শিরোনাম
শনিবার, ১১ জানুয়ারি, ২০১৪ ০০:০০ টা
খোলা কলাম

ভোটারবিহীন নির্বাচন সরকারকে দুর্বলই করবে

মইনুল হোসেন

ভোটারবিহীন নির্বাচন সরকারকে দুর্বলই করবে

আমাদের বলতে হবে গণতান্ত্রিক নির্বাচন কাকে বলে। শাসনতন্ত্রের কোনো নিয়ম মানার বাধ্যবাধকতা ভিন্ন ব্যাপার। শাসনতন্ত্রের বিধান অনুযায়ী নির্বাচন কখন হবে আর নির্বাচন গণতন্ত্রসম্মত অবাধ ও নিরপেক্ষ হওয়ার নিশ্চয়তা একান্তভাবেই স্বতন্ত্র বিষয়। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে যেটা ঘটেছে তা হলো, জনপ্রিয়তা হারিয়ে ফেলা একটি সরকার ক্ষমতায় থেকে নির্বাচনে জয়লাভের স্বার্থে শাসনতন্ত্র একতরফাভাবে পরিবর্তন করে নিয়েছে। বাংলাদেশের জনগণ সঠিকভাবেই অনুধাবন করতে সক্ষম হয়েছে যে, তারা দীর্ঘকাল ধরে গণতন্ত্রের জন্য যে সংগ্রাম করে এসেছে তা একতরফা নির্বাচনে জয়ী হতে গিয়ে তার অবমাননা করা হয়েছে। ভোটারবিহীন নির্বাচন যেমন সম্ভব নয়, তেমনি নিয়ন্ত্রিত নির্বাচনের মাধ্যমে গণতন্ত্র রক্ষা করা অসম্ভব।

আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় একতরফা নির্বাচন অনুষ্ঠানের এতটা সমালোচনা করছিল যে, তাকে সহজে অবজ্ঞা করা হবে এমনটা বিশ্বাস করা যায়নি। বস্তুত যেদিন একতরফা নির্বাচন অনুষ্ঠানের অনুকূলে শাসনতন্ত্র পরিবর্তন করার পরিকল্পনা করা হয়েছিল কার্যত সেদিনই একদলীয় শাসন প্রতিষ্ঠার নির্বাচন সম্পন্ন করা হয়েছিল। সবার অংশগ্রহণে নির্বাচন অনুষ্ঠানের যুক্তি এবং গণতন্ত্রকে অস্বীকার করে চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল ক্ষমতায় থেকে নিয়ন্ত্রিত নির্বাচনী ব্যবস্থাকে।

ভারতের দাবি হচ্ছে_ এ অঞ্চলের জন্য কী ভালো সে-ই সবচেয়ে ভালো বোঝে, এটা এ অঞ্চলের অন্য দেশগুলোর ব্যাপারে পুরোপুরি সত্য নয়। এটা অবশ্যই ভারতীয় নীতির ব্যর্থতা যে, এ অঞ্চলের অনেকেই ভারতকে বিশ্বস্ত বন্ধু হিসেবে দেখে না। আমরা, আমাদের দিক থেকে বরাবর বাংলাদেশের শান্তি ও গণতন্ত্র বিনির্মাণে ভারতের সহযোগিতা প্রত্যাশা করে এসেছি। কারণ মুক্তিযুদ্ধে সে দেশ আমাদের সাহায্য করেছিল। ভারতের প্রতি আমাদের বিশ্বাসের ভিত্তি সুদৃঢ় কিনা, আমরা নিশ্চিত হতে পারছি না।

আমাদের ভালোমন্দের ব্যাপারে ভারত যদি তার ধ্যান-ধারণা আমাদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া সম্ভব মনে করে থাকে তবে ভারত মস্তবড় ভুল করবে এবং এই ভুল ভাঙতে খুব সময় লাগবে না। যেকোনো ধরনের সংকট মোকাবিলা করার জন্য এই ভুয়া নির্বাচন শেখ হাসিনার সরকারকে অধিকতর শক্তিশালী করার বদলে অধিকতর দুর্বল করেছে। নিশ্চিতভাবে বলা যায়, বিদ্যমান সংকট ছাড়াও নতুন আরও জটিল সমস্যার সম্মুখীন হতে হবে তাকে। তা ছাড়া সরকারের দক্ষতা তো বাইরে থেকে আনা যায় না।

আরামপ্রদ গণতন্ত্রের পটভূমিতে একটা সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী সরকার প্রতিষ্ঠার অভিপ্রায় নিয়ে একশ্রেণীর বিজ্ঞ ব্যক্তি এই পরিকল্পনা করেছিলেন এবং এই নীলনকশা বাস্তবায়নে যাতে ব্যর্থতার কোনো অবকাশ না থাকে সে জন্য কঠোর পরিশ্রমও তারা করেছিলেন; কিন্তু বাস্তবায়নের পদ্ধতি ছিল লজ্জাজনক ও চরম অগণতান্ত্রিক। শাসনতন্ত্রের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সরকার যে নির্বাচনী ব্যবস্থা চালু করেছে তাতে অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠান কোনোভাবেই সম্ভব ছিল না। বিদ্যমান সরকারের ব্যবস্থাপনায় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কারণে বিরোধী দলের বিজয় অর্জনের কোনো সুযোগ রাখা হয়নি। শাসনতন্ত্র অনুযায়ী সরকার পরিবর্তনের নির্বাচন ব্যবস্থা আর নেই।

জাতিসংঘ, যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং অন্যদের অনুমোদন না থাকা সত্ত্বেও এ রকম চরম নির্লজ্জ নির্বাচনী বিজয় এনে দেওয়ার জন্য বিজ্ঞ ব্যক্তিদের দরকার ছিল কিছু বাইরের প্রণোদনা। ভারতের অনুসৃত নীতি সেটাই করছে। বাংলাদেশের নির্বাচন ধ্বংস করার জন্য বিজেপি কংগ্রেস সরকারের সমালোচনা করেছে, আশা করা হচ্ছে যে, আগামী নির্বাচনে ভারতের ক্ষমতায় আসবে এই বিজেপি।

নির্বাচনের সময়টাতে বিরোধী দলের নেতা বেগম খালেদা জিয়াকে গৃহবন্দী করে রাখা হয়েছিল। তৃতীয় বৃহত্তম দলনেতা সাবেক প্রেসিডেন্ট হুসেইন মুহম্মদ এরশাদকে সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য নিয়ে তার চলাফেরার স্বাধীনতা অস্বীকার করা হলো। কারণ তিনি অগ্রহণযোগ্য নির্বাচন থেকে দূরে থাকতে চেয়েছিলেন। প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছাড়াই সংসদীয় আসন এবং মন্ত্রিত্বের লোভ দেখিয়ে তার দল ভাঙা হলো এবং তাকে বাইরে বেরুতে দেওয়া হলো না।

পূর্ব পরিকল্পিত একতরফা নির্বাচনে সরকারের বিজয় পুনরায় নিশ্চিত করার জন্য কমিউনিস্ট দেশগুলোর মতো ৫ জানুয়ারি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলো। এই তথাকথিত নির্বাচনের আগেই জোটের শরিকদের মধ্যে আসন ভাগাভাগির মাধ্যমে বিজয় পাকাপোক্ত হয়ে গিয়েছিল যখন ৩০০ আসনের মধ্যে ১৫৩টি আসনের ফল বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্ধারিত হয়ে যায়।

প্রধান বিরোধী দল বিএনপির অনুপস্থিতিতে বাকি ১৪৭ সিটের নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যাপারটি ছিল আনুষ্ঠানিকতা, বিরোধী দলের নির্বাচন বর্জন ও বানচালের কর্মসূচির মধ্যে সেই আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করতে গিয়ে ২২ জনের প্রাণ যায়। নিরাপত্তাজনিত কারণে ১৪৮টি ভোটকেন্দ্রের ভোটগ্রহণ স্থগিত করা হয়।

দেশজুড়ে এখনো আগুন জ্বলছে। মানুষকে জীবন হারাতে হচ্ছে। এটা নিশ্চয়ই অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক যে, ভোটারবিহীন নির্বাচন নিয়ে হিন্দু-মুসলমান সম্প্রীতির সম্পর্কেও দেখা দিয়েছে অনাকাঙ্ক্ষিত সংঘাত। সরকারকে অবশ্যই হিন্দুদের জানমালের নিরাপত্তা দিতে হবে। অপরের কাঁধে দোষ চাপানো সরকারের দায়িত্ব হতে পারে না। এ রকম পরিস্থিতিতে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে প্রদত্ত ভোটের পরিমাণ ছিল তুলনামূলক বিচারে সর্বনিম্ন। অনেক কেন্দ্রে কোনো ভোটই দিতে আসেনি ভোটাররা। সাধারণত নির্বাচনকে কেন্দ্র করে যে জনজীবনে ভোট উৎসব হয়ে থাকে এবার সেই উৎসবের মেজাজই ছিল না। সত্যি বলতে কি, এবারের নির্বাচনে জনগণের কোনো সম্পৃক্ততা ছিল না। সরকার পরিচালিত এই নির্বাচন আন্তর্জাতিকভাবে গৃহীত হয়নি।

আগেই সব ভবিষ্যৎবাণীতে বলা হয়েছিল, অবাধ নিরপেক্ষ নির্বাচন হলে আওয়ামী লীগ সরকার অবশ্যই ব্যাপক ব্যবধানে পরাজিত হবে; কিন্তু এমনভাবে নির্বাচনে কারচুপি করা হয়েছে যে, সরকার দুই-তৃতীয়াংশের চেয়ে বেশি আসনে বিজয়ী হয়েছে। কোন বিচারে নবনির্বাচিত সরকারকে জনপ্রিয় সরকার বলা যাবে বুঝি না।

কিছু লোক এখনো আশা করছেন, নির্বাচন শেষ হওয়ার পর নতুন করে আপস-আলোচনার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। এ ধরনের চিন্তাভাবনাও আমার কাছে সম্পূর্ণ অবাস্তব। জনগণের ভোটাধিকার অস্বীকার করে যে সরকার বাইরের সাহায্য নিয়ে ক্ষমতায় থাকতে চায় সেই সরকার কোনো অর্থবহ সমঝোতার জন্য প্রস্তুত থাকতে পারে না। নিজের জনগণের ইচ্ছার বিরুদ্ধে যেমন সরকার নির্বাচনে বিজয়ী হয়েছে, তেমনি সেই জনগণের ইচ্ছার তোয়াক্কা না করেই দেশ শাসন করতে চাইবে। জনগণের ইচ্ছার বিরুদ্ধে নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার অর্থ জনগণের সঙ্গে আগাগোড়া লড়াই করে যাওয়া। এ রকম পরিস্থিতি শান্তি ও স্থিতিশীলতার জন্য শুভ বার্তা বহন করে না। দেশে বিভিন্ন ধরনের ষড়যন্ত্রের সুযোগই তৈরি হয়েছে।

যারা এ রকম আশা পোষণ করেন যে, নির্বাচন তো হয়ে গেল এখন প্রধান দুটি রাজনৈতিক দল সমঝোতায় এসে শীঘ্রই নতুন নির্বাচন অনুষ্ঠানের দিকেই যাবে_ তাদের উদ্দেশে আমি বলব, এর সঙ্গে সম্পৃক্ত রাজনৈতিক জটিলতা সম্পর্কে তারা খুব কম জ্ঞান রাখেন।

আমাদের দৃষ্টিতে এটা আসলে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যকার লড়াই নয়, এ লড়াই হচ্ছে বাংলাদেশের জাতিসত্তার লড়াই, কারা এ দেশকে শাসন করার বৈধ অধিকারী সেটা নিষ্পত্তির লড়াই। এ লড়াইয়ে দুর্নীতির মাধ্যমে আনুগত্য কেনা-বেচার যে পদ্ধতি চালু আছে সেটিকে রক্ষা করতে হবে। দেশে এমন লোকও আছেন যারা বিশ্বাস করেন জনগণ নয়, তারাই মুক্তিযোদ্ধা এবং তাদের সমর্থকরাই দেশ শাসন করবে। সর্বজনীন জনগণের ভোটে নয়, জনগণের ভালো-মন্দ নির্ধারণ করার বৈধ অধিকার কেবল তাদেরই রয়েছে। সুতরাং আমাদের জনগণ যে সংকট মোকাবিলা করছেন তার মূল আরও গভীরে নিহিত এবং দীর্ঘদিনের। এমনো হতে পারে যে, এ থেকে গৃহযুদ্ধের মতো ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে এবং এমন সব বিষয় উঠে আসতে পারে, যা এখনো আলোচনায় আসেনি।

এটা নিশ্চিতভাবে বলা যায়, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে সমাধান খুঁজে পাওয়ার কোনো পরিকল্পনা সরকারের ছিল না এবং এটা চরম উদ্বেগের বিষয় না হয়ে পারে না যখন শাসনতান্ত্রিকভাবে কোনো সমস্যার গণতান্ত্রিক সমাধানের বিকল্প খুঁজে পাওয়া অসম্ভব করা হয়। কোনো জাতির আত্দপরিচিতি বাইরের শক্তি নির্ধারণ করতে পারে না এবং গণশক্তির এই যুগে কোথাও কোনো শ্রেণী বা জনতার একটি ক্ষুদ্রাংশ জনগণকে শাসন করার বৈধতা অর্জনের দাবি করতে পারে না। দেশে কাদের রাজনীতি করার অধিকার থাকবে এবং কে কার সঙ্গে জোট বেঁধে রাজনীতি করতে পারবে অথবা পারবে না, এ সিদ্ধান্ত কেবল জনগণই নিতে পারে। এ ব্যাপারে কোনো দলের সিদ্ধান্ত বা নির্দেশনা গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। সবার কাছে আমাদের আবেদন থাকবে গণতন্ত্রের জন্য বাংলাদেশের সংগ্রাম যেন ব্যর্থ না হয়। সবকিছুর জন্য যদি পুলিশি শক্তির ওপর নির্ভরশীল থাকতে হয় তাহলে রাজনৈতিক সরকার বা নির্বাচিত সরকারের গুরুত্ব কোথায় থাকে তা আমি বুঝি না।

লেখক : তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা।

 

 

সর্বশেষ খবর