রবিবার, ২২ জুন, ২০১৪ ০০:০০ টা
কলকাতার চিঠি

বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক

সুখরঞ্জন দাশগুপ্ত

দিল্লি ও ঢাকার মধ্যে দ্বিপক্ষীয় সুসম্পর্ক এবং পারস্পরিক আস্থা অর্জনের জন্য ভারতের নতুন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। শুধু বাংলাদেশের সঙ্গে নয়, সার্কভুক্ত বাকি সাত দেশের সঙ্গেই যে নতুন করে সম্পর্ক গড়ে তুলতে তিনি আগ্রহী তা গত মে মাসে শপথ নেওয়ার দিনই পরিষ্কার করে বুঝিয়ে দিয়েছেন। এ ব্যাপারে দেরি তার না-পছন্দ। তাই পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজকে তিনি ঢাকায় পাঠাচ্ছেন। তাকে বলা হয়েছে সরকারিভাবে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে দিল্লিতে আমন্ত্রণ জানানোর জন্য। সুষমার সঙ্গে শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত পরিচয় অনেক দিনের। অটল বিহারির আমলে তিনি যখন ভারতের তথ্য ও সংস্কৃতি বিভাগের মন্ত্রী ছিলেন তখনো একাধিক সম্মেলনে ঢাকায় গিয়েছেন। আপাতদৃষ্টিতে মোদি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াকে একটি পরিবার হিসেবেই দেখতে আগ্রহী। এ ব্যাপারে পদক্ষেপ নিতে গেলে স্বভাবতই বাংলাদেশের গুরুত্বও অপরিসীম। কারণ, বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক বিগত শতকের '৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের আমল থেকেই। পূর্বতন প্রধানমন্ত্রীরা, বিশেষত ইন্দিরা গান্ধী, রাজীব গান্ধী, অটল বিহারি বাজপেয়ি ও ড. মনমোহন সিং_ সবাই ঢাকার ব্যাপারে যথেষ্ট উৎসাহী ছিলেন। তারা বহুবার ঢাকা সফর করেছেন এবং বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও দুবার দিল্লিতে এসেছেন। তাকে ফের সরকারি আমন্ত্রণ জানানোর জন্যই সুষমার এবারের ঢাকা সফর।

ঢাকার সঙ্গে দিল্লির কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা দীর্ঘদিন ধরে জিইয়ে রাখা হয়েছে। যেমন তিস্তাসহ সীমান্তের অন্যান্য নদীর জলবণ্টন চুক্তি, দুই দেশের সীমানা স্থায়ীভাবে চিহ্নিতকরণ, ছিটমহল বিনিময় চুক্তি ইত্যাদি। এগুলোর প্রতিটিই বাংলাদেশের দিক থেকে অত্যন্ত গুরুত্বের। ২০১২ সালে প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিং উত্তর-পূর্ব রাজ্যগুলোর মুখ্যমন্ত্রীদের নিয়ে ঢাকা সফরে যান। কথা ছিল তার ওই সফরেই তিস্তার জল বণ্টন নিয়ে চুক্তিটি সম্পাদিত হবে। কিন্তু বাধা হয়ে দাঁড়ায় পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর আপত্তি। মমতা ব্যানার্জি যে কেন সেবার ওই বাধা দিয়েছিলেন তা কিন্তু এ পর্যন্ত ব্যাখ্যা করেননি। অন্যদিকে বাংলাদেশে সাম্প্রতিক নির্বাচনের আগে তার মন্ত্রিসভার অন্তত দুজন সদস্য যথাক্রমে ফিরহাদ ওরফে ববি হাকিম ও জাভেদ খান প্রচারমাধ্যমে বারবার বলেছেন যে, শেখ হাসিনাকে যেনতেন প্রকারে নির্বাচনে জেতানোর জন্যই মনমোহন সিংয়ের ওই প্রয়াস ছিল। তারা বলেন, এটা তারা করতে দেননি এবং দেবেনও না। কেন যে এটা তারা করতে দেবেন না তা পরে ব্যাখ্যা করেছিলেন বসিরহাটের প্রাক্তন এমপি হাজি নুরুল ইসলাম (যিনি এবার জঙ্গিপুর থেকে লোকসভা নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেও পরাজিত হয়েছেন)। তার কথায়_ খালেদা জিয়া বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হলে এবং মমতা যখন ভারতের প্রধানমন্ত্রী হবেন তখনই একমাত্র এরকম চুক্তি সম্ভব হতে পারে। যদিও তখন সে চুক্তির শর্তাবলি কী হবে, তা তিনি জানাননি। তাদের এসব মন্তব্য নিয়ে সে সময়ই সারা ভারতে কেবল চর্চাই হয়নি, মানুষ এ নিয়ে তাদের ধিক্কারও জানিয়েছে।

সেবারের ঢাকা সফরের সময় প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিং পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির সঙ্গে আলোচনার জন্য তার জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা শিবশঙ্কর মেননকে বারবার কলকাতায় পাঠিয়েছিলেন। ড. সিং এ ব্যাপারে নিজে বেশ কয়েকবার মমতার সঙ্গে কথাও বলেছেন। কিন্তু বরফ গলেনি। এখানে উল্লেখ্য, শেখ হাসিনা যেবার প্রথম প্রধানমন্ত্রী হন তখনই ফারাক্কার জল নিয়ে দীর্ঘ ৩০ বছর মেয়াদি চুক্তি হয়, যার নেপথ্যে ছিলেন পশ্চিমবঙ্গের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু এবং কেন্দ্রের ও রাজ্যের প্রাক্তন মন্ত্রী, মালদহের এ বি এ গনি খান চৌধুরী। তাদের সঙ্গে এ ব্যাপারে নিয়মিত যোগাযোগ রাখতেন বাংলাদেশের প্রয়াত মন্ত্রী, আওয়ামী লীগ নেতা আবদুর রাজ্জাক। বিশেষভাবে মনে রাখতে হবে যে, বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর সামরিক একনায়ক জিয়াউর রহমান ফারাক্কার জল পাওয়ার ব্যাপারে ভারতের বিরুদ্ধে জাতিসংঘে নালিশও করেছিলেন। জাতিসংঘ থেকে প্রস্তাব নিয়ে বলা হয়, এটি আন্তর্জাতিক বিষয় নয়, দ্বিপক্ষীয়ভাবেই এ সমস্যার সমাধান কাম্য এবং ঘটনাও তা-ই হয়। ভারতের পক্ষ থেকে ঢাকাকে বারবার সতর্ক করা হয়েছে সন্ত্রাসবাদীদের আশ্রয় না দেয়ার জন্য। ঢাকাও এ ব্যাপারে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে দেখা যাচ্ছে যে, ঢাকার জামায়াতসহ বাংলাদেশের স্বাধীনতাবিরোধীরা ওপারে অপকর্ম করে এপারে আশ্রয় নিচ্ছে। বিশেষ করে বর্তমান পশ্চিমবঙ্গ সরকারের আমলে সন্ত্রাসবাদী, যেমন জামায়াত ও রাজাকাররা পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা ও আসামসহ উত্তর-পূর্ব রাজ্যগুলোয় নিশ্চিন্তে আশ্রয় নিচ্ছে। এদের আশ্রয় দিচ্ছেন বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গের বর্তমান শাসকগোষ্ঠীর ঘনিষ্ঠ একদল নেতা। পশ্চিমবঙ্গের একশ্রেণির পুলিশকর্তাও এ ব্যাপারে জড়িত বলে ভারত সরকারের কাছে অভিযোগ আছে। এসব ঘটনা সম্পর্কে সম্পূর্ণ ওয়াকিবহাল মোদি পশ্চিমবঙ্গে নির্বাচনী সফরে এসে এসব প্রসঙ্গ তুলেছিলেন। তিনি এ বিষয়ে একটা স্থায়ী সমাধানসূত্র বার করার ব্যাপারে চেষ্টা চালাতে বদ্ধপরিকর। সম্প্রতি বেশকিছু সন্ত্রাসবাদী কেন্দ্রীয় গোয়েন্দাদের হাতে ধরাও পড়েছে। কিন্তু তার পরেও অভিযোগের অন্ত নেই। এসব সন্ত্রাসবাদী এপার-ওপারে কেবল মানুষ পাচারই করে না, হাওলার মাধ্যমে টাকাও দেওয়া-নেওয়া করে। এ টাকাই খেটেছে চিটফান্ডওয়ালাদের কারবারে, যা নিয়ে এ মুহূর্তে পশ্চিমবঙ্গের রাজ্য রাজনীতি রীতিমতো সরগরম।

একদা ঢাকার মার্কিন দূতাবাসের পদস্থ অফিসার জনৈক মহিলা কূটনীতিক, বর্তমানে যিনি কলকাতা ও দিল্লিতে কর্মরত, তার কর্মকাণ্ড নিয়েও প্রশ্ন আছে। মমতা ক্ষমতায় আসার পর প্রাক্তন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন ঢাকা ছুঁয়ে কলকাতায় ছুটে আসেন। শুধু তাই নয়, মমতার সঙ্গে তিনি বৈঠকও করেছিলেন। ওই বৈঠকের আলোচ্য বিষয় বাইরে না এলেও কূটনৈতিক মহলের দৃঢ় ধারণা, মার্কিনিরা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার, বিশেষ করে ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে সুসম্পর্ক গড়ে উঠুক তা চায় না। '৭১ সালে স্বাধীন বাংলাদেশ গঠনের চরম বিরোধিতা করেছিল মার্কিন সরকার। ওই সময় তারা পাকিস্তানকে সমর্থনও করেছিল। তখন মার্কিন কূটনীতি ব্যর্থ হওয়ায় তারা প্রতিশোধের জন্য উন্মত্ত হয়ে ওঠে। এমনকি তৎকালীন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিনজার বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে সহায়তা দেওয়ার জন্য ভারতের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার হুমকিও দেন।

আন্তরিক চেষ্টা সত্ত্বেও ড. সিং যে কেন তখন ঢাকার সঙ্গে চুক্তিতে সফল হতে পারেননি তা ব্যাখ্যা করার সময় এসেছে। ইউপিএর ১০ বছরের রাজত্বের মধ্যে ২০০৪ থেকে ২০০৯ পর্যন্ত সংসদে তৃণমূলের সদস্যসংখ্যা ছিল মাত্র একজন_ স্বয়ং মমতা। দ্বিতীয় ইউপিএর সময় মমতা ছিলেন কোয়ালিশন সরকারের অংশীদর। তিনি বারবার ইউপিএকে ব্ল্যাকমেইল করেছেন। নিজের ক্ষমতার বাইরে গিয়ে নানা পদক্ষেপ নিয়েছেন। সরকার টেকানোর জন্য ইউপিএকে তা মানতেও হয়েছে। চুক্তি মমতাকে বাদ দিয়েও হতে পারত, কারণ পররাষ্ট্রনীতিতে কোনো রাজ্য সরকার কখনো হস্তক্ষেপ করতে পারে না। কিন্তু ড. সিং জোট রাজনীতির বাধ্যবাধকতার জন্য এবং বিশেষ করে ভদ্রতাবশতই এ ব্যাপারে একক পদক্ষেপ নিতে চাননি।

মোদি প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর বিষয়টি নিয়ে মতিলাল নেহরু মার্গে ড. সিংয়ের নতুন বাসভবনে গিয়ে এ নিয়ে দীর্ঘ বৈঠক করেছেন। আলোচনায় ড. সিং মোদিকে জানান, তিনি ভদ্রতাবশত এ ব্যাপারে যা জরুরি ও করণীয় ছিল সে পদক্ষেপ নিতে পারেননি ঠিকই, কিন্তু দুটি দেশের স্বার্থেই এ মুহূর্তে তা নেওয়া জরুরি। তিনি মোদিকে মনে করিয়ে দিয়েছেন যে, তার হাতে সংখ্যাগরিষ্ঠতা আছে যা ড. সিংয়ের হাতে ছিল না।

সীমান্ত চুক্তি এবং ছিটমহল বিনিময় : ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে এ দুটি বিষয় নিয়ে ইন্দিরা গান্ধী ও শেখ মুজিব ১৯৭৪ সালে দিল্লিতে এক ঐতিহাসিক চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন। কিন্তু তারপর গঙ্গা-পদ্মা দিয়ে বহু জল গড়িয়ে গেলেও সে চুক্তি কার্যকর করা সম্ভব হয়নি। কেন হয়নি তা নিয়ে দিল্লি ও ঢাকার তরফে বহু ব্যাখ্যাও আছে। যদিও বিগত সময়ে শেখ হাসিনার দিল্লি এবং ড. সিংয়ের ঢাকা সফরকালে বিষয়টি বহুবার উঠে এসেছে এবং আলোচনাও যে হয়নি তা নয়। দিল্লিও চায় এসব চুক্তি কার্যকর হোক। কিন্তু সমস্যা হলো, এগুলো কার্যকর করতে হলে ভারতের সংবিধান সংশোধন করতে হবে। সে জন্য রাজ্যসভায় যখন কংগ্রেস সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সালমান খুরশিদ সংশোধনী বিলটি উত্থাপন করছিলেন তখন মমতার আদেশেই তৃণমূল সাংসদরা তা তার হাত থেকে নিয়ে ছিঁড়ে ফেলে দেন। ঘটনার দু-এক দিনের মধ্যেই বিষয়টি নিয়ে ড. সিং লোকসভা-রাজ্যসভায় বিজেপির বর্ষীয়ান নেতাদের সঙ্গে দীর্ঘ আলোচনা করেন। পরে ওই বিল ফের উত্থাপিত হয় এবং তৃণমূল চেয়েও তাতে আর বাধা দিতে পারেনি। বিলটি বর্তমানে রাজ্যসভায় ঝুলে আছে। এখন সংবিধান সংশোধনে মোদি ও তার দলের কোনো অসুবিধা নেই। কারণ, এ ব্যাপারে তারা তৃণমূল বাদে কংগ্রেসসহ সব দলেরই সমর্থন পাবে। তাই দুই দেশের স্বার্থেই বিষয়গুলোর দ্রুত সমাধান কাম্য। যত দ্রুত তা হবে ততই মঙ্গল। সুতরাং সুষমার এ সফরে চাইলে অনেক বকেয়া জটই খুলতে পারে এবং দুই দেশের মধ্যে স্থায়ী সুসম্পর্ক গড়ে ওঠার পথও সুগম হতে পারে।

লেখক : ভারতের প্রবীণ সাংবাদিক, কলামিস্ট।

 

 

সর্বশেষ খবর