সোমবার, ১৬ মার্চ, ২০১৫ ০০:০০ টা

সার্কাসের গাধার সাধননিষ্ঠা

আবু তাহের

আটান্ন বছর আগে উজ্জ্বলপুর ছেড়ে আমরা অন্য এলাকায় গিয়ে বাস শুরু করেছি। কিন্তু আজও আমার স্মৃতিতে উজ্জ্বল সেই উজ্জ্বলপুর। কৈশোর ছুঁই-ছুঁই জীবনে জেলা শহরের দক্ষিণ-পূর্ব প্রান্তের ওই লোকালয়ে ঘটে যাওয়া অনেক ঘটনার একটিকে বলা যেতে পারে 'বৃক্ষশাখে রাজার বাসা/ ধান্দাবাজের মেটে আশা।'

মহল্লার যাকে নিয়ে সবচেয়ে জল্পনা-কল্পনা চলত তার নাম 'বোম্বাই আকবর'। ছিপছিপে গড়ন, দীর্ঘদেহী, ফর্সা ও নম্রকণ্ঠ আকবর কী কারণে 'বোম্বাই আকবর' খেতাব পেল কেউই নিশ্চিত জানে না। কারও কারও মতে, বোম্বাই (অধুনা 'মুম্বাই') নগরীতে কিছুকাল চাকরি করেছিল আকবর, সে জন্য এই নাম। কেউ কেউ বলে চট্টগ্রাম শহরে তিন বছর কাটিয়ে এসে আকবর দাবি করে 'এতদিন বোম্বাই ছিলাম জ্যাঠা।' তাই, খোঁচা দেওয়ার জন্য 'বোম্বাই আকবর'। তবে একবার আমার প্রশ্নের জবাবে সে বলে, 'জোয়ানকালে আমার চেহারা ছিল বোম্বাই, ফিল্মের হিরোর লাহান। সে জন্য আর কি, বুঝলা?'

প্রাইমারি স্কুলের সহপাঠী রহমত এক দুপুরে জানায়, 'বোম্বাইরে ধরতে পুলিশ গেছে তাগো বাড়ি। কত ব্যাডা গেছে ঘটনা দেখতে! চল আমরাও যাই।' পৌরবাজারে আকবরের মুদি দোকান আছে। রহমত বলে, 'দোকানদারি হইছে ভংচং। ওর আসল কাম চুরি-চোট্টামি। নারে চুরিও না। ডাকাতি ডাকাতি।' মনে মনে বলি, ডাকাত ধরতে পুলিশ এলো, কেমনে ধরলো দেখতে হয়।

আকবরের বাড়িতে মস্ত উঠোন। তিন দিকে টিনের চৌচালা তিনটি ঘর। প্রতিটি ঘরের দু'পাশে দুটি করে গাছ। সেগুলোয় টসটসে বরই শোভা পাচ্ছে। সবচেয়ে উঁচু বরই গাছের শাখায় লুঙ্গি পরা গেঞ্জি গায়ে বোম্বাই আকবর দণ্ডায়মান। উঠোনে ত্রিশ কি চল্লিশ জন লোক; তারা নিশ্চুপ। একটা ঘরে ভীষণ কর্কশ কণ্ঠে কেউ একজন বলছে, 'দুরমুশ দিয়া তক্তা বানাইয়া ফালামু কইলাম।' উঠোনের পাবলিকদের মধ্য থেকে একজন বলল, 'খাইছে! আমজাদ আলী দারোগা। হারামি তো নিজেই একটা চোর। চোরের বাচ্চা চোরে ধরবে ডাকাত! ফ্যাহ্।'

দারোগার সঙ্গে আসা তিন কনস্টেবল ঘর থেকে বেরিয়ে অন্যান্য ঘরে গিয়ে তল্লাশি চালায়। দারোগা কই? তিনি আকবরের ঘরে পাটিসাপটা পিঠা উদরসাৎ করার পর একটু খেজুরের রসের পায়েস খাচ্ছেন। কনস্টেবলরা তিন ঘর থেকে বরই ভর্তি তিনটি টুকরি বের করে আনলো। উঁচুগলায় বলল, 'বারাইয়া আয়েন স্যার।'

