আমেরিকায় ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বরের সন্ত্রাসী ঘটনার পর সারা বিশ্বে আন্তঃসাম্প্রদায়িক সম্পর্কের চরম অবনতি ঘটেছে। মুসলমান, খ্রিস্টান, ইহুদি এই তিনটি ধর্মীয় সম্প্রদায়ের দ্বন্দ্ব বিশ্ব শান্তির জন্য মারাত্দক হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই দ্বন্দ্ব মানবসভ্যতাকে কোন পথে নিয়ে যাচ্ছে_ তা বিশ্বের প্রতিটি সচেতন মানুষকে ভাবিয়ে তুলেছে। আন্তঃসাম্প্রদায়িক দ্বন্দ্বে_ কি পূর্ব কি পশ্চিম কোথাও মানুষ নিজেকে নিরাপদ ভাবতে পারছে না। মানবজাতির অস্তিত্বকেও তা হুমকির মুখে ঠেলে দিচ্ছে। এ সমস্যার সমাধানে কোন পথে এগুনো যায় উদারমনা ধর্মবিদরা তা নিয়ে ভাবা শুরু করেছেন। তাদের কেউ কেউ বলছেন পৃথিবীতে আজ যে হানাহানি মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে তার নেপথ্যে প্রধান তিনটি ধর্মমত মুসলমান, খ্রিস্টান ও ইহুদিদের পারস্পরিক অবিশ্বাসই মূলত দায়ী। এ অবিশ্বাসের রশি টেনে ধরতে এ মুহূর্তের সর্বোত্তম পদক্ষেপ হতে পারে মিল্লাতে ইব্রাহিমের ঐক্য প্রতিষ্ঠা। আরব ভূখণ্ডে উদ্ভাবিত তিনটি ধর্মীয় মতবাদ ইহুদি, খ্রিস্টান এবং মুসলমানদের কাছে হজরত ইব্রাহিম (আ.) পরম শ্রদ্ধেয় ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব হিসেবে সম্মানিত। মুসলমানরা প্রতিবছর যে ঈদুল আজহা বা কোরবানির ঈদ পালন করেন তা মূলত হজরত ইব্রাহিমেরই (আ.) সুন্নত। হজ পালনের সঙ্গেও ওই মহাপুরুষের পবিত্র স্মৃতি জড়িত।
হজরত ইব্রাহিমের (আ.) জন্ম মানব সভ্যতার পাদপীঠ ইরাকের উর নগরীতে। তার বাবা ছিলেন পৌত্তলিক। শুধু মূর্তিপূজারীই নন, মূর্তি বানানোর শিল্পীও ছিলেন তিনি। ছোটবেলা থেকেই ইব্রাহিম (আ.) উপলব্ধি করেন কোনো মূর্তিকে ঈশ্বর জ্ঞানে পূজা করার মধ্যে সার্থকতা নেই। মূর্তির যে কোনো ক্ষমতা নেই তিনি তা প্রমাণও করেন।
হজরত ইব্রাহিম একেশ্বরবাদের কথা প্রচার করেন। শিক্ষা দেন আল্লাহ এক। তার কোনো শরিক নেই। এই শিক্ষায় ক্ষেপে ওঠে অসত্য, অসুন্দর, অকল্যাণের অনুসারীরা। হজরত ইব্রাহিমের একেশ্বরবাদের কথা রাজা নমরুদের কানে যায়। আত্দগর্বী এই রাজা নিজেকে ঈশ্বর বলে দাবি করতেন। তিনি হজরত ইব্রাহিম (আ.)কে ধর্মদ্রোহিতার অপরাধে অভিযুক্ত করেন। এ নিয়ে ধর্মীয় গ্রন্থগুলোতে রয়েছে মনোগ্রাহী কাহিনী। বলা হয়, নমরুদ ইব্রাহিম (আ.)কে অগি্নকুণ্ডে নিক্ষেপ করার সিদ্ধান্ত নেন। বলেন, তোমার আল্লাহর যদি কোনো ক্ষমতা থাকে তবে এ অগি্নকুণ্ড থেকে রক্ষা করুক। যথাসময়ে সাজানো হয় অগি্নকুণ্ড। উৎসবী আমেজে মেতে ওঠে রাজা নমরুদের অনুসারীরা। ঢোল, বাদ্য আর নাচের তালে তালে হজরত ইব্রাহিম (আ.)কে নিক্ষেপ করা হয় অগি্নকুণ্ডে। কিন্তু তাজ্জব ব্যাপার। মুহূর্তেই অগি্নকুণ্ড পরিণত হয় ফুলবাগানে। হজরত ইব্রাহিম (আ.) রক্ষা পান নিশ্চিত মৃত্যু থেকে। প্রমাণিত হয় হজরত ইব্রাহিমের (আ.) আল্লাহ সত্যিকার অর্থেই সর্বশক্তিমান। অদৃশ্য ও নিরাকার এই আল্লাহ ইচ্ছা করলেই অগি্নকুণ্ডকেও ফুলবাগানে পরিণত করতে পারেন। হজরত ইব্রাহিম (আ.)কে কেন্দ্র করে তৌরাত, ইঞ্জিল ও পবিত্র কোরআনে অনেক আয়াত রয়েছে। মুসলমান, ইহুদি ও খ্রিস্টানদের মধ্যে প্রচলিত রয়েছে অনেক ধর্মীয় কাহিনী। বলা হয়, হজরত ইব্রাহিমের (আ.) কোনো পুত্র সন্তান ছিল না। বৃদ্ধ বয়সে তিনি পুত্রের জনক হন। স্ত্রী হাজেরার গর্ভে জন্ম নেন হজরত ইসমাঈল (আ.)। ছোটবেলা থেকেই যিনি ছিলেন পিতার মতোই আল্লাহপ্রেমী। ইমানের বলে বলীয়ান।হজরত ইব্রাহিম (আ.) একদিন স্বপ্ন দেখলেন আল্লাহ তাকে কোরবানি দেওয়ার আহ্বান করছেন। সবচেয়ে প্রিয় জিনিসকে আল্লাহর রাহে উৎসর্গ করার নির্দেশ পান তিনি। এ স্বপ্ন দেখার পর হজরত ইব্রাহিম (আ.) সকালে উঠেই হালাল পশু কোরবানি দেন। সেদিন রাতেই আবার দেখেন একই স্বপ্ন। এ স্বপ্ন দেখার পর আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য আবারও পশু কোরবানি দেন হজরত ইব্রাহিম (আ.)। তৃতীয় রাতেও একই স্বপ্ন দেখার পর নবীর বোধোদয় হলো। তিনি গভীরভাবে উপলব্ধি করেন তার সবচেয়ে প্রিয় বস্তু তো পুত্র ইসমাঈল। আর আল্লাহ তো প্রিয় বস্তুকে কোরবানির নির্দেশ দিয়েছেন। হজরত ইব্রাহিম (আ.) সিদ্ধান্ত নেন যত কষ্টকরই হোক আল্লাহর নির্দেশই তিনি পালন করবেন। তারপর সকালে উঠেই পুত্রকে নিয়ে গেলেন এক বিরান প্রান্তরে। পথিমধ্যে শয়তান ইসমাঈলকে জানায় তাকে আল্লাহর উদ্দেশ্যে কোরবানির জন্য নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। হজরত ইসমাঈল (আ.) শয়তানকে ভর্ৎসনা করেন। বলেন, আল্লাহর উদ্দেশে কোরবানি হতে পারা তো পরম সৌভাগ্য।
হজরত ইব্রাহিম (আ.) যথাস্থানে এসে প্রিয় পুত্রকে তার স্বপ্নের কথা খুলে বলেন। হজরত ইসমাঈল (আ.) দ্বিধাহীনভাবে বাবাকে বলেন, আল্লাহর রাহে কোরবানি হতে আমি প্রস্তুত। হজরত ইব্রাহিম (আ.) চোখে কাপড় বেঁধে কোরবানি করেন প্রিয় পুত্রকে। কোরবানি শেষে চোখ খুলতেই তিনি দেখেন সামনে একটি দুম্বা জবাই হয়ে আছে। পাশে দাঁড়িয়ে প্রিয় সন্তান ইসমাঈল। আল্লাহ হজরত ইব্রাহিমের (আ.) আত্দত্যাগের পরীক্ষায় সন্তুষ্ট হন। হজরত ইব্রাহিমের (আ.) স্মৃতির স্মরণেই মুসলমানরা ঈদুল আজহায় পশু কোরবানি দেন। অবস্থাপন্ন মুসলমানরা এ সময়ে পবিত্র কাবাগৃহে পালন করেন হজব্রত। মুসলমানদের কেবলা হিসেবে পরিচিত কাবাগৃহ পুনঃনির্মাণের সঙ্গেও হজরত ইব্রাহিম (আ.) ও তাঁর পুত্র ইসমাঈলের স্মৃতি জড়িত। বিশ্বাস করা হয় কাবাগৃহ নির্মাণ করেন ফেরেস্তারা। হজরত ইব্রাহিম (আ.) তা পুনঃনির্মাণ করেন।
বিপথগামী মানুষকে সত্যের পথে আহ্বান জানান হজরত ইব্রাহিম (আ.)। তাঁর আহ্বানে সাড়া দেয় ইহুদিরা। আল্লাহ বা যিহোবাকে তারা মেনে নেয় ত্রাণকর্তা হিসেবে। হজরত ইব্রাহিমের (আ.) শিক্ষায় নিজেদের আলোকিত করে তারা। ঐক্যবদ্ধ হয় আল্লাহর প্রেরিত পুুরুষের পেছনে। এ ঐক্য ইহুদিদের ভাগ্য ফিরায়। যারা ছিল অভিশপ্ত জাতি তারা পায় নিজস্ব ভূখণ্ড। গঠিত হয় নতুন দেশ। যার নাম কানান। যে দেশটি এখন ফিলিস্তিন বা প্যালেস্টাইন নামে পরিচিত। হজরত ইব্রাহিম (আ.) মানুষকে শিক্ষা দেন আল্লাহ এক। নিরাকার তিনি। যার আকারই নেই তার কোনো মূর্তি হতে পারে না। হজরত ইব্রাহিমের (আ.) শিক্ষাকে ইহুদিরা ধরে রাখতে পারেনি। তারা ভুলে যায় আল্লাহর কথা। মূর্তিপূজা শুরু করে তারা। যে উপাসনাগারে একদিন কোনো মূর্তির ঠাঁই ছিল না; সেখানে আবিভর্ূত হয় বেল, মার্কুড প্রমুখের মূর্তি। ঈশ্বর ভেবে তারা এ দুই দেবতার পূজা শুরু করে। জড়িয়ে পড়ে সামাজিক অনাচারে। শুরু হয় বিভেদ ও হানাহানি। ফলে নেমে আসে আল্লাহর অভিশাপ।
হজরত ইব্রাহিমের (আ.) প্রচেষ্টায় ইহুদিরা আত্দপ্রকাশ করে স্বাধীন জাতি হিসেবে। সে স্বাধীনতা বিসর্জন দেয় তারা। ইহুদিরা পরিণত হয় উদ্বাস্তু জাতিতে। নিজস্ব ভূখণ্ড থেকে তারা বিতাড়িত হয়। ঠাঁই নেয় মিসরে। দাসত্বের জীবন বরণ করতে বাধ্য হয় তারা। এ অবস্থায় আল্লাহর কৃপা হয়। তিনি মুসেজ বা হজরত মুসা (আ.)কে পাঠান ইহুদিদের কাছে। অভিশপ্ত ইহুদিদের মুক্তির পথ দেখান তিনি। প্রচার করেন মহান আল্লাহর বাণী। তার এ সত্য প্রচারে ক্ষুব্ধ হয় ফেরাউন। যিনি নিজেকে স্বয়ং খোদা বলে দাবি করতেন। ফেরাউন তার সেনাবাহিনীকে লেলিয়ে দেন মুসার বিরুদ্ধে। বিপদে পড়েন আল্লাহর নবী। তিনি এ বিপদে আল্লাহর সাহায্য চান। মুসা ও তার অনুসারীদের ফেরাউনের হাত থেকে বাঁচাতে আল্লাহ নীল নদের মাঝ দিয়ে রাস্তা বানিয়ে দেন। সে রাস্তা দিয়েই ইহুদিরা আবারও ফিরে আসে স্বদেশ ভূমিতে। মুসার বিরুদ্ধে ধাববান ফেরাউন বাহিনী নদীতে ডুবে মারা যায়। আল্লাহ বারবার ইহুদিদের সত্য পথে আনার জন্য একের পর এক নবী পাঠিয়েছেন। কিন্তু কথায় বলে 'চোরা না শোনে ধর্মের কাহিনী'। নবীর অন্তর্ধানের পরই তারা ভুলে যেত তার উপদেশ। ফিরে যেত আলো থেকে অন্ধকারে। সত্য, সুন্দর-কল্যাণের পথ থেকে দূরে সরে যেত অবলীলায়। আল্লাহ পৃথিবীতে যত নবী পাঠিয়েছেন তার এক বিরাট অংশই এসেছে ইহুদিদের কাছে। কিন্তু এ 'অভিশপ্ত জাতি' সত্যের পথে কখনো অটল থাকেনি।
খ্রিস্টান ধর্মের প্রবর্তক যিশুখ্রিস্ট বা হজরত ঈসা (আ.) ছিলেন এক পুণ্য পুরুষ। বলা হয় তার কোনো পিতা ছিল না। আল্লাহর ইচ্ছায় এটি সম্ভব হয়েছিল। মেরি বা মরিয়মের গর্ভে জন্মলাভ করেন এ পবিত্র শিশু। বিপথগামীদের সত্য পথে চালিত করতে এক মহাপুরুষের আবির্ভাব হবে, এটি প্রতিটি ধর্মপ্রাণ মানুষ বিশ্বাস করতেন। ইহুদিদের ধর্মীয় গ্রন্থে হজরত ঈসার (আ.) অভ্যুদয় সম্পর্কে ইশারা ছিল। তিনি ইহুদি জাতির মুক্তিদাতা হবেন_ এ ওয়াদাও করা হয় স ষ্টার পক্ষ থেকে।
হজরত ঈসা (আ.) বা যিশুর সত্য, সুন্দর ও কল্যাণের পথে জড়ো হয় পথহারা মানুষ। পথের দিশা খুঁজে পায় তারা। ইহুদি পুরোহিতরা তার এ অভ্যুদয়কে মেনে নিতে পারেনি। তারা হজরত ইব্রাহিম (আ.) ও হজরত মুসার (আ.) শিক্ষা ভুলে অশুভ শক্তির কাছে নিজেদের জিম্মি করে। ইহুদি পুরোহিতদের যোগসাজশে ঈসাকে ক্রুশবিদ্ধ করা হয়। এ সম্পর্কে অবশ্য খ্রিস্টীয় ও ইসলামী বিশ্বাসের মধ্যে কিছু পার্থক্য আছে। খ্রিস্টানদের মতে, ক্রুশবিদ্ধ হয়ে যিশুর মৃত্যু হয়। ইসলামী বিশ্বাসে আল্লাহ তাঁর প্রিয় নবীকে ঊধর্্বলোকে তুলে নেন।
হজরত ঈসার (আ.) প্রায় পৌনে ছয়শ বছর পর আরবের মক্কা নগরীতে হজরত মুহাম্মদের (সা.) অভ্যুদয় ঘটে। সে ছিল এক অন্ধকার যুগ। আরববাসী হজরত ইব্রাহিমের (আ.) শিক্ষা ভুলে মূর্তিপূজায় মেতে ওঠে। পবিত্র কাবাগৃহে তখন ছিল নানা দেবদেবীর মূর্তি। হজরত ইব্রাহিম, মুসা, ঈসা (আ.)-এর অনুকরণে হজরত মুহাম্মদ (সা.) এক আল্লাহর বাণী প্রচার করেন। কোরআনের ভাষায় হজরত মুহাম্মদ (সা.) হলেন শ্রেষ্ঠ ও শেষ নবী। তাঁর পর আল্লাহ আর কোনো নবীকে পৃথিবীতে পাঠাবেন না।
আরব ভূখণ্ডেই পৃথিবীর তিনটি প্রধান ধর্ম ইহুদি, খ্রিস্টান ও ইসলামের অভ্যুদয়। পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার দুই-তৃতীয়াংশের বেশি এ তিন ধর্মের অনুসারী। এদিক থেকে ভারতবর্ষেরও আলাদা এক মর্যাদা রয়েছে। দুনিয়ার অন্যতম প্রধান দুটি ধর্মমত হিন্দু ও বৌদ্ধ ধর্মের অভ্যুদয় ঘটেছে ভারতীয় উপমহাদেশে। এ দুটি ধর্মমতের অনুসারীর সংখ্যাও কম নয়। বিশ্বের এক-চতুর্থাংশ মানুষ এ দুটি ধর্মে বিশ্বাসী। হিন্দু ধর্মের প্রাণপুরুষ শ্রীকৃষ্ণ। বৌদ্ধ ধর্মের প্রবর্তক ভগবান বুদ্ধ। পৃথিবীর সব ধর্মের প্রবর্তকরাই সত্য, সুন্দর কল্যাণের পথে চলার শিক্ষা দিয়েছেন। তা সত্ত্বেও মানুষে মানুষে এত ভেদাভেদ কেন? সব ধর্মের লক্ষ্য যেখানে সত্য, সুন্দর কল্যাণের অনুবর্তী হওয়া, সেখানে অসত্য, অসুন্দর ও অকল্যাণের দাপট কেন?
পৃথিবীর কোনো ধর্মই অপর ধর্মকে ঘৃণা করতে শেখায়নি। হিন্দু ধর্মে মানবতার সেবাকে ঈশ্বর সেবা হিসেবে উল্লেখ করেছে। এ ধর্মের এক অবতার শ্রী চৈতন্য দেব বলেছেন, 'সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপর কেহ নাই'। বৌদ্ধ ধর্ম তো সক্রিয়ভাবে অহিংসাকে পরম ধর্ম হিসেবে ঘোষণা করেছে। আর ইসলামের অর্থই হলো শান্তি। মহাপুরুষ হজরত মুহাম্মদ (সা.) ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ির বিরুদ্ধে অনুসারীদের সতর্ক করেছেন। পবিত্র কোরআন বলেছে, 'তোমার ধর্ম তোমার কাছে আমার ধর্ম আমার কাছে'।
রক্তপাত এড়াতে মহানবী নিশ্চিত বিজয়ের মুখে মক্কা জয় থেকে বিরত থেকেছেন। আবদ্ধ হয়েছেন হোদায়রিয়ার সন্ধিতে। মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) কুরাইশদের ষড়যন্ত্রে মক্কা থেকে মদিনা চলে যেতে বাধ্য হন। বারবার বিধর্মীদের দ্বারা আক্রান্ত হয়েছেন। অথচ মক্কা দখলের পর তিনি প্রতিহিংসার কোনো পথ বেছে নেননি। ইসলামের এক খলিফা খ্রিস্টান অতিথিকে মসজিদে তাদের উপাসনা করার সুযোগ দিয়েছেন।
ইসলাম ধর্মের প্রবর্তক হজরত মুহাম্মদ (সা.) পরধর্মের প্রতি সহিষ্ণুতার অনন্য দৃষ্টান্ত রেখেছেন। কতটা সহিষ্ণু ছিলেন মহানবী (সা.), তার মদিনা জীবনের একটি উদাহরণ এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যায়। হজরত মুহম্মদ (সা.) একদিন সাহাবাবেষ্টিত হয়ে বসে আছেন মসজিদে। এমন সময় সেখানে এলো একদল ইহুদি। তারা বলল আমরা বাইরের বাসিন্দা। মদিনায় এসেছিলাম। কাজ শেষে সময়মতো নিজেদের আস্তানায় ফিরে যেতে পারিনি। মদিনায় আমাদের রাত কাটানোর মতো কোনো জায়গাও নেই। মসজিদে রাত কাটানোর জন্য তারা নবীর কাছে আবেদন জানাল।
আল্লাহর নবী ইহুদিদের প্রস্তাবে রাজি হলেন। বললেন আজ তোমরা আমাদের অতিথি। মসজিদেই রাত কাটাতে পারবে তোমরা। আমার এবং সাহাবাদের খেজুরের ভাগও পাবে। রাতে মহানবী (সা.) এশার নামাজ শেষে মসজিদ ত্যাগ করলেন। ইহুদিরা যাতে ভালোভাবে রাত কাটাতে পারে সে ব্যবস্থাও করলেন। কিন্তু ইহুদিরা আসলে বিপদে পড়ে মসজিদে আসেনি। এসেছিল মসজিদের ক্ষতি করতে। তারা মলমূত্র ত্যাগ করে মসজিদ অপবিত্র করার চেষ্টা করল। তারপর ভোর হওয়ার আগেই পালিয়ে গেল মদিনা থেকে।
ফজরের নামাজের আগে মহানবী (সা.) মসজিদে এসে দেখেন ইহুদিরা নেই। মলমূত্রের দুর্গন্ধে দূষিত হয়ে পড়েছে মসজিদের পরিবেশ। সাহাবারা তা দেখে ক্রোধে ফেটে পড়লেন। বললেন, আমরা ওদের এখনই ধাওয়া করব। ওদের কতল করে প্রতিশোধ নেব।
মহানবী (সা.) তাদের মানা করলেন। বললেন না। এ মসজিদ আমাদের জন্য পবিত্র। ইহুদিদের জন্য নয়। সে কারণে ওরা এ পবিত্র স্থানকে অপবিত্র করার সাহস পেয়েছে। এ জন্য প্রতিশোধ নেওয়ার দরকার নেই। মসজিদ আল্লাহর ঘর। তিনিই এ ঘর হেফাজত করবেন। নির্বোধদের ওপর উত্তেজিত হওয়ার দরকার নেই।
ধর্মান্ধতার কারণেই আজ মানবসভ্যতা বিপন্ন অবস্থায় পড়েছে। যে ইসলাম ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি না করার শিক্ষা দিয়েছে সেখানেও লাদেনের মতো অসহিষ্ণু প্রতিভুর উদয় হয়েছে।
মানুষকে ভালোবাসার শিক্ষা দিতেন যে হজরত ঈসা বা যিশুখ্রিস্ট, তাঁর ধর্মের নামেও আবির্ভাব হয়েছে বুশ-ব্লেয়ারের মতো যুদ্ধবাজরা। ১১ সেপ্টেম্বরের পর ক্রুসেড বা ধর্মযুদ্ধের হুমকিও দিয়েছে তারা। হত্যা করেছে ইরাক ও আফগানিস্তানের নিরপরাধ শিশুকে। অসহায় বৃদ্ধ, নারী কেউই তাদের প্রতিহিংসা থেকে রক্ষা পায়নি। হজরত মুসার (আ.) অনুসারী হিসেবে গর্বিত পরিচয় দিয়ে ইহুদি রাষ্ট্র ইসরাইলের শাসক হিসেবে একের পর এক কসাইয়ের আবির্ভাব হয়েছে।
ফিলিস্তিনি শিশুদের এতিম করাকে যারা মহাপুণ্যের কাজ বলে ভেবে নিয়েছে। নারী, বৃদ্ধ কেউই তাদের প্রতিহিংসা থেকে বাদ যাচ্ছে না।
মানবসেবাকে প্রকৃত ধর্ম বলে অভিহিত করেছে হিন্দু ধর্মের অবতাররা। সে ধর্মের সোল এজেন্ট হিসেবে নিজেদের দাবি করে ভারতে বিংশ শতাব্দীর শেষদিকে আবির্ভূত হয় নরেশ মোদীরা।
গুজরাটে হাজার হাজার শিশু, নারী, বৃদ্ধ, যুবককে তারা হত্যা করে পবিত্র হিন্দু ধর্মেরই নামে। বাবরি মসজিদ ভাঙার উপাখ্যান তো সবারই জানা। বৌদ্ধ ধর্মের প্রবর্তক মহাপুরুষ বুদ্ধের শিক্ষা ছিল অহিংসা পরম ধর্ম।
বিশ্বাসীদের আদি পিতা হজরত ইব্রাহিম (আ.) মানুষকে সত্য, সুন্দর ও ত্যাগের শিক্ষা দিয়েছেন। যীশুখ্রিষ্টের শিক্ষা 'মানুষকে ভালোবাস'। কতটুকু ভালোবাসায় বিমুগ্ধ ছিলেন এই মহাপুরুষ? তিনি ক্রুশে বিদ্ধ হওয়ার সময় তার বিরুদ্ধে যারা ষড়যন্ত্র করেছে তাদেরও ক্ষমা করার জন্য সন দূরে অবস্থান করছে? হজরত ইব্রাহিম (আ.) থেকে মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) পর্যন্ত সব নবী-পয়গম্বর মানুষকে সহিষ্ণু হওয়ার শিক্ষা দিয়েছেন। এ শিক্ষার সঙ্গে ভগবান বুদ্ধ, শ্রীকৃষ্ণ, গুরু নানকের শিক্ষার কোনো পার্থক্য নেই। মহাপুরুষদের এসব শিক্ষাকে আমরা কতটা আত্দস্থ করেছি? ধর্মের নামে ধর্মান্ধতা কেন বারবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে? কেন লাঞ্ছিত হচ্ছে কোরআন, বাইবেল, গীতা, ত্রিপিটকের উপদেশ। এটি আজ সব ধর্মের সব সচেতন মানুষকেই ভেবে দেখতে হবে।
লেখাটির শুরুতে ঈদুল আজহার কথা বলেছি। হজরত ইব্রাহিমের (আ.) সুন্নত হিসেবে মুসলমানরা যে এই উৎসব পালন করেন সে কথাও বলেছি। হজরত ইব্রাহিম (আ.) শুধু মুসলমান নন, পৃথিবীর অন্য দুটি প্রধান ধর্মাবলম্বী খ্রিস্টান ও ইহুদিদের কাছেও সমানভাবে সমাদৃত। অশেষ শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতার সঙ্গে তারাও স্মরণ করেন এই মহাপুরুষের নাম।
বিশ্বের তিনটি প্রধান ধর্মীয় মতবাদ ইসলাম, খ্রিস্টান ও ইহুদি ধর্মের অনুসারীরা আজ দ্বন্দ্ব-সংঘাতে লিপ্ত। তাদের এই সংঘাত বিশ্ব শান্তির জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ তিন ধর্মের প্রবর্তকরা মানুষে মানুষে শান্তি ও সৌহার্দ্যের কথা প্রচার করলেও তাদের অনুসারীদের মধ্যে দানা বেঁধে উঠেছে গভীর অবিশ্বাস। এ অবিশ্বাসই ১১ সেপ্টেম্বরের মতো মর্মান্তিক ট্রাজেডির জন্ম দিয়েছে। এই সংঘাতের কারণেই আফগানিস্তানের স্বাধীনতা লুণ্ঠিত হয়েছে। মানব সভ্যতার পাদপীঠ ইরাক পরিণত হয়েছে ধ্বংসস্তূপে। ঘৃণা ও অবিশ্বাসের বাতাবরণে ফিলিস্তিনিরা আজ এক এতিমের জাতিতে পরিণত হতে চলেছে। একক পরাশক্তির দাবিদার মার্কিনিরা শক্তি বলে নিজেদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার অহংকারী পথে চললেও সে প্রত্যাশা আজ সুদূরপরাহত। ঘৃণা ও অবিশ্বাসের পরিবেশ যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা বিশ্বের প্রতিটি নাগরিকের নিরাপত্তা কেড়ে নিয়েছে। মানবজাতি আজ যখন অনাকাঙ্ক্ষিত সংঘাতে লিপ্ত তখন হজরত ইব্রাহিমের (আ.) স্মৃতি সংকটের গ্রন্থিমোচনে সহায়তা করতে পারে। বিশ্বাসীদের আদি পিতা হজরত ইব্রাহিম (আ.)কে কেন্দ্র করে গড়ে উঠতে পারে ঐক্যের পরিবেশ। হিংসা, হানাহানি ও অশান্তির পথ থেকে সরে আসার জন্য হজরত ইব্রাহিমের (আ.) সন্তানদের ঐক্য নতুন পথ দেখাতে পারে। যে পথ শান্তি ও সহাবস্থানের পথ। মানুষে মানুষে ভালোবাসা ও মৈত্রীর পথ। এ পথই আজ মানব জাতিকে নিশ্চিত ধ্বংস থেকে বাঁচাতে পারে।
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট
ই-মেইল : [email protected]