শিরোনাম
রবিবার, ১৪ ডিসেম্বর, ২০১৪ ০০:০০ টা

গণতন্ত্র খেলাপি সরকার গ্রহণযোগ্য হয় না

কাজী সিরাজ

গণতন্ত্র খেলাপি সরকার গ্রহণযোগ্য হয় না

পাকিস্তান নামক অসম রাষ্ট্রটির আত্মপ্রকাশের পর থেকেই আজকের বাংলাদেশ ভূখণ্ডের জনগণ গণতন্ত্রের জন্য অবিরাম অবিনাশী লড়াই করে আসছে। সে লড়াই কিছুতেই যেন থামতে চাইছে না। কখনো গণতন্ত্রের মায়াবী আলো দেখা যায়, কখনোবা সে আলোয় কিছুটা পথচলা। চক্রান্তের নিকষ-কালো অন্ধকারের চাদর আবার ঢেকে দেয় সে আলো, থেমে যায় গণতন্ত্রের আলোকময়, সুরভিত পথচলা। আবার সংগ্রাম, আবার লড়াই। লড়াকু যুব-তরুণের প্রাণ যায়, রক্ত ঝরে; তবু লড়াই চলে অবিরাম অবিরত।

১৯৪৭ সালের ধর্মীয় দ্বি-জাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত হয় দেড় হাজার মাইল ব্যবধানের পূর্ব-পশ্চিমের দুটি পৃথক জাতিসত্তার দুটি অঞ্চল নিয়ে গঠিত এই অসম রাষ্ট্র পাকিস্তান। শাসনক্ষমতা নিরঙ্কুশভাবে থেকে যায় পশ্চিম পাকিস্তানের বিজাতীয় শাসক-শোষক গোষ্ঠীর হাতে। অথচ তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালি জনগোষ্ঠী পাকিস্তান না চাইলে রাষ্ট্রটির জন্মই হতো না। পূর্ব পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালিদের আকাঙ্ক্ষা বা গণরায় যে শক্তিশালী গণতন্ত্রের শর্ত তৈরি করে, গণতন্ত্রের সেই শর্তই ভারত বিভক্তি নিশ্চিত করে এবং এই ভূখণ্ডে দুটি পৃথক স্বাধীন রাষ্ট্র ভারত ও পাকিস্তানের অভ্যুদয় অনিবার্য করে তোলে। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানে কেন্দ্রীভূত অসম রাষ্ট্র পাকিস্তানের এককেন্দ্রিক ভিন্নভাষী, বিজাতীয় শাসক-শোষকগোষ্ঠী শুরু থেকেই রাষ্ট্রটির জন্মের মৌলিক ভিত্তি গণতন্ত্রের শর্ত লঙ্ঘন করতে থাকে। এই ভূখণ্ডের বাঙালি জনগোষ্ঠীর আশা-আকাঙ্ক্ষা ও স্বপ্নের সঙ্গে তারা চরম বিশ্বাসঘাতকতা করে। ভাষা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে পাকিস্তানের অবাঙালি শাসক-শোষকদের ধর্মীয় মুখোশের আড়ালে লুকানো প্রকৃত ও বীভৎস চেহারা প্রকাশ হয়ে পড়ে। বাংলা আমাদের এই ভূখণ্ডের মানুষের মাতৃভাষা। পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ ৫৬ শতাংশ মানুষের মুখের বুলি বাংলা। পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলা ভাষার স্বীকৃতি দাবি ছিল একটি অতি ন্যায্য গণতান্ত্রিক দাবি। সংখ্যাগরিষ্ঠের ভাষা রাষ্ট্রভাষা হবে না কেন? কিন্তু ভাষার প্রশ্নে গণতন্ত্রের এই শর্ত অমান্য, অগ্রাহ্য করে পশ্চিমারা (পশ্চিমা বলতে তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তান ও বর্তমান পাকিস্তানকে বোঝানো হচ্ছে, বিশ্বের পশ্চিমা দেশসমূহকে নয়)। ফলে ভাষার দাবিতে বাঙালিদের লড়াই তীব্র ও শাণিত হয়। অনেক জীবন বলি দিতে হয়, রাজপথ রঞ্জিত হয় শহীদদের তপ্ত খুনে।

সাতচল্লিশে এই বাংলা ভূখণ্ডের যে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠী মুসলমান হিসেবে পাকিস্তানের পক্ষে হিমালয়ের মতো দাঁড়িয়েছিল, সংখ্যাগরিষ্ঠের ভাষার স্বীকৃতির প্রশ্নে গণতন্ত্রের শর্ত পদদলিত হওয়ায় নিজেদের প্রকৃত বাঙালি জাতিসত্তা ধারণে সেই মুসলিম বাঙালিরা কালবিলম্ব করেনি।

আটান্ন সালে আবার গণতন্ত্রের শর্ত লঙ্ঘন করে পশ্চিমারা। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন এই ভূখণ্ডে যে বাঙালি জাতীয়তাবাদী জাগরণের সৃষ্টি করে, সেই জাগরণ-জোয়ারের প্রবল ঢেউ লাগে চুয়ান্নর নির্বাচনে। হক-ভাসানী-সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে সেই নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট তথা বাঙালিরা বিপুল বিজয় অর্জন করে। পূর্ব পাকিস্তানে শেরে বাংলা এ. কে. ফজলুল হকের নেতৃত্বে গঠিত হয় বাঙালি সরকার। সেই গণরায়কে সম্বল করেই হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীও কিছুদিনের জন্য পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন। কিন্তু পশ্চিমারা আবার গণতন্ত্রের শর্ত ভঙ্গ করে। এই ভূখণ্ডের বাঙালি জনগোষ্ঠীর স্বার্থের প্রতি তারা অবিচার করে। শোষণ-বঞ্চনার জাঁতাকলে পিষ্ট করতে থাকে সমগ্র পূর্বাঞ্চলকে। 'পূর্ব পাকিস্তানের' আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের দাবিকে অগ্রাহ্য করে তারা। জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছ থেকে শাসনক্ষমতা কেড়ে নেওয়া হয়। অনেক অঘটনের পর পাকিস্তানের তৎকালীন সেনাপ্রধান আইউব খান আটান্ন সালে সামরিক আইন জারি করে গণতন্ত্রকে কফিনবন্দী করে ফেলে। আবার বাঙালির নতুন লড়াইয়ের শুরু। গণতন্ত্রের অমোঘ শর্ত লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে বাঙালির গণতন্ত্র অর্জনের লড়াই। পশ্চিমাদের মনোভাব শুরু থেকেই অাঁচ করতে পেরেছিলেন আমাদের এই ভূখণ্ডের প্রায় সব নেতার নেতা মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানী। চুয়ান্ন সালের গণরায় ভূলুণ্ঠিত হবে, পশ্চিমারা সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালির শাসন মানবে না, এই ভূখণ্ডের মানুষকে বঞ্চিত, প্রতারিত করা থেকে তারা বিরত থাকবে না এবং শোষণ-লুণ্ঠনের পথ তারা পরিহার করবে না আন্দাজ করে অনেক আগেই তিনি আজকের পাকিস্তানিদের 'আসসালামু আলাইকুম' জানিয়ে দিয়েছিলেন। তার এই 'আসসালামু আলাইকুম' প্রশ্নে দুটি ভিন্ন মত আছে, কখন তিনি তা বলেছিলেন সে বিষয় নিয়ে। সাধারণত বলা হয়ে থাকে ১৯৫৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিত কাগমারী সম্মেলনে তিনি তার এই ঐতিহাসিক বক্তব্যটি দিয়েছিলেন। হ্যাঁ, কাগমারী সম্মেলনে তিনি পশ্চিমাদের 'আসসালামু আলাইকুম' বলেছিলেন ঠিক কিন্তু তার আগেও তিনি পশ্চিমাদের উদ্দেশে একই কথা বলেছিলেন। ভাষা আন্দোলনের অন্যতম স্বীকৃত নায়ক মরহুম জননেতা অলি আহাদের ঐতিহাসিক গ্রন্থ 'জাতীয় রাজনীতি : ১৯৪৫-৭৫'-এ বিষয়টি স্পষ্টভাবে সনি্নবেশিত আছে। অলি আহাদ তার গ্রন্থের ২২৭ পৃষ্ঠায় উল্লেখ করেছেন, '১৯৫৫ সালের ১৭ জুন রোজ শুক্রবার অপরাহ্নে ঢাকার পল্টন ময়দানের জনসভায় সভাপতির ভাষণ দানকালে মওলানা ভাসানী পাকিস্তানের সামগ্রিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিশ্লেষণ প্রসঙ্গে কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতি সাবধানবাণী উচ্চারণ করিয়া ঘোষণা করেন যে, শোষণ-শাসনের মনোবৃত্তি ত্যাগ না করিলে পূর্ব পাকিস্তান 'আসসালামু আলাইকুম' বলিতে বাধ্য হইবে অর্থাৎ পূর্ব পাকিস্তান পৃথক হইয়া যাইবে'। এই বক্তব্যই তিনি আরও স্পষ্ট করে বলেছিলেন ঐতিহাসিক কাগমারী সম্মেলনে-১৯৫৭ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি, কাউন্সিলের উদ্বোধনী অধিবেশনে।

এরপর সত্তরের নির্বাচনে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের গণমানুষের রায়কে ঔদ্ধত্যপূর্ণভাবে অগ্রাহ্য করা হয়। আজকের বাংলাদেশের মানুষ পাকিস্তানে বাঙালি শাসনের পক্ষে রায় দিয়েছিল। পাকিস্তান জাতীয় পরিষদে পূর্ব পাকিস্তানে ১৬৯ আসনের মধ্যে ১৬৭ আসনে জয়ী হয় আওয়ামী লীগ। অপর দুই আসনে জয়ী হন পিডিপির জনাব নুরুল আমীন এবং রাজা ত্রিদিব রায়। পাকিস্তানের ৩০০ আসনের জাতীয় পরিষদে ১৬৭ আসন পেয়ে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে পাকিস্তান শাসনের অধিকার লাভ করে। প্রাদেশিক পরিষদে ৩০০ আসনের মধ্যে ২৮৮ আসনে জিতেছিলেন আওয়ামী লীগ প্রার্থীরা। বাকি ১২ আসনে পিডিপি-২, নেজামে ইসলাম-১, জামায়াতে ইসলামী পাকিস্তান-১, ন্যাপ (মস্কোপন্থি)-১ এবং স্বতন্ত্র প্রার্থীরা ৭টি আসনে জয়লাভ করেন। কিন্তু ক্ষমতা হস্তান্তরে পশ্চিম পাকিস্তানিরা টালবাহানা শুরু করে। পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের অধিবেশন ডেকেও ইয়াহিয়া খান তা স্থগিত করেন। সংসদ বসলেই বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে পাকিস্তানের নতুন সরকার হওয়ার কথা। ইয়াহিয়া খানকে প্রেসিডেন্ট হিসেবে মেনে নিয়েও বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে সরকার গঠনের একটা সমঝোতা হয়েছিল ইয়াইয়া-মুজিব-ভুট্টো আলোচনায়। ৭ মার্চ '৭১-এর ঐতিহাসিক ভাষণের পর ১৫ থেকে ২৩ মার্চ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু এই সমঝোতার আলোচনা চালিয়ে যান। বঙ্গবন্ধু চেয়েছেন পশ্চিমারাই গণতন্ত্রের শর্ত আগে ভঙ্গ করুক এবং তার করুণ পরিণতি ভোগ করুক। বঙ্গবন্ধু ক্ষমতার বাইরে থেকে তার উপলব্ধি দিয়ে বুঝেছিলেন জনগণের রায় অগ্রাহ্য করলে, জনগণের আশা ও স্বপ্ন ভেঙে দিলে জনগণ ফুঁসে ওঠে এবং জনগণের দ্রোহের আগুন দম্ভিত যে কোনো ফ্যাসিস্ট সরকারের মসনদ ছাই করে দিতে পারে। গণতন্ত্রের শর্ত ভঙ্গ করেই পশ্চিম পাকিস্তানিরা বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধকে অনিবার্য করে তোলে। আওয়ামী লীগের নির্বাচিত গণপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করলেই পূর্ব-পশ্চিমের সব দ্বন্দ্বের অবসান হতো এমন কথা আমি বলছি না। দ্বন্দ্বটা তখনই চরম বিরোধে রূপান্তরিত হয়ে সংঘাতের তাৎক্ষণিক রূপ নিত না। তবে পাকিস্তানের এককেন্দ্রিক বিজাতীয় শাসকগোষ্ঠীর পরিচালিত রাষ্ট্রযন্ত্রের সঙ্গে সমগ্র বাঙালি জাতির দ্বন্দ্ব এমন এক মীমাংসার অযোগ্য স্তরে পৌঁছেছিল যে, পাকিস্তান রাষ্ট্রের ভাঙন ছাড়া সেই দ্বন্দ্ব অবসানের অন্য কোনো পথ ছিল না। সময়ের কিছু হেরফের হতো হয়তো। আজকের পাকিস্তানিরা পাকিস্তানের অখণ্ডতা আরও কিছুদিন টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করতে পারত গণতন্ত্রের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে, গণতন্ত্রের শর্ত পূরণ করে।

গণতন্ত্রের জন্য এই ভূখণ্ডের মানুষের লড়াই চিরন্তন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের শাসনভার গ্রহণের আগে আজীবন গণতন্ত্রের জন্য লড়াই করেছেন, জীবনের অনেক সোনালি সময় কাটিয়েছেন জেল-জুলুম সহ্য করে। কিন্তু বাংলাদেশের নিরঙ্কুশ শাসনক্ষমতা হাতে নিয়ে তিনি তার চারপাশে এমন এক ক্ষমতার দেউল নির্মাণ করেন, যার ওপর অতিমাত্রায় নির্ভরতা গণতন্ত্রের শর্তভঙ্গে তাকেও উৎসাহিত করে। সোভিয়েত পদ্ধতিতে দেশ শাসনে তিনি উদ্বুদ্ধ হন এবং দেশে জাতীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আগেই সমাজতন্ত্র কায়েমের স্বপ্নবিলাস তাকে পথভ্রষ্ট করে। বাহাত্তরে একটি গণতান্ত্রিক সংবিধান জাতিকে উপহার দিয়েও তিনি গণতন্ত্রের মসৃণ সড়ক ধীরে ধীরে ত্যাগ করতে থাকেন। ১৯৭৩ সালের ৭ মার্চ বাংলাদেশের প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, তখন বঙ্গবন্ধু জাতির অবিসংবাদিত নেতা। কিন্তু প্রতিপক্ষের সমালোচনা বোধহয় তার সহ্য হচ্ছিল না। কী প্রয়োজন ছিল সেই নির্বাচনে খন্দকার মোশতাককে জোর করে জিতিয়ে আনার? ডক্টর আলীম আল-রাজী, রাশেদ খান মেনন, রশিদ ইঞ্জিনিয়ার, মেজর (অব.) হাফিজের বাবার মতো ৫-৭ জন নির্বাচিত হয়ে সংসদে এলে কী এমন ক্ষতি হতো? তাদের জোরজবরদস্তি করে হারিয়ে না দিলে কী বঙ্গবন্ধু প্রধানমন্ত্রী থাকতে পারতেন না। বলা হয়ে থাকে ভাসানী ন্যাপের ব্যারিস্টার সালাহউদ্দিনও জিততেন না বৃহত্তর ফরিদপুরের লোক না হলে। সেই নির্বাচনে গণতন্ত্রের প্রতি বঙ্গবন্ধুর অসহিষ্ণুতার প্রকাশ ঘটে। ঘটনাগুলো যদি বঙ্গবন্ধুর অগোচরে ঘটত পরবর্তীকালে কোনো ব্যবস্থা নিতে দেখা যেত। সবকিছু স্পষ্ট হয়ে যায়, একদলীয় বাকশাল কায়েমের মাধ্যমে। এখনো সমালোচনা হয় যে, মণিসিংয়ের কমিউনিস্ট পার্টি, মস্কোপন্থি মুজাফফর ন্যাপ ও আওয়ামী লীগ নিয়ে গঠিত প্রথমে ত্রিদলীয় ঐক্যজোট এবং পরে গণঐক্যজোট ছিল 'বাকশালগৃহের' দৃঢ় 'পাটাতন'। সব দল, মত নিষিদ্ধ করে একদলীয় বাকশাল ছিল গণতন্ত্রের কফিনে শক্ত পেরেক। এর পরিণাম শুভ ও সুখকর হয়নি। বাকশাল কায়েমের কঠোর সমালোচনা হয় বিদেশেও।

হু. মু. এরশাদ ক্ষমতায় এসেছিলেনই গণতন্ত্র হত্যা করে। দেশে তখন ছিল বিচারপতি সাত্তারের নেতৃত্বাধীন একটি নির্বাচিত সরকার। সংসদ এবং প্রেসিডেন্ট জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত। নির্বাচিত সরকার উৎখাত করে ক্ষমতায় এসে স্বৈরাচার এরশাদ ছিয়াশি সালে এক পাতানো নির্বাচনের আয়োজন করেছিল। সব বিরোধী দলের সেই নির্বাচন বর্জনের সিদ্ধান্ত ছিল। বিএনপি সিদ্ধান্তে অটল থাকলেও শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ জামায়াতকে সঙ্গে নিয়ে সেই পাতানো তৃতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে। গ্রহণযোগ্যতা পায়নি সেই নির্বাচন। এরপর '৮৮ সালে সংসদ নির্বাচন ও প্রেসিডেন্ট নির্বাচনও ছিল সব বিরোধী দল বর্জিত এবং ভোটারবিহীন। গণতন্ত্রের নামে তা ছিল এক তামাশা। নব্বইয়ের গণঅভ্যুত্থান স্বৈরাচার এরশাদকে চরম শিক্ষা দিয়ে ক্ষমতার স্বাদ মিটিয়ে দিয়েছে।

বর্তমান লীগ সরকারও পদে পদে গণতন্ত্রের শর্তভঙ্গ করছে। ৫ জানুয়ারির নির্বাচন ও সেই একপক্ষীয় নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত সংসদের বলে বলীয়ান হয়ে গঠিত বর্তমান সরকার দেশ-বিদেশে এখন তীব্র সমালোচনার মুখে। দিন যত যাচ্ছে একটি অংশগ্রহণমূলক গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের পক্ষে জনমত প্রবল হচ্ছে এবং আন্দোলনের হাওয়াও উত্তপ্ত হচ্ছে বলে মনে হয়। স্বৈরাচার এরশাদের আমলে আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও বাম নেতৃত্বাধীন তিন জোটের রূপরেখা অনুযায়ী নির্বাচনকালীন নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান সব দল গ্রহণ করে ও বিপুল জনসমর্থন পায়। নির্বাচনকে প্রভাবিত করার কুমতলবেই সংবিধানে পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে এই সর্বজনীন ব্যবস্থাটি লীগ সরকার বাতিল করে দেয়। শেখ হাসিনার দ্বিতীয় সরকারের আমলেই এই উদ্যোগের মাধ্যমে গণতন্ত্রের শর্তভঙ্গের প্রকাশ্য সূচনা হয়। এরপরের ঘটনা দেশবাসীর জানা। প্রধান বিরোধী দলে বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোটসহ সব গণসংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক দলই ৫ জানুয়ারির নির্বাচন বর্জন করে। দেশি-বিদেশি নানা উদ্যোগ চলে সব দলের অংশগ্রহণে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে সরকার ও বিরোধী পক্ষের মধ্যে সংলাপ ও সমঝোতার। ইউরোপীয় ইউনিয়ন, কমনওয়েলথ এবং শেষ পর্যন্ত জাতিসংঘের উদ্যোগও ব্যর্থ হয়। জাতিসংঘ মহাসচিব বান-কি মুনের ব্যক্তিগত উদ্যোগও কোনো কাজে আসেনি। সংবিধানের দোহাই দিয়ে সরকার অনেকটা একগুঁয়েমিপনা করেই দশম সংসদ নির্বাচন সম্পন্ন করে। বিস্ময়কর ব্যাপার হচ্ছে, কোনো নির্বাচন-ভোটাভোটি ছাড়াই ৩০০ আসনের সংসদে ১৫৩ জন এমপি হয়ে যান। অথচ আমাদের সংবিধানের ৬৫(২) অনুচ্ছেদে বলা আছে, 'একক আঞ্চলিক নির্বাচনী এলাকাসমূহ হইতে প্রত্যক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে আইনানুযায়ী নির্বাচিত তিনশত সদস্য লইয়া এবং এই অনুচ্ছেদের (৩) দফার কার্যকরতাকালে উক্ত দফায় বর্ণিত (সংরক্ষিত মহিলা আসন) সদস্যদিগকে লইয়া সংসদ গঠিত হইবে; সদস্যগণ সংসদ-সদস্য বলিয়া অভিহিত হইবেন।' সংবিধানের এই অপরিহার্য শর্ত লীগ সরকার অগ্রাহ্য করে কার্যত গণতন্ত্রের শর্তই অগ্রাহ্য করেছে। ৫ জানুয়ারির অনুষ্ঠিত ১৪৭ আসনের নির্বাচনও কেমন হয়েছে তা নিয়ে যত কম বলা যায় ততই ভালো। ৫ জানুয়ারির নির্বাচনটি যে সঠিক ও গ্রহণযোগ্য হয়নি সরকারপক্ষ কী তা জানে না? নিশ্চয়ই জানে। কিন্তু এসব কিছু তারা গ্রাহ্য করছে না। ক্ষমতার উত্তাপ খুবই খারাপ উত্তাপ। শরীরে তখন অন্য কোনো বাতাস লাগে না। ধরাকে সরা মনে হয়। আগামী ১৬ ডিসেম্বর আমাদের বিজয় দিবস। আজ পালিত হবে বুদ্ধিজীবী দিবস। এসব দিবসের মর্মবাণীই তো হচ্ছে একটি উন্নত, সমৃদ্ধ স্বদেশ- একমাত্র গণতন্ত্রের চর্চা ও অনুশীলনই তা নিশ্চিত করতে পারে। লীগ সরকারের কর্মকাণ্ডে দৃশ্যত মনে হয় তারা বাকশাল ধাঁচের একটি একনায়কত্বমূলক সরকার চালাতে চায়। এই নির্বাচন 'নিয়ম রক্ষার নির্বাচন' বলে শাসকলীগের উপরিমহলের অঙ্গীকার সরকার এখন অস্বীকার করছে। রাষ্ট্রশক্তি প্রয়োগ করে যে ক্ষমতায় বেশিদিন টিকে থাকা যায় না সে শিক্ষার জন্য তো আমাদের বাইরে তাকাতে হয় না। এ বিজয় দিবসে তাই সরকার ও বিরোধীপক্ষের অঙ্গীকার হোক গণতন্ত্রের শর্ত পূরণ করে দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠার, জনগণের কল্যাণ সাধনের। সরকার বিরোধী পক্ষকে দুর্বল ভেবে অন্যথা করলে ফলও ভিন্ন হতে পারে। জনগণ কিন্তু দুর্বল নয় এবং জনগণ কখনো পরাজিত হয় না।

লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট

ই-মেইল : [email protected]

 

 

সর্বশেষ খবর