শুক্রবার, ১৬ জুন, ২০২৩ ০০:০০ টা

ভূত দাদু

নিশো আল মামুন

ভূত দাদু

আমি তখন খুব ছোট। তোমাদের মতো। শহরে একটা শাদা রঙের দোতলা বাড়িতে থাকতাম। তিন ভাইবোন মিলেমিশে একটা রুমে গল্প করতে করতে ঘুমিয়ে যেতাম। গল্পের ফাঁকে ফাঁকে কখনো কখনো খুব জোরে হেসে উঠতাম। কী যে আনন্দ! তোমরা হয়তো বিশ্বাস করবে না। একদিন রাতে কোনো কারণে আমাকে সেই রুমে একা থাকতে হলো। কেন জানি ঘুম আসছিল না। এপাশ ওপাশ করছি। দেয়াল ঘড়ি টিক টিক করে অনেক বেজে গেছে। এর মধ্যে আমাদের বাসায় দু’একটা ভূতের কান্ড-কারখানাও ঘটে গেছে।। শুধু ভূতের কথা মনে পড়তে লাগল। দেয়াল ঘড়িতে ঢং ঢং করে একটা বেজে গেল। হঠাৎ মনে হলো কে যেন অন্ধকারে আমার বিছানার চারপাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে। পায়ের আওয়াজ, ঘন ঘন নিঃশ্বাসের শব্দ স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে। সে যেন কী খুঁজছে, পাচ্ছে না। দ্রুত একবার রুমে একবার বারান্দায় ছোটাছুটি করছে। ধপ করে একটা হাত আমার শরীরে স্পর্শ করল। ভয়ে আমার গা ছমছম করতে লাগল। তারপরও ভয় ভয় গলায় বললাম, কে, কে ওখানে? হঠাৎ সব শব্দ থেমে গেল। একটা কথা খুব স্পষ্ট শুনতে পেলাম, আমি দাদু ভাই। ভূত! ভয় পাচ্ছ? গল্প করতে এসেছি তোমার সাথে।

আমি ভয় পেয়ে কোলবালিশটা খুব শক্ত করে ধরলাম, কিছুক্ষণ পর আমার ভয়টা একটু কেটে গেলে বললাম, এই রাতে কেউ গল্প করে?

বল কী? আমরা তো রাতেই গল্প করি। ঘুরে বেড়াই। কী সুন্দর জোছনা! একবার দেখতে ইচ্ছে করে না?

আমার ভয় ততক্ষণে আরও অনেকখানি কেটে গেছে। জানালার পর্দা একটু সরিয়ে দেখি, ঝক ঝকে জোছনা। বললাম, তুমি দেখ। আমি ঘুমিয়ে পড়ি। সে বলল, তুমি একা বুঝি? তবে, তবে তোমাকে নিয়ে একটা জায়গায় বসে গল্প করা যাক।

কোথায়?

ভয় নেই। আমি তোমার দাদুর মতো। তুমি আমাকে ভূত দাদু বলে ডাকবে।

ভূত দাদু আমাকে সাঁই সাঁই করে উড়ে নিয়ে শহরের শেষ প্রান্তে বসল। বলল, একশ বছর আগে আমিও ঠিক তোমার মতো ছোট ছিলাম। গ্রামে ছ’ভাই আর তিন বোন, মা-বাবা মিলে থাকতাম। একটা লম্বা তালগাছে। তালগাছের নীচে উঠোনটা ফক ফক করত। পাশে পুকুরটা চকচক করত। গ্রামটা ছিল রূপসী চাঁদের মতো।

তোমার যেমন তিন ভাইবোন গল্প করে, ঠিক তেমন করে আমরা ভাইবোনরা মিলে গল্প করতাম। এই পঞ্চাশ বছর ধরে শুধু একা একাই শহরে হু হু করে বেড়াচ্ছি। আজ তোমার সাথে আমার সেই ছোটবেলার গল্প করব। নিরুপায় দেখে উৎসাহ নিয়ে বললাম, সেই ভালো।

সবচেয়ে মজার কথা যদি শুনতে চাও তাহলে আমাদের গ্রামের কথা বলি। ভূত দাদু চাঁদের দিকে তাকাল। তারপর বলল, গ্রামটা ম’রে গেছে। গ্রাম থেকে পালিয়ে এসেছে অনেকেই। পালিয়ে এসেছি আমি। ওই গ্রাম আজও স্বপ্নে দেখি। ফেরার আর পথ নেই। পুকুর বাঁধানো ঘাটে ভিড় লেগে থাকত। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত। নদীটা একেবেঁকে চলে গেছে বহু দূর। উত্তর দিকটা ছিল বনের মতো। সেকথা আমার স্পষ্ট মনে আছে। শুনছ? কেমন লাগছে। আমি বললাম, মানুষ দাদুর চেয়ে তোমার গল্পের শুরুটি বেশ মজার।

তবে শোন, যখন জোছনায় ভেসে যেত সমস্ত গ্রাম। আমরা সবাই মিলে নদীতে গোসল করতাম। মাঠে নেচে গেয়ে খেলতাম। আমার ভাই বাঁশি বাজাত খুব সুন্দর। বোনেরা মিলে উড়ে উড়ে সমস্ত গ্রাম, পুল ঘাট ঘুরে বেড়াতাম। পশ্চিমে মাঝির বাড়িটা ছিল খুব চকচকে ঝলমলে। ইচ্ছে হচ্ছে গ্রামটা তোমার চোখের সামনে দাঁড় করি। যেন রূপসী, সবুজ, শ্যামল কন্যার মতো। তোমার কী মনে হয়।

আমি খুব নীচু স্বরে বললাম, আমি তো গ্রাম দেখিনি। তবে ছবিতে দেখেছি। বুঝেছি ছবির চেয়েও সুন্দর গ্রাম। তোমাকে আর অনেক বলতে হবে না। ভূত দাদু খপ করে আমার ডান হাত চেপে ধরল। বলল, অন্ধকার রাতে বাতাসে বাতাবি লেবুর শাদা ফুলের গন্ধ ভেসে আসত। জোনাকি পোকা জ্বলত নিভত। ঘুগরা পোকা ঝিঁইইই ঝিঁই ডাকত। ঝুম বৃষ্টি এলে মাঝি বাড়িতে, মাতবরের বাড়িতে ভুনা খিচুড়ির গন্ধ বের হতো। তখন আমরা ভাই বোনেরা টিনের চালে ঢিল ছুড়তাম। তারা ভয়ে জড়সড়ো হয়ে পড়ত। গ্রামের সড়কটা খুব উঁচু ছিল না। পিচঢালা ছিল না। মাঠ থেকে একটু উঁচু ছিল। ওই সড়ক ধরে মানুষ যেত। গরু যেত। ভোরবেলায় মক্তবে আওয়াজ উঠত, আলিফ দুইপেশ উন, বে দুই পেশ বুন। খালি গায়ে হেডমাস্টার সাহেব নাদুশ নুদুশ শরীর দুলিয়ে সিসার ঘটি নিয়ে ঘাটে যেতেন। মহাজন বাবু যেতেন সাইকেলে। ফিরে আসতেন সন্ধের পর হলুদ কলার কাঁদিটা থাকত সাইকেলে। কখনো কখনো আমরা ভাইবোনেরা সাইকেল টেনে ধরতাম। পালকিও যেত দু’একটা। নতুন বউ। শীত এলে গাঁয়ের মা, খালা, নানি-দাদিরা পিঠা বানাত। আমরা আশেপাশে ঘুরতাম। হঠাৎ হঠাৎ হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলতাম, দে একটা পিঠা!

তোমরা তো বেশ দুষ্ট ছিলে।

ভূত দাদু খট খট করে হেসে উঠল। বললাম, গ্রাম ছেড়ে চলে এলে কেন? ভূত দাদু গো গো করে নিঃশ্বাস ছাড়ল। বলল, আহ্ দাদুভাই গ্রাম আর গ্রাম নেই। আগে সব শোন।

একদিন সকালে দেখি কালো একটা গাড়িএলো। কী সব নামানো হলো। ক্যামেরা, দুরবিন আরও কত কিছু। ইয়া মোটা কালো লোকও নামল গাড়ি থেকে। চোখ দুটো শকুনের মতো। কিছু দিনের মধ্যে মটমট করে গাছ ভাঙল, ঘর ভাঙল, গ্রামটাও ভেঙে গেল। সড়কটাও খুব বেশি উঁচু হয়ে গেল। মাটিতে বড় বড় দালান উঠল। ঠিক যেন নরপিশাচের কঙ্কালের মতো। একদিন তালগাছটাকেও মট করে ভেঙে ফেলল। সমস্ত গ্রামটার মৃত্যু হলো। ভূত দাদু কথা শেষ করে কান্না করল। তারপর বলল, সুন্দর রাত্রী। ফুট ফুটে জোছনা। দক্ষিণের বাতাস আর নেই দাদু ভাই। আমরা সবাই চলে এলাম তোমাদের এই শহরে।

আমারও খুব খারাপ লাগল। ইচ্ছে হলো কেঁদে ফেলি। ভূত দাদু আমাকে একটা কলম দিল। বলল, যখন বড় হবে। মানুষ হবে। গ্রামের মতো সুন্দর করে এই নগরগুলো গড়ে তুলবে।

গল্পটা কেমন লাগল। আমি বললাম, খুব ভালো। ভোরে প্রথম কাক ডাকল। বললাম দাদু ভাই আরও গল্প করবে কী? কোনো আওয়াজ শুনলাম না। দেখি আমি বিছানায় শুয়ে আছি। ভোরের আলো ঘরে ঢুকল।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর