বুধবার, ১৬ জানুয়ারি, ২০১৩ ০০:০০ টা
প্রসঙ্গক্রমে

বাংলাদেশের গত চার বছর

মহিবুল ইজদানী খান ডাবলু

সম্প্রতি পত্র-পত্রিকায় বাংলাদেশে বর্তমান সরকারের চার বছর ক্ষমতায় থাকার নানা অবস্থান তুলে ধরা হয়েছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই বড় বড় করে সরকারের মন্দ দিকটাই নানাভাবে প্রকাশ করা হয়েছে। বাংলাদেশের রাজনীতিতে এটা কোনো নতুন বিষয় নয়। আমরা যদি অতীতের দিকে লক্ষ্য করি তাহলে দেখা যায়, যে দল যখন ক্ষমতায় আসে সে শুধু দেশের খারাপ কাজই করে। সরকার যে কোনো ক্ষেত্রে ভালো কাজ করতে পারে কিংবা করে যাচ্ছে তা কখনো দেশের মিডিয়া বা রাজনৈতিক দলগুলো থেকে বলা হয় না। অর্থাৎ বাংলাদেশের রাজনীতিবিদরা কিংবা অনেকক্ষেত্রে কিছু কিছু সাংবাদিকও ভালোকে ভালো আর মন্দকে মন্দ বলতে ইচ্ছা প্রকাশ করেন না। তার মানে দাঁড়াল, বাংলাদেশে এ পর্যন্ত সব ক্ষমতাসীন সরকার কোনো সময়ই কোনো কিছু ভালো করেনি। তারা শুধু খারাপ কাজই করে গেছে। বর্তমান সরকারের আমলে দেশে কোনো ভালো কাজই হয়নি এমন কথা কি জনগণ বিশ্বাস করবে, এ কথা কি বিশ্বাস করা যায়? বর্তমান সরকারের আমলে সবচেয়ে বড় অর্জন ছিল জঙ্গি দমন। এ ছাড়া অর্থনৈতিক উন্নতি, বিজ্ঞান-প্রযুক্তি, সমাজ-শিক্ষা-সংস্কৃতি, কৃষি, ক্রীড়া ও পররাষ্ট্রনীতি ইত্যাদি ক্ষেত্রে বর্তমান সরকারের অবশ্যই সফলতা আছে। কিন্তু এসব সফলতার কথা কখনই বিরোধী দল থেকে বলা হয়নি। সরকার থেকে দেশের স্কুল ছাত্রছাত্রীদের বিনামূল্যে বই বিতরণের ঘটনা বাংলাদেশের ইতিহাসের পাতায় এক উজ্জ্বল ঘটনা হলেও বিরোধী দল থেকে এ ব্যাপারে প্রশংসা করা তো দূরে থাক, কোনো টুঁ শব্দই করা হয়নি। ২০১২ সরকারের সবচেয়ে বড় সাফল্য হলো বাংলাদেশের সমুদ্র বিজয়। বিরোধী দল প্রথম দিকে ধন্যবাদ জানালেও পরে বিরুদ্ধ সমালোচনায় জড়িয়ে পড়ে। সরকারের এই কাজ সবার প্রশংসিত হলেও বিরোধী দল আগের মতোই তাদের নেগেটিভ মতামত প্রকাশ করে। বছরের শুরুতেই যুদ্ধাপরাধীর অভিযোগে জামায়াত নেতা গোলাম আযমের গ্রেফতারের ঘটনা দেশে আলোড়ন সৃষ্টি করে। বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধ ইস্যু ছিল বছরের প্রধান আলোচনার বিষয়। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকার্য জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য হলেও বিএনপি সুপরিচিত এসব যুদ্ধাপরাধীর পক্ষ নিয়ে এই বিচারের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে। তবে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিতে সরকার ততটা সফল হতে পারেনি বললে হয়তো ভুল বলা হবে না। মিডিয়ায় প্রকাশিত হয়েছে গত চার বছরে বাংলাদেশে হত্যা হয়েছে ১১ হাজার লোক। দেশের জনগোষ্ঠী ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সংখ্যানুসারে এই সংখ্যা কি তেমন কিছু? যদিও আমরা কখনই চাইব না আদৌ কোনো হত্যা হোক। এখন যদি আমরা উপরোক্ত সংখ্যাকে চার ভাগ করি তাহলে দাঁড়ায় বছরে ২৭৫০ জন। ১৬ কোটির জনসংখ্যার দেশ বাংলাদেশে এই সংখ্যা কি বিরাট কিছু? আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতে ২০০৭-০৮ হত্যা হয়েছে ৩২ হাজার, পাকিস্তানে এ সময় ৯ হাজার ৭০০ জন, আমেরিকায় ১৬ হাজার ৭০০ জন, সাউথ আফ্রিকায় ৩১ হাজার। ২০০৮ সালে শুধু নিউইয়র্ক শহরেই হত্যা হয়েছে ৮৩৭ জন। শিকাগোতে ২০০৩ সালে হত্যা হয়েছে ৫৯৯ জন। ২০০৫ সালে আমেরিকায় হত্যা হয়েছে ১৬ হাজার ৬৯২ জন। অন্যদিকে ব্রাজিলে ২০০৫ হত্যা হয়েছে ৫৫ হাজার। রাশিয়ায় প্রতি বছর হত্যা হয় ৩০ হাজার। আর আমেরিকায় প্রতি বছর ১৫ হাজার। মাত্র নব্বই লাখের দেশ সুইডেনে প্রতি বছর হত্যা হয় ১০০ জন। এখন বাংলাদেশের জনসংখ্যানুসারে প্রতি বছর ২৭৫০ হত্যাকে আমরা কীভাবে মূল্যায়ন করতে পারি, সেটাই এখন প্রশ্ন। প্রশ্নটা আমি বাংলাদেশের জনগণের কাছেই ছেড়ে দিলাম। তবে কোনো ধরনের হত্যা ও গুমকেই আমরা সমর্থন করতে পারি না। তাই আমাদের আশা থাকবে, এ ব্যাপারে সরকার যেন আরও দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণে এগিয়ে আসে। অন্যদিকে অনেক ক্ষেত্রে সরকারের ব্যর্থতাও রয়েছে। দেশের বিভিন্ন সেক্টরে দুর্নীতি, পদ্মা সেতু নিয়ে বিশ্বব্যাংক ও সরকারের মধ্যে দুর্নীতির বিষয়ে টানাপড়েন, ছাত্রলীগের বিতর্কিত ভূমিকা, পিটিয়ে নিরীহ দর্জি বিশ্বজিৎকে হত্যা, বিএনপি নেতা ইলিয়াস আলী গুম, সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের এপিএসের কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ আটক, পুঁজিবাজার ধস, সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি হত্যা, কঙ্বাজারের রামুতে বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের ওপর বর্বরোচিত হামলা ইত্যাদি ঘটনা ক্ষমতাসীন সরকারের বিশাল সাফল্যকে অনেকাংশেই ম্লান করে দিয়েছে বলতে হয়। বিষয়গুলো এখনো বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে তোলপাড়ের সৃষ্টি করে আছে। বিভিন্ন বিষয়ে দ্রুত সমাধানের পরিবর্তে সরকারের ধীরে চলার নীতিতে জনগণের মাঝে হতাশা দেখা দিয়েছে। আগামী সময়গুলোতে জনগণ সরকারের কাছে অনেক অমীমাংসিত ঘটনার ফলাফল দেখতে চায়। পারবে কি বর্তমান সরকার জনগণের এই আশা পূরণ করতে? সেইসঙ্গে আমরা বিরোধী দলকে ভালোকে ভালো আর মন্দকে মন্দ বলার লক্ষ্যে এগিয়ে আসার জন্য অনুরোধ জানাব। আমরা শুধু নেগেটিভ নয়, পজেটিভ সমালোচনাও শুনতে চাই। পারবে কি বিরোধী দল তাদের পূর্ব অবস্থান থেকে সরে আসতে? বাংলাদেশের রাজনীতিতে এ ধরনের একটা পজেটিভ পরিবর্তন আসুক, এটাই জনগণের সবচেয়ে বড় আশা। বর্তমান মুহূর্তে বাংলাদেশের রাজনীতিতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় দুই পক্ষের মধ্যে আলোচনার মাধ্যমে দেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনা। দুই নেত্রীকে যে একত্রে বসতেই হবে এমন কোনো কথা নয়। বিরোধী দল ও সরকারি দলের প্রতিনিধিরা এ ব্যাপারে এগিয়ে আসতে পারে। অতীতে সফল না হলেও এ ধরনের আলোচনা হয়েছে আওয়ামী লীগ নেতা এম এ জলিল ও বিএনপি নেতা মান্নান ভূঁইয়ার সঙ্গে। সুতরাং আগে একমত হয়নি দেখে এবারও যে হবে না এমন কোনো কথা নেই। বাংলাদেশের জনগণের এই প্রত্যাশা পারবে কি আওয়ামী লীগ-বিএনপি পূরণ করতে? লেখক : সাবেক নির্বাচিত কাউন্সিলর স্টকহলম সিটি কাউন্সিল ও স্টকহলম ডিস্ট্রিক কাউন্সিলর ই-মেইল :wlhan3¦hotmail.c.om

সর্বশেষ খবর