শুক্রবার, ৩০ আগস্ট, ২০১৩ ০০:০০ টা
খোলা কলাম

এরশাদ সকালে বিকালে ভিন্ন কথা বলেন কেন?

ফকির আশরাফ

এরশাদ সকালে বিকালে ভিন্ন কথা বলেন কেন?

এক. বাংলাদেশ প্রতিদিনে আমার সর্বশেষ লেখা বের হয় বিগত ২ জুন। নিবন্ধের শিরোনাম ছিল 'ঈশপের গল্প এবং বাংলাদেশের রাজনীতি'। লেখাটি প্রকাশিত হওয়ার পর বরাবরের মতো অসংখ্য ফোন কল আসে পরপর তিন দিন। ই-মেইল ঠিকানায়ও আসে অগণিত মন্তব্য। 'ঈশপের গল্প এবং বাংলাদেশের রাজনীতি' শীর্ষক লেখাটি প্রকাশিত হওয়ার পর অসংখ্য প্রশংসাসূচক ফোনকলের মাঝে একটি পেলাম ব্যতিক্রমী ফোন। তিনি আমাকে তিরস্কার করলেন এবং কিছুটা মৃদু হুমকি দিয়েও বললেন, আমার নেত্রীর বিরুদ্ধে এত লেখা লেখিস তুই, তোর নেতা এরশাদের বিরুদ্ধে লেখছ না কেন? তাকে বিনীতভাবে জিজ্ঞাসা করেছি আমি, কি লিখব এরশাদের বিরুদ্ধে? উত্তর, 'এরশাদ সকালে বলে এক কথা, বিকালে বলে ভিন্ন কথা, এইডা কোনো রাজনীতিবিদের চরিত্র হইল?' এরশাদ সম্পর্কে অনেক আজেবাজে কথা বলার পর আমার কাছে প্রতিশ্রুতি চাইল, আমি বিষয়টি নিয়ে লিখব কিনা। উত্তরে বললাম, যদি না লিখি। প্রত্যুত্তরে বলল, তোর নামটি মনে রাখব। পরিচয় জানতে চাইলে সে বলল, একদিন রাস্তাঘাটে পরিচয় পাইবি। যা হোক, আমি তাকে আশ্বস্ত করে বললাম, সরকারি চাকরিসহ একাধিক পেশায় ছিলাম আমি। কিন্তু মূলত আমি একজন সাংবাদিক। বর্তমানে রাজনীতির সঙ্গে জড়িত থাকলেও হাতে যখন কলম নিই, তখন ভুলে যাই আমার রাজনৈতিক পরিচয়। আপনার হুমকিতে ভীত হয়ে নই, একজন কলামিস্ট হিসেবে আমার নৈতিক দায়িত্ববোধ থেকেই কথা দিচ্ছি_ আপনার দাবি মোতাবেক অবশ্যই লিখব বিষয়টি নিয়ে।

বছর খানেক আগে ঢাকায় অনুষ্ঠিত জাতীয় পার্টির তৃণমূল পর্যায়ের নেতাদের এক সমাবেশে সাতক্ষীরার কালিগঞ্জ উপজেলার সাধারণ সম্পাদক হাফেজ রশিদ তার বক্তৃতায় ঠিক একই অভিযোগ উত্থাপন করেন এরশাদ সাহেবের উপস্থিতিতে। সেদিন মঞ্চে উপবিষ্ট ছিলাম আমি। আলোচ্য অভিযোগটি অধিক আলোচনায় আসে বিগত ৬ জুলাই অনুষ্ঠিত গাজীপুর সিটি নির্বাচনকে কেন্দ্র করে। ২৯ জুন বনানী মাঠে দলীয় কর্মী সমাবেশে এরশাদ ঘোষণা করেছিলেন, গাজীপুর নির্বাচনে আমরা সমর্থন দেব না আওয়ামী লীগ প্রার্থীকে। এরপর আওয়ামী লীগ প্রার্থী অ্যাডভোকেট আজমত উল্লাহ খান এবং বিএনপির প্রার্থী অধ্যাপক আবদুল মান্নান পৃথক পৃথকভাবে সাক্ষাৎ করে সমর্থন প্রার্থনা করেন এরশাদের। অতঃপর দেশবাসীকে জানানো হলো কাউকে সমর্থন দেননি এরশাদ। কিন্তু নির্বাচনের একদিন আগে অর্থাৎ ৪ জুলাই একটি ব্যাংকে বসে টিভি ক্যামেরার সামনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী আজমত উল্লাহ খানের পক্ষে এরশাদ সমর্থন ঘোষণা করেন দ্ব্যর্থহীন ভাষায়। তার পাশে না ছিলেন দলের কিংবদন্তি রাজনীতিবিদ কাজী জাফর আহমদ, না ছিলেন মহাসচিব রুহুল আমিন হাওলাদার। কেবল তার পাশে উপবিষ্ট ছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার স্নেহধন্য জাতীয় পার্টির নেতা জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলু। এ ঘোষণার ফলে সারা দেশে বিতর্কের ঝড় ওঠে এরশাদকে নিয়ে। তার এ সমর্থনের ফলে বিন্দুমাত্র লাভ হয়নি আওয়ামী লীগ প্রার্থীর। কারণ ২৯ জুন এরশাদ আওয়ামী প্রার্থীকে সমর্থন না দেওয়ার যে ঘোষণা দিয়েছিলেন তারই ভিত্তিতে গাজীপুরের জাপা নেতা-কর্মীরা চলে গিয়েছিলেন বিএনপি প্রার্থীর পক্ষে। অধ্যাপক মান্নানের সমর্থনেই ছিলেন তারা শেষ পর্যন্ত। কর্মীরা রক্ষা করেছে তাদের কমিটমেন্ট। কিন্তু পারেননি তাদের নেতা এরশাদ। এ সম্পর্কে কাজী জাফর বলেছেন, প্রচণ্ড চাপের মধ্যে ছিলেন এরশাদ। এ ব্যাপারে সাবেক রাষ্ট্রপতি এরশাদ ১৩ জুলাই বাংলাদেশ প্রতিদিনের প্রথম পৃষ্ঠায় 'এখন সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারব' শিরোনামে একটি নিবন্ধ লিখে আওয়ামী লীগের প্রার্থী আজমত উল্লাহ খানকে কেন শেষ মুহূর্তে সমর্থন দিলেন তার কৌশলগত কারণ ব্যাখ্যা করেছেন অতি সুখপাঠ্য প্রাঞ্জল ভাষায়। একজন পাঠক তার লেখাটি পাঠ করে ফোন করেছেন আমাকে এবং বলেছেন, এরশাদ একজন কৌশলী রাজনীতিবিদ। কৌশল করেই যে তিনি শুধু বেঁচে আছেন তাই নয়, বাংলাদেশের রাজনীতিতে অপরিহার্য করে তুলেছেন তার চাহিদা।

দুই. শামীম নামের একটি ছেলে আছে আমার বাসায়। বয়স ১০ বছর। পাশের গ্রাম থেকে নিয়ে এসেছি ওকে। ছেলেটি খুব বুদ্ধিমান, সৎ, বিশ্বস্ত এবং কর্মঠ; কিন্তু নিরক্ষর। তারপরও মোবাইল ফোন হ্যান্ডলিংয়ে পারদর্শী। নাম এবং নম্বর সেভ করতে পারে অনায়াসে। গত পহেলা বৈশাখ ভোরে একগুচ্ছ ফুল নিয়ে নববর্ষের শুভেচ্ছা জানাতে গিয়েছিলাম এরশাদ সাহেবের বারিধারার বাসভবন প্রেসিডেন্ট পার্কে। আমার পেছনে দাঁড়িয়েছিল শামীম। স্যার জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ও কে? উত্তরে বলেছিলাম, আমার সংসারের ম্যানেজার। মুচকি হাসলেন স্যার। সঙ্গে সঙ্গে স্যারের দু'পা স্পর্শ করে সালাম করল শামীম। বাইরে এসে উৎফুল্ল চিত্তে বলল, 'আইজ আমার জীবন সার্থক হইয়া গেছে স্যার।' জিজ্ঞাসা করলাম, কেন? প্রত্যুত্তরে বলল, 'এরশাদের মতো অতবড় মানুষটারে কাছে গিয়া দেখলাম, আর আপনে আমারে তার কাছে মেনাজার বইল্যা পরিচয় দিলেন।

টেলিভিশনের প্রতি ওর দারুণ নেশা। আমি যখন বাসায় বসে টেলিভিশন দেখি ও বসে আমার পাশে। আমি সাধারণত বেশি দেখি খবর এবং টকশো। ওগুলো ওর পছন্দ নয়। ক'দিন আগে অধৈর্য হয়ে বলল, চ্যানেল পাল্টাইয়া দেন স্যার। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, কোন চ্যানেলে দেব? ও বলল, ডিসরাবি চ্যানেল দেন। আমি বললাম, 'ডিসরাবি' বলে কোনো চ্যানেল নেই। ও জোর দিয়ে বলল, আছে স্যার। মৃদু ধমক দিয়ে বললাম, পাগলামি করিস না, ডিসরাবি নামে কোনো চ্যানেল নেই। ও বিনয়ের সঙ্গে বলল, রিমোটটা আমার কাছে দ্যান স্যার, আমি বের করে দেই। একটু বিরক্তির ভাব নিয়ে ওর হাতেই দিয়ে দিলাম রিমোট। ও রিমোট টিপতে টিপতে গিয়ে থামল এক জায়গায়। উচ্ছ্বাসে চিৎকার দিয়ে বলল, পাইয়া গেলাম স্যার। আমি বললাম, এটা ডিসরাবি নয়, ডিসকভারি চ্যানেল। ও হেসে বলল, আমি তো ইংরেজি টিংরেজি বুঝি না স্যার। আইজ শিখলাম। ডিসকভারির পর্দায় চোখ পড়তেই দেখলাম, টিকটিকি জাতীয় একটি প্রাণীকে পেছন থেকে ধাওয়া করছে একটা সবুজ রংয়ের সাপ। ধারা ভাষ্যকার সাপটির বর্ণনা দিতে গিয়ে বলছেন, দেখতে খুব চিকন হলেও দৈর্ঘ্য প্রায় ১০ ফুট। মাথা চওড়া। অনেকক্ষণ যাবৎ টিকটিকি জাতীয় প্রাণীটিকে ধরার চেষ্টা করছে সাপটি। হঠাৎ দেখলাম, টিকটিকি নেই, কোথাও যেন উধাও হয়ে গেছে প্রাণীটি। অনেকক্ষণ ধরে খোঁজাখুঁজি করল সাপটি। যে বৃক্ষের কাণ্ড বেয়ে উপরের দিকে পালিয়ে যাচ্ছিল টিকটিকি জাতীয় প্রাণীটি সে বৃক্ষের কাণ্ডের ওপর থমকে অনেকক্ষণ বসে রইল সাপটি। এরপর বৃক্ষের ওপর নিচে কয়েকবার ওঠা-নামা করে টিকটিকির সন্ধান পেল না শিকারি ক্ষুধার্ত সাপ। নিরাশ হয়ে গাছ থেকে নিচে নেমে যখন অনেক দূর চলে গেল সাপটি, তখন বৃক্ষের কাণ্ডের ওপর স্বরূপে আত্দপ্রকাশ করল টিকটিকি। ধারাভাষ্যকার বললেন, গাছের ছালের অবিকল রূপ ধারণ করে কাণ্ডের গায়ে লেপটে শুয়ে ছিল টিকটিকি। ফলে শিকারকে খুঁজে পেল না শিকারি। গাছ থেকে যখন নিচে নেমে গেল টিকটিকি তখন তাকে ধরার জন্য মরিয়া হয়ে পিছু ধাওয়া করছে অপর একটি সরীসৃপ জাতীয় হিংস্র প্রাণী। টিকটিকি অন্য একটি গাছের পাতার আড়ালে গিয়ে হয়ে গেল অদৃশ্য। অনেক খোঁজাখুঁজি করল হিংস্র প্রাণীটি। সেও নিরাশ হয়ে ফিরে গেল শেষ পর্যন্ত। পাতার আড়াল থেকে আপন রূপে বেরিয়ে এলো টিকটিকি। ধারাভাষ্যে বলা হলো, সবুজ রং ধারণ করে পাতার আড়ালে লুকিয়ে ছিল টিকটিকি। ভাষ্যকার আরও বললেন, টিকটিকি জাতীয় প্রাণীটি বিপদে পড়লে আত্দরক্ষার জন্য সে রং বদলায়। ক্ষণে ক্ষণে রং বদল করা তার আত্দরক্ষার বড় কৌশল। কিছুক্ষণ পর দেখা গেল ওই টিকটিকির পেছনে ছুটছে ব্যাঙ জাতীয় আরেকটি অদ্ভুত প্রাণী। টিকটিকি দৌড়ে চলে আর ব্যাঙটি যায় লাফিয়ে লাফিয়ে। ফলে এ শিকারির হাত থেকে রক্ষা পাওয়া যেন কষ্টকর হয়ে পড়ল টিকটিকির জন্য। তাই অনন্যোপায় হয়ে ঘুরে দাঁড়াল টিকটিকি এবং মুখ থেকে থুতু ছিটিয়ে দিল অদ্ভুত ব্যাঙের চোখে মুখে। মনে হলো বিষক্রিয়া হয়েছে ব্যাঙের চোখে মুখে। দিশাহারা হয়ে ঠায় বসে রইল ব্যাঙ।

তিন. প্রিয় পাঠক, ১৯৯৯ সালের একটি ঘটনা বলছি আপনাকে। আমি তখন সাবেক রাষ্ট্রপতি এরশাদের তথ্য উপদেষ্টা। তার বারিধারার অফিসে দুই বেলা বসতে হতো আমাকে। স্যারকেও দেখেছি দুই বেলা অফিস করতেন বারিধারায়। সন্ধ্যার পর দর্শনার্থী হতো খুব কম। ব্যক্তিগত কাজ গোছাতেই তখন অফিসে যেতেন তিনি। বিশেষ করে লেখালেখির কাজ নিয়ে তাকে ব্যস্ত থাকতে দেখেছি এ সময়। আমি তার পাশের একটি কক্ষে বসতাম নিয়মিত। মাঝে-মধ্যে রাত ৮টা কিংবা ৯টায় তিনি ডাকতেন আমাকে। অনেক কথার মধ্যে একদিন সাহস করে একটি কথা বলে ফেললাম তাকে। বলতে চেয়েছিলাম, স্যার আপনাকে নিয়ে ভুল বোঝাবুঝি আছে মানুষের মধ্যে। আপনি সকালে বলেন এক কথা, বিকালে বলেন ভিন্ন কথা। কিন্তু এমন একটি গুরুতর অভিযোগ তার সামনে বসে বলতে সাহস হলো না আমার। কথাটা ঘুরিয়ে শুধু বললাম, স্যার আপনার ডিপ্লোমেটিক কথাবার্তা নিয়ে অনেকে ভুল বোঝে আপনাকে। আপনার ডিপ্লোমেসি দুর্বোধ্য। তিনি মুচকি হেসে বললেন, আমার ডিপ্লোমেসি যদি তুমি বুঝেই ফেল তাহলে সেটা হবে বেস্ট ডিপ্লোমেসি।

চার. রাজনীতি শব্দের মূল অর্থ অস্তিত্ব রক্ষার সংগ্রাম। স্বীয় অস্তিত্ব রক্ষার প্রয়োজনে অনুসৃত নীতির নাম রাজনীতি। এককালে ছিল রাজা। তিনি নিজের অস্তিত্ব রক্ষার প্রয়োজনে প্রণয়ন করতেন নীতি। সেখান থেকেই রাজনীতি শব্দের জন্ম। আজকে রাজা নেই, আছে রাজনীতি। শ্রমিক যখন রাস্তায় নেমে স্লোগান ধরে, আমাদের দাবি মানতে হবে, কৃষক বলে, কৃষকের দাবি মানতে হবে, ছাত্র বলে, তাদের দাবি মানতে হবে; শিক্ষক, সাংবাদিক, শিল্পী, ব্যবসায়ী প্রতিটি শ্রেণী তাদের শ্রেণী-স্বার্থ রক্ষায় সংগ্রাম করে যায় অবিরাম। কার্ল মার্কসের ভাষায়, এগুলো হলো শ্রেণী সংগ্রাম। সব শ্রেণী-পেশার মানুষ তথা বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর স্বার্থ রক্ষার প্রয়োজনে গড়ে ওঠে যে সংগঠন, সেটাই হলো রাজনৈতিক দল। একটি গণতান্ত্রিক দেশে রাজনৈতিক দল থাকে দুই বা ততোধিক। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে অবিরাম চলতে থাকে অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই। এই লড়াইয়ে হার নয়, জিততেই হবে_ এটাই মুখ্য উদ্দেশ্য। যুদ্ধের ময়দানে প্রতিপক্ষকে ধোঁকা দেওয়ার জন্য সেনাপতি যেভাবে প্রণয়ন করেন রণকৌশল ঠিক একইভাবে রাজনৈতিক লড়াইয়ের মধ্যেও চলে ধোঁকাবাজি। দলীয় অস্তিত্বই হচ্ছে মুখ্য বিষয়। সে জন্য প্রতিপক্ষকে ধোঁকা দেওয়ার লক্ষ্যে সকাল-বিকাল কৌশলের হয় পরিবর্তন।

এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যায়, ১৯৮৬ সালে অনুষ্ঠিত নির্বাচন প্রসঙ্গ। চট্টগ্রামের লালদীঘি ময়দানে আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ হাসিনা ঘোষণা দিলেন_ এরশাদের অধীনে যারা নির্বাচনে যাবে তারা হবে জাতীয় বেইমান। তার একদিন পরই তিনি সংবাদ সম্মেলন ডেকে নির্বাচনে যাওয়ার ঘোষণা দিলেন দ্ব্যর্থহীন ভাষায়। নির্বাচনে অংশগ্রহণের ফলে আওয়ামী লীগ যে জাতীয় বেইমান হয়ে গেছে, তা কিন্তু নয়। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর বিভক্ত হয়ে গিয়েছিল দল। হতাশা এবং নৈরাশ্যে আচ্ছন্ন ছিল নেতা-কর্মীদের মন। '৮৬ সালের নির্বাচনে অংশগ্রহণের ফলে দলীয় কর্মীরা হয়েছে চাঙ্গা, দল হয়েছে শক্তিশালী। যার ফলশ্রুতিতে আওয়ামী লীগ এ পর্যন্ত আরও দু'বার ক্ষমতায় আসতে পেরেছে বিপুল ভোটাধিক্যে। পাকিস্তানে সফল পররাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন জুলফিকার আলী ভুট্টো। তার সার্বক্ষণিক উল্টাপাল্টা কথার জন্য দ্রুততর হয়েছে পাকিস্তানের বিভক্তি। পরবর্তী পর্যায়ে তিনি হয়েছেন বিভক্ত পাকিস্তানের পশ্চিম অংশের প্রধানমন্ত্রী। তিনি এবং তার দল হয়েছে লাভবান। আমি ছিলাম মওলানা ভাসানীর একজন অনুসারী। রাজনীতিতে তার সুকৌশলী অভিনয়ের মর্মার্থ ছিল দুর্বোধ্য। রাজনীতির মঞ্চে সেরা অভিনেতা ছিলেন শেরেবাংলা ফজলুল হক। বিশ্বের সব দেশেই রাজনীতিবিদ হিসেবে যারা প্রতিষ্ঠা পেয়েছেন তারা ছিলেন সবাই কম-বেশি দক্ষ অভিনেতা। এমনকি মহাত্দা গান্ধীর মতো রাজনীতিবিদও (যাকে আমি অনুসরণের চেষ্টা করি ব্যক্তিগত জীবনে) রাজনীতির ক্ষেত্রে দ্বিমুখী ভূমিকা গ্রহণ করেছেন, এমন অভিযোগ রয়েছে তারও বিরুদ্ধে। ১৯৩৮ সালে নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু গান্ধীর সমর্থনে এবং সর্বসম্মতিক্রমে নির্বাচিত হন সর্ব-ভারতীয় কংগ্রেস সভাপতি। পরবর্তী বছর সভাপতি পদে পুনঃনির্বাচিত হওয়ার ব্যাপারে দলীয় কর্মীদের মধ্যে বিপুল জনপ্রিয়তার কারণে সুভাষ বসুকে প্রকাশ্য সমর্থন দিলেও তার বিরুদ্ধে মহাত্দা গান্ধী কাজ শুরু করেন গোপনে। তাই ১৯৩৯ সালে সভাপতি পদে পুনঃনির্বাচিত হলেও গান্ধীর সমর্থন লাভে ব্যর্থ হওয়ায় পদত্যাগে বাধ্য হন সুভাষ চন্দ্র বসু। প্রথমে সমর্থন দিয়ে পরবর্তী সময়ে বিরুদ্ধাচারণ করায় প্রচণ্ড সমালোচনার মুখে পড়েছিলেন মহাত্দা গান্ধী। সুভাষ চন্দ্র বসু এক বছর কংগ্রেসের সভাপতি থাকাকালে গান্ধী বুঝতে পেরেছিলেন সুভাষ বিপজ্জনক। গান্ধীজির অহিংস রাজনীতি বিপন্ন হয়ে যাবে সুভাষ আরেকবার সভাপতি হলে। অহিংস আন্দোলনে বিশ্বাসী ছিলেন মহাত্দা গান্ধী। আর সহিংস সংগ্রামের মাধ্যমে ভারতের স্বাধীনতায় বিশ্বাসী ছিলেন নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু। তাই গান্ধীর রাজনীতির সঙ্গে একাত্দ হতে না পেরে পদত্যাগের মাধ্যমে ছেড়ে দেন কংগ্রেস। গঠন করেন নতুন রাজনৈতিক দল ফরওয়ার্ড ব্লক। সশস্ত্র বিপ্লবের মাধ্যমে যারা ভারতকে স্বাধীন করতে চায় সেই সব বিপ্লবী শক্তিগুলোকে সুসংহত করতে প্রয়াসী হন তিনি। ইতোমধ্যে শুরু হয়ে গেছে দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধ। মাও সে তুং-এর 'শত্রুর শত্রু মিত্র'-বাণী অনুসরণ করে তিনি ঝুঁকে পড়লের অক্ষ শক্তির দিকে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জার্মান, জাপান ও ইতালি_ এ তিন দেশ মিলে গঠিত হলো অক্ষশক্তি। অপর দিকে ব্রিটেন, ফ্রান্স, আমেরিকাসহ অবশিষ্ট বিশ্ব একত্রে দাঁড়াল অক্ষশক্তির বিরুদ্ধে। মিত্রশক্তি নামে পরিচিত হলো তারা। ভারতের স্বাধীনতাকামী মানুষের শত্রু ইংরেজ অর্থাৎ ব্রিটেন। ব্রিটেনের শত্রু অক্ষশক্তি। সেই হিসেবে অক্ষশক্তি মিত্র হতে পারে ভারতবাসীর। ওই চিন্তা থেকেই সুভাষ বসু ১৯৪১ সালের ২৬ জানুয়ারি গোপনে ত্যাগ করেন কলকাতা। সীমান্ত পাড়ি দিয়ে রাশিয়া হয়ে পৌঁছেন জার্মানির রাজধানী বার্লিন। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন সংগঠনের জন্য তিনি লাভ করেন হিটলার তথা জার্মানির সমর্থন। তিনি বার্লিনে গঠন করেন ভারতের অস্থায়ী স্বাধীন সরকার এবং সেখান থেকে শুরু হয় নিয়মিত বেতার সম্প্রচার। তারপর জলপথে জার্মানির একটি সাবমেরিনে চড়ে পৌঁছেন সিঙ্গাপুর। সেখান থেকে টোকিও। জাপান সরকারের সমর্থন লাভ করেন সুভাষ বসু। সেখানে ভারতের অপর বিপ্লবী রাস বিহারী বসুর সঙ্গে সাক্ষাৎ হয় তার। পূর্ব এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় অবস্থানরত ভারতীয়দের নিয়ে রাস বিহারী ইতোমধ্যে গড়ে তুলেছেন 'আজাদ হিন্দ ফৌজ'। এ ফৌজি সংগঠনের পুরো দায়িত্ব রাস বিহারী বসু অর্পণ করেন নেতাজী সুভাষ বসুর ওপর। তার নেতৃত্বে আজাদ হিন্দ ফৌজ ভারত-বার্মা সীমান্তে ব্রিটিশ বাহিনীর বিরুদ্ধে শুরু করে সামরিক অভিযান। তারপর তিনি অগ্রসর হতে থাকেন ভারতের দিকে। ইতোমধ্যে মার্কিন আণবিক বোমার আঘাতে আত্দসমর্পণ করে জাপান। মিত্রশক্তির কাছে পরাজিত হয় হিটলারের জার্মানি এবং মুসোলিনির ইতালি। পৃষ্ঠপোষকের অভাবে চিরতরে থেমে যায় নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসুর সশস্ত্র আন্দোলন। কথিত আছে ১৯৪৫ সালের আগস্টের কোনো এক তারিখে ফরমোজায় (বর্তমান-তাইওয়ান) বিমান দুর্ঘটনায় নিহত হন সুভাষ চন্দ্র বসু। যদিও বিষয়টি নিশ্চিত নয় আজ অবধি। তার মৃত্যু রহস্যাবৃত ভারতবাসীর কাছে। আন্দোলন-সংগ্রামের কথা শুনতে ভালোবাসে যে কোনো রাজনৈতিক দলের কর্মীরা। সুভাষ বসু যেহেতু সশস্ত্র সংগ্রামের কথা বলতেন দলীয় কর্মী সমাবেশে, তাই তিনি খুব জনপ্রিয় ছিলেন কর্মীদের মধ্যে। কর্মীদের চাপের মুখে গান্ধীজি প্রকাশ্যে সুভাষ চন্দ্র বসুকে সমর্থন দিয়েছিলেন তার পুনঃনির্বাচনে। কিন্তু দূরদৃষ্টিসম্পন্ন গান্ধী বুঝতে পেরেছিলেন তার অহিংস আন্দোলনই সফল হবে, সুভাষ বসুর সহিংস সংগ্রাম নয়। তাই গান্ধী প্রথমে গোপনে করলেও শেষ পর্যায়ে প্রকাশ্যে বিরুদ্ধাচরণ করেন সুভাষ বসুর।

পাঁচ. সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের বয়স কত তা জানা আছে দেশবাসীর। এই বয়সে তাকে কৌশলের আশ্রয় নেওয়া ছাড়া উপায় কি বলুন। প্রতি মুহূর্তে জুজুর ভয় দেখানো হয় তাকে। তিনিই বাংলাদেশের একমাত্র রাজনীতিবিদ, যিনি এক নাগাড়ে জেল খেটেছেন ছয় বছর ১১ দিন। তার জেল জীবনের বীভৎস এবং রোমহর্ষক নির্যাতনের কাহিনী বহুবার প্রকাশিত হয়েছে এ দেশের পত্র-পত্রিকায়। রাজনৈতিক প্রতিহিংসার কারণে দুই ডজনেরও বেশি ফৌজদারি মোকদ্দমা দেওয়া হয়েছে তার বিরুদ্ধে। বিচারের স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় কয়েকটি মামলা থেকে বেকসুর খালাস পেয়েছেন তিনি। এখনো ঝুলে আছে ডজন খানেক। বিগত প্রায় ২৩ বছর যাবৎ অনবরত হাজিরা দিয়ে চলেছেন আদালতে। যে দলই ক্ষমতায় আসে তারা নিজেদের মামলাগুলো তুলে নেয় চটজলদি। কিন্তু এরশাদের মামলা তুলে নেওয়া দূরে থাক বরং তাকে হাতের মুঠোয় রাখার জন্য এগুলোকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হয় তারই বিরুদ্ধে। এরশাদের জন্যই হলো মহাজোট। তারই কারণে মহাজোট বিজয়ী হয়েছে তিন চতুর্থাংশ আসনে। তারপর কিভাবে তাকে এবং তার দলকে পদে পদে বঞ্চিত-অবহেলিত ও অবমূল্যায়ন করা হয়েছে, সেই চিত্র এরশাদ তুলে ধরেছেন তার 'এখন সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারব' শীর্ষক নিবন্ধে। একটি কথা তিনি প্রায়ই বলে থাকেন, 'আমরা আর কারও ক্ষমতায় যাওয়ার সিঁড়ি হব না।' আমি বলব, স্যার, আপনি আর সিঁড়ি হবেন কেন এখন থেকে সিঁড়ি ব্যবহার করবেন। এরশাদের বিরুদ্ধে আরেকটি অভিযোগ প্রায়ই শোনা যায়, 'এরশাদকে বিশ্বাস করা যায় না।' প্রিয় পাঠক, আমার অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, কেউ কাউকে বিশ্বাস করে না রাজনীতিতে। প্রত্যেকেই প্রত্যেকের শত্রু। শুধু কমন স্বার্থের কারণে মিত্র থাকে সাময়িক। এরশাদের বিরুদ্ধে মূল অভিযোগ, তিনি সকালে বলেন এক কথা, বিকালে ভিন্ন। এটি শুধু এরশাদের বিরুদ্ধে কেন? আশৈশব শুনে এসেছি, শেষ কথা বলতে কিছু নেই রাজনীতিতে। শুধু কি এরশাদের জন্যই প্রচলন হয়েছে প্রবচনটি!

পরিশেষে আমি ধন্যবাদ দিতে চাই আমার সংসারের ১০ বছর বয়সের ক্ষুদে ম্যানেজার শামীমকে। ও যদি সে দিন পীড়াপীড়ি করে আমার হাত থেকে রিমোট নিয়ে ডিসকভারি চ্যানেল বের না করত তাহলে প্রতিশ্রুতি মোতাবেক নিবন্ধটি লেখা সম্ভব হতো না আমার পক্ষে। টিকটিকি জাতীয় প্রাণীটি আত্দরক্ষার জন্য আক্রান্ত হলেই যেভাবে রং বদলায় সেভাবে রং বদলানো কি অপরাধ? হাজারও হুমকির মুখে এভাবেই তো টিকে আছেন এরশাদ। তার নিবন্ধ সম্পর্কে এক পাঠকের ভাষ্য পুনরুল্লেখ করে বলতে হয়_ 'এরশাদ একজন কৌশলী রাজনীতিবিদ। কৌশল করেই যে তিনি শুধু বেঁচে আছেন তাই নয়, বাংলাদেশের রাজনীতিতে অপরিহার্য করে তুলেছেন তার চাহিদা।' শেষ পর্যায়ে একটি সনির্বন্ধ অনুরোধ করতে চাই, স্যার আপনাকে যারা অবিরাম প্রাণ সংহারী হুমকি দিয়ে চলেছে, তাদের মুখের ওপর টিকটিকি জাতীয় প্রাণীর মতো থুতু দিয়ে ঘুরে দাঁড়ান আপনি। দেখবেন, ওদের চোখে-মুখে শুরু হয়েছে বিষক্রিয়া আর পিপীলিকার মতো সারিবদ্ধ হয়ে ছুটে আসছে দেশপ্রেমিক কোটি কোটি মানুষ আপনার পেছনে।

লেখক : কথাসাহিত্যিক, কলামিস্ট, রাজনীতিবিদ

ই-মেইল : [email protected]

 

 

সর্বশেষ খবর