রবিবার, ১২ এপ্রিল, ২০১৫ ০০:০০ টা
রৌদ্র ছায়ার নিচে

বাংলাদেশ এবং পেঙ্গুইন আইল্যান্ড

মাকিদ হায়দার

বাংলাদেশ এবং পেঙ্গুইন আইল্যান্ড

১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের পর তৎকালীন পূর্ববঙ্গের ভাগে এসেছিল মাত্র ১৭টি জেলা। উত্তরবঙ্গের ১৭টি জেলা থেকে পূর্ববঙ্গের ভাগে পড়েছিল মাত্র পাঁচটি। বিভাগীয় শহর হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছিল রাজশাহী। সেই রাজশাহী বিভাগের অধীনে ছিল আমাদের পাবনা, বগুড়া, রংপুর এবং দিনাজপুর। বরেন্দ্রভূমি রাজশাহীতে, পার্শ্ববর্তী পশ্চিমবঙ্গ থেকে হাজার হাজার রিফিউজি এসে দখল নিয়েছিল হিন্দুদের বাড়িঘর, সহায়-সম্পদ। অপরদিকে পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ, মালদহ, রানাঘাটে যেসব মুসলিমের বাড়ি, জমি, এমনকি হুগলি, বর্ধমানের অনেক জোতদারদের সহায়-সম্পদ পূর্ববঙ্গের উদ্বাস্তুরা দখল করেছিল। কেননা উভয় দেশের সরকারেরই হয়তো প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিত ছিল, যার ফলশ্রুতিতে ভারত সরকার, পাকিস্তান সরকার উদ্বাস্তুদের প্রতি খড়গহস্ত না হয়ে বরং সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল অনাশ্রিত মানুষদের আশ্রয়ের জন্য।

তৎকালীন পূর্ববঙ্গের ইতিহাসখ্যাত পুণ্ড্রনগরী বগুড়ায় কিছু বাস্তুহারা লোক এসে বগুড়া শহরে এবং আশপাশের গ্রামে থিতু হয়েছিলেন। মুর্শিদাবাদ, মালদহের জমিজমার বিনিময়ে তারা বগুড়াসহ অন্যান্য জেলা শহরে এবং মহকুমায় ঠাঁই নেন। যেসব রিফিউজি বা উদ্বাস্তু নিজ জন্মভূমি ত্যাগ করেছিলেন নিজের এবং পরিবারের জীবন রক্ষার্থে। উপরন্তু ধর্মের নামে প্রতিষ্ঠিত, মুসলিম ঐক্যের প্রতীক হিসেবে সেকালের পূর্ববঙ্গের মুসলমানরা দেখতে পেয়েছিলেন মোহাম্মদ আলী জিন্নাহকেই এবং পাকিস্তান যে মুসলমানদের জন্যই প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে, সেটি ১৯৪৭-এর পর থেকেই তৎকালীন মুসলিম লীগের নেতারা যেভাবে সমগ্র পূর্ববঙ্গের আনাচে-কানাচে প্রচার করেছিলেন তাতে স্বভাবতই এদেশে বসবাসকারী হিন্দু সম্প্রদায়ের ভিতরে ভীতির সৃষ্টি করেছিল। বগুড়ার কট্টর মুসলিম লীগ নেতারা ছিলেন সক্রিয়। ১৯৪৭ থেকে ১৯৫৩ অব্দি মুসলিম লীগের একচ্ছত্র শাসনব্যবস্থায় চির ধরিয়েছিলেন পাকিস্তানের স্রষ্টা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ স্বয়ং। ১৯৪৮ সালে রেসকোর্সের ময়দানে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার ঘোষণা দিয়েছিলেন তিনি। ওই দিনের বক্তৃতায় বাংলা ভাষা না হয় সেই দিকটিকেও প্রাধান্য দিয়েছিলেন পাকিস্তানের স্রষ্টা। ১৯৫২ সালের রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে মুসলিম লীগের পতন শুরু হলেও তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রীর শাসনামলে ঢাকায় তৈরি হয়েছিল দৃষ্টিনন্দন হোটেল শাহবাগ এবং ঢাকার নিউমার্কেট। ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের প্রচণ্ড ধূলিঝড়ে ধূলিসাৎ মুসলিম লীগ হয়ে গেলেও তাদের অনুসারীরা ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরের মাঝামাঝি পর্যন্ত সক্রিয় ছিলেন পূর্ববঙ্গে। মুসলিম লীগের সঙ্গে হাত মিলিয়েছিল অপর একটি মৌলবাদী দল জামায়াতে ইসলামী। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় সমগ্র বাংলাদেশে যে অনাচার, অত্যাচার, হত্যা হয়েছে, লুণ্ঠন, অগি্নসংযোগ- এসব কিছুর ইন্ধনদাতা ছিলেন পাকিস্তানপ্রেমী মুসলিম লীগ, জামায়াতে ইসলামী, নেজামে ইসলাম এবং নূরুল আমিনের পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক পার্টি বা পিডিপি। ঢাকা শহরের মগবাজারে ছিল পিডিপির প্রধান কার্যালয়। যেমন আওয়ামী লীগের অফিস ছিল পুরানা পল্টনের একটি বাড়িতে। সেই মুসলিম লীগ, জামায়াতে ইসলামী, নেজামে ইসলামের সমর্থকদের এখনো অনেকেই বসবাস করছেন পুণ্ড্রনগরী বগুড়ায়।

পৃথিবী বিখ্যাত দার্শনিক আনাতোল ফ্রাঁস যদি জানতেন ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরে পৃথিবীতে বাংলাদেশ নামক একটি নতুন রাষ্ট্রের জন্ম হবে তাহলে আনাতোল ফ্রাঁস তিনি তার জগদ্বিখ্যাত গ্রন্থে 'পেঙ্গুইন আইল্যান্ড'-এর যেসব বর্ণনা দিয়েছেন সেটির উদ্ধৃতি দেওয়া যেতে পারে। 'হায় আমার মাথার চতুর্দিকে যদি চোখ বসানো থাকত, তাহলে আচক্রবাল বিস্তৃত এই সুন্দরী ধরণীর সম্পূর্ণ সৌন্দর্য একসঙ্গে দেখতে পেতুম'। পৃথিবী বিখ্যাত দার্শনিক আনাতোল ফ্রাঁস আরও বলেছেন, 'আমার মনের চোখ তো একটি বা দুটি নয়, মনের চোখ বাড়ানো-কমানো সম্পূর্ণ নিজের হাতে। নানা জ্ঞান-বিজ্ঞান যতই আমি আয়ত্ত করতে থাকি, ততই একটি করে আমার মনের চোখ ফুটতে থাকে।'

এই বিখ্যাত দার্শনিক তার 'পেঙ্গুইন আইল্যান্ড' নামে একটি গ্রন্থে পাঠকদের জানিয়েছেন, কী করে পেঙ্গুইন পাখিরা মানুষরূপে একদিন রূপান্তরিত হলো বহুবিধ বিবর্তনের মধ্যদিয়ে এমনকি শেষ অবধি তাদের কী পরিণতি ঘটল কপালে। পাখিকে মানুষ বানানোর জন্য কোনো কঠিন প্রক্রিয়ার সাহায্য নিতে হয়নি। ঈশ্বরের ইচ্ছা হলো- পাখিরা মানুষ হোক, তখনই পেঙ্গুইনগুলো মানুষ হয়ে গেল।

অষ্টাদশ এবং ঊনবিংশ শতাব্দীতে এমনকি বিংশ শতাব্দীতে অথবা প্রাগৈতিহাসিককালেও হয়তো অনুরূপ ঘটনা ঘটেছিল। তবে ফ্রাঁস বোধহয় সংবাদটি পাননি যে, বাংলাদেশ নামক একটি শান্তিপ্রিয় দেশে গত ৫ জানুয়ারি ২০১৫ থেকে সেসব পেঙ্গুইন থেকে মনুষ্য রূপ পাওয়া দত্যিদের কথা। খবরটি পেলে নিশ্চয়ই তিনি তার 'পেঙ্গুইন আইল্যান্ড' গ্রন্থের কলেবর বৃদ্ধির সুযোগ পেতেন।

যতদূর জানা যায়, প্রাচীনকালের আর্যরা বাংলাদেশের সেই সময়ের অধিবাসীদের বসবাসকারীদের পক্ষী জাতি হিসেবেই বর্ণনা করেছিলেন। আগেই বলেছি, অষ্টাদশ, ঊনবিংশ, বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি পর্যন্ত বিভিন্ন চরিত্রের পক্ষীদের যেসব বর্ণনা, 'হুতোম পেঁচার নকশায়' গ্রন্থাকার কালীপ্রসন্ন সিংহ ১৮৬২ সালে এবং প্যারীচাঁদ মিত্র 'আলালের ঘরে দুলাল' গ্রন্থে পক্ষী ও ওই সময়ের দুলালদের কথা জানালেও জানাননি পক্ষীরা এবং দুলালেরা কোনো রাজনৈতিক দলের নেতা ছিলেন কিনা কিংবা সুবিধাবাদী বা দলবদলকারী কেউ ছিলেন কিনা, সেটি যেমন বঙ্গের দুই খ্যাতিমান লেখক জানতে পারেননি, পারেননি আনাতোল নিজেও। জানলে ফরাসিদের সুবিধা হতো। ভারতবর্ষের পাশেই বঙ্গদেশ নামক একটি দেশ আছে, সে দেশের জনগণকে ঈশ্বর পক্ষী বানানোর আগেই বঙ্গবাসী পক্ষী হওয়ার অপেক্ষায় বসে আছেন মাটির ওপরে। গাছের ডালে এমনকি ফ্রাঁসের যদি জানা থাকত তার পেঙ্গুইন আইল্যান্ডের হাজার হাজার সংস্করণে ঠাঁই পেত বঙ্গদেশ বা বাংলাদেশ। অথবা পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের দ্বিপদসম্পন্ন পক্ষীদের।

সেই বাংলাদেশের উত্তরে আছে বগুড়া নামক জেলাশহর এবং সেই জেলাশহরে আছে অনেক উপজেলা। সেই উপজেলার ভিতরে আছে অনেক গ্রাম, সেই গ্রামেরই একটি নাম নন্দীগ্রাম, আরও আছে গাবতলী, শাজাহানপুর। গাবতলী উপজেলার প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক বকুল মিয়া। তিনিসহ আরও অনেকেই ২০১৩ সালের নভেম্বর মাসে চাঁদের ভিতরে দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর চেহারা দেখতে পেয়েছিলেন। অপরদিকে বগুড়া জেলার দক্ষিণে নন্দীগ্রাম নামক উপজেলায় মৌলবাদীরা যে তাণ্ডবের সৃষ্টি করেছিল সেটি কল্পনাতীত। জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে মানুষ হত্যা করে সমগ্র বাংলাদেশের জনমনে শুধু আতঙ্কই সৃষ্টি করেনি, চেষ্টা করেছিল দেশটিকে একটি মৌলবাদী দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে।

আনাতোল ফ্রাঁস তার 'পেঙ্গুইন আইল্যান্ডে' যদি লিখতেন, বাংলাদেশের মানুষ ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে দুর্ধর্ষ পাকিস্তানি খুনিদের পরাজিত করেছিল, শেখ মুজিবুর রহমান নামের একজন বাঙালির ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ শুনে এবং ৯ মাসের যুদ্ধে একটি দেশের স্বাধীনতা এনে দিয়েছিল মাত্র একটি লোকের উদাত্ত আহ্বানে। সেই বাংলাদেশের জনগণ স্বাধীনতার ৪৩ বছর পর কেন স্বদেশের মানুষকে পেট্রলবোমা মেরে, গাড়ি জ্বালিয়ে আহত-নিহত করছে। ফ্রাঁস হয়তো আরও লিখতে পারতেন, মুসলিম এবং খ্রিস্টানদের কবর দেওয়া হয়, বৌদ্ধ ও হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষদের শ্মশানে নিয়ে দাহ করা হয়। এখন দেখছি একজন মুসলমান আর একজন মুসলমানকে জীবন্ত দাহ করছে পেট্রলবোমায়। কোনো ধর্মে আছে কি, জীবন্ত মানুষকে পুড়িয়ে মারা?

পেঙ্গুইন পাখিরা যেদিন থেকে মানুষরূপে রূপান্তরিত হলো, সেদিন থেকেই বিভিন্ন দলের গোত্রে বিভক্ত হলেও তাদের মাথায় হয়তো রাজনীতি শব্দটির উদ্ভব হয়নি। পরবর্তী সময় কোথাকার কোন দুষ্ট লোক এসে শুরু করল দলবাজি, রাজনীতি নামের এক নতুন খেলা। সেই যে খেলা শুরু হয়েছে তার আর শেষ নেই। যে খেলার শেষ নেই, সে খেলায় যে ফাইনাল কোনো দিনই হবে না, হয়তো এটা আশা করা সমীচীন নাও হতে পারে। কিন্তু এর অর্থ এই নয় যে, মানুষ পুড়িয়ে মারা, দেশের অর্থনীতিকে পঙ্গু করে দেওয়া। ফ্রাঁস তার গ্রন্থে আরও কিছু তথ্য দিতে পারতেন, কিংবা গ্রন্থটির কলেবর বৃদ্ধির জন্য মৌমাছিদের আচার-আচরণ নিয়ে লিখলে সহৃদয় পাঠক জানতেন, মৌমাছিরা ফুল থেকে মধু সংগ্রহ করে তাদেরই রানীর নির্দেশে। হয়তো ফরাসি দেশে মৌমাছিদের দেখা পাওয়া দুষ্কর হলেও বঙ্গদেশের সুন্দরবনে, এমনকি অনেকের বাড়ির আম-জাম গাছে এই বসন্তকালে প্রচুর মৌচাক দেখতে পাওয়া যায়। মৌচাকের শ্রমিক মৌমাছিরা রানীমার নির্দেশ পেলেই কাউকে কামড়াতে দ্বিধাবোধ করে না এবং কর্ম শেষে রানীমাকে গিয়ে শ্রমিক মৌমাছিরা জানিয়ে দেয়, আপনার নির্দেশানুসারেই কামড়ে দিয়েছি পেঙ্গুইন পাখি থেকে রূপান্তরিত ১৬-১৭ কোটি বাংলাদেশি পুঙ্গবদের। হয়তো রানী মৌমাছি শ্রমিক মৌমাছিদের কথা শুনে স্মিতহাস্যে জানিয়ে দেয়, আরও কামড়াতে হবে, যেন চোখ-মুখ চেনা না যায়। যেন বাংলাদেশি পুঙ্গবরা পাকিস্তানিদের চেহারা ফিরে পায়, ফিরে পেলেই আরাম শান্তি।

১৯০৫ সালে বঙ্গবঙ্গের কথা আনাতোল ফ্রাঁস জানতেন কিনা জানি না, জানলে নিশ্চয়ই তিনি কবি রবীন্দ্রনাথকে লিখতে দিতেন না। 'হে মোর দুর্ভাগা দেশ' নামের পদ্যটি। যদি ফ্রাঁসের মাথায় চতুর্দিকে চোখ বসানো থাকত। বলাবাহুল্য, বগুড়ার দৈনিক জনকণ্ঠের সাংবাদিক কিংবা দৈনিক কালের কণ্ঠের সাংবাদিক (সমুদ্র হক, কিংবা জিএম রউফ) যদি ভবিষ্যতে আমাকে জিজ্ঞাসা করেন, পুণ্ড্রনগরী বগুড়াকে নিয়ে অনেক কথাই লিখেছিলেন, ভবিষ্যতে কি বরিশাল গিয়ে কিছু লিখবেন কিনা? সমুদ্রের এবং রউফের প্রশ্নের উত্তরটা দেব, বরিশালের কৃতী ফুটবলার, সন্তান, অবসরপ্রাপ্ত মেজর হাফিজের উদ্ধৃতি থেকে। যেহেতু তিনি ৩১ জানুয়ারি ২০১৫ তারিখ শনিবার বিবিসির সংলাপে আমাদের জানিয়েছিলেন 'কিসের পরীক্ষা, কিসের কি? প্রয়োজনে পরীক্ষা পিছিয়ে দিন', কথাটি যদি আনাতোল ফ্রাঁস শুনতে পেতেন, তিনি নিশ্চয়ই একদিন মেজর (অব.) সাহেবকে দেখতে আসতেন বলেই আমার বিশ্বাস এবং একই সঙ্গে দেখতে পেতেন পেট্রলবোমায় আহত, নিহতদের বিকৃত মুখ, বাংলাদেশ নামক দেশটিতে এসে।

লেখক : কবি।

 

সর্বশেষ খবর