বুধবার, ১৬ জানুয়ারি, ২০১৩ ০০:০০ টা
খোলা কলাম

২০১৩ : প্রত্যাশা ও শঙ্কা

মেজর জেনারেল এ কে মোহাম্মাদ আলী শিকদার, পিএসসি (অব.)

২০১৩ : প্রত্যাশা ও শঙ্কা
এ বছরের ৬ জানুয়ারি আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে বর্তমান মহাজোট সরকারের চার বছর পূর্ণ হলো। ব্যক্তিজীবনের চাওয়া-পাওয়ার সঙ্গে রাষ্ট্রীয় ঘটনার প্রভাব সম্পর্কে বাংলাদেশের মানুষ আগের যে কোনো সময় থেকে এখন অধিকতর সচেতন। সুতরাং সঙ্গত কারণে বছরের শুরুতে বিগত চার বছরের সরকার ও বিরোধী দলের কর্মকাণ্ড নিয়ে সব শ্রেণীর মানুষের মধ্যে আলোচনা, সমালোচনা, বিচার-বিশ্লেষণ ছিল তুঙ্গে। বলা যায় বছরজুড়ে তা অব্যাহত থাকবে। কারণ এ বছরের শেষদিকে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। সরকারের চার বছর পূর্তি উপলক্ষে দেশের কয়েকটি দৈনিক পত্রিকা নিজেদের মতো জরিপ চালিয়ে মানুষের মতামত সংগ্রহ করে তার ফল প্রকাশ করেছে। ইতোমধ্যে এসব জরিপের গ্রহণযোগ্যতার মাত্রা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। কারণ তৃতীয় বিশ্বের জরিপকারীদের দক্ষতা, অভিজ্ঞতা এবং পেশার নিরপেক্ষতা এখনো প্রশ্নবিদ্ধ। পত্রিকায় এ মর্মে খবর বেরিয়েছে কোনো কোনো জরিপকারী নিজেদের এজেন্ডা ও পছন্দের প্রশ্নমালা দিয়ে জরিপের কাজ চালিয়েছেন। তবে যারা রিপোর্টগুলো পড়েছেন এবং জরিপের 'বিটুইন দ্য লাইন' বা অন্তর্নিহিত তথ্য ও কথাগুলোকে উদ্ঘাটন করতে পেরেছেন তারা বাস্তবতার কাছাকাছি একটা চিত্র এখান থেকে পেলেও পেতে পারেন। বিদেশে কিছু নামকরা প্রতিষ্ঠিত জরিপকারী সংস্থা আছে। তারা পৃথিবীতে জরিপের কাজ করে। এর মধ্যে পুওর অ্যান্ড স্ট্যান্ডার্ড, মুডিস এবং গ্যালাপ ২০১২ সালের বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবস্থার ওপর জরিপ চালিয়ে তার ফল প্রকাশ করেছে। এ তিনটি সংস্থার প্রকাশিত রিপোর্টগুলোর দিকে তাকালেও বর্তমান সরকারের সাফল্য-ব্যর্থতার একটা চিত্র বোঝা যায়। বাংলাদেশের মতো একটি স্বল্পোন্নত (এলডিসিভুক্ত) দেশ, যার লোকসংখ্যা প্রায় ১৬ কোটি, গরিষ্ঠ মানুষ অশিক্ষিত, অর্ধশিক্ষিত এবং ধনিক শ্রেণী উঠতি পুঁজির সংক্রামক ব্যাধির আক্রমণে যে কোনো উপায়ে পুঁজি সংগ্রহের মোহে নৈতিকতার সব বস্ত্র ঝেড়ে ফেলেছে, সে দেশের যে কোনো সরকারের পক্ষে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের সন্তুষ্টি অর্জন করা অত্যন্ত কঠিন কাজ। কারণ সম্পদের অপ্রতুলতা ও ঘরে-বাইরের বহুমুখী চাপ ও সীমাবদ্ধতার কারণে মানুষের ক্রমবর্ধমান চাহিদার সঙ্গে সরকারের ডেলিভারির সামঞ্জস্যতা থাকে না, সব সময়ই ঘাটতি থাকে। ফলে মানুষের মধ্যে সরকারবিরোধী একটা মনোভাব