বেরিয়ে এসেই স্যার বললেন, 'য়্যাত্ত মানুষ ক্যান্? যাও আপনা আপনা কামে। ওমা! লড়ে না দেখি! এমন দুরমুশ দিমু এক্কেরে তক্তা হয়া যাবা।' পুলিশ প্রস্থান করছে। তিন কনস্টেবলের প্রত্যেকের কাঁখে বরইভর্তি টুকরি। তাদের সামনে সামনে হাঁটছেন দারোগা আমজাদ আলী। মোটকা লম্বা কালো : ভুঁড়িখানা ফাটোফাটো।

জনতা দেখেছে, গাছে আকবর। ধরিয়ে দিল না। কেন? রটনা আছে, আকবর চুরি-ডাকাতি করে যা আনে তার বিরাট একটি অংশ সে দুস্থজনের সেবায় ব্যয় করে। আমরা অবশ্য কখনো তাকে দান খয়রাত করতে দেখিনি। দেখেছি, সে বড়শি দিয়ে মাছ ধরে আর পুকুরে ছেড়ে দেয়। দেখেছি, হ্যান্ডেল না ধরে সামনের চাকা মাটি থেকে উপরে তোলা সাইকেল চালায় ফুলস্পিডে। দেখেছি, তার পোষা দুটি ছাগল অসুস্থ হলে তাদের কাঁধে করে চিকিৎসার জন্য নিয়ে যাচ্ছে তিন মাইল দূরের পশু হাসপাতালে।

'তোমারে টোকাইতে টোকাইতে পুলিশরা হইতেছিল হয়রানি' বলে মহল্লার ফাজিল যুবক সামাইদ্দা, 'আর তুমি কাগা করলা কী, আরামসে চ্যাগাইয়া, খাড়াইয়া রইলা গাছের ডগায়।' বোম্বাই আকবর বলে, 'তুই বুঝি এরকুম বুঝলিরি বাপ? শুন, কতক্ষণে পুলিশ যাইবো গা অপেক্ষা করতে করতে অস্থির হইয়া পড়ছিলাম। কী যে কষ্ট যদি বুঝতি! মরণেও এমন কষ্ট হয় না রে আব্বা।'

গফরগাঁওয়ের কৃতী সন্তান প্রবীণ সাংবাদিক আবদুল লতিফ এবং তার সহকর্মীরা (এদের মধ্যে আমিও ছিলাম) ঈদুল ফিতরের ১৫ দিন আগে উৎসব বোনাস পাওয়ার জন্য সকাল ১০টা থেকে কর্মস্থলে অপেক্ষা করছি। দুপুর ১২টায় জানানো হয়, মধ্যাহ্নভোজের পর বোনাস দেওয়া শুরু হবে। বিকাল ৩টায় ঘোষণা, 'মাগরিবের পরে যোগাযোগ করতে হবে।' তারাবির নামাজ শুরুর দু'মিনিট আগে বলা হয়, 'আজ হলো না। দুঃখিত। কাল অবশ্যই হবে।'

টানা পাঁচ দিনই 'কাল অবশ্যই বোনাস হবে' ঘোষণা শুনতে শুনতে দুরমুশ ছাড়াই তক্তা হয়ে যাওয়ার দশা। ষষ্ঠ দিনে আমি অপেক্ষমাণদের ভিড়ে ছিলাম না। কর্মস্থলের দূরে থাকলেও যোগাযোগ রক্ষা করছিলাম। ইফতারের পর এসে শুনি, বোনাস হবে। গভীর রাত পর্যন্ত বোনাস বিতরণ হয়েছে। কিন্তু লতিফ ভাই বিতরণ শুরুর আগেই বাড়ি চলে গেছেন। আমরা জানতে চাই, এতদিন অপেক্ষা করলেন, কাল করলে কী দোষ হতো। আবদুল লতিফ বলেন, 'আল ইন্তেজারু আশহাদ্দু মিনাল মওতে।' আরবি এই প্রবচনটির অর্থ হচ্ছে- 'অপেক্ষা মৃত্যুর চেয়েও ভয়ঙ্কর।' অপেক্ষার সঙ্গে আশা জড়িত থাকে। জড়িত থাকে স্বপ্নও। যা আশা করা হয়, যথাসময়ে তার প্রাপ্তি পুলকিত করে প্রাণমন। যা স্বপ্ন থাকে তা বাস্তব হয়ে উঠলে আনন্দে আমরা গেয়ে উঠি- 'তাইরে নাইরে না।' ইরানের শাহ রেজা পাহলভির আশা ছিল, মার্কিন মদদে তিনি ফের সিংহাসনে বসবেন। তাই, ১৯৭৯ সালে জনরোষের মুখে ফ্রান্সে আশ্রয় নিলেও তার মেজাজ ছিল ফুরফুরে। কেননা, ২৫ বছর আগেও জনরোষ থেকে বাঁচতে ইরান ত্যাগ করেছিলেন এবং মার্কিন উদ্যোগে ক্যু-দেতা করে জেনারেল জাহেদী ফের শাহকে নিয়ে এসেছিলেন।

বছরের পর বছর গড়ায়। শাহ রেজা পাহলভি অপেক্ষা করতে থাকেন। নিরাশা শুরু হয়। অসুস্থ হতে থাকেন তিনি। ফ্রান্সে ইরানিরা তার বিরুদ্ধে বিক্ষোভ করতে থাকে। তিনি চলে গেলেন যুক্তরাষ্ট্রে। সেখানে ইরানিদের তুমুল বিক্ষোভ। এবার গেলেন বার্বাডোস। যেখানেই যান বিক্ষোভ। শেষতক আশ্রয় নিলেন মিসরে। 'নিউজউইক'কে বললেন : 'আমেরিকার বুদ্ধিতে আমি দেশত্যাগ করলাম। তাদের স্বার্থে কাজ করায় ইরানিদের দুশমন হলাম। অথচ আমেরিকা আমাকে মরা ইঁদুরের মতো ছুড়ে ফেলে দিয়েছে।'

গণবিরোধী শাহ যে উচিত শিক্ষা পেয়েছিলেন তা দেখে গণবিরোধী প্রেসিডেন্ট ফার্দিনান্দ মার্কোস শিক্ষা নিতে পারতেন। ফিলিপাইনের মানুষ মার্কোসের বিরুদ্ধে ফুঁসে উঠলে মন্ত্রীরা একে একে 'জনতার শক্তি'র সঙ্গে যোগ দেন। ক'দিন পরে জনতার কাতারে এলেন সেনাবাহিনীর উপ-প্রধান জেনারেল ফিদেল রামোস। বিপদ দেখে মার্কোস ফোন করেন তার দোস্ত স্টিফেন সোলার্জকে। সোলার্জ ছিলেন মার্কিন সিনেটের এশীয়-প্রশান্ত মহাসাগরীয় বিষয়ক কমিটির চেয়ারম্যান। খুবই প্রভাবশালী রাজনীতিক।

'সোলার্জ! তুমি এখনই হোয়াইট হাউসে যাও। প্রেসিডেন্ট রিগানকে বল, কোরাজন একুইনো আমায় ধ্বংস করতে চাইছে। অল-রেডি সে নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নিয়েছে। আমি তো আরও এক টার্ম প্রেসিডেন্ট থাকতে চাই। আমায় বাঁচাও সোলার্জ।' কেঁদে ফেললেন মার্কোস। সোলার্জ বলেন, 'কাঁদে না বন্ধু। কাঁদে না। আমি একটা ব্যবস্থা অবশ্যই করব।'

হ্যাঁ, ব্যবস্থা করেছিলেন স্টিফেন সোলার্জ। ঘণ্টা দু'য়েক অপেক্ষা করতে করতে মৃত্যুর চেয়ে বেশি যন্ত্রণা ভোগ করা মার্কোসকে ফোনে সোলার্জ বললেন, 'প্রেসিডেন্ট রিগান তোমার নিরাপত্তার ভার নিয়েছেন। কেউ যাতে তোমার কেশাগ্র স্পর্শ করতে না পারে সে ব্যবস্থা যুক্তরাষ্ট্র করবে। ফিলিপাইনের ক্লার্ক ঘাঁটিতে অবস্থানরত আমেরিকান সৈন্যরা তোমাকে নিরাপদে দেশের বাইরে নিয়ে আসবে। এ ব্যাপারে রিগান খুব সিরিয়াস।'

নিবেদিতপ্রাণ বন্ধুর আপদকালে তাকে বর্জন করে যুক্তরাষ্ট্র। এ দেশটি নিজের স্বার্থ বাইশ আনা বোঝে, অন্যের স্বার্থ আড়াই আনাও নয়। দুষ্টজনরা এ জন্যই বলে, আমেরিকা যে দেশের বন্ধু সে দেশের আর শত্রুর দরকার হয় না। জর্জ বার্নার্ড শ' এসব কারণে যুক্তরাষ্ট্রকে একটি অসংস্কৃত ভূখণ্ড বলতেন। এ জন্য মার্কিনিরা কুপিত ছিলেন এই নাট্যকারের ওপর। তারা ভাবল, লোকটাকে ডেকে এনে আদরযত্ন করলে ইতিবাচক ফল পাওয়া যাবে।

আমন্ত্রিত হয়ে যুক্তরাষ্ট্রে গেলেন বার্নার্ড শ'। সে দেশের বড় বড় শহরে তাকে নাগরিক সংবর্ধনা দেওয়া হয়। দিয়ে উপকার পাওয়া গেল না। বার্নার্ড শ' প্রায় প্রতিটি অনুষ্ঠানেই যুক্তরাষ্ট্রে সাংস্কৃতিক মান কত নিচু তার বর্ণনা দেন। সফরের শেষ পর্যায়ে এলেন নিউইয়র্ক নগরীতে। এখানে তিনি হলভর্তি শ্রোতাদের সামনে বললেন, 'মার্কিন নাগরিকদের অর্ধেকই গাড়ল, নির্বোধ, বোকার হদ্দ।'

শ্রোতারা হৈচৈ শুরু করে। দুয়ো ধ্বনি দেয়। হট্টগোল বাড়তেই থাকে। 'লেট মি ফিনিশ। লেট মি ফিনিশ,' বলেন বার্নার্ড শ' 'মার্কিন নাগরিকদের শতকরা ৫০ ভাগ অত্যন্ত বুদ্ধিমান, চতুর, চটপটে।' শ্রোতারা এবার তুমুল করতালি দেয়। বার্নার্ড শ' বললেন, 'তোমাদের এই উল্লাস প্রমাণ করে, তোমাদের আহাম্মকি সম্পর্কে যা যা আমি বলেছি তা শতভাগ সত্য।'

নিউইয়র্কের পত্রিকাগুলো ক্ষিপ্ত হয়ে ঠিক করে তাচ্ছিল্যের জবাব তারা তাচ্ছিল্যে দেবে। তাই তারা লিখল, 'গত রাতে নগরীর একটি সুপার মার্কেটে ৫০ হাজার ডলারের কেনাকাটা করেছেন ব্রিটিশ এক মহিলা, তার নাম মিসেস শ'। তার স্বামী নাকি একজন লেখক।'

তাচ্ছিল্য প্রসঙ্গ থাক। গুরুত্ব প্রসঙ্গ চলুক। সার্কাসের সং একটা হুমকি দেয়। গাধা সেই হুমকিকে গুরুত্ব দিয়ে অপেক্ষা করতে থাকে- 'সে জানে না, আল ইন্তেজারু আশহাদ্দু মিনাল মওতে।'

নদীর এপারে সার্কাসের তাঁবু। ওপারে রাজবাড়ি। সার্কাসের গাধা নদীতে গোসল করতে যায়। রাজবাড়ির গাধাও আসে গোসলে। ওপার থেকে রাজবাড়ির গাধা বলে, 'তুমি শুকিয়ে গেছ কেন?' সার্কাসের গাধা বলে, 'শুকাবোই তো! খেতে দেয় আধপেটা-সিকিপেটা।' রাজবাড়ি বলে, 'এপারে চলে এসো। রাজবাড়িতে থাকবে। খেয়ে দেয়ে আমার মতো মোটাতাজা হবে।' সার্কাস বলে, 'নারে ভাই, ওপার যাব না। রাজবাড়ি বলে, খেতে পাওনা তবু ওখানে থাকবে? থেকে কী লাভ।'

সার্কাসের গাধা বলে, 'উঁচু করে টানা চিকন তারের ওপর দিয়ে সুন্দরী যে মেয়েটি হাঁটে তাকে ক্লাউন বলে, এই ছেমরি, সাধবানে হাঁটবি। পড়ে গেলে কিন্তু গাধার সঙ্গে তোর বিয়ে দিয়ে দেব। একদিন না একদিন মেয়েটি পড়ে যাবেই, আমি সেই অপেক্ষায় আছি।'

সুখকর ঘটনার জন্য আমরাও অন্তহীন অপেক্ষা করছি। এ জন্য কেউ আমাদের 'গর্দভ' বললে রেগে যাওয়া কী ঠিক?

লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট।

 

 

সর্বশেষ খবর