রবিবার, ২২ জুন, ২০১৪ ০০:০০ টা

সংলাপ নিয়ে দুই নেত্রীর মিঠে-কড়া বচন

কাজী সিরাজ

সংলাপ নিয়ে দুই নেত্রীর মিঠে-কড়া বচন

জাতিসংঘ মহাসচিব বান কি মুন আবারও সব দলের অংশগ্রহণের ভিত্তিতে বাংলাদেশে নতুন করে নির্বাচনের কথা বলেছেন। গত বৃহস্পতিবার রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের সঙ্গে বৈঠকে তিনি আরও বলেছেন, চলমান রাজনৈতিক অচলাবস্থা নিরসনে নির্বাচনের বিকল্প নেই। এ জন্য সংলাপের ওপরও জোর দিয়েছেন তিনি। রাষ্ট্রপতি সংকট নিরসনে সংলাপের গুরুত্ব স্বীকার করলেও এ ব্যাপারে লীগ সরকারের প্রেসক্রিপশনই উগলে দিয়েছেন। বলেছেন, সংলাপ হবে এই সরকারের মেয়াদ শেষে। তিনি রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ ব্যক্তি। দেশের ও জনগণের রাষ্ট্রপতি হিসেবে তিনি কথাটা বলেছেন, না কি লীগ সরকার ও শাসক লীগের প্রেসিডেন্ট হিসেবে কথাটা বলেছেন, তা নিয়ে ইতিমধ্যে প্রশ্ন উঠেছে। গত ১৭ জুন মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক প্রেস ব্রিফিংয়ে পররাষ্ট্র দফতরের মুখপাত্র জেন সাকিও সাফ জানিয়েছেন, বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক উত্তরণের জন্য প্রতিদ্বন্দ্বী দুটি প্রধান রাজনৈতিক দলের মধ্যে সংলাপের অবস্থান থেকে সরে আসেনি যুক্তরাষ্ট্র।

সংলাপ-সমঝোতা নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে সরব আলোচনা চলছেই। সব দলের অংশগ্রহণের মাধ্যমে দেশে-বিদেশে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য একটি নির্বাচন আয়োজনের লক্ষ্যেই দেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের মধ্যে সংলাপের কথা বলা হচ্ছে। এ বিষয়ে দেশে-বিদেশে 'সদরে-অন্দরে' আলোচনা নজিরবিহীন দশম সংসদ নির্বাচনের পর থেকেই চলছে_ যে আলোচনার সূত্রপাত হয়েছিল বিতর্কিত ওই নির্বাচনের আগে। তবে অতি সম্প্রতি সংলাপের বিষয়ে অর্থবহ আলোচনার সূত্রপাত করেছেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। ৮ জুন ইউরোপীয় ইউনিয়নের দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া অঞ্চলের পরিচালক ইউগো আস্তোতোর সঙ্গে এক বৈঠকে তিনি বলেছেন, 'সব দলের অংশগ্রহণে বাংলাদেশে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজনে বিএনপি যে কোনো সময় সংলাপে বসতে প্রস্তুত।' বৈঠক শেষে বিএনপির পক্ষ থেকে গণমাধ্যমকে জানানো হয়, বিএনপির পক্ষ থেকে ইইউ প্রতিনিধিকে জানানো হয়, 'ইইউ যেসব বিষয় বিশ্বের কাছে তুলে ধরে সে বিষয়গুলো হচ্ছে মানবাধিকার, আইনের শাসন, গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা_ যার কোনোটিই বাংলাদেশে নেই। বর্তমান সরকারও জনগণের প্রতিনিধিত্বশীল সরকার নয়। বাংলাদেশে যদি রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ফিরে না আসে তাহলে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।' এ বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে ইইউ প্রতিনিধি বিএনপি চেয়ারপারসনের কাছে জানতে চেয়েছিলেন তিনি সংলাপের জন্য প্রস্তুত আছেন কি না? ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত বিভিন্ন দেশ বাংলাদেশের উন্নয়ন সহযোগী। বাংলাদেশে তাদের বিনিয়োগকৃত অর্থের নিরাপত্তা এবং ভবিষ্যৎ বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ নিয়ে ইইউর উৎকণ্ঠা ও আগ্রহ_ দুই-ই থাকা স্বাভাবিক। যে কোনো দেশে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগের নিরাপত্তা-সুরক্ষা সে দেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার ওপর অনেকটাই নির্ভরশীল। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার রক্ষাকবচ হচ্ছে গণতন্ত্র ও সুশাসন। বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে অনেকেই বলছেন, 'থমথমে' প্রচণ্ড একটা ঝড়ের পূর্বাবস্থা। সরকার যতই উচ্চস্বরে প্রচার করুক, দশম সংসদ নির্বাচনের পর সব কিছু মিটে গেছে, বিপদ কেটে গেছে, পরিস্থিতি এখন সম্পূর্ণই শান্ত; এর ওপর কেউ কিন্তু আস্থা রাখতে পারছে না। এ দেশের প্রাকৃতিক আবহাওয়া যেমন বিচিত্র_ সব কিছু ঠিকঠাক, সুনসান, মুহূর্তেই আবার ঝড়, জলোচ্ছ্বাস ও টর্নেডোর তাণ্ডব_ রাজনীতির গতি-প্রকৃতিও ঠিক তেমন। সবার ধারণা, কখন কী হয়, বলা যায় না। এর কারণ, সরকারের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী প্রতিপক্ষ ভুঁইফোড় কোনো রাজনৈতিক দল নয়। বিএনপি গঠনের পর থেকে অনুষ্ঠিত সব নির্বাচনের পরিসংখ্যানের দিকে নজর দিলেই স্পষ্ট হয়, ভোট প্রাপ্তির দিক থেকে দুই দলই সমানে-সমান। কখনো বিএনপি কখনো আওয়ামী লীগ_ ভোটের ব্যবধান থাকে দুই থেকে তিন শতাংশ। বিএনপির সঙ্গে ১৯-দলীয় জোটে আছে জামায়াতে ইসলামীর মতো একটি নিবেদিতপ্রাণ সংগঠন। এদের ভোটও পাঁচ থেকে ছয় শতাংশ। ভোটের জোর কম থাকলেও তাদের লড়াই করার জোর ভোটের জোরের চেয়ে অনেক বেশি। এই শক্তির কথা বিবেচনা করেই সরকার তলে তলে নয়, তাদের সঙ্গে একটা সমঝোতার উদ্যোগ নিয়েছে বলে অনেকটা দৃশ্যত মনে হচ্ছে_ যদিও সে সমঝোতা হয়ে গেলে সরকার আরও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের বিরাট শক্তির সমর্থন তারা হারাবে। আওয়ামী লীগ-বিএনপির মতো দল যখন রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বে থাকে, জনস্বার্থবিরোধী নানা কর্মকাণ্ড, লুটপাট, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, দখলবাজি, হত্যা, সন্ত্রাস, রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস ইত্যাদির কারণে জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। তখন আগের ক্ষমতাসীনদের অপশাসন, দুর্নীতি, দুরাচারের কথা মানুষ ভুলে যায়। ক্ষমতাসীনদেরই চোখের সামনে দানব হিসেবে দেখে এবং সরকারবিরোধী প্রধান দলকে সমর্থন জানায়। শত দুর্বলতার পরও বিএনপি এখন দেশের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের সমর্থন-সুবিধা ভোগ করছে। এ অবস্থায় বিএনপি জামায়াত-নির্ভরতা এখন আর জরুরি নয়। কাজেই বিএনপি নামক আগ্নেয়গিরি (সরকারের জন্য) থেকেই যে কোনো সময় বিস্ফোরণ ঘটতে পারে, অগ্ন্যুৎপাত শুরু হতে পারে। সেই অগ্ন্যুৎপাতে বিএনপির সব আবর্জনাও সাফ হয়ে যেতে পারে। অর্থাৎ উৎপাদন, উন্নয়ন, সমৃদ্ধি ও শান্তিপ্রত্যাশীদের স্বস্তিতে থাকার কোনো কারণ নেই। সর্বত্রই কী হয়, কী হয় একটা গুমোট ভাব। ভালো নেই কেউ। সরকারি দল ও বিরোধী দলের দুর্বৃত্তায়নের রাজনীতির সঙ্গে যারা সংশ্লিষ্ট তারা উপরতলার মানুষ। তারা ছাড়া একজন আজন্ম সৎ ব্যবসায়ীকে জিজ্ঞাসা করুন, বলবে ভালো নেই, কিছুই ভালো মতো চলছে না। একজন সৎ চাকরিজীবী, শিক্ষক, সাংবাদিক, পেশাজীবীকে জিজ্ঞাসা করুন, বলবে ভালো নেই। একজন শ্রমজীবী, রিকশাচালক, ভ্যানচালক, মুটে, মজুর কিংবা কল-কারখানার শ্রমিককে জিজ্ঞাসা করুন_ বলবে 'ভালো নেই'। ভালো আছে কারা? আগেই তো বললাম। রাজনৈতিক দুর্বৃত্তরা, নূর হোসেনরা, তাদের গডফাদাররা এবং গডফাদারদের দেখভালের দায়িত্বে আছে যারা, তারাই ভালো আছে আপাতত। এই কিছু লোকের ভালো থাকা, এত ভালো থাকা কিন্তু ভালো নয়। কখন, কোন দিক থেকে বিস্ফোরণ ঘটে যাবে, বলা মুশকিল। টিভি চ্যানেলের টকশোতে সরকারের কোনো কোনো নির্লজ্জ স্তাবক বলছেন এবং পত্রপত্রিকায় লিখেও চলেছেন, সব কিছুই তো ঠিকঠাকই আছে, চলছে খুব স্মুথলি; জাপান-চীন ডলার দিয়ে তো ভাসিয়ে দিচ্ছে, আর পায় কে? ডলার আইউব-ইয়াহিয়ার আমলেও কম আসেনি। রাস্তাঘাট, পুল-কালভার্ট, স্কুল-কলেজের উন্নয়ন একেবারে বন্ধ ছিল না। ডলার কোন সরকার আমলে একেবারে কম এসেছে বা উন্নয়ন একেবারেই থেমে ছিল? তারপরও আমরা ঊনসত্তর দেখেছি, একাত্তর দেখেছি। দেখেছি পঁচাত্তর, দেখেছি নব্বই, ছিয়ানব্বই, দুই হাজার এক, দেখেছি ওয়ান-ইলেভেনসহ আরও কত কী! ডলার দিয়ে কেউ রাজনৈতিক স্থিতি কিনতে পারেনি, ডলারের বাঁধ দিয়ে ধস ও পতন ঠেকাতে পারেনি।

আমাদের প্রিয় স্বদেশ একটি অপার সম্ভাবনার দেশ। সম্ভাবনাকে কাজে লাগানোর সুযোগ আছে বলেই বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দা তাগড়া-তাগড়া অর্থনীতির অনেক দেশে ধস নামিয়ে দিয়েছিল, আমেরিকার মতো দেশেও অনেক প্রাসাদবাসীকে রাস্তায় নামিয়ে দিয়েছিল, কিন্তু বাংলাদেশের পরিশ্রমী, মেধাবী ও দেশপ্রেমিক ব্যবসায়ী-শিল্পপতিদের উদ্যমী ভূমিকার জন্য তা বাংলাদেশকে কাবু করতে পারেনি। সে জন্যই বাংলাদেশের কাছের দেশ চীন, জাপান এখনো আগ্রহ হারায়নি। দেশে যদি গণতন্ত্র, সুশাসন, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার নিশ্চয়তা থাকে, সারা দুনিয়া, গোটা উন্নত বিশ্ব ও আন্তর্জাতিক বিনিয়োগকারীরাও আগ্রহী হয়ে এগিয়ে আসবে বাংলাদেশে, বাড়াবে সহযোগিতার হাত। পুঁজি তো আমাদের দেশেও আছে। সুরক্ষার নিশ্চয়তা ও পরিবেশ পেলে তারাও এগিয়ে আসবে বিনিয়োগে।

আমাদের এখন প্রয়োজন একটি সভ্য, গণতান্ত্রিক দেশ ও জাতি হিসেবে নিজেদের গর্বিত পরিচয় তুলে ধরা। এ ব্যাপারে বিগত সংসদ নির্বাচন নিয়ে সারা দুনিয়ার সভ্যসমাজের কাছে জাতি হিসেবে আমরা লজ্জায় ডুবে আছি। এ লজ্জা ক্ষমতাসীনদেরও। ভারতের নতুন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে পাঠানো অভিনন্দন বার্তায় কী করে আমাদের বিনা ভোটে নির্বাচিত(!) প্রধানমন্ত্রী লিখতে পারলেন, আপনিও বিপুলভাবে নির্বাচিত, আমাদের সরকারও জনগণ কর্তৃক নির্বাচিত, তা একমাত্র তিনিই বলতে পারেন। এতে কিন্তু আমাদের জাতীয় সম্মান বাড়েনি। অথচ ছোট দেশ, ছোট অর্থনীতি হলেও বহু গণতান্ত্রিক লড়াই ও একটি সশস্ত্র এবং রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন হওয়া একটি মাথা উঁচু জাতির মাথা আজ হেঁট হয়ে আছে চৌর্যবৃত্তির এক নির্বাচনী কলঙ্কের দায়ে, গণতন্ত্রহীন, সুশাসনহীন এক দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ ও জাতি হিসেবে। এই অপবাদ আমাদের অবশ্যই ঘোচাতে হবে। ছোট দেশ হলেও সভ্য ও গণতান্ত্রিক বিশ্বের কাছ থেকে আমাদের আদায় করতে হবে যথাযোগ্য সমীহ। সে জন্য সর্বাগ্রে জাতিকে সবার অংশগ্রহণহীন, প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন, ভোটারবিহীন কলুষিত নির্বাচনের কালিমা থেকে মুক্ত করতে হবে। একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত সংসদ ও সরকারই জনগণের প্রতিনিধিত্বশীল মর্যাদাবান সংসদ ও সরকারের অপার গৌরবের অধিকারী হতে পারে। সে সরকারই হতে পারে একটি প্রকৃত আস্থাশীল সরকার এবং সেই সরকারই দেশে গণতন্ত্র ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায়, জনগণের ও রাষ্ট্রের কল্যাণে কাঙ্ক্ষিত ভূমিকা পালন করতে পারে। সেই সরকারকে গদি রক্ষার জন্য দলীয় মাস্তান ও পেশিশক্তির ওপর নির্ভর করতে হয় না, প্রতিবাদ ও গণপ্রতিরোধ দমনে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস চালাতে হয় না। একদিকে সংসদ ও সরকার থাকে জনসমর্থিত, অপরদিকে সেই সংসদের বিরোধী দলও হয় সরকারের যে কোনো অন্যায়, জনগণ ও রাষ্ট্রের স্বার্থবিরোধী সব কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে বলিষ্ঠ প্রতিবাদের 'মিসাইল'। সংসদের মাধ্যমে জবাবদিহিতা থাকে সবার_ সরকারের এবং বিরোধী দল, উভয়ের। ২০ ডিসেম্বর ২০১৩ 'অ্যাডভান্স ডেলিভারি'র মতো আগাম নিষ্পন্ন হয়ে যাওয়া নির্বাচন কমিশন ঘোষিত ৫ জানুয়ারি ২০১৪-এর দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন কোনো ব্যাখ্যা বিশ্লেষণই একটি সর্বর্জনগ্রাহ্য নির্বাচন হিসেবে বিবেচিত হবে না, হতে পারে না। ওই নির্বাচনের দোহাই দিয়ে ক্ষমতার বড়াই করা চলে না। হ্যাঁ, রাষ্ট্রশক্তি তথা পুলিশ, র্যাব, বিজিবি ইত্যাদিকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যতদিন বশ মানিয়ে ব্যবহার করা যাবে বিনা প্রতিবাদে-প্রতিরোধে, ততদিন হয়তো জোড়াতালি দিয়ে চলবে কোনো প্রকারে। কিন্তু আমাদের দেশের ইতিহাস বড় নির্মম। বালির বাঁধ বেশি দিন টিকেনি, টিকে না। তখন? তার আগেই সবার হুঁশে আসা দরকার। যত দ্রুত সম্ভব একটি ইনক্লুসিভ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের পথে হাঁটা উচিত সবার। দুভাবে তা হতে পারে। (১) মৃত্যুঞ্জয়ী লড়াই-আন্দোলনে (২) সংলাপ ও সমঝোতায়। এখন পর্যন্ত রাষ্ট্রশক্তি ব্যবহার করে প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক শক্তিকে ঘরে আবদ্ধ করে রাখা যাচ্ছে। সব কিছু শান্ত মনে হচ্ছে। শাসক লীগের নেতানেত্রী এবং লীগ সরকারের মন্ত্রী-মিনিস্টাররা বলছেনও, সব কিছু তো নর্মাল (!)। বিরোধী দল তো অক্ষম। কী দরকার সংলাপের, সমঝোতার? কী প্রয়োজন মধ্যবর্তী বা আগাম নির্বাচনের? দেশে তো কোনো সহিংসতা নেই। তাদের কথায় মনে হয়, সহিংসতা ছড়িয়ে না পড়লে এসব বিষয়ে চিন্তা করার কোনো প্রয়োজন নেই। আগেই উল্লেখ করেছি, রাজনীতি যাদের কাছে ব্যবসা, বিত্ত-বৈভব গড়ার সহজ ও নিরাপদ অবলম্বন, যারা ভালোই আছেন, সরকারি-বেসরকারি সেই রাজনৈতিক ফড়িয়ারা কী করলেন বা করবেন, কষ্টভোগী, দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া জনগণ তাদের জন্য অপেক্ষা না-ও করতে পারে। সেই রাজনৈতিক 'আইলা-সিডর'-এর জন্য অপেক্ষা করা শুভ হবে না। শান্তিপূর্ণ পথেই সমাধান খোঁজা উচিত। রাজনৈতিক অঙ্গনে সংলাপের বিষয়টি আকস্মিক মনে হলেও গুরুত্বহীন নয়। ইইউ প্রতিনিধি কর্তৃক বিষয়টির পুনরুত্থাপন অকারণেও নয়। জাতিসংঘ মহাসচিব, মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের মুখপাত্রও অকারণে বক বক করছেন না। সে জন্য বিরোধীদলীয় নেতা হিসেবে আন্দোলনে ব্যর্থ ও অক্ষম এমন অপবাদের পরও বেগম জিয়ার হঠাৎ সংলাপে সম্মতি প্রদান এবং চীন থেকে ফিরে গত ১৫ জুন সংবাদ সম্মেলনে নানা তির্যক কথা বলার পরও সংলাপের বিষয়টি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তুড়ি মেরে উড়িয়ে না দেওয়া বা সম্পূর্ণ নাকচ করে না দেওয়া খুবই অর্থপূর্ণ। যদিও শেখ হাসিনা এ ব্যাপারে ব্যঙ্গ-বিদ্রূপও করেছেন। একটা অনীহার ভাব দেখিয়েছেন। প্রলম্বিত প্রক্রিয়া অনুসরণেরই ইঙ্গিত দিয়েছেন, তবুও নাকচ না করার বিষয়টি তাৎপর্যপূর্ণ। সংলাপের জন্য সরকারের গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রীরা সরকারকে বৈধতার স্বীকৃতি দেওয়ার যে দাবি করছেন, ১৮ জুন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল তার জবাবও দিয়ে দিয়েছেন। বলেছেন, লীগ সরকারের সঙ্গেই তারা সংলাপ করতে চান।

জনগণ ও রাষ্ট্রের স্বার্থেই সংলাপ প্রয়োজন, প্রয়োজন একটি অংশগ্রহণমূলক গ্রহণযোগ্য নির্বাচন ত্বরান্বিত করার জন্য। এখানে একটি বিষয় মনে রাখা দরকার, যেভাবেই হোক, লীগ সরকারের হাতেই এখন ক্ষমতা। বাহুবলে, রাষ্ট্রীয় শক্তি ব্যবহার করে তারা যতদিন সম্ভব হয় ক্ষমতা প্রলম্বিত করার চেষ্টা করতে পারেন। জাতীয়-আন্তর্জাতিক নানা সমীকরণ ও সঙ্গত কারণে সংলাপের বিরোধিতা না করলেও তারা নানা বাহানা খুঁজতে পারেন তা বিলম্বিত করে সময় কাটিয়ে দেওয়ার জন্য। দেশের প্রয়োজনে তো বটেই, দলীয় স্বার্থেও সংলাপটা বেশি প্রয়োজন বিএনপির। এ ব্যাপারে সরকারকে বাধ্য করার পথ সহজ নয়, অন্যদিকে আন্তর্জাতিক মহলও সহিংসতা অনুমোদন করে না। কিন্তু সংলাপ, সমঝোতা ও একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য প্রবল চাপ আছে সর্বমহলের। স্থায়ী শান্তি ও রাষ্ট্রীয় স্থিতির জন্য গণপ্রত্যাশাও তাই। কাজেই এ ব্যাপারে বিএনপিকে সংযত আচরণ করতে হবে, তারেক রহমানকে বাক-সংযম করতে হবে। উসকানিমূলক এমন কোনো কথা বলা উচিত হবে না, যাকে ইস্যু করে আওয়ামী লীগ সংলাপ থেকে পিছলে যায়। তারেক রহমান ইতিমধ্যে আওয়ামী লীগের জন্য ইরিটেটিং যেসব বক্তব্য দিয়েছেন তার কিছু কিছু সংলাপের উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টির পরিপন্থী। বিলাতে বসে নীতিগত, আদর্শগত কথাবার্তা বলা যাবে, মাঠের আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া যাবে না। আর আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর চশমা দিয়ে তারেক রহমানের বিলাত থেকে বাংলাদেশ দেখাও ঠিক হবে না। বেগম জিয়া আগেও এমন পরিস্থিতির মোকাবিলা করেছেন। এখন তার অভিজ্ঞতাও অনেক বেশি। সংলাপের ব্যাপারে খালেদা জিয়ার উপলব্ধিই সঠিক। কাজেই সংলাপ-সমঝোতার মতো বর্তমান গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো তার হাতে ছেড়ে দিলেই তারেক ভালো করবেন_ এটা পর্যবেক্ষকদের অভিমত। বিদেশে থেকে তারেক রহমান তার দলের আন্তর্জাতিক মিত্রের পরিধি বিস্তৃত করতে পারেন। এখন সে সুযোগটি তার আছে। অনেকে বলেন, ভারতের নরেন্দ্র মোদি সরকারের সঙ্গে, এমন কী বিজেপির সঙ্গে বিএনপির নতুন সম্পর্কের যে বিন্যাস, তা তারই কৃতিত্ব। দেশে রাজনৈতিক সংলাপ তার কোনো বক্তব্য বা আচরণে বাধাপ্রাপ্ত বা ক্ষতিগ্রস্ত হলে তার দলের সাফারিংসই বাড়বে। দেশের ক্ষতি তো হবেই।

লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট

ই-মেইল : [email protected]

 

 

সর্বশেষ খবর