শুক্রবার, ৮ সেপ্টেম্বর, ২০১৭ ০০:০০ টা

পাপ্পুর স্কুলবাড়ি

শামীম শিকদার

পাপ্পুর স্কুলবাড়ি

পাপ্পু পাড়াতলি গাঁয়ের আদর্শ বিদ্যানিকেতন স্কুলের পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ে। ছাত্র হিসেবে তেমন ভালো না হলেও খুব মেধাবী, যখন তখন তার মাথায় অদ্ভুত যত সব চিন্তা চলে আসে। বাড়ির কাছে স্কুল বলে কখনো স্কুলে আগে আসে না। সারাদিন বাড়িতে দুষ্টামি করে আর যখন স্কুলের ঘণ্টা পড়ে তখন কাঁধে ব্যাগ নিয়ে স্কুলে চলে আসে, তার জন্য পাপ্পুর পূর্ব প্রস্তুতির প্রয়োজন পড়ে না, নিয়মিত তাকে দেখলে মনে হবে সর্বদাই যেন সে স্কুলে আসার জন্য প্রস্তুত। স্কুলের সব শিক্ষক-শিক্ষিকা তাকে এক নামে  চেনে। পাপ্পুকে যেমন চেনে সবাই তেমনি তার বাবাকেও চেনে। আর যদি কেউ না চেনে তবে পাপ্পুর সঙ্গে পরিচয় হওয়ার দু-এক দিনের ভিতরেই তার বাবাকে চিনতে হয়। কারণ সে যেসব কর্মকাণ্ড করে বেড়ায় তার জন্য প্রতিনিয়ত তার বাবার কাছে নালিশ যায়। পাপ্পুর স্কুল শুধু তার স্কুল ভবনের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। আশপাশের এক কিলোমিটার পর্যন্ত চলে তার স্কুলের কার্যক্রম। পাপ্পুর খুব ভালো বন্ধু চল্টু, সেও অনেকটা পাপ্পুর মতো, তবে তার পড়া লেখা পুরোপুরিভাবে ঠিক আছে। গত বৃহস্পতিবার পাপ্পু স্কুলে আসা পর্যন্তই শেষ ক্লাসের পেছনের বেঞ্চে ব্যাগটি রেখে চল্টুকে নিয়ে চলে গেল আক্কাস মিয়ার আমবাগানে। ছোট ছোট আম গাছ। নিচে থেকে আম ছেঁড়া যায়। চল্টু ও পাপ্পু অনেক আম ছিঁড়ল। এখন শুধু স্কুলে আনার পালা। স্কুলে মরিচের গুঁড়া দিয়ে লবণ নিয়ে এসেছে চল্টু। যা মজা হয় না স্কেল দিয়ে কেটে কেটে মরিচের গুঁড়ার সঙ্গে লবণ দিয়ে আম খেতে। কিন্তু কোনো বারই তাদের মিশন সঠিকভাবে শেষ করতে পারে না। প্রতিবারই ধরা পড়ে যায় আর ধরা পড়লে তো বাবার কাছে নালিশ যাবে এটাই স্বাভাবিক। কার গাছের আমগুলো বড় হয়েছে, কার গাছের পেঁপে লাল হয়েছে, কার গাছের ফল মিষ্টি— এসব নিয়ে সারাদিন ব্যাস্ত থাকে তারা দুই বন্ধু। বিশেষ করে পাখি ধরে বাড়িতে নিয়ে আসা তাদের একটি বদঅভ্যাস। এ গাছ থেকে ওই গাছে, ওই গাছ থেকে অন্য গাছে সারাক্ষণ পাখির বাসা খুঁজবে তারা। এমনভাবে ঘুরে তারা কী যে আনন্দ পায় নিজেও তা জানে না। বিকালে পাড়ার সবাই মিলে মাঠে জড়ো হয়ে গল্প, আড্ডা ও বিভিন্ন খেলার আয়োজন করে। চল্টু দোকান সাজিয়ে বসে, পল্টু তার দোকানে কিনতে যায়, অন্যরা তাদের বাড়িতে বেড়াতে