শুক্রবার, ৪ আগস্ট, ২০২৩ ০০:০০ টা
গল্প

মায়ের জন্য কিনলাম

রেবা হাবিব

মায়ের জন্য কিনলাম
দূর থেকে মেলার ভিড় দেখা যাচ্ছে। চারদিকে গাড়ি ও বিপুলসংখ্যক লোক, কোথাও কোথাও অন্যান্য যানবাহনের সারিও দেখা গেল। ফাঁকা জায়গা দেখে রাইসুল কাকা গাড়ি থামালেন, তারপর সবাই গাড়ি থেকে নেমে পড়ল

দবির থাকে একটা ছোট্ট গ্রামে যৌথ পরিবারে। তার বয়স আট বছর। প্রতিদিনের মতো দবির খুব ভোরে ওঠে। সকাল সকাল গোসল করে আর পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন পোশাক পরে। আজ দবির খুব খুশি। আজকের দিনটির জন্য সে এক মাস ধরে অপেক্ষা করে আছে। আজ দাদা সবাইকে নিয়ে যাবেন চন্দ্রতলা মেলায়। প্রতি বছর দাদা বাড়ির ও পাড়ার সব ছেলেমেয়েকে গাড়িতে করে ইছামতী নদীর তীরে তেঁতুলতলার ঘাটে মেলায় নিয়ে যান।

বাড়িতে তোলপাড় শুরু হয়ে গেছে। সকাল থেকেই দবিরের মা রান্নাঘরে নাশতা ও খাবার তৈরিতে ব্যস্ত। দাদি নিজের কাজে ব্যস্ত আছেন। মহিলারা বাড়ির সামনের জায়গাটি ঝাড়ু দিয়ে পরিষ্কার করছেন। রাস্তায় একটা ছেলেমেয়েকেও খেলতে দেখা গেল না, সবাই মেলায় যাওয়ার প্রস্তুতিতে ব্যস্ত।

রাইসুল কাকা প্রথম দিনই গাড়ি ভাড়া করেছেন। দবিরের মা পথের মধ্যে খাওয়ার জন্য খাবার তৈরি করে সঙ্গে দিয়েছেন। রাইসুল কাকা দেশাত্মবোধক একটা গান গুনগুন করতে করতে গাড়িতে খাবার, পানির বোতল, প্রয়োজনীয় কিছু জিনিসপত্র রাখলেন। দবিরের উদ্যম বাড়ছে, এখন এক মুহূর্ত বাড়ি থাকা সহ্য হচ্ছে না। মেলায় যাওয়ার জন্য অধৈর্য হয়ে উঠেছে। দাদুকে বলল, দাদা কখন মেলায় যাবে? এখনই চলো, অনেক দেরি হয়ে গেছে। সবাই নিশ্চয়ই পৌঁছে গেছে।

দবিরের অধৈর্যতা বাড়তে দেখে কিছুক্ষণের মধ্যে সবাই গাড়িতে বসে মেলার উদ্দেশে

রওনা হলো। তাদের সাজানো গাড়ি যখন গ্রামের রাস্তা দিয়ে গেল তখন সবার চোখ স্থির হয়ে গেল। তারা গাড়িতে সারা পথ মজা করেছে, পথে যা কিছু এসেছে তার কথা বলছে।

আলোচনার মধ্যে পাখি, সারস, বগলা, প্রজাপতি, কাঠবিড়ালি, কুকুর, বিড়াল, বাঁশঝাড়, গাছপালা, নদী, পুকুর, মাছ, ব্যাঙ, মসজিদ, সূর্য, চাঁদ, তারা আরও কত কী! ছেলেমেয়েরা সব সময় দাদুকে নিয়ে খুশি। এভাবে হাসতে হাসতে গান গাইতে গাইতে শেষ পর্যন্ত মেলায় পৌঁছে গেল গাড়ি।

দূর থেকে মেলার ভিড় দেখা যাচ্ছে। চারদিকে গাড়ি ও বিপুলসংখ্যক লোক, কোথাও কোথাও অন্যান্য যানবাহনের সারিও দেখা গেল। ফাঁকা জায়গা দেখে রাইসুল কাকা গাড়ি থামালেন, তারপর সবাই গাড়ি থেকে নেমে পড়ল। ছেলেমেয়েদের পাশাপাশি রাইসুল কাকাকেও খুব খুশি দেখাচ্ছে, এজন্যই ওরা সব কিছু হুট করেই করছে, হাসছে আর গান করছে। সবাই নিচে তেরপল বিছিয়ে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিল। তারপর দাদা সব বাচ্চাকে নিয়ে মেলার দিকে গেলেন।

ইছামতী নদীর ওপর সেতুতেও ভিড় অনেক, অনেকে নদীতে গোসল করছে। হাত-পা ধুয়ে মেলার দিকে চলে গেল। মেলায় দূর থেকে দেখা বিভিন্ন ধরনের বড় বড় দোলনা। একদিকে মিষ্টির দোকান। খেলনা, সাজসজ্জা, গহনার দোকান, জুতা, জামাকাপড়, গৃহস্থালীর জিনিসপত্র, খাওয়ার সামগ্রীসহ সব কিছু মেলার সৌন্দর্য বাড়িয়ে দিচ্ছে।

দাদু দবিরের হাত ধরে হাঁটছেন, কারণ দবির সবার ছোট। বাকি ছেলেমেয়েও একে অপরের হাত ধরে দাদুকে অনুসরণ করছে। রাইসুল কাকা পেছনে হাঁটছেন যাতে সব বাচ্চাকে দেখতে পান। প্রথমত, দাদা বাচ্চাদের জন্য প্রচুর আখ নিয়েছেন, যাতে গাড়িতে বসে বাচ্চারা তা উপভোগ করতে পারে আর ক্ষুধার্ত হলে খেতে পারে। মেলায় সাজানো দোকান ও পণ্যসামগ্রী সবার নজর কাড়ছে।

বাচ্চারা খেলনা, মিষ্টি, নিজের পছন্দের জিনিস কিনল, কিন্তু দবির শুধু দেখল। সে এখনো কোনো জিনিস গ্রহণ করেনি। দাদু বললেন, তুমিও এখন নিজের জন্য কিছু কিনো, দেখো সব ছেলেমেয়ে নিজের জন্য কিছু নিয়ে গেছে।

দবির বলল, হ্যাঁ দাদা, আমি যখন আমার পছন্দের কিছু খুঁজে পাব তখন আমার কাছেও থাকবে।

দাদাসহ সব ছেলেমেয়ে হাসিমুখে মেলা উপভোগ করল। হঠাৎ লোহার দোকানের সামনে দবিরের পা থেমে গেল। সে দোকানদারের কাছে গেল। দর কষাকষি করতে লাগল। দাদা পেছন ফিরে তাকিয়ে বললেন, দবির, এই লোহার দোকানে কী করছ? এখানে এসো, এখানে এসো, এখন বাড়ি ফিরতে হবে।

দাদা একটু দাঁড়ান, আমি একটি বটি নিয়ে আসছি।

দাদু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, বটি দিয়ে কী করবে? আমাদের বাড়িতে আগে থেকেই চার-পাঁচটা বটি আছে।

দবির বলল, আমাদের বাড়ির বটিটা অনেক পুরনো আর আঁকাবাঁকা হয়ে গেছে, সবজি কাটতে গিয়ে মায়ের আঙুল অনেকবার কেটে যায়, একটা নতুন বটি নিতে হবে দাদা।

দবিরের কথা শুনে বাকি ছেলেমেয়েও হাসতে লাগল। তার বোন চিৎকার করে বলল, তুমি কি বটি নিয়ে ধান কাটতে চাও?

দবির উত্তর দিল না। এত ছোট ছেলের মুখ থেকে এমন কথা শুনে দাদুর চোখ ভিজে গেল। মায়ের প্রতি দবিরের যত্ন, উদ্বেগ ও ভালোবাসা দেখে দাদা আনন্দিত হলেন। দাদু বটি নিয়ে দবিরের দিকে এগিয়ে গেলেন। বটি পেয়ে দবির খুব খুশি হলো। মনে হলো সে ‘কুঁড়েঘরের ছেলে’ গল্পের ছেলে ‘হামিদ’। একবার ক্লাসে তার শিক্ষক গল্পটি শোনালেন। এই গল্প শুনে দবিরের চোখ পানিতে ভরে গেল, সেই ছোট্ট ছেলেটিও তার দায়িত্ব উপলব্ধি করল। তার মধ্যে নৈতিকতা ও কর্তব্যপরায়ণতার ভিত্তি স্থাপিত হয়েছে। সে হামিদের মতো ধার্মিক সন্তান হওয়ার সংকল্প করল। বটি কিনে মায়ের প্রতি দায়িত্ব পালন করে সে আজ অপরিসীম আনন্দ অনুভব করল, আর দাদা মনে মনে দবিরের শিক্ষককে ধন্যবাদ জানালেন, কারণ শিশুদের মধ্যে নৈতিক গুণাবলির বিকাশে শিক্ষকেরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। শিক্ষকরা শিশুদের ভালো মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার জন্য তাদের মধ্যে নৈতিকতার বীজ শুরুতেই বুনে থাকেন।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর