রবিবার, ১৪ ডিসেম্বর, ২০১৪ ০০:০০ টা

দেখতে একই রকম হলেও ওরা মানুষ নয়

সুমন পালিত

শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস আজ। মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি হানাদার এবং তাদের দোসরদের হাতে যেসব বুদ্ধিজীবী প্রাণ হারিয়েছিলেন, তাদের স্মরণে এ দিনটি পালন করা হয়। বুদ্ধিজীবী হত্যা ছিল এক পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড। এ হত্যাকাণ্ডে জড়িত ছিল মানববেশী কিছু দালাল। নাম তাদের আলবদর, আলশামস, রাজাকার। পশ্চিম বাংলার নকশালপন্থিদের গোপন মুখপত্র দেশব্রতে সাড়ে তিন দশক আগে একটি কবিতা ছাপা হয়েছিল। কবিতাটি হুবহু মনে নেই। তবে তার বক্তব্যটি ছিল এমন- একজন মানুষের যা যা থাকা দরকার সবকিছুই তার ছিল, তবুও সে মানুষ ছিল না। কারণ তার মাথায় ছিল হেলমেট। গায়ে ছিল খাকি পোশাক। হাতে ছিল রাইফেল। একাত্তরে পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের সহযোগীদের ক্ষেত্রে দেশব্রতে ছাপা হওয়া ওই কবিতাটির উপমা সহজেই প্রয়োগ করা যায়। হানাদার পাকিস্তানি বাহিনী কিংবা তাদের সহযোগী রাজাকার, আলবদর, আলশামসরা দেখতে যে অন্যসব মানুষের মতোই ছিল তাতে সংশয়ের কোনো অবকাশ নেই। হাত, কান, চোখ সবকিছু থাকলেও তারা তাদের বিবেককে অশুভ শক্তির কাছে বন্দী রেখেছিল। মনুষ্য চেহারা ধারণ করলেও তারা ছিল কল্পকথার ড্রাকুলাদের মতো। অশুভ আত্দার যে প্রতিভূরা মানুষের ঘাড় মটকে রক্ত পান করত।

একাত্তরে পাকিস্তানি হানাদার ও তাদের এ দেশীয় বশংবদরা নিজেদের মনুষ্য সত্তাকে পশু সত্তার কাছে জিম্মি রেখেছিল। তারা একটি জাতিকে ইতিহাসের পাতা থেকে নিশ্চিহ্ন করার ষড়যন্ত্রে মেতেছিল। এ ষড়যন্ত্রেরই অংশ ছিল বুদ্ধিজীবী হত্যা। একাত্তরে সহস্রাধিক বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবীকে হত্যা করা হয়। এর মধ্যে ৯৯১ জন শিক্ষাবিদ, ১৩ জন সাংবাদিক, ৪২ জন আইনজীবী, ১৬ জন শিল্পী-সাহিত্যিক রয়েছেন। ২৫ মার্চ কালরাতে যে হত্যাকাণ্ডের শুরু তা চলে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত। এমনকি স্বাধীনতার পরও পাকিস্তানি বাহিনীর বশংবদ বিহারিদের হাতে জহির রায়হানের মতো প্রথিতযশা বুদ্ধিজীবীকে প্রাণ হারাতে হয়েছে। ১৪ ডিসেম্বরকে আমরা বুদ্ধিজীবী হত্যা দিবস হিসেবে পালন করলেও একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের নয় মাসের এমন একটি দিন নেই- যেদিন কোনো না কোনো বুদ্ধিজীবীর রক্ত ঝরেনি। কবি, সাহিত্যিক, শিক্ষক-শিল্পীদের অপরাধ- তারা বাঙালি জাতিকে জাগিয়ে তোলার চেষ্টা করেছেন। ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্টের স্বাধীনতা যে ভুয়া ছিল সে সত্যটি বুদ্ধিজীবীরাই প্রথম তুলে ধরেন। '৫২ সালের ভাষা আন্দোলন ছাত্রদের নেতৃত্বে শুরু হলেও বুদ্ধিজীবীরাই ছিল তাদের প্রেরণাদাতা। তারাই পূর্ব বাংলার সঙ্গে পশ্চিম পাকিস্তানের বৈষম্য তুলে ধরেন। সংখ্যায় সংখ্যাগরিষ্ঠ হওয়া সত্ত্বেও বাঙালিরা সর্বক্ষেত্রে কীভাবে উপেক্ষিত হচ্ছে তা বুদ্ধিজীবীরা তাদের লেখায়, ভাবনায় মানুষের সামনে তুলে ধরেছেন এবং তাদের জাগিয়ে তুলেছেন। বলা যায়, রাজনৈতিক নেতারা আমাদের মুক্তি সংগ্রামের নেতৃত্বে থাকলেও নেপথ্যে ছিল বুদ্ধিজীবীদের চিন্তা-ভাবনা। মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী এবং তাদের দোসর আলবদর, আলশামস, রাজাকারদের হাতে যেসব বুদ্ধিজীবী প্রাণ হারিয়েছেন তাদের মধ্যে আছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শনের অধ্যাপক ডক্টর গোবিন্দ চক্রদেব। মানবতাবাদী হিসেবে যিনি সব মহলেই প্রশংসিত ছিলেন। শাহাদাতবরণ করেছেন বরেণ্য চিকিৎসক ডা. মোহাম্মদ ফজলে রাব্বী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, বিশিষ্ট বিজ্ঞানী অধ্যাপক এ এন এম মনিরুজ্জামান, খ্যাতনামা সুরকার ও সংগীতজ্ঞ আলতাফ মাহমুদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজির অধ্যাপক ড. জ্যোতির্ময় গুহ ঠাকুরতা, বাংলার অধ্যাপক মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, চিকিৎসক ডা. আলীম চৌধুরী, সাংবাদিক সিরাজউদ্দীন হোসেন, আ ন ম গোলাম মোস্তফা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলার অধ্যাপক খ্যাতনামা নাট্যকার এ এন মুনীর চৌধুরী, বাংলার অধ্যাপক ও সুসাহিত্যিক আনোয়ার পাশা, সাহিত্যিক সাংবাদিক শহীদুল্লাহ কায়সার, খ্যাতনামা ইতিহাসবিদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের অধ্যাপক সন্তোষ চন্দ্র ভট্টাচার্য, অধ্যাপক ফজলুর রহমান খান, অধ্যাপক মুহম্মদ আবদুল মুকতাদির, প্রতিভাবান সাহিত্যিক সাংবাদিক শহীদ সাবের, কবি মেহেরুন্নেসা, সাংবাদিক সেলিনা পারভীন, পাকিস্তান জাতীয় পরিষদে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাব উত্থাপনকারী খ্যাতনামা রাজনীতিবিদ, আইনজীবী ও সমাজসেবক ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত, রাজনীতিবিদ ও আইনজীবী মশিউর রহমান, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার ২ নম্বর আসামি পাকিস্তানি নৌবাহিনীর সাবেক কর্মকর্তা লে. কমান্ডার মোয়াজ্জেম হোসেন, জগন্নাথ কলেজের রসায়নের শিক্ষক অধ্যাপক যোগেশ চন্দ্র ঘোষ, গণিতবিদ হাবিবুর রহমান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের অধ্যাপক আবুল খায়ের, ইতিহাসের আরেক অধ্যাপক গিয়াস উদ্দিন আহমদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজির অধ্যাপক রাশীদুল হাসান, চিকিৎসক মোহাম্মদ মোর্তজা প্রমুখ। বুদ্ধিজীবী হত্যায় জামায়াতে ইসলামীর সে সময়ের ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্রসংঘ হানাদার বাহিনীর চোখ ও কান হিসেবে কাজ করেছে। এ বাহিনীর সদস্যরা বুদ্ধিজীবীদের চোখ বেঁধে নিয়ে যেত নির্যাতন ক্যাম্পে। সেখানে তাদের ওপর নির্মম নির্যাতন চালানো হতো। সারা দেহ ক্ষতবিক্ষত করে আনন্দ পেত আলবদর নামের নব্য ড্রাকুলারা।

বুদ্ধিজীবীরা হলেন জাতির বিবেক। তারা অন্ধকারে আলো জ্বালান। একটি জাতিকে মেধাগত দিক থেকে এগিয়ে নেন। পাকিস্তানিরা এবং তাদের বশংবদরা এটিকে অপরাধ বলে ভেবেছিল। যে কারণে মুক্তিযুদ্ধে বুদ্ধিজীবীরা ছিল তাদের প্রতিহিংসার শিকার। মুক্তিযুদ্ধের শেষ দিনগুলোতে যখন পাকিস্তানিদের পরাজয় অনিবার্য হয়ে উঠেছে তখনো জোরেশোরে চলেছে বুদ্ধিজীবী হত্যা। এমনকি পাকিস্তানিদের আত্দসমর্পণের দুই দিন আগেও বেশ কজন বুদ্ধিজীবীকে চোখ বেঁধে তাদের বাসভবন থেকে ধরে নিয়ে যায় আলবদর সদস্যরা। রায়েরবাজার বধ্যভূমিতে তাদের চোখ ও হাত বাঁধা ক্ষতবিক্ষত লাশ পাওয়া যায়। বুদ্ধিজীবী হত্যায় কারা জড়িত ছিল তা একটি ওপেন সিক্রেট। কারণ শহীদ বুদ্ধিজীবীদের স্বজনরা জানেন কারা তাদের ধরে নিয়ে গিয়েছিল, তাদের পরিচয়ই বা কী।

স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধুর সরকার একাত্তরের ঘাতক দালালদের বিচার শুরু করে। বুদ্ধিজীবী হত্যার অপনায়কদের কাউকে কাউকে গ্রেফতারও করা হয়। কিন্তু স্বাধীনতার সাড়ে তিন বছর পর দেশি ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের ফলশ্রুতিতে পাকিস্তানি বশংবদরা ক্ষমতায় আসায় থেমে যায় সে বিচার প্রক্রিয়া। দীর্ঘ চার দশক পর হলেও একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু হয়েছে। বুদ্ধিজীবী হত্যার অপনায়কদের জন্য অপেক্ষা করছে ফাঁসির দড়ি। আমরা আশা করব, এ বিচার দ্রুত সম্পন্ন করে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের প্রতি জাতির দায় মেটানো হবে। খুনিদের কোনোভাবেই রেহাই দেওয়া হবে না।

লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট

ই-মেইল : [email protected]

 

 

সর্বশেষ খবর