আসে। কাঁঠাল পাতা টাকা হিসেবে ব্যবহার করে। কার কত টাকা আছে তা দেখানোর জন্য, একসময় সবাই নেমে পড়ে কাঁঠাল পাতা কুড়াতে। মাঝে মাঝে তারা লুকোচুরি খেলাও খেলে, তার মধ্যে একজনকে বানানো হয় চোর বাকিরা সবাই সুবিধামতো বিভিন্ন জায়গায় লুকিয়ে থাকে আর যে চোর হয় সে সবাইকে খোঁজে। দুপুরবেলা পাড়ার সবাই একসঙ্গে গোসল করতে যায় নদীতে, গোসলের মাঝেও জমে ওঠে নানা খেলা, কেউ আবার মনের আনন্দে সাঁতার কাটে। যখন বর্ষাকাল আসে তখন বাড়ির বড়রা জাল নিয়ে ছুটে যায় নদীতে, ঝোলা ভরে মাছ নিয়ে ফিরে বাড়িতে। তাদের পুকুর ভরা মাছ, বেশ কয়েকটি গাভীও রয়েছে, নিয়মিত পাপ্পু দাদার সঙ্গে গাভীর দুধ নিয়ে হাটে যায়। তার পৃথিবীটা যেন সম্পূর্ণ স্বাধীন একটি পৃথিবী। সন্ধ্যা হলে দাদুর কাছে বসে শোনে রাজা-রানী ও রূপকথার গল্প। শুধু পাপ্পু নয়, গল্প শোনার জন্য পাড়ার অনেক ছেলে চলে আসে তাদের বাড়িতে। শীতকালে ঘরে ঘরে জমে খেজুর রসের মেলা, পাপ্পুর মা প্রতি শীতে রসের পিঠা বানায়, যা মজা হয় না। শীতের সকালে আবছা কুয়াশায় কাঠের টুকরো নিয়ে আগুন জ্বালিয়ে গোল করে সবাই চারপাশ দিয়ে বসে। পাপ্পুর গ্রামের স্কুলের সবাই যেন স্বাধীন পৃথিবীর স্বাধীন মানুষ। স্কুলের স্যার, ম্যাডামগুলোও যেন কত আপন। সবাই সবাইকে চেনে। শুধু সবাইকে নয়, সব ছাত্র-ছাত্রীর বাড়িও চেনে। ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা কী সুন্দর একা একা স্কুলে চলে আসে। কিন্তু পাপ্পু প্রায়ই শহরের ছেলেমেয়েদের গল্প শুনে তাদের সঙ্গে মা-বাবাকেও স্কুলে যেতে হয়। তা ছাড়া তাদের খেলার কোনো মাঠ থাকে না, তাই তারা সারাদিন টেলিভিশন দেখে, গেম খেলে কিন্তু পাপ্পুদের কত বড় খেলার মাঠ। প্রতি বছর স্কুলে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয়, বিকালে জমে খেলার আসর। স্কুলের সামনে উত্তর কর্নারে রয়েছে একটি কৃষ্ণচূড়া ফুলের গাছ। বসন্তকালে লাল টাকটকে ফুল ফুটে গাছে। হয়তো পাপ্পুর স্কুলে শহরের মতো অত ভালো পড়ালেখা হয় না। কিন্তু স্যার, ম্যাডাম ও ছাত্র-ছাত্রীদের ভালোবাসার সীমা নেই। তা ছাড়া গ্রামের সবাই সবাইকে চেনে, বিপদে সবাই সবাইকে সাহায্য করে। স্কুলে এলে সবার ভালোবাসায় বাড়িতে যাওয়ার কথা প্রায় সময় ভুলে যায়, স্কুলটিকে তার একটি বাড়ি বলে মনে হয়। পাপ্পুর কাছে মাঝে মাঝে মনে হয় তার স্কুলটি পৃথিবীর একটি শ্রেষ্ঠ স্কুল।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর