শুক্রবার, ১৬ আগস্ট, ২০১৯ ০০:০০ টা

কেটুর স্কুল

শাম্মী তুলতুল

কেটুর স্কুল

কেটুর বাবা একজন জেলে। কেটুকে সঙ্গে নিয়ে তার বাবা রোজ মধ্য রাতে চলে যায় মাছ ধরতে। বাপ-ছেলে প্রতিদিন লুঙ্গি গোছ মেরে মাছ ধরে। কিন্তু কেটুর এসব ভালো লাগে না। কেটুর মন চায় স্কুলে যেতে। লেখাপড়া করতে। যখন সে দেখে তার বয়সী ছেলে-মেয়েরা বই হাতে স্কুলে যায় তখন সে মুখ কালো করে তাদের দিকে তাকিয়ে থাকে। গ্রামে একটি এনজিও স্কুল আছে। স্কুলের সামনে প্রায় সময় সে দাঁড়িয়ে থাকে। এভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে স্কুলের আমীন স্যার তা খেয়াল করেছিল।

একদিন তাকে ডেকে বললেন, কি বাবা এখানে দাঁড়িয়ে কি দেখছ?

কেটু একটা হাসি দিয়ে বলে, ফরতে দেহি।

তুমি পড়তে চাও?

বাবা ফরতে দিবোনা।

আমি বোঝাবো তোমার বাবাকে।

কেটু যেন স্যারের দিকে বিস্ময় দৃষ্টিতে তাকায়। স্যারকে বলে, সত্য কইবেন।

হ্যাঁ বলব।

স্যার কথামতো কেটুর বাবাকে সব বুঝিয়ে বলল। কেটুর বাবা অবশেষে রাজি হলো। স্যার তাকে স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিল। কেটু স্কুলে যাওয়া শুরু করে দিল। কেটু তো মহাখুশি। প্রথম দিন ক্লাস রুমের চারপাশে সে তাকায় আর অবাক হয়। যাদের সে একসময় দাঁড়িয়ে দাড়িয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখত আজ সে তাদের ভিড়ে। নিজেকে ছাত্রদের মাঝে দেখতে পেয়ে আত্মহারা।

সে উঠতে বসতে তার বই ছুঁয়ে দেখে। বইয়ের ঘ্রাণ শুকে দেখে। ভাবে এই বই শুধু তার। এই বই কেউ কেড়ে নিতে পারবে না তার কাছ থেকে। বই বুকে নিয়ে সে রোজ ঘুমিয়ে পরে। তার ভাবনায় এখন রঙিন স্বপ্ন। একদিন বড় হয়ে কিছু করবে বাবা-মায়ের দুঃখ দূর করবে। ভাবতে ভাবতে ঘুমের ঘোরে মধ্য রাতে প্রতিদিন বাবার ডাকে কেটুর ঘুম ভাঙে। বাবা কেটুকে মাছ ধরতে যাওয়ার জন্য হাক দেয়।

কেটু তরিঘরি করে বই রেখে বাবার সঙ্গে মাছ ধরতে বেড়িয়ে পড়ে।

ভোর হতে না হতেই তারা মাছ ধরে বাড়ি ফিরে। আর কেটু না ঘুমিয়ে দৌড় দেয় স্কুলে। লেখাপড়ার প্রতি কেটুর আগ্রহে দেখে বাবা-মা বেশ খুশী।

কেটু সব সময় সময়মতো স্কুলে চলে যায়। একদিন স্কুলের ক্লাস টিচার সকলের নাম ডাকার পর সবার থেকে পড়া নেওয়া শুরু করলে কেটুর পালা এলো। স্যার কেটুর সামনে বই নিয়ে দাড়াতেই মুখে হাত দিল। কেটুর শরীরে গন্ধ। স্যার তাকে জিজ্ঞেস করল তোর গায়ে এত গন্ধ কেন?

কেটু বলল, কাল সারা রাত বাপের লগে মাছ ধরছি।

কি বললি? তাই বলে কি পরিষ্কার  হয়ে আসা মানা। কে বলে তোদের স্কুলে পড়তে। বের হ এখন। স্যার কেটুকে কান মুচড়ে ক্লাস রুম থেকে বের করে দিল। কেটু কাঁদতে কাঁদতে বাড়ি চলে এলো। বাড়িতে এসে সব খুলে বললে বাবা-মা মন খারাপ করে ফেলল। মা বলে, গরীব বইলা আমাগো কোন দাম নাই? এইভাবে মারন লাগে, বুঝাইলে হয়না। মা কেটুকে শান্ত্বনা দিয়ে তার কান্না বন্ধ

করল। সেদিন রাতে কেটুর গায়ে খুব জ্বর এলো। যার কারণে পরদিন সে আর স্কুলে যেতে পারল না। এভাবে কয়েকদিন গত হলো। সুস্থ হলে কেটু আর ভয়ে স্কুলে যেতে চাইল না। বাবা-মাও কিছু বলল না। কয়েকদিন ধরে কেটুকে ক্লাসে দেখতে না পেয়ে আমীন স্যার অন্য ছাত্রদের জিজ্ঞেস করলে তারা বিস্তারিত খুলে বলে। এতে স্যার খুব দুঃখ পেলেন। স্কুল ছুটি হলে স্কুল থেকে ফেরার পথে স্যার কেটুদের বাড়িতে চলে গেলেন। স্কুলে যেতে পারছে না বলে কেটুর খুব মন খারাপ।

স্যার কেটুকে উঠোনে ছোট ছোট পায়ে পায়চারি করতে দেখে ডাক দিলেন। কেটু ছুটে এসে স্যারকে জড়িয়ে ধরলেন। স্যার কেটুর জন্য কিছু  চিপস আর চকলেটও নিয়ে আসলেন। তার হাতে দিয়ে বললেন, কি বাবু শরীর ভালোতো।

কেটু একটা ভেটকি হাসি দিয়ে বলল, হে স্যার ভালা। কেটুর মা মুখে বড় ঘোমটা টেনে বলল, স্যার আমার পোলাডার কান দেহেন কি অবস্থা ফুইলা গেছে।

আমি সব জানি বোন। এ ব্যাপারে আমি কথা বলেছি উনার সাথে।

আমার পুত আর যাইবনা ইশকুলে।

এটা তো কোন সমাধান না বোন। পড়তেতো হবেই। আর আপনি খেয়াল করেন ওর সম বয়সী অন্যরা কি করছে। তাছাড়া ও আপনাদের অনেক সহযোগিতা করতে পারবে।

কেটু হঠাৎ স্যারের কথার মাঝখানে বলে উঠল, স্যার স্যার আমি স্কুলে গেছি বলে  মাছের হিসেব করতে পারছি।

দেখেছেন? লেখাপড়া জানা থাকলে আপনাদের কেউ ঠকাতে পারবে না। একদিন এই জেলে পল্লীতে কেটু সবাইকে উৎসাহ দিবে লেখাপড়া করতে।

আফনি এত ভালা আর উনি কেমন মানুষ। এতো বেশকম হয় কেমনে?

ও কিছু না এসব ভুলে যান। কাল থেকে ওকে স্কুলে পাঠান বাকিটা আমি দেখব।

কেটুর মা আইচ্ছা বলে মাথা নাড়ল। স্যার  কেটুর মাথায় হাত বুলিয়ে চলে গেল। কেটু স্কুলের যাওয়ার খুশিতে উৎফুল্ল হয়ে উঠল। নতুন করে আবার স্বপ্ন দেখা শুরু করল। তার চোখে মুখে হাসি দেখে মায়ের চোখ ছলছল করে উঠল। কেটুদের স্বপ্ন পূরণে  আমাদের সামান্য সহযোগিতাই যথেষ্ট।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর