শনিবার, ১৯ অক্টোবর, ২০১৩ ০০:০০ টা
খোলা কলাম

স্থানীয় সরকারের মাধ্যমে গণতন্ত্রায়ন

ড. নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহ

স্থানীয় সরকারের মাধ্যমে গণতন্ত্রায়ন

এক. গণতান্ত্রিক স্থানীয় সরকারের জন্য আন্দোলন দেখে অনেকে বক্রোক্তি করে বলেন, যে দেশে জাতীয়তে গণতন্ত্র নেই, সে দেশে স্থানীয়তে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা পায় কীভাবে! সেক্ষেত্রে আমাদের বক্তব্য, পাকিস্তান ও বাংলাদেশের উভয় আমলে প্রায় ৬৭ বছর ধরে জাতীয়তে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য আন্দোলন চালু রয়েছে। কিন্তু গণতন্ত্র কতটুকু প্রতিষ্ঠা পেয়েছে, তা এখনো প্রশ্নবিদ্ধ। কিন্তু জনগণ স্থানীয়তে এক প্রকার গণতান্ত্রিক মানসিকতা নিয়েই বসবাস করছেন। তবে স্থানীয়তে যতটুকু গণতন্ত্র রয়েছে সেটুকুও বিভিন্নভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে অগণতান্ত্রিক জাতীয় রাজনীতির কারণে। তাই আমরা মনে করি, স্থানীয়তে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার মাধ্যমেও জাতীয়কে গণতান্ত্রিক করা সম্ভব। তার আগে 'গণতান্ত্রিক স্থানীয় সরকার' বলতে কি বুঝায় সেটি পরিষ্কার হওয়া দরকার। এক কথায় বলা যায়, স্থানীয় মানুষের সেবা ও উন্নয়নের জন্য যে স্বাবলম্বী ও স্বশাসিত 'স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা' থাকে তাকেই গণতান্ত্রিক স্থানীয় সরকার বলে। স্থানীয় সরকার নিজস্ব আয় দ্বারা প্রথমে শতভাগ সিস্টেম কস্ট তথা দাফতরিক খরচ, নির্বাচিত প্রতিনিধি ও অনির্বাচিত কর্মকর্তা-কর্মীদের বেতন-ভাতা, বিদ্যুৎ বিল, টেলিফোন বিল, ইন্টারনেট বিল, আপ্যায়ন ব্যয় ইত্যাদি নির্বাহ করবে। একই সঙ্গে নিজস্ব উদ্বৃত্ত আয়ে ও প্রয়োজনে কেন্দ্রীয় সরকারের আর্থিক ও অন্যান্য সহায়তা নিয়ে নিজস্ব এলাকায় সেবামূলক ও উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড পরিচালিত করবে। সমগ্র জনগোষ্ঠী চারটি তৃণমূলীয় স্থানীয় ইউনিটে বসবাস করে, তা হলো_ ইউনিয়ন, পৌরসভা, সিটি করপোরেশন ও ক্যান্টনমেন্ট বোর্ড। তাই বলা যায়, স্থানীয় সরকার স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়া মানেই গোটা দেশ স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়া এবং স্থানীয় সেবা ও উন্নয়ন মানেই সমগ্র দেশের সমষ্টিগত সেবা ও উন্নয়ন। কিন্তু এসব বিবেচনায় নিয়ে বলা যায়, বাংলাদেশে গণতন্ত্রের ভিত হিসেবে কোনো স্বাবলম্বী ও স্বশাসিত স্থানীয় সরকারব্যবস্থা নেই। অথচ স্থানীয় সরকারগুলো নাগরিক তৈরির কারখানা হিসেবে দায়িত্ব পালন করার কথা।

দুই. বর্তমানে ৭টি বিভাগ, ৬৪টি জেলা, ১১টি সিটি করপোরেশন, ৩০৮টি পৌরসভা, ৪৫০৩টি ইউনিয়নসহ বেশ কয়েকটি ক্যান্টনমেন্ট বোর্ড রয়েছে। এসব স্থানীয় ইউনিট তিন ভাগে ভাগ করা যায় : ১. গ্রামীণ স্থানীয় ইউনিট, যেমন_ ৪,৫০৩টি ইউনিয়ন এবং ১৭৯টি উপজেলা (কারণ এসব ইউনিট আইন মোতাবেক গ্রামীণ এলাকা নিয়ে গঠিত); ২. নগরীয় স্থানীয় ইউনিট, যেমন_ ৩০৮টি পৌরসভা ও ১১টি নগর করপোরেশন, (কারণ এসব ইউনিট আইন মোতাবেক শুধু নগরীয় এলাকা নিয়ে গঠিত) এবং ৩. গ্রামীণ-নগরীয় স্থানীয় ইউনিট, যেমন_ ৭টি বিভাগ, ৬৪টি জেলা ও ৩০৮টি উপজেলা (কারণ এসব ইউনিট গ্রামীণ ও নগরীয় এলাকার সমন্বয়ে গঠিত)। সাধারণত গ্রামীণ স্থানীয় ইউনিটে গঠিত স্থানীয় সরকারকে বলা হয় 'গ্রামীণ স্থানীয় সরকার'; নগরীয় স্থানীয় ইউনিটে গঠিত স্থানীয় সরকারকে বলা হয় 'নগরীয় স্থানীয় সরকার' এবং গ্রামীণ-নগরীয় স্থানীয় ইউনিটে গঠিত স্থানীয় সরকারকে বলা হয় 'গ্রামীণ-নগরীয় স্থানীয় সরকার'। কিন্তু বাংলাদেশে স্থানীয় ইউনিটের প্রকারভেদকরণ যথার্থভাবে করা যায়নি বলে স্থানীয় সরকারের প্রকারভেদকরণ যথার্থভাবে করা সম্ভব হয়নি এবং তার ফলে ক্ষমতা ও দায়িত্ব যথার্থভাবে নির্ধারিত ও বণ্টিত হয়নি, হচ্ছে না। এখানে লক্ষণীয়, নগরের আয়তন, সংখ্যা ও জনসংখ্যা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে গ্রামীণ ইউনিটগুলোর আয়তন, সংখ্যা ও জনসংখ্যা কমতে থাকবে। গোটা বাংলাদেশ নগরে পরিণত হয়ে যাওয়ার ফলে ২০৫০ সাল নাগাদ গ্রামীণ ইউনিটগুলো বিলুপ্ত হয়ে যাবে; ফলে বাংলাদেশ অনেকগুলো নগরীয় ইউনিটে বিভক্ত হয়ে পড়বে; বাংলাদেশ শুরু থেকেই এককেন্দ্রিক সরকার হওয়ায়, তথা প্রদেশ সৃষ্টি না করায় স্থানীয় সরকারগুলো সরাসরি কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ করছে। সে জন্য কেউ কেউ প্রদেশ সৃষ্টি করে ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ চাচ্ছেন। সেক্ষেত্রে সিডিএলজির বক্তব্য হলো_ 'প্রদেশ' নামক একটি পূর্ণাঙ্গ সরকারের প্রশাসনিক ব্যয়ভার আসবে কোত্থেকে? সবার জানা রয়েছে, উন্নয়নের পূর্ব শর্ত হলো আয় থেকে ব্যয় কম হওয়া। তাছাড়া এ দেশে আয়তন, ভৌগোলিক অবস্থান, ইতিহাস-ঐতিহ্য, জনসংখ্যা ইত্যাদি প্রদেশ সৃষ্টির অনুকূল নয়। একই কারণে এ দেশে প্রদেশকেন্দ্রিক চিন্তা ও কাজও নেই (উদাহরণস্বরূপ পাশর্্ববর্তী দেশ ভারতে তিন প্রকারের কাজ ও চিন্তা বিদ্যমান, তা হলো স্থানীয়, রাজ্যিক ও জাতীয়)। সে জন্য দুই প্রকারের চিন্তা ও কাজ, তথা জাতীয় ও স্থানীয় কাজগুলো সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করার স্বার্থে কেন্দ্রীয় সরকার ও স্থানীয় সরকার ব্যবস্থাই বাস্তবানুগ। তার আগে অবশ্যই স্থানীয় সরকারের সমন্বিত স্তরবিন্যাস করতে হবে। আমাদের জেলাগুলোতে গড়ে প্রায় ২৭ লাখ লোক বসবাস করছে। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, আওয়ামী লীগ দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় গেলে জেলাতে বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ন্ত্রণসহ বহু কাজ ন্যস্ত করা হবে। কেন্দ্রের হাতে পলিসি তৈরি, বাজেট প্রণয়ন, বাণিজ্যসহ মুষ্টিমেয় কিছু কাজ সংরক্ষিত থাকবে। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, বিএনপি ক্ষমতায় গেলে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট পার্লামেন্ট গঠন করবে। বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়াও বলেছেন, বিএনপি ক্ষমতায় গেলে নতুন ধারার সরকারব্যবস্থা বাস্তবায়ন করা হবে। জাতীয় নেতাদের মুখে এ জাতীয় কথা গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ গড়ার জন্য একটি সুখবর। কিন্তু জেলাগুলোতে সে রকম জনবল, অর্থবল ও প্রশাসনিক অবকাঠামো নেই। তা হলো বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো উচ্চ বিদ্যাপীঠ নিয়ন্ত্রিত হবে কীভাবে? আবার এ দেশে তো প্রদেশ নেই। সংসদের উচ্চকক্ষের প্রতিনিধি আসবে কোথা থেকে? সে জন্য গণতান্ত্রিক স্থানীয় সরকারের রূপরেখা অনুযায়ী প্রত্যেক জেলায় 'জেলা সরকার' স্থাপন করতে হবে। বাংলাদেশে ইতিহাস-ঐতিহ্যে জেলা একটি গুরুত্বপূর্ণ স্তর হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। জনসংখ্যার দিক থেকে একটি জেলা মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপের বহু দেশের সমান। ৬৪টি জেলা থেকে ১২৮ জন প্রতিনিধি নিয়ে (তাদের মধ্যে একজন নারী ও একজন পুরুষ) উচ্চকক্ষ সৃষ্টি করা যেতে পারে। সে জন্য অনেকে জেলাকে সর্বোচ্চ স্তর হিসেবে দেখতে চান। অর্থাৎ এককেন্দ্রিক সরকারব্যবস্থায় 'টু টায়ার বিশিষ্ট' স্থানীয় সরকার বাস্তবায়নের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ সম্ভব।

তিন. গ্রামীণ এলাকায় ইউনিয়নের নিচে আর কোনো প্রশাসনিক ইউনিটের প্রয়োজনীয়তা না থাকা সত্ত্বেও অতীতে স্বনির্ভর গ্রাম সরকার, পল্লী পরিষদ, গ্রাম সভা, গ্রাম পরিষদ, গ্রাম সরকার ইত্যাদি নামে আরেকটি স্থানীয় ইউনিট স্থাপন করার নামে বহু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়েছে এবং তা করতে গিয়ে দেশের কোটি কোটি টাকা ও মূল্যবান সময় অপচয় করা হয়েছে। এতে ইউনিয়নকে দুর্বল থেকে দুর্বলতর প্রতিষ্ঠানে পরিণত করা হয়েছে। আবার স্থানীয় সরকারের সর্বোচ্চ ইউনিট (বিভাগ অথবা জেলা) গঠন ও কার্যকর করার ওপর জোর না দিয়ে মধ্যবর্তী ইউনিট হিসেবে উপজেলার ওপর অতিমাত্রায় জোর দিতে গিয়েও ইউনিয়নকে অবহেলিত ও দুর্বলতম প্রতিষ্ঠানে পরিণত করা হয়েছে। অনুরূপ প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে বর্তমানে 'ওয়ার্ড সভা' নামে আরেকটি অপ্রয়োজনীয় প্রতিষ্ঠান সৃষ্টির চেষ্টা করা হচ্ছে। অথচ আমাদের জানা রয়েছে, ইউনিয়ন কার্যকর হওয়া মানে গ্রাম, পাড়া, ওয়ার্ড কার্যকর হয়ে যাওয়া। সে জন্য অতীত থেকে শিক্ষা নিয়ে দেশের স্বার্থে এসব অপ্রয়োজনীয় তৎপরতা এখনই বন্ধ হওয়া উচিত।

চার. সরকার কী, সরকার কীভাবে গঠিত হয়, সরকারের তিনটি বিভাগের মধ্যে কোন বিভাগের কি ক্ষমতা ও দায়িত্ব, সরকারের রাজস্ব আয়ের উৎস কি কি, বিধানিক, প্রশাসনিক ও বিচারিক বিভাগের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক, ক্ষমতার পৃথকীকরণ ইত্যাদি বিষয় তৃণমূলের ইউনিটে দৃশ্যমান না থাকায় মানুষের কাছে 'সরকার' একটি অস্পষ্ট ও দূরবর্তী বিষয় হিসেবে রয়ে গেছে। সে জন্য জাতীয় এবং স্থানীয় উন্নয়নের স্বার্থেই কেন্দ্রীয় সরকারের মতো স্থানীয় ইউনিটগুলোতেও স্থানীয় প্রশাসন, স্থানীয় সংসদ ও স্থানীয় আদালত সংবলিত 'সরকার ব্যবস্থা' স্থাপন করতে হবে; অর্থাৎ ক্ষমতার পৃথকীকরণ তত্ত্বের প্রয়োগ ঘটাতে হবে। স্থানীয় প্রশাসনগুলো হবে : বিভাগীয়/জেলা প্রশাসন, নগর প্রশাসন, উপজেলা প্রশাসন ও ইউনিয়ন প্রশাসন। স্থানীয় সংসদগুলো হবে : বিভাগীয়/জেলা সংসদ, নগর সংসদ, উপজেলা সংসদ ও ইউনিয়ন সংসদ। অনুরূপভাবে ইউনিয়ন আদালত, নগর আদালত ইত্যাদি গঠন করতে হবে। উদাহরণস্বরূপ, ইউনিয়ন প্রশাসন, ইউনিয়ন আদালত (গ্রাম আদালতের পরিবর্তে) ও ইউনিয়ন সংসদ/কাউন্সিল মিলে 'ইউনিয়ন সরকার' গঠিত হবে।

পাঁচ. প্রতিটি স্থানীয় ইউনিটে সরকার কাঠামোর বাইরে একটি করে নির্বাচনী বোর্ড থাকবে, তথা ইউনিয়নে 'ইউনিয়ন নির্বাচনী বোর্ড', উপজেলায় 'উপজেলা নির্বাচনী বোর্ড', জেলায় 'জেলা নির্বাচনী বোর্ড' এবং নগরে 'নগর নির্বাচনী বোর্ড' গঠন করতে হবে। সে রকম ব্যবস্থা গৃহীত হলে প্রতিটি ইউনিট নিজস্ব দায়িত্বে, নিজস্ব অর্থে সময় মতো সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজন করার ব্যবস্থা করবে (যেমনিভাবে প্রেসক্লাব, ব্যবসায়ী সমিতি, বিভিন্ন কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় করে থাকে)। উল্লেখ্য, স্থানীয়তে স্থানীয় জনগণের মাধ্যমে যদি নির্বাচন সম্ভব হয়, তাহলে জাতীয় পর্যায়েও বরেণ্য ব্যক্তিদের নিয়ে জাতীয় নির্বাচনিক বোর্ড গঠন করে জাতীয় সরকারের নির্বাচন করাও সম্ভব হবে। এতে কেন্দ্রীয় সরকারের প্রচুর অর্থ সাশ্রয় হবে, স্থানীয় সরকারসহ কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতিনিধিরা অধিকতর দায়িত্বশীল হয়ে উঠবেন এবং সর্বত্র আস্থার সমাজ গড়া সম্ভব হবে। প্রতিটি ইউনিটে একজন করে ন্যায়পাল থাকবেন, তথা ইউনিয়নে 'ইউনিয়ন ন্যায়পাল', উপজেলায় 'উপজেলা ন্যায়পাল', জেলায় 'জেলা ন্যায়পাল', 'নগর ন্যায়পাল' থাকবেন। তারা নির্বাচনের মাধ্যমে অথবা মনোনয়নের ভিত্তিতে নিযুক্ত হবেন। স্থানীয় ন্যায়পালরা প্রতিটি ইউনিটের নির্বাচিত প্রতিনিধি ও অনির্বাচিত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ যাচাই-বাছাই সাপেক্ষে মীমাংসা করবেন। এতে প্রতিটি ইউনিটে জবাবদিহিতা ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত হবে এবং তাতে প্রতিনিয়ত গণ-অসন্তোষ নিরসন করা সম্ভব হবে।

ছয়. পরিবেশের প্রতি চরম উদাসীনতা, অপরিকল্পিত নগর ও নগরায়নের কারণে ঢাকা শহর আজকের মরণদশায় উপনীত হয়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, ৭ রিকটার মাত্রার ভূমিকম্প হলে ঢাকা শহর ধ্বংসস্তূপে পরিণত হবে এবং তাতে তাৎক্ষণিকভাবে এক লাখ লোকের মৃত্যু ঘটার আশঙ্কা রয়েছে। লক্ষণীয়, ঢাকা শহরকেন্দ্রিক একটি মাত্র সরকারব্যবস্থা থাকার কারণে সমগ্র দেশের মানুষ ঢাকা শহরমুখী। তবে বর্তমানে ঢাকা শহরের যে অবস্থা, সে অবস্থা আগামীতে অন্যান্য শহরেও প্রকটভাবে দেখা দেবে, যার আলামত ইতোমধ্যে দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে। অর্থাৎ ঢাকামুখী ব্যবস্থা রেখে কোনো পদ্ধতিই ঢাকা নগরকে বাঁচাতে পারবে না। সে জন্য দেশের ৩১৯টি শহরে ৩১৯টি নগর সরকার গঠন করে তাদের মাধ্যমে পরিবেশবান্ধব পরিকল্পিত ৩১৯টি নগর গড়তে হবে এবং তা সব সময় বজায় রাখতে হবে (একইভাবে ক্যান্টনমেন্ট বোর্ডগুলোতেও 'ক্যান্টনমেন্ট নগর সরকার' গঠন করতে হবে)। এতে একদিকে ঢাকা শহরকেন্দ্রিকতা ক্রমান্বয়ে হ্রাস পাবে এবং অন্যদিকে ঢাকা শহরসহ আধুনিক সুযোগ-সুবিধা সংবলিত দেশের ৩১৯টি শহরকেন্দ্রিক উন্নয়ন ভাবনা, কর্মকাণ্ড পরিচালিত ও বিকশিত হবে। বর্তমানে প্রায় পাঁচ কোটি লোক নগরে বসবাস করছে। সে জন্য এখনই দেশের ৩১৯টি নগরকে পরিবেশবান্ধব পরিকল্পিত নগরে পরিণত করতে হবে এবং পরিবেশবান্ধব পরিকল্পিত নগর, নগরায়ন বজায় রাখতে গ্রামীণ সংস্কৃতি ও গ্রামীণ স্থানীয় সরকারব্যবস্থার পরিবর্তে যথাক্রমে নগরীয় কৃষি, নগরীয় জীবন, নগরীয় সমাজ, নগরীয় সভা এবং কৃষি জমি রক্ষায় একটি মহাপরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। ক্রমাগতভাবে দ্রুত নগরায়নের ফলে ২০৫০ সাল নাগাদ গ্রামভিত্তিক প্রশাসনিক ইউনিটের (ইউনিয়ন, উপজেলা ও জেলা) বিলুপ্তি ঘটবে; ফলশ্রুতিতে সে সময় নগরগুলো বিভাগ/জেলার অধীনে পরিচালিত হবে। তখন গোটা সরকারব্যবস্থা তিন স্তরবিশিষ্ট হয়ে যাবে। অর্থাৎ তখন কেন্দ্রীয় সরকার, বিভাগীয় সরকার ও নগর সরকার অথবা কেন্দ্রীয় সরকার, জেলা সরকার ও নগর সরকার থাকবে। ফলে গ্রামীণ কৃষি, গ্রামীণ জীবন, গ্রামীণ সমাজ, গ্রামীণ সভ্যতা, নগরীয় সংস্কৃতি ও নগরীয় স্থানীয় সরকারব্যবস্থা গড়ে উঠতে থাকবে। বর্তমানে বিপুল জনসংখ্যার জন্য খাদ্য নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করতে গ্রামীণ কৃষি ব্যবস্থার পাশাপাশি নগর সরকারের মাধ্যমে প্রতি নগরে নগরীয় কৃষি ব্যবস্থা গড়ে তোলার ওপর সবিশেষ জোর দিতে হবে এবং ভবিষ্যতের কৃষি হিসেবে নগরীয় কৃষির ওপর বিশেষ গুরুত্বারোপ করতে হবে এবং 'নগর মানে কৃষি নয়' এই ক্ষতিকর ভাবনার বিপরীতে 'কৃষিকে নিয়েই নগর' এই সময়োপযোগী ভাবনা সমাজে সুপ্রতিষ্ঠিত করতে হবে।

সাত. পরিকল্পিত কিংবা অপরিকল্পিত যে যুদ্ধের মাধ্যমেই হোক দেশটি স্বাধীন হয়ে গেছে। আমরা এখন স্বাধীন দেশের নাগরিক। স্বাধীন দেশে জনগণ প্রজা হিসেবে বসবাস করে না, মালিক হিসেবে বসবাস করে। রাজনৈতিক দলগুলো মুখে জনগণের সার্বভৌমত্ব বাস্তবায়নের কথা বলছে। কিন্তু তাদের কর্মসূচি এখনো পরাধীন আমলের মতো। লেখক-বুদ্ধিজীবী-সুশীল সমাজের কথাবার্তাগুলোও প্রতিক্রিয়ামূলক, সমাধানমূলক নয়। তারা রাজনৈতিক দলের হয়ে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করছেন মাত্র। অথচ তাদের বক্তব্য হওয়া উচিত পরামর্শমূলক, সহযোগিতামূলক ও দৃষ্টান্তমূলক। আমরা জানি, মালিকানাবোধ সম্পন্ন কোনো রাজনৈতিক নেতা-নেত্রী কখনো বিদেশের কাছে বিচারপ্রার্থী হন না (যেহেতু উন্নত বিশ্বের নেতা-নেত্রীরা তাদের দেশ সম্পর্কে আমাদের নেতা-নেত্রীর কাছে কোনো অভিযোগ দায়ের করেন না)। সে জন্য এখন প্রয়োজন জনগণের সার্বভৌমত্ব তথা জনগণের রাজত্ব বাস্তবায়নের জন্য উপযুক্ত 'উপায়' বের করা। সে ক্ষেত্রে আমরা মনে করি, গণতান্ত্রিক স্থানীয় সরকারই হতে পারে সেই আন্দোলনের উপযুক্ত মাধ্যম। সেই লক্ষ্যে সিডিএলজি বিষয়টি নিয়ে একটি বুদ্ধিবৃত্তিক ক্যাম্পেইন করে আসছে। প্রস্তাবিত গণতান্ত্রিক স্থানীয় সরকারের রূপরেখার কপি ও তার আলোকে প্রণীত বিভিন্ন দফা, সুপারিশের কপি ও তার সারসংক্ষেপ মহামান্য রাষ্ট্রপতি, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী, জাতীয় সংসদ সদস্য, বিরোধীদলীয় নেতানেত্রী, স্থানীয় সরকার প্রতিনিধি, রাজনীতিক, গবেষক, লেখক, সাংবাদিক, আইনজীবী, প্রকৌশলী, ডাক্তার, এনজিও ব্যক্তিত্বসহ সংশ্লিষ্ট সবার সদয় অবগতি ও বিবেচনার জন্য পেশ করা হয়েছে; এর পাশাপাশি সভা, সেমিনার, মতবিনিময় সভা, দলগত সভা, একজন-একজন করে মতবিনিময় সভা, টেলিসংলাপ, প্রকাশনা, পত্রিকায় লেখালেখি, ই-মেইল সংবাদ প্রেরণ ইত্যাদি করা হয়েছে, হচ্ছে। এসবের মাধ্যমে সবার মাঝে ওই রূপরেখা ও সুপারিশের প্রতি একটি ইতিবাচক প্রত্যয় ও দৃঢ সমর্থন পরিলক্ষিত হয়ে আসছে। সে সঙ্গে দেশে আরও ২৩টি ক্ষেত্রে (জাতীয় ও স্থানীয়সহ ২৫টি) গণতন্ত্র বাস্তবায়নের ডিজাইন তৈরির কাজ চলছে (যেমন গণতান্ত্রিক জাতীয় সংসদ, গণতান্ত্রিক জাতীয় উচ্চকক্ষ, গণতান্ত্রিক জাতীয় নির্বাচনিক বোর্ড, স্থানীয় সংসদ ও জাতীয় সংসদ দ্বারা রাষ্ট্রপতি নির্বাচন ইত্যাদি)। এ বিষয়ে গণতন্ত্রমনা রাজনীতিক, গবেষক ও বুদ্ধিজীবীদের সহযোগিতা কামনা করা হচ্ছে। তাই বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের স্বার্থে প্রস্তাবিত গণতান্ত্রিক স্থানীয় সরকারের রূপরেখাটি এবং তার আলোকে প্রণীত সুপারিশগুলো অবিলম্বে বাস্তবায়নের লক্ষ্যে গণসমর্থন ও সহযোগিতা আরও বিস্তৃত ও ব্যাপকতর করতে আমরা সবার দৃঢ় সমর্থন ও সহযোগিতা কামনা করছি এবং সরকারকে বিশেষ গুরুত্বসহকারে বিবেচনায় নিয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের আহ্বান জানাচ্ছি।

লেখক : চেয়ারম্যান, জানিপপ, সহলেখক : প্রফেসর ড. একেএম রিয়াজুল হাসান, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, বিসিএস শিক্ষা এবং মোশাররফ হোসেন মুসা, সদস্য, সিডিএলজি। ই-মেইল- [email protected]

 

 

সর্বশেষ খবর