বিরাজ করা সব স্বল্পোন্নত ও উন্নয়নশীল দেশের জন্য কমন বিষয়। অন্যদিকে শ্রেণী দ্বন্দ্ব প্রতিক্ষেত্রেই প্রকট আকারে বিদ্যমান। উৎপাদনকারী ও ক্রয়কারী, সেবা প্রদানকারী ও গ্রহণকারী, মালিক-শ্রমিক সব ক্ষেত্রেই থাকে বিপরীতমুখী আকাঙ্ক্ষা ও প্রত্যাশা। আর প্রকৃতির অমোঘ নিয়মের কারণেই মানুষের চাহিদার কোনো শেষ নেই। চাহিদা না থাকলে পৃথিবী অচল ও স্থবির হয়ে যেত। আবার চাহিদা থেকে সৃষ্টি হয় প্রত্যাশার। অর্থনীতিবিদ এ এইচ মাসলোর থিওরি অনুসারে একজন মানুষের একটি প্রত্যাশা পূর্ণ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মনুষ্য সহজাত কারণেই তার ভেতরে আরও একটা উচ্চ স্তরের প্রত্যাশার সৃষ্টি হয় এবং পরবর্তীতে যে কোনো ঘটনায় তার প্রতিক্রিয়া হয় নতুন প্রত্যাশার যোগ-বিয়োগের হিসাব মতে। তাই একটা সরকারের এক মেয়াদের পারফরম্যান্স বা কর্মকাণ্ড বিচার করতে হলে তা অবশ্যই অব্যবহিত আগের সরকারের সঙ্গে তুলনা করে একটা তুলনামূলক চিত্র তুলে ধরা উচিত। সরকারের পারফরম্যান্সের ওপর প্রভাব বিস্তারকারী অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি কোনো সরকারের সময় কতখানি অনুকূল ও প্রতিকূল ছিল তাও একই সঙ্গে উল্লেখ করা জরুরি। এই তুলনামূলক চিত্র আমাদের পত্রিকাগুলোর জরিপে বা কোনো রিপোর্টর্ে পরিষ্কারভাবে ফুটে ওঠেনি। বিদেশি জরিপকারী সংস্থাগুলো নির্ধারিত সূচকসমূহের বর্তমান যে অবস্থান তুলে ধরেছেন সেখানে তুলনামূলক চিত্র না থাকাটাই স্বাভাবিক। কিন্তু দেশীয় জরিপকারীরা তা তুলে ধরলে সাধারণ মানুষের পক্ষে দুই প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী দলের রাষ্ট্র পরিচালনার সক্ষমতা, দক্ষতা এবং সাফল্য-ব্যর্থতার তুলনামূলক বিচার করা সহজ হতো। সেটা হলে আলোচনা, সমালোচনা অর্থবহ ও সার্থক হয়। দেশ এবং জাতি উপকৃত হয়। তবে যারা বিগত বিএনপি-জামায়াত সরকারের ২০০১-২০০৬ মেয়াদের পারফরম্যান্স সূচকগুলোকে মনে রেখেছেন তাদের জন্য তুলনা করাটা কঠিন হবে না। আগেই বলেছি, দিন দিন বাংলাদেশের মানুষের রাজনৈতিক সচেতনতা বাড়ছে। তারা নির্বাচনের সময় সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে কখনো ভুল করেনি। তাই প্রত্যাশা পূরণের বিবেচনায় অনেকেরই অসন্তুষ্টি আপাতত থাকতে পারে, তবে ভোটের সময় তারা দুই দিকে তাকিয়ে ও হিসাব করেই ভোট দেবেন, যা আগেও দেখা গেছে। কিন্তু শঙ্কা হলো, গণতন্ত্রের যাত্রা আবার আগের মতো বাধাগ্রস্ত হবে কিনা। মানুষের ভোটের অধিকার এর আগে একাধিকবার নস্যাৎ করা হয়েছে। ষড়যন্ত্র হয়েছে, আবার সে ষড়যন্ত্র ব্যর্থও হয়েছে। এ বিষয়ে সবার সতর্ক থাকা প্রয়োজন। গণতন্ত্রের চলমান পথে একটি ক্ষমতাসীন সরকারের মেয়াদ শেষে পরবর্তী সরকার, সেটি তত্ত্বাবধায়ক, অন্তর্বর্তীকালীন বা নির্বাচিত একই দলের বা বিপরীত দলের হোক, তাদের কাছে শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর একটা গুরুত্বপূর্ণ ক্রান্তিকাল। ১৯৯৬ ও ২০০৬ সালে বিএনপি দু-বারই তাতে অক্ষম হয়েছে। ২০০১ সালে আওয়ামী লীগ তা সুষ্ঠুভাবে করেছে। এবার আবার আওয়ামী লীগের সক্ষমতা মানুষ দেখার অপেক্ষায়। ২০০১-২০০৬ মেয়াদের বিএনপি ও ২০০৯-২০১২ পর্যন্ত আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে বিরাজমান অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি, যা সরকারের পারফরম্যান্সের ওপর প্রভাব বিস্তার করে তার কোনটি কোন সময়ে কতটুকু অনুকূল ও প্রতিকূল ছিল তা নিবন্ধের পরিসরে বিস্তারিতভাবে তুলে ধরা সম্ভব নয়। তবে এটুকু বলা যায়, সব পরিস্থিতির সূচক আগের তুলনায় বর্তমানে বেশি প্রতিকূল। ২০০৭-২০০৮ মেয়াদের জরুরি আইনের সরকার অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতিকে বর্তমান সরকারের জন্য আরও জটিল ও প্রতিকূল করে রেখে যায়। খাদ্য ও কৃষি খাতে বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে বড় কোনো অভিযোগ নেই। প্রায় ৩০ লাখ টন ঘাটতি নিয়ে শুরু করলেও দেশ এখন খাদ্যে প্রায় স্বয়ংসম্পূর্ণ। গত বিএনপি সরকার ২০০১ সালে খাদ্যে প্রায় স্বয়ংসম্পূর্ণতা নিয়ে যাত্রা শুরু করে ২০০৬ সালে যাওয়ার সময় ৩০ লাখ টন খাদ্য ঘাটতি রেখে যায়। ওই সময় উত্তরবঙ্গের মঙ্গাকবলিত মানুষকে তৎকালীন অর্থমন্ত্রী প্রয়াত সাইফুর রহমান ভাতের বদলে কপি খাওয়ার উপদেশ দিয়েছিলেন। বর্তমানে মঙ্গা বলতে কিছু নেই। খাদ্যদ্রব্যের ঊধর্্বগতির রোষানলে তৎকালীন বাণিজ্যমন্ত্রী আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী মন্ত্রিত্ব হারিয়েছিলেন। শিক্ষা খাতে বর্তমান সরকারের অর্জন এখন সব বিতর্কের ঊধের্্ব। সব জরিপে এই খাতকে একশত নম্বরের ভেতরে সবাই নব্বইয়ের উপরে নম্বর দিয়েছেন। সবার কাছে গ্রহণযোগ্য একটি আধুনিক, বিজ্ঞানসম্মত এবং দেশপ্রেমের চেতনায় সমৃদ্ধ শিক্ষানীতি গৃহীত হয়েছে এবং দ্রুত তা বাস্তবায়িত হচ্ছে। এই শিক্ষানীতির আলোকে প্রকৃত শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে এখনকার স্কুল-কলেজের ছেলে-মেয়েরা যখন কর্মক্ষেত্রে সুদৃঢ় অবস্থানে পেঁৗছবে তখন রাষ্ট্রীয় অঙ্গনের সব জায়গায় এখন যেসব অনাচার ও অনৈতিকতা জেঁকে বসেছে তা ক্রমান্বয়ে দূর হতে থাকবে। রাষ্ট্রের মৌলিক ভিত্তি শক্তিশালী হবে। গত বিএনপি সরকারের আমলে বিজ্ঞান ও অংকের মতো আধুনিক বিষয়ের গুরুত্বকে খাটো করে ধর্মীয় শিক্ষাকে প্রাধান্য দিয়ে একটা শিক্ষানীতি প্রণয়নের চেষ্টা করা হয়েছিল। কিন্তু কিছু সাহসী শিক্ষাবিদ ও তরুণ প্রজন্মের প্রতিবাদের মুখে তৎকালীন বিএনপি সরকার তা বাতিল করতে বাধ্য হয়। বিদ্যুৎ খাতে বর্তমান সরকার ১০-১২ ঘণ্টা লোডশেডিং নিয়ে যাত্রা শুরু করে। এখন তা দুই ঘণ্টায় নামিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছে। কুইক রেন্টাল নিয়ে ভালো-মন্দ অনেক সমালোচনা আছে। তবে দ্রুত বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়ানো না গেলে আজ বিদ্যুৎ পরিস্থিতি কত ভয়াবহ হতো তা যেমন চিন্তার বিষয়, তেমনি এত দ্রুত, মাত্র সাড়ে তিন বছরের মাথায় সাড়ে তিন হাজার মেগাওয়াট নতুনভাবে উৎপাদনে যোগ করার জন্য অন্য কোনো বিকল্প পন্থা সরকারের কাছে ছিল কিনা তাও বিবেচনা করা দরকার। বিএনপি তাদের পাঁচ বছরে (২০০১-২০০৬) এক মেগাওয়াট বিদ্যুৎও নতুনভাবে উৎপাদনে আনতে পারেনি। বিএনপির সময়ের প্রথম বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী ইকবাল মাহমুদ ব্যর্থ হয়ে পদত্যাগ করলে নতুন বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী হয়েছিলেন জেনারেল আনোয়ারুল কবির তালুকদার। ব্যর্থতার জন্য হাওয়া ভবনের দিকে আঙ্গুল তুলে তিনিও ছয় মাসের মাথায় পদত্যাগ করেছিলেন। আইসিটি বা তথ্য-প্রযুক্তির ক্ষেত্রে দেশের সাধারণ মানুষ, নতুন প্রজন্মের বাঙালিরা ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার অসামান্য উৎসাহ-উদ্দীপনা নিয়ে কাজ করছে। মোবাইল, ইন্টারনেট এবং অনলাইন কার্যক্রমের ব্যাপক প্রসার ও বিস্তার ঘটেছে বিগত চার বছরে। অথচ গত বিএনপি-জামায়াত সরকারের সময় এই খাতটি ছিল অবহেলিত ও স্থবির। অনলাইনে আউট সোর্সিংয়ের মাধ্যমে কাজ করে এ দেশের একশ্রেণীর নবীন ছেলে-মেয়ে প্রায় ২০০ কোটি ডলার আয় করেছে শুধু ২০১২ সালে। এই ধারা অব্যাহত থাকলে আগামী কয়েক বছরের মধ্যে এ খাতে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের অন্যতম বৃহৎ খাত হিসেবে আবির্ভূত হবে। যুদ্ধাপরাধী বিচারের জন্য দৃঢ় পদক্ষেপকে এই সরকারের অন্যতম সাফল্য হিসেবে দেখছেন দেশের মানুষ। দেশি-বিদেশি সব জরিপে দেখা যায় বাংলাদেশের ৭৫ ভাগ মানুষ যুদ্ধাপরাধীদের কঠোর শাস্তি দেওয়ার পক্ষে। এই জায়গায় বিএনপির অবস্থান সম্পূর্ণ বিপরীত। দেশি-বিদেশি সব জরিপের রেজাল্টে দেখা যায় বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সেক্টরের সব সূচক আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে এখন ভালো অবস্থানে আছে। আন্তর্জাতিক জরিপ সংস্থা গ্যালাপ-এর ২০১২ সালের রিপোর্ট অনুযায়ী অর্থনৈতিকভাবে বাংলাদেশের ৩৮ ভাগ মানুষ মোটামুটি ভালো, ৩৭ ভাগ ভালো এবং ৩ ভাগ অত্যন্ত ভালো আছে (ডেইলি স্টার, ৩ জানুয়ারি, ২০১৩)। অর্থাৎ প্রায় ৭৮ ভাগ মানুষ এক্ষেত্রে সন্তোষ প্রকাশ করেছে। জঙ্গি দমনে সরকারের সাফল্য এবং অনমনীয় অবস্থানের ফলে বিশ্বে বাংলাদেশের গ্রহণযোগ্যতা বেড়েছে। দীর্ঘ ৪০ বছর পর বঙ্গোপসাগরের জলসীমার ওপর নিরঙ্কুশ অধিকার প্রতিষ্ঠিত হওয়া বাংলাদেশের এযাবৎকালের সেরা অর্জন। রাষ্ট্রের মৌলিক ভিত্তিকে শক্তিশালী করার জন্য গঠিত হয়েছে তথ্য কমিশন ও মানবাধিকার কমিশন। এতদসংক্রান্ত আইনও প্রণয়ন করা হয়েছে। এগুলো রাষ্ট্রের অগ্রযাত্রার পথে সুদূরপ্রসারী পদক্ষেপ। দুর্নীতি দমন কমিশন এখনো মানুষের প্রত্যাশার অনেক পেছনে আছে। তারা দুর্নীতির বিস্তার রোধে সক্ষম হয়নি। কিন্তু বিএনপির আমলে বিচারপতি সুলতান উদ্দিন হোসেন ও অধ্যাপক মনিরুজ্জামান মিয়াকে নিয়ে গঠিত কমিশনের কথা মনে হলে পার্থক্যের জায়গাটি বুঝা যায়। বর্তমান সরকার সবচেয়ে বিরূপ সমালোচনার মুখে পড়েছে পদ্মা সেতু নিয়ে। এ প্রসঙ্গে বিশ্বব্যাংকের ঋণ দেওয়া না দেওয়া নিয়ে সরকারের অবস্থানের পক্ষে-বিপক্ষে বিস্তর লেখালেখি এবং আলোচনা-সমালোচনা হয়েছে। কিন্তু 'এন্ড রেজাল্ট' হলো মূল সেতু নির্মাণের কাজ এখনো শুরু হয়নি। বর্তমান সরকারের ওপর মানুষের যে অসন্তুষ্টি আছে তার প্রধান কারণ পদ্মা সেতু, শেয়ার বাজারের বিশৃঙ্খলা এবং সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডের সুরাহা করতে না পারা। দ্বিতীয়ত, একটি অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনায় মানুষ যত না নাখোশ হয়েছে, তার চেয়ে ঘটে যাওয়া ঘটনা সম্পর্কে কতিপয় মন্ত্রীর বেমানান, বালকসুলভ বেফাঁস ও অসামঞ্জস্যপূর্ণ কথা এবং বক্তব্য মানুষকে অনেক বেশি হতাশ করেছে। তৃতীয়ত, ছাত্রলীগের নামে যে রকম উচ্ছৃঙ্খলতার খবর প্রায় প্রতিনিয়ত খবরের কাগজে ছবিসহ আসছে তাতে মনে হয় সরকারি দলের জনসমর্থনকে পেছন থেকে টেনে নামিয়ে দেওয়ার জন্য সুপরিকল্পিত কোনো চক্রান্ত এক্ষেত্রে কাজ করছে। ডেসটিনি ও হলমার্কের ঘটনায় এবং বিশ্বজিৎ হত্যাকাণ্ডে মানুষ প্রথমদিকে বিরূপ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করলেও সরকারের পক্ষ থেকে শক্ত আইনি ব্যবস্থা নেওয়ায় নেতিবাচক সমালোচনা এখন কমে গেছে। ক্ষমতাসীন সরকারের কর্মকাণ্ড যেমন_ রাজস্ব, বিদ্যুৎ, জ্বালানি, শিক্ষা, কৃষি, খাদ্য, অর্থনীতি, বৈদেশিক নীতি ও ব্যবসা-বাণিজ্যসহ সব কর্মনীতির ভালো-মন্দের দিক উল্লেখপূর্বক প্রতিক্ষেত্রের জন্য বিকল্প কর্মপন্থা জনগণের কাছে কতটুকু গ্রহণযোগ্যভাবে তুলে ধরতে পেরেছে তার ওপর ভিত্তি করেই বিরোধী দলের সাফল্য-ব্যর্থতাকে বিচার করা হয় গণতান্ত্রিক বিশ্বে। একই সঙ্গে আগে তারা যখন সরকারে ছিল তখন প্রতিটি ক্ষেত্রে কতটুকু কি করতে পেরেছিল এবং যা পারেনি, তা কেন পারেনি সে ব্যাখ্যা দিলে মানুষ তুলনামূলক বিচার করতে সক্ষম হয়। কারণ 'মানুষ কি করতে পারে, তার একমাত্র সূত্র সে কি করেছে'। বিএনপি গত চার বছরে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুনর্বহালের জন্য, বেগম খালেদা জিয়া এবং তারেক-কোকোর দুর্নীতি মামলা বাতিলের জন্য অনেক আন্দোলন-সংগ্রাম ও হরতাল করেছে। কিন্তু উপরোক্ত রাষ্ট্রীয় কর্মকাণ্ড, যা প্রকৃত জনকল্যাণ সম্পর্কিত সে বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো কর্মপন্থা তুলে ধরেনি। দেশীয় পত্রিকার জরিপের ফল অনুসারে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ওপর মানুষের আস্থা ও জনসমর্থন বেড়েছে; পক্ষান্তরে বিরোধীদলীয় নেতা বেগম খালেদা জিয়ার বেলায় তা কমে গেছে। ২০১২ সালের গ্যালাপ কর্তৃক জরিপের রিপোর্টে দেখা যায়, প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শেখ হাসিনার ওপর মানুষের প্রবল আস্থা এখনো বিদ্যমান। সাফল্য-ব্যর্থতা মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ। এটাই গণতন্ত্র। এভাবেই দেশ ক্রমশ সামনের দিকে এগুবে। তাই নতুন বছরকে ঘিরে মানুষের প্রত্যাশার জায়গা আপাতত দুটি। প্রথমত, মানুষ যুদ্ধাপরাধীদের বিচার সুসম্পন্ন ও তার রায় দ্রুত কার্যকর হয়েছে তা দেখতে চায়। এর মাধ্যমে রাষ্ট্র কলঙ্কমুক্ত হবে। একই সঙ্গে বাংলাদেশের রাজনীতিকে কলুষমুক্ত করার জন্য এটা হবে একটা টার্নিং পয়েন্ট। কিন্তু এখানে বড় আশঙ্কাটি হলো, জামায়াত-শিবির আরও ভয়ঙ্কর হবে এবং ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞে নামবে। এখানে বিএনপির ভূমিকা কি হবে তা মানুষ দেখার অপেক্ষায়। আর সরকার জামায়াত-শিবিরের উচ্ছৃঙ্খলতাকে কত শক্ত ও দক্ষভাবে হ্যান্ডেল করতে পারবে তাও দেখার বিষয়। দ্বিতীয় প্রত্যাশাটি হলো, বছরান্তে অনুষ্ঠিতব্য সাধারণ নির্বাচনটি যেন সবার অংশগ্রহণে অবাধ ও সুষ্ঠু হয়। সব পক্ষেরই আপস ও সমঝোতার মনোভাব থাকা চাই। হরতাল, ভাঙচুর নয়। নির্বাচন কমিশন যে কোনো সময়ের চেয়ে এখন অনেক স্বাধীন ও শক্তিশালী। বিএনপি তত্ত্বাবধায়ক ইস্যু নিয়ে যত আন্দোলন-সংগ্রাম করেছে, তার সিকি ভাগ যদি নির্বাচন কমিশন আরও শক্তিশালী কীভাবে করা যায় তার ওপর কাজ করত, তাহলে হয়তো তত্ত্বাবধায়কের বিকল্প একটা পন্থা এতদিনে বের হতো। একই সঙ্গে প্রমাণিত হতো বিএনপি হট্টগোল নয়, প্রকৃত একটা সুষ্ঠু নির্বাচন চায়। লেখক : নিরাপত্তা বিশ্লেষক ই-মেইল :[email protected]

সর্বশেষ খবর