শুক্রবার, ১৯ জুলাই, ২০২৪ ০০:০০ টা

গোলাপি প্রজাপতি

সুন্নাহ সাজিদা খান

গোলাপি প্রজাপতি

পাহাড়সম ময়লার স্তূপ। পাশের নদীর পানি কুঁচকুঁচে কালো। কোনো মাছ মনে হয় না এতে আছে। থাকলেও টাকি মাছ থাকতে পারে। কচুরিপানায় ভরে আছে নদীটা। স্থানীয় লোকজন মিলে বাঁশ দিয়ে কচুরিপানা আটকে রেখেছে। এই জায়গাটায় মানুষ গোসলসহ গৃহস্থালির যাবতীয় কাজ করে, এমনকি গরুকেও এখানেই গোসল করায়। নদী ভরাটের জন্য স্রোত নেই কোনো। তাই নদীই যেন হয়ে উঠেছে আস্ত একটা জলাশয়। কুলসুম এ নদীতেই প্রতিদিন গোসল করতে আসে। গোলগালমুখ, গায়ের রং শ্যামলা ছিল তবে রোদেবানে ঘুরে এখন কালোই হয়ে গেছে। চুলগুলো লালচে, তবে খুব সুন্দর করে আঁচড়ানো। বয়স সাত বা আটের কাছকাছি। লাল একটা ফ্রক পরে কুলসুম গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে যাচ্ছে নদীর ধারে গোসল করতে। তার ভালো লাগে না এমন পচা পানিতে গোসল করা। গায়ে ফোঁসকা পড়ে, চুলকায়ও। ওদের গ্রামে টিউবওয়েল আছে মাত্র দুইটা। সরকার থেকে দিয়েছে। তবে খড়ার কারণে পর্যাপ্ত পানি তারা পায় না। যেটুকু পানি ওঠে তা খাওয়ার জন্য রাখতে হয়। এমনও সময় যায় নদীর পানিই ফুটিয়ে খেতে হয় গ্রামের মানুষদের। এতে অনেক মানুষ পানিবাহিত রোগে আক্রান্ত হয়, অনেকে মারাও যায়। গত বছরেই শেফালি মারা গেল ডায়রিয়া হয়ে। মেয়েটা সহজসরল ছিল, সব সময় কুলসুমের সঙ্গেই খেলা করত। টিউবওয়েল যেখানে তাদের খাবার পানিরই জোগান দিতে পারছে না, সেখানে গোসল বা অন্য কাজের জন্য পানি কীভাবে পাবে। যার ফলে এই কালো পানি ছাড়া ওদের কোনো উপায় নেই। কুলসুম গোসল শেষে বাড়ি ফিরেই ওর মাকে জিজ্ঞেস করল, ‘নদীর পানিটা এমন কালা ক্যান আম্মা? আর অত ময়লা এইহানে ফালায় ক্যান? আমরা যে এখানে গোছল করি এরা কি দেহে না? দেহো হাতে আরও নতুন দুইডা ফেসকা পড়ছে’। মেয়ের মুখে মা প্রায়ই একথা শুনেছে। কুলসুমের মা ভাতের ফ্যান ফেলতে ফেলতে বলল, ‘মারে এইখানে সব কলকারখানা আর বড়লোক মাইনষের বাসাবাড়ির ময়লা ফালায়, হেরার অনেক টেকা, এল্লিগা আমরা কিছু কইতে পারতাম না, কইলে আমগরে এহানতে উঠায়া দিব। বাঁইচ্যা আছস এইটা নিয়াই শুক্কুর কর।’ কুলসুম কিছু একটা বলতে চাইল, কিন্তু ওর মা থামিয়ে দিল। ‘যা নুনটা ঘরে রেখে আয়, ছাই পড়ব এইহানে থাকলে। আর টেবিলের ওপরে মলম আছে, লাগাইলেই ভালা হয়া যাইবো। কত ময়লা আবর্জনা খাইতাছি এই ছাইয়ে আর কী ক্ষতি হইবো!’ ভাবতে ভাবতে কুলসুম লবণের বাটি হাতে নিয়ে ঘরে চলে গেল। রাতে ওর বাবাকেও একই প্রশ্ন করল। ওর বাবাও কিছুটা এমনি উত্তর দিল। আজ রাতে কুলসুমের চোখে ঘুম আসছে না। বাইরে ট্রাকের শব্দ হচ্ছে। সে জানে ট্রাক আসছে ময়লা ফেলতে। সে ভাবতে থাকে, ময়লার স্তূপ আরও বড় হবে। নদীর পানি আরও কালো হবে। এ পানিতে গোসল করলে শরীরে আরও ফুসকা হবে, ব্যথা করবে, ছোট বড় সবার কদিন পরপর পেটের অসুখ করবে। কুলসুমের চোখ ভিজে গেছে। মেয়েটা দুবেলা ঠিক মতো ভাত খেতে পায় না, তা নিয়ে তার কোনো কষ্ট নেই। কষ্ট শুধু একটাই, বাড়ির চারপাশ এত ময়লা, নদীর পানি এত কালো। তবু এটা নিয়ে কেউ কিছুই বলে না।

ভাবতে ভাবতে কুলসুম ঘুমিয়ে গেল।

কুলসুম হঠাৎ যেন নিজেকে আবিষ্কার করল তুলতুলে সাদা চাদর বিছানো একটা বিছানায়। ভালো করে দেখল এটা ওদেরি ঘর কিন্তু সব কিছুই কেমন পরিষ্কার। ওর কাছে ব্যাপারটা একটু অস্বাভাবিক লাগল, তাও তার ভালো লাগছে। দৌড়ে ঘর থেকে বের হলো, দেখল ঘরটা ওদের হলেও বাহিরটা অন্যরকম। পায়ের নিচে নরম কচি ঘাস, গাছে গাছে ফুল, পাখির ডাকাডাকি, অনেক অনেক প্রজাপতি ঘুরছে। নীল, হলুদ, সাদা, কালোর মাঝে সাদা ছোপছোপ, এ যেন প্রজাপতির এক মেলা। সে একটা গোলাপি প্রজাপতি দেখতে পেল, কুলসুম আগে কখনো গোলাপি রঙের প্রজাপতি দেখেনি তাই এটাই তাকে বেশি আকৃষ্ট করেছে। প্রজাপতিটি উড়ে চলে যাচ্ছে দেখে সে পিছু পিছু দৌড়াতে লাগল। এরই মধ্যে সে লক্ষ্য করল হাতে পায়ের ফোসকা গুলি নেই, গায়ে সাদা একটা জামা, পায়ের নিচে ময়লার পরিবর্তে সবুজ ঘাস। মাঝপথে শেফালিদের বাড়ির সামনেও বাগান দেখল। সেখানটায় অনেক রকম ফুল ফুটে আছে। বাড়ির ডান পাশে একটা ড্রেইন ছিল, যে ড্রেইন দিয়ে কালো পানি এসে নদীতে পড়ত, তা এখন আর নেই। ওর মন যেন খুশিতে ভরে উঠল। দৌড়াতে দৌড়াতে পৌঁছে গেল একটা নদীর কাছে তখনই প্রজাপতিটা উধাও হয়ে গেল। নদীটা প্রথমে সে চিনতে পারল না, কিছুক্ষণ ভালো করে চার দিকটা দেখার পর সে বুঝতে পারল, বাড়ির পাশের নদীটাই তো এটা। কিন্তু নদীর পাশে ময়লার স্তূপ নেই, নদীর পানি স্বচ্ছ, স্রোত বয়ে যাচ্ছে। নদীতে কারা যেন জাল ফেলে মাছও ধরছে। কুলসুম বিশ্বাস করতে পারছে না এটা সেই আগের কালো পানির নদী। কুলসুম নদীর পানিতে পা ভিজিয়ে বসে আছে। পায়ে ছোট ছোট মাছ এসে ঠুকর দিচ্ছে। আহা শান্তি, এত সুন্দর বাতাস, নীল আকাশ, ভোরের সূর্য, ভেসে আসছে কামিনী ফুলের ঘ্রাণ। কুলসুম মনে মনে বলতে লাগল, ‘ময়লা ফেলার লোকগুলো ভালো হয়ে গেছে, ওর আর কালো পানিতে গোসল করতে হবে না, ময়লার পচা গন্ধে দম বন্ধ হবে না। আর কোনো শেফালির মৃত্যু হবে না ডায়রিয়াতে।’ তখনই কুলসুমের মনে হলো মাকে তো বলা হয়নি, দৌড়ে মাকে ডাকতে গেল, আম্মা আম্মা আম্মা...

কুলসুমের মা : কিরে মা কি হইছে, ঘুমের মইদ্দে স্বপন দেখলি নাকি, কুলসুম এই কুলসুম।

শোয়া থেকে কুলসুম উঠে বসে পড়ল, এদিক সেদিক তাকিয়ে বলতে লাগল, ‘আম্মা সাদা জামা কই আমার, ঘর ময়লা, পচা গেরান!! গোলাপি প্রজাপতি, গোলাপি প্রজাপতি...’

কুলসুম চুপ হয়ে গেছে। ওর আর বুঝতে বাকি নেই সবই স্বপ্ন ছিল। তার মানে নদীর পানি এখনো কালো, ময়লার স্তূপও জায়গা মতো আছে। সে এখন নদীর দিকে যাচ্ছে মুখ ধুতে। কালো পানি ওর শ্যামলা মুখকে আরও কালো করে দিবে। কালো পানি, কালো পানিতেই কুলসুমের জীবন।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর