বুধবার, ১৬ জানুয়ারি, ২০১৩ ০০:০০ টা
খোলা কলাম

যাত্রা শুরু হোক

মাহমুদুর রহমান মান্না

যাত্রা শুরু হোক
১১ তারিখ শুক্রবার বিকাল সাড়ে ৩টায় বিএমএ অডিটরিয়ামে আমার ফেসবুক বন্ধুদের নিয়ে একটা আড্ডা ছিল। আমি ফেসবুক অ্যাকাউন্ট করেছি মাসদেড়েক হয়। এ সময়ের মধ্যে আট হাজারেরও বেশি বন্ধু হয়েছে আমার, যারা ঢাকায়, ঢাকার বাইরে এবং বিদেশেও আছেন। ঢাকায় অবস্থিত যারা তাদের আড্ডায় ডেকেছিলাম। ফেসবুক সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে বিশ্বব্যাপী। বাংলাদেশেও এর প্রচার ও ব্যবহার হচ্ছে প্রচুর। ফেসবুক ও ব্লকের লেখা আমি মাঝে-মধ্যেই ফলো করি। আমার কাছে মনে হয় এগুলোর মধ্য দিয়ে আমাদের বর্তমান সমাজ, রাষ্ট্র ও রাজনীতি সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। এ ধারণাটি ঠিকমতো বোঝা এবং সেটাকে কোনো ইতিবাচক কাজে লাগানোর চিন্তা মাঝে-মধ্যে ক্রিয়া করে আর সেই বিবেচনা থেকেই এই আড্ডার আয়োজন। আড্ডাটা আমি ব্যক্তিগতভাবে ডেকেছিলাম। সবার জন্য ফ্লোরটা উন্মুক্ত ছিল, যাতে তারা নিজেদের মতো করে কথা বলতে পারেন। সেদিন দেড়শর মতো একেবারেই অপরিচিত ফেসবুক বন্ধু উপস্থিত ছিলেন। তারা কথা বলেছেন, সবাই না হলেও প্রায় ৩০ জনের মতো। মজার ব্যাপার হচ্ছে, যারা কথা বলেছেন শুরু থেকেই তারা আমাকে ও রাজনীতিকে কেন্দ্র করে এবং একটা পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষায় কথা বলেছেন। তাদের সবাই বর্তমান রাজনৈতিক, সামাজিক ব্যবস্থায় বিক্ষুব্ধ এবং পরিবর্তন চান। আমার কাছে জানতে চেয়েছেন পরিবর্তন কীভাবে সম্ভব। আমি টেলিভিশনের টকশোতে এবং পত্রপত্রিকায় লেখালেখিতে যে বিষয়গুলো বলি বা লিখি, বোঝা যায় সেই বিষয় থেকে সবকিছু তারা পরিষ্কার হতে পারেননি। তাদের মধ্যে অনেক আগ্রহী-মনোযোগী পাঠক ও দর্শক আছেন তারাও প্রশ্ন তুলেছেন এটার বাস্তবতা কতখানি। গত সংখ্যায় 'বিকল্প রাজনীতি অনাগত নয়' এই শিরোনামে আমার লেখা প্রকাশ হওয়ার পরে এক মহিলা পাঠক আমাকে প্রশ্ন করেছিলেন, আপনি কি সত্যি বিশ্বাস করেন মানুষ আওয়ামী লীগ-বিএনপির বিকল্প হিসেবে অন্য কোনো শক্তিকে ভোট দেবে? এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। স্বাধীনতার পর থেকে এই ৪১ বছরে (হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের সময় বাদ দিলে) যতগুলো গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হয়েছে তাতে তো মানুষ এ দুই দলের পক্ষে বা বিপক্ষেই ভোট দিয়েছে। এরশাদ বা জামায়াতকে মানুষ ভোট দেয়, কিন্তু আওয়ামী লীগ, বিএনপির