে বসা। 

হ্যারিকেনটি মাটিতে রেখে শাহিনের বাবা বলল, আপনাদের এই অবস্থা!

একজন মুক্তিযোদ্ধা কাঁধ থেকে এলএমজিটা নামাতে নামাতে বলল, একটু পানি খাওয়াতে পারবেন? তারপর ঘরে যদি খাবার থাকে তাহলে খেতে দিন। আমরা সারা দিন কিছু খাইনি। শরীর আর চলছে না।

মুক্তিযোদ্ধার কথা শুনে শাহিনের কান্না পায়। এত কষ্ট করে তারা দেশের জন্য যুদ্ধ করছে! আহা রে।

শাহিনের মা দরজা থেকে কথাটা শুনেই রান্নাঘরের দিকে ছুটল। এক জগ পানি এনে একজন মুক্তিযোদ্ধার হাতে দিয়ে আবার রান্নাঘরের দিকে ছুটল। ঘরে যে খাবার ছিল সেগুলোই তাড়াতাড়ি নিয়ে এসে বলল, আপনারা এটুকু খেয়ে অপেক্ষা করেন। আমি রান্না চড়িয়ে দিচ্ছি।

আরেকজন মুক্তিযোদ্ধা বলল, আর কিছু লাগবে না। আমাদের বন্ধু আহত হয়েছে। তাকে কাঁধে করে আনতে আনতে ক্লান্ত হয়ে গেছি। আর পারছি না। ও রাতটা আপনাদের বাড়িতে থাকবে। কাল এসে আমরা নিয়ে যাব।

মুক্তিযোদ্ধাকে এখানে রেখে যাবে, আবার আহত কথাটা শুনে শাহিনের বাবা সমস্যায় পড়ে গেল। যদিও মনে হচ্ছে দেশ স্বাধীন হয়ে যাবে তবু তারাকান্দায় এখনো রাজাকার আছে। ওরা টের পেলে উপায় নেই। কিন্তু আহত মুক্তিযোদ্ধাকে দেখে তার মন মায়ায় ভরে গেল। মরণ হলে হবে কিন্তু এই আহত মুক্তিযোদ্ধাকে আশ্রয় দিতেই হবে।

শাহিনের বাবা বলল, ওনাকে ঘরে নিয়ে চলুন।

দুজন মুক্তিযোদ্ধা ধরাধরি করে আহত মুক্তিযোদ্ধাকে নিয়ে একটা ঘরে গেল। বিছানা করে তাকে শোয়ালো। তার পা থেকে রক্ত ঝরছে।

শাহিনের বাবা রক্ত বন্ধ করার জন্য কাপড় দিয়ে বেঁধে দিল। কিন্তু কাজ হলো না।

সামান্য কটা ভাত খেয়েই দুজন মুক্তিযোদ্ধা চলে গেল। আর বলে গেল, আপনি কোনো চিন্তা করবেন না। তারাকান্দা এখন মুক্ত। দেশের অনেক অংশই এখন আমাদের দখলে। খুব তাড়াতাড়িই বাংলাদেশ স্বাধীন হবে।

আরেকজন বলল, আমরা ক্যাম্পে গিয়েই লোক পাঠাব। আমাদের বন্ধুকে নিয়ে যাবে। আল্লাহ আল্লাহ করে যদি রাতটা ওর কাটে তাহলেই হয়।  

রাত প্রায় শেষ হয়ে আসে। আহত মুক্তিযোদ্ধার রক্তক্ষরণ কোনোভাবেই কমছে না। মুক্তিযোদ্ধার মুখটা শুকিয়ে আসছে। ঠোঁট দুটি ফ্যাকাসে হয়ে গেছে। আশপাশে কোনো ডাক্তারও নেই যে ডেকে আনবে। মা পাশে বসে আছে। বাবা মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। আমি আর নীপাও পাশে বসে আছি। নীপা বারবার চোখ মুছছে। ওর কান্না দেখে আমারও কান্না পায়। আমারও চোখ ভিজে যায়।

সকাল হয়। আহত মুক্তিযোদ্ধার চোখ বন্ধ হয়ে যায়। নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে যায়। কোনো নাড়াচাড়া নেই।

শাহিনের বাবা চোখ মুছতে মুছতে বলল, নেই। এই বীর মুক্তিযোদ্ধা আর বেঁচে নেই।

শাহিনের মা কাঁদতে কাঁদতে নিজের ঘরে চলে গেল। নীপাও হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে মায়ের সঙ্গে সঙ্গে গেল। শাহিনের বাবা মুক্তিযোদ্ধার শরীর ঢেকে দিয়ে শিয়রের পাশে বসে মনে মনে সূরা পড়ছে। শাহিন বাবার পাশে করুণ চোখে লাশের দিকে তাকিয়ে আছে।

সকালেই চারজন মুক্তিযোদ্ধা চলে এলো। তাদের মধ্যে একজন ডাক্তার।

গ্রামের মানুষও ভিড় করে। শহীদ মুক্তিযোদ্ধাকে দেখতে আসে।

লাশ ঘর থেকে বের করে উঠোনে রাখা হয়। লাশ ঘিরে দাঁড়ায় অনেক মানুষ। অনেক শিশুও এসেছে। সবার চোখ পানিতে টলমল করছে।

একজন মুক্তিযোদ্ধা বলল, এই শহীদ বীরকে আপনাদের গ্রামেই কবর দিতে হবে। এছাড়া উপায় নেই।

লাশের গোসল করানোর প্রস্তুতি চলছে। একটা বড় পাতিলে পানি গরম করা হচ্ছে। পানির ওপর কয়েকটি বড়ই পাতা দেওয়া হয়েছে। গ্রামের কয়েকজন গোর কাটতে গেল। কেউ কেউ কাফনের বাঁশ কাটতে গেল। শিশুরা লাশের পাশে নির্বাক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

একজন মুক্তিযোদ্ধা বলল, ওর জামার পকেটে কিছু আছে কিনা দেখ তো লোকমান। শহীদ মুক্তিযোদ্ধার পরনে লুঙ্গি ছিল। লুঙ্গিটিও রক্তে ভেজা। 

লোকমান নামের মুক্তিযোদ্ধা শহীদ মুক্তিযোদ্ধার জামার পকেট হাতড়ে বেড়ায়। পকেটে একটা ভাঁজ করা কাগজ পায়।

ভাঁজ করা কাগজটি সবার সামনে মেলে ধরে লোকমান। একটি কাগজে বাংলাদেশের পতাকা আঁকা। মনে হলো খুব ছোট্ট শিশুর হাতে আঁকা। রংও লেপ্টে গেছে। তার নিচে আঁকাবাঁকা বর্ণে ও ভুল বানানে লেখা, ‘আমার পিয় বাবা তুমি দেশ সাধীন করে এই পতাকাটা উড়ায়া আসবা। তারপর আমারে কুলে নিবা। তোমার খোকা।’

কাগজটির দিকে সবার চোখ আটকে যায়। কারও মুখে কোনো শব্দ নেই। সারাটা উঠোনে স্তব্ধতা।

শহীদের লাশ ঘিরে যেসব শিশু দাঁড়িয়ে ছিল তাদের সবার চোখ পানিতে ভরে গেল।

সর্বশেষ খবর