শনিবার, ১৭ মে, ২০১৪ ০০:০০ টা

দলবাজি ছেড়ে মানবতার মিছিলে যোগ দিই

মাহমুদুর রহমান মান্না

দলবাজি ছেড়ে মানবতার মিছিলে যোগ দিই

গত ১৩ তারিখ নারায়ণগঞ্জে গিয়েছিলাম। 'আমরা নারায়ণগঞ্জবাসী' নামের একটি নাগরিক সংগঠন নারায়ণগঞ্জে ৭(১১)! খুন, অপহরণ শীর্ষক একটি গোলটেবিল বৈঠকের আয়োজন করেছিল। ১৯-২০ পার হয়ে গেল কিন্তু নারায়ণগঞ্জের বিভীষিকা আমাদের পিছু ছাড়ছে না। নারায়ণগঞ্জবাসীর জন্য সেটা আরও ভয়ের, আশঙ্কার, লজ্জা ও দুঃখের। নারায়ণগঞ্জ এক সময় শান্তির শহর ছিল। প্রাচ্যের ড্যান্ডি বলা হতো নারায়ণগঞ্জকে। অথচ সেই শহর আজ এক সন্ত্রাসের নগরী। নারায়ণগঞ্জবাসীর বিশেষ করে নারায়ণগঞ্জের অগ্রণী নাগরিক সমাজের গভীর দুঃখ এটা। ফেসবুকে পত্রিকায় দুটো ছোট ছোট লেখার কথা বললেন স্থানীয় বক্তারা। এক. হাইওয়েতে যেতে যেতে গাড়ির আরোহীরা দেখলেন পথের পাশে সাইনবোর্ডের মতো তীরচিহ্ন দেওয়া, তাতে লেখা সামনে নারায়ণগঞ্জ। আরোহীরা চালককে বললেন, গাড়ি ওদিকে যেও না। দুই. এক মা তার দুষ্ট ছেলেকে ভয় দেখিয়ে বলছেন, এত দুষ্টামি করলে তোকে নারায়ণগঞ্জ পাঠিয়ে দিব।

নারায়ণগঞ্জ ক্লাবে ছিল আমরা নারায়ণগঞ্জবাসীর এই গোলটেবিল। আয়োজন করেছিলেন নারায়ণগঞ্জ ক্লাবে। সুন্দর ক্লাবটি। সুন্দর তার ব্যবস্থাপনা। সেখানেই শুনলাম, এই ক্লাবটিই নাকি বাংলাদেশের প্রাচীনতম। আমি জানি না এটি সত্য কিনা। তবে নির্মাণে, ব্যবস্থাপনায়, আতিথেয়তায় তারা ঢাকা বা চট্টগ্রাম ক্লাবের মতো একটি বনেদিপনা তৈরি করেছেন। ২-৩ তলা বড় হলরুমটি প্রায় কানায় কানায় ভর্তি ছিল। যেখানে এই গোলটেবিলটির আয়োজন করা হয়েছিল। বক্তৃতা করলেন বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন থেকে অন্তত ১৫ জন। এর মধ্যে একজন ওয়ার্কার্স পার্টি ও একজন ন্যাপের নেতাও ছিলেন। ৫-৬ জন সময়ের অভাবে বলতে পারলেন না বলে মনও খারাপ করলেন। সবাই বললেন মনোকষ্টের কথা। নারায়ণগঞ্জ কি শেষ পর্যন্ত সন্ত্রাসের হাতে ধ্বংস হয়ে যাবে? সবাই বললেন, সেরকম কথা।

ঢাকার খুব কাছে বলে নারায়ণগঞ্জকে এখন ঢাকাই মনে হয়। ফ্লাইওভার হওয়ার পরে গুলিস্তান থেকে চাষাঢ়া যেতে ৩০ থেকে ৪০ মিনিট সময় লাগে। যেখানে গুলশান আসতে লাগে কখনো কখনো দেড়-দুই ঘণ্টা। নারায়ণগঞ্জের মানুষকে তাই আর যাই হোক মফস্বলের মানুষ ভাবা যাবে না। যারা যারা আলোচনা করলেন তাদের আলোচনা শোনার মতো। এই মানুষগুলোই ২৭ তারিখের অপহরণের পর ঘুরে দাঁড়িয়েছিলেন। এরাই রিট করে র‌্যাবের তিন কর্মকর্তার গ্রেফতারের পরোয়ানা নিয়েছিলেন হাইকোর্ট থেকে। শুধু যারা বক্তৃতা করেছিলেন তাদের কথা বলছি না, আমি সাধারণভাবে নারায়ণগঞ্জের মানুষের কথা বলছি। ওই যে এক শহীদুল চেয়ারম্যান, অসাধারণ সাহসী, রীতিমতো সাহসের বোমা ফাটিয়ে দিয়েছেন। না হলে তো র‌্যাবের মতো একটি ভয়াবহ বাহিনীর বিরুদ্ধে কেউ কথা বলতে সাহসই পাচ্ছিলেন না। নারায়ণগঞ্জ আইনজীবী সমিতির সাখাওয়াত আলী খানও বক্তৃতা করেছিলেন, যার নেতৃত্বে এখনো নারায়ণগঞ্জের আইনজীবীরা আন্দোলন করছেন। তারপরও তাদের মধ্যে এক ধরনের ক্ষোভ, ভয়, হতাশা কী হবে শেষ পর্যন্ত। তদন্ত কমিটির কথা বললেন তারা। বললেন গণশুনানির কথা। ভয়ে লোকজন সেখানে যাচ্ছে না। তখন পর্যন্ত কেউ গ্রেফতার হয়নি। হাইকোর্টের নির্দেশনা সত্ত্বেও র‌্যাবের তিন কর্মকর্তা মুক্ত আছেন। আমরা নারায়ণগঞ্জবাসীর নেতা অ্যাডভোকেট ইসমাঈল হোসেন, যিনি ওই রিট পিটিশনের একজন স্বাক্ষরকারী ছিলেন, আড়াই ঘণ্টা বসে থাকার পরও গণশুনানি তার বক্তব্য শুনেনি। এসব নিয়েই হতাশা বক্তাদের।

প্রায় সব বক্তাই বললেন কোনো একটা কাজ প্রধানমন্ত্রী ছাড়া হয় না। সব কাজ কি প্রধানমন্ত্রীর একা করা সম্ভব? সব মিলে এক অনিশ্চয়তা, হতাশার মধ্যে বাস করছেন তারা। বললেন গুম এবং খুন এ তো প্রথম নয়। এর আগেও এগুলো নিয়ে কথা বলেছি আমরা। কোনো কাজ হয়নি। এখনো কি হবে? আজকে আমার লেখার মূল প্রতিপাদ্য এটাই। ভূমিকা বড় হয়ে গেল। কিন্তু এর প্রয়োজন ছিল। এতে সমস্যার মানবিক দিকগুলো বোঝা গেল আর দুর্বলতার দিকগুলো ধরা পড়ল।

দুর্বলতার কথা বলছি কেন? বলছি এ জন্য যে, সেখানে বসে বসে আমার মনে হচ্ছিল এই যে আমার সামনে বসা এত মানুষ এরা কত সাহসী, শক্তিশালী। অথচ এরা তা বুঝতে পারছে না। শহীদুল চেয়ারম্যানের প্রশংসা করে, তার সাহসের তারিফ করে আমি বক্তৃতা করলাম তাতে সবাই হাততালি দিলেন। বাংলাদেশের একটি ঘটনা পুকুরের মধ্যে ঢেউ তুলে শেষ পর্যন্ত কিনারেও আসতে পারে না মিলিয়ে যায়। একটা বড় ঘটনা, একটা বড় ঘটনাকে গিলে ফেলে, তার চেয়ে বড় আরেকটি ঘটনা। কিন্তু গত মাসের ২৭ তারিখে সংঘটিত এই অপহরণ এবং পরবর্তীতে হত্যাকাণ্ড এখনো এই ১৯-২০ দিন পর্যন্ত ঝুলে আছে। এটা কি আন্দোলন নয়। আন্দোলন মানেই কি কেবল লাখো লোকের মিছিল-সমাবেশ। অ্যাডভোকেট চন্দন সরকার ও প্যানেল মেয়র নজরুল ইসলামের জানাজায় তো সেই লাখো লোক হয়েছিল। এই মানুষগুলো কি কেবল তাদের রুহের মাগফিরাত কামনা করার জন্য এসেছিলেন? নাকি এটা ছিল ঘটে যাওয়া অমানবিকতার বিরুদ্ধে মানবতার প্রতিবাদ।

এ কথা সত্য, স্বাভাবিকভাবে যা হওয়ার কথা ছিল এই ৭(১১)! গুম-খুনের ব্যাপারে তা হয়নি। প্রধানমন্ত্রীসহ সরকারের বিভিন্ন কর্তাব্যক্তি অবশ্য আশ্বস্ত করার চেষ্টা করছেন কিন্তু তাতে মানুষ স্বস্তিবোধ করছে না। র্যাবের ওই তিন কর্মকর্তা এখন পর্যন্ত গ্রেফতার হলেন না কেন? হাইকোর্ট যদি আদেশ না দিত তাহলে কি সরকার বা প্রশাসন এদের গ্রেফতার করার কথা ভাবত। আদেশ দেওয়ার পরও এত সময় লাগছে কেন? প্রধানমন্ত্রী এই রিট আবেদনের ওপরে এত নাখোশ কেন? রিট তো নাগরিকের মৌলিক অধিকার। তিনি বললেন, 'অতি উৎসাহীদের রিট আবেদনের কারণে সাত খুনের মামলার কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। যে কাজটি নির্বাহী বিভাগের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর করার কথা সে কাজটি যদি বিচার বিভাগ করে দেয় তাহলে আমাদের কি করণীয় থাকে। মনে হয় যেন আমাদের হাত-পা বেঁধে দেওয়া হয়েছে। এ কথার মানে কী? অন্যায় কি রিট যারা করেছেন তারা করল নাকি যে আদালত রায় দিলেন তারা? এটা আদালতের এখতিয়ারে হাত দেওয়ার শামিল হয়ে যায় না?

স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেছেন, আরেক বিস্ময়কর কথা। এক সুবোধ, অবোধ বালকের মতো তিনি বলেছেন, এই তিন র‌্যাব কর্মকর্তাকে আত্মসমর্পণ করতেই হবে। তার মানে কি, তাদের গ্রেফতার করতে হবে না? যে অলঙ্গবৃত্তের মধ্যে বাস করছেন ওই তিন কর্মকর্তা সেখানে আইনশৃঙ্খলা পৌঁছবে না। সরকারি কোনো কোনো মহল আরও মজার কথা বলছেন বিলম্বের পক্ষে যুক্তি দেখিয়ে। তারা বলছেন, হাইকোর্ট তো কোনো সময়সীমা বেঁধে দেয়নি গ্রেফতারের। তার মানে কি এই যে, উচ্চ আদালত কোনো রায় দিলেও অনির্দিষ্টকাল তা কার্যকর করার জন্য ফেলে রাখা যায়। অথচ ১৪ তারিখে আইনজীবীদের সমাবেশে আইনজীবীরা বললেন, কেন হুকুম তামিল করা হলো না এই মর্মে হাইকোর্ট এখন সরকারকে শোকজ করতে পারে।

আইনি প্যাঁচের মধ্যে আমি ঢুকতে চাই না। আমি আইনজীবী নই। আইন ভালো বুঝিও না। কিন্তু এটা দেখতে পাচ্ছি মানুষ হতাশার আগুনে পুড়ছে। এত বড় বর্বরতা, পাশবিকতা অন্যবারের মতো এবারও পার পেয়ে যাবে। মানুষ তো প্রধানমন্ত্রীর ওপরই নির্ভর করতে চাইবে। তা সেই প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন আর নির্বাচন ছাড়াই হন। কিন্তু সেখানে তারা আস্থা রাখতে পারছেন না।

১৪ তারিখের সমাবেশে আইনজীবীরা বলেছেন, অ্যাডভোকেট চন্দন সরকারসহ সাত খুনের বিচারের দাবিতে তারা সারা দেশের আইনজীবীদের সমাবেশ করবেন। যথাযথ তদন্ত ও বিচার না হওয়া পর্যন্ত তারা এ আন্দোলন অব্যাহত রাখবেন। দেশের নাগরিক সমাজ তো ইতিপূর্বে সংসদ ভবনের সামনে মানববন্ধন করতে গিয়েছিল, পুলিশের বাধার মুখে সেদিন মানববন্ধন অনুষ্ঠিত হতে না পারলেও তারা পিছু হটেননি। একদিন পর আরও বৃহৎ আকারে তাদের সে মানববন্ধন সেই একই জায়গায় অনুষ্ঠিত হয়েছিল।

আমি মনে করি, নারায়ণগঞ্জকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা আন্দোলন তার গতি হারায়নি। এ আন্দোলন তার অভিধায় পৌঁছতে পারবে কিনা সে জবাব এখনই দেওয়া যাবে না। আন্দোলনকে বিপদগামী করার জন্য, আন্দোলনে ভাঙন সৃষ্টির জন্য, আন্দোলনকে দুর্বল করতে নানা রকম অপতৎপরতা, ষড়যন্ত্র, বিভ্রান্তিমূলক প্রচারণা হবে। ইতিমধ্যে এ ঘটনাকে দলীয় রূপ দেওয়ার বিভিন্ন চেষ্টা হয়েছে। এ ব্যাপারেও সতর্ক থাকা দরকার। দল আছে এ জন্য দলবাজিও আছে কিন্তু মানুষ যখন মরে যায় তখন তার দল থাকে না। আইনের কোনো দল নেই। মৌলিক অধিকারসমূহের কোনো দল নেই। গত ৪২ বছরে বা ৫ বছরে যদি নারায়ণগঞ্জের ঘটনাটিই একটি ঘটনা হতো, তাহলেও হয়তো এত কথা হতো না। কিন্তু গুম, খুন, একটি নিয়মিত ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই প্রক্রিয়ায় হত্যাকাণ্ডকে আইনি অনুমোদন দেওয়ার মতো অমানবিক কাজ আমরা করেছি। এর বিরুদ্ধে দাঁড়াতে হবে এবং দাঁড়িয়ে থাকতে হবে। কেউ যদি ছলেবলে কৌশলে এই হন্তারকদের রক্ষা করতে চায় তাহলে তার মুখোশ উন্মোচন করে দিতে হবে।

আমি মনে করি, এক শক্তিশালী মিডিয়া গড়ে উঠেছে আমাদের দেশে। বাঙালি একটি সাহসী জাতি, তারা আরও সাহসী হয়েছে নারায়ণগঞ্জ আরেকবার তার প্রমাণ দিয়েছে। এত বড় পৈশাচিক হত্যাকাণ্ডের পরও যখন মানুষ দাঁড়িয়েছে তখন সেই মানুষকে আর পরাজিত করা যাবে না।

শঠতা, ষড়যন্ত্র ও মিথ্যার জাল বুনবার চেষ্টা হবে, আমরা যেন সেই জালে আটকা না পড়ি। আমরা যে যে দলই করি যেন সত্যনিষ্ঠভাবে করি। দলবাজির বেড়াজাল ছিঁড়ে মানবতার ডাকে মিছিলে যোগ দিই।

লেখক : রাজনীতিক।

 

সর্বশেষ খবর