তুলনায় সেটা ধর্তব্যের মধ্যে আসে না। সেখানে একেবারে বিকল্প রাজনীতি? প্রশ্নটা অবশ্যই যুক্তিসঙ্গত। আমার ফেসবুক বন্ধুদের আমি সে কথা বলেছিলাম। আমি বলেছিলাম, অক্টোবর বিপ্লবের কথা। আমরা জানি, সেখানে অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতার পরিবর্তন হয়েছে। যারা অভ্যুত্থান করেছেন তারা ক্ষমতায় গেছেন। কিন্তু আমাদের দেশে '৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান থেকে শুরু করে সর্বশেষ মিসরের তেহরির স্কোয়ারের অভ্যুত্থান পর্যন্ত যদি আমরা দেখি তাহলে অভ্যুত্থানের মাধ্যমে যারা ক্ষমতায় ছিলেন স্বেচ্ছাচারী, স্বৈরাচারী তারা পদত্যাগে বাধ্য হয়েছেন। কিন্তু পরবর্তী সরকার গঠনের জন্য নির্বাচনে যেতে হয়েছে। বাংলাদেশেও যদি কেউ পরিবর্তন করার কথা ভাবেন তাহলে তাকে নির্বাচনের মাধ্যমেই যেতে হবে, এর বিকল্প নেই। নির্বাচন নিয়ে দেশের মধ্যে অনেক বিতর্ক আছে, অনিশ্চয়তা আছে। যেনতেন নির্বাচন হলেই যে একটি পরিবর্তন ইতিবাচক অর্থে সূচিত হবে এমন কোনো কথা নেই। কারণ সেই নির্বাচনটা সবার কাছে গ্রহণযোগ্য হতে হবে। নির্বাচনটা সুষ্ঠু-স্বচ্ছ হবে, সেটি একটি আবশ্যিক শব্দ। আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি সুষ্ঠু, স্বচ্ছ, নিরপেক্ষ এবং সবার কাছে গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের কোনো বিকল্প নেই। গণতন্ত্র প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখার জন্য সেটা করতে হবে। কিন্তু তারপরও কথা আছে, সেটা বিশেষ করে মিসরের সর্বশেষ পরিস্থিতি থেকে আমরা শিখতে পারি। অভ্যুত্থান হয়েছে, সরকার পরিবর্তন হয়েছে, নির্বাচন হয়েছে, সেই নির্বাচনে প্রধানত মুসলিম ব্রাদারহুড জয়লাভ করেছে, মুরসি সেখানকার প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন। সেই মুরসিকে কেন্দ্র করেই এখন সেখানে বিতর্ক; কারণ মুরসি গণতান্ত্রিকভাবে এগুচ্ছেন_ সেরকম মনে হয় না। মিসরে এরকম হলো কেন তার কারণ হিসেবে একটি কথাই বলা যায়, হোসনি মোবারক এবং মুসলিম ব্রাদারহুডের বাইরে জনগণের কাছে আর কোনো বিকল্প ছিল না। অতএব, লাখো জনতা দীর্ঘদিন ধরে লাগাতার সংগ্রাম করলেও সেখানে সত্যিকার অর্থে জনগণের সংগঠিত শক্তি গড়ে ওঠেনি। সংসদীয় গণতন্ত্র মানেই হচ্ছে দলের শাসন। রাজনৈতিক দল থাকবে, সেই দলগুলো নির্বাচন করবে আর সেই নির্বাচনে যারা বেশি ভোট পাবেন তারা পরবর্তী পাঁচ বছরের জন্য নির্বাচিত হবেন। সেই পাঁচ বছর তারা কীভাবে দেশ শাসন করবেন, যারা সংখ্যাগরিষ্ঠ হতে পারেননি অথচ সমর্থনের দিক থেকে উল্লেখযোগ্য বা এমনি যে নাগরিক আছেন তাদের কোন বিবেচনায় নিয়ে শাসনকার্য চালাবেন সেই আলোচনা এখানে আমি তুলছি না। কথা উঠেছে বাংলাদেশে দুটি দল যারা পালাক্রমে প্রায় তিন দশক দেশ শাসন করেছেন, তারা জনগণকে সন্তুষ্ট করার মতো, দেশের কল্যাণ করার মতো সে ধরনের উল্লেখযোগ্য সাফল্য দেখাতে পারছেন না। অতএব, এ দুই দলের বাইরে আরেকটি রাজনৈতিক শক্তি গড়ে উঠতে পারে কিনা? বিকল্প রাজনীতি বা তৃতীয় শক্তি এভাবেই একটা বর্তমানে বহুল ব্যবহৃত আলোচিত শব্দ হয়েছে। যদিও কেউ কেউ এটাকে কদর্থ করার চেষ্টা করেছেন যে, বিকল্প শক্তি মানেই সামরিক বাহিনী। একটা অদ্ভুত কথা, এ প্রসঙ্গে না বলে পারছি না। বিগত যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছিল তাকে অনেকেই বলতেন সামরিক বাহিনী সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার। এমন সরকার কি আছে যারা সামরিক বাহিনীর সমর্থনপুষ্ট নয়? যেমন বর্তমান সরকার। আগে যখন বিএনপি ক্ষমতায় ছিল সেই সরকার? সামরিক বাহিনী যদি তাদের পছন্দ না করে তাহলে সেই সরকার দেশ চালাবে কী করে? সামরিক বাহিনীর সমর্থন থাকতেই হবে। সামরিক বাহিনীর সমর্থন থাকা মানেই সামরিক শাসন প্রতিষ্ঠিত করা নয়। তৃতীয় শক্তি মানে তাই সামরিক শক্তি নয়, একটি রাজনৈতিক শক্তি। প্রশ্ন হচ্ছে, এতগুলো দল থাকা সত্ত্বেও কি সেই শক্তি গড়ে উঠতে পারে? ব্যাপারটা নিশ্চয়ই সহজ নয়। বিলাসিতা করার জন্য নিশ্চয়ই কেউ এরকম কথা বলছেন না। আওয়ামী লীগ বা বিএনপি যদি সঠিকভাবে, গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে দল ও দেশ চালাতে পারে তবে সেটাই সবচেয়ে খুশির বিষয়। আর যদি তা চালাতে না পারে তখনই আসবে বিকল্পের প্রশ্ন, সেটা যত দুরূহই হোক না কেন। কীভাবে হতে পারে সেটা? এক হতে পারে একেবারেই আরোহী পদ্ধতি, নিচে থেকে ধীরে ধীরে দল গড়ে উঠবে, যেমন পাকিস্তানের ইমরান খান গড়ে তুলেছেন কিংবা ভারতে বিজেপি তার যাত্রা শুরু করেছিল। আরেকটা হতে পারে, যেহেতু ব্যাপক মানুষের মধ্যে এই আশঙ্কাটা তীব্র মনে হচ্ছে। অতএব, আগামী নির্বাচনে দেশজুড়ে যাদের ৩০০ আসনে মানুষ পছন্দ করে সেই উন্নয়নের প্রার্থী খুঁজে বের করা, যারা গ্রহণযোগ্য এবং সক্ষম। সক্ষম বলতে আমি বোঝাচ্ছি, যেহেতু কোনো রাজনৈতিক দল এখানে নেই, নাগরিকদের মধ্যে থেকে এ উদ্যোগটা আসছে, সেই নাগরিক যিনি প্রার্থী হতে চাইবেন তার যেন নির্বাচন করার মতো শক্তি-সামর্থ্য থাকে এটা দেখতে হবে। সেভাবে যদি নির্বাচন করে আসতে পারেন তাহলে সেটা একটা পদ্ধতি হতে পারে। এ কথাগুলো আমি ওই আড্ডায় বলেছিলাম। পত্র-পত্রিকাগুলো লিখেছে আমি ৩০০ আসনে প্রার্থী খুঁজছি। কথাটার মধ্যে একটু সংযোজন করা ভালো। সেটা হচ্ছে আমি প্রার্থীর খোঁজে মাঠে নামিনি। কিন্তু আমি এ কথা বলেছি যে, এ দুটি দলের বাইরে যদি তৃতীয় রাজনৈতিক শক্তি গঠন করতে হয় তাহলে নাগরিকরা সবাই মিলে হোক, এই নাগরিকদের উদ্যোগের সঙ্গে আর যেসব রাজনৈতিক দল আছে একরকম করে ভাবেন তারা মিলে হোক সত্যি সত্যি সৎ, যোগ্য প্রার্থীদের মাঠে নামান, কাজ করুক, যেন তারা নির্বাচনটা মোকাবিলা করতে পারেন। এখানেই উক্ত মহিলা প্রশ্ন তুলেছেন, বড় দুটি দলের ঝড়ো হাওয়ার সামনে এই 'তৃতীয় শক্তি' কি দাঁড়াতে পারবে। তারা কি জিততে পারবে? অথবা ভালো কোনো ফলাফল করতে পারবে? এ প্রশ্নের বাস্তব কোনো জবাব তো হতে পারে না, যতক্ষণ পর্যন্ত না সেরকম একটি বাস্তব ঘটনা না ঘটে। এখন যা বলব তা হবে অনুমাননির্ভর, কল্পনাপ্রসূত। '৫৪-তে যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে যা হয়েছিল তা তো কেউ ভাবতেই পারে না। এখন কি সেরকম হতে পারে? আমি মনে করি, বস্তুগতভাবে সে পরিস্থিতি বিরাজ করছে। কিন্তু সাংগঠনিক প্রস্তুতি নেই। আমি সেই প্রস্তুতি নিতে বলছি। ফলাফল যাই হোক, যাত্রাটা শুরু হওয়া উচিত। রাজনীতিতে কেউ ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারে না। কিন্তু ভিশন থাকতে হয়। '৫৪-তে হক-ভাসানী-সোহরাওয়ার্দী এক হয়েছিলেন। এখনো কেন্দ্রে সেরকম একটা ছাতা তৈরি হতে হবে, যার প্রতি মানুষ অধিকতর আস্থাশীল হতে পারে। লেখা শেষ করার আগে বলছি, এটা যেহেতু আড্ডা ছিল তাই এর মধ্যে বক্তৃতা, ঠাট্টা, হাসি, তামাশা, রসিকতাসহ অনেক কিছুই হয়েছে। আমাদের দেশের গণতান্ত্রিক পদ্ধতি কেমন, আমাদের দেশের মহিলারা মূল নেতৃত্বে আছেন, প্রধানমন্ত্রী মহিলা হওয়া সত্ত্বেও ধর্ষণ এত বাড়ছে কেন ইত্যাদি। মহিলা নেতৃত্ব সম্পর্কে কথা বলতে গিয়ে আমি কিছু কথা বলেছি কিন্তু কোনোভাবেই সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের নাম আমি উচ্চারণ করিনি। কোনো কোনো পত্রিকা বিশেষত বাংলাদেশ প্রতিদিন সেটা ভুলবশত প্রকাশ করেছে। সৈয়দ আশরাফুল ইসলামকে আমি একজন ভদ্রলোক মনে করি, কারও ক্ষতি তিনি করেন আমি সেটা মনে করি না। সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম কতখানি যোগ্য সাধারণ সম্পাদক সেটা আমি জানি না, কিন্তু তিনি কাজ করলে করতে পারেন। তাকে কোনোভাবেই তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করার যোগ্যতা আমার নেই। লেখক : রাজনীতিক, আহ্বায়ক নাগরিক ঐক্য ই-মেইল : [email protected]

সর্বশেষ খবর