বৃহস্পতিবার, ৪ জুন, ২০১৫ ০০:০০ টা

জাতীয় বাজেট ২০১৫-২০১৬ অর্থবছর

আবু হেনা

জাতীয় বাজেট ২০১৫-২০১৬ অর্থবছর

কয়েক দিন ধরে দেখছি একুশে টেলিভিশনের পর্দায় এ দেশের একজন প্রতিশ্রুতিশীল প্রতিভাবান তরুণ অর্থনীতিবিদ, উন্নয়ন অন্বেষণের চেয়ারম্যান প্রফেসর রাশেদ আল-মাহমুদ তিতুমীর জাতির সামনে প্রশ্ন তুলে ধরছেন, 'জাতীয় বাজেট কি শুধুই আয়-ব্যয়ের হিসাব নাকি অন্যকিছু?'

আভিধানিক অর্থে জাতীয় বাজেট হচ্ছে জাতীয় রাজস্ব এবং রাষ্ট্রীয় ব্যয় সংবলিত একটি প্রাক্কলন বা অ্যাস্টিমেট যা সরকারের পক্ষ থেকে অর্থমন্ত্রী সংসদে অনুমোদনের জন্য উপস্থাপন করেন। এর সঙ্গে থাকে কিছু কর প্রস্তাব এবং সংস্থাপন ব্যয়ের একটি প্রতিবেদন এবং বার্ষিক উন্নয়নের জন্য ব্যয় বরাদ্দ। অর্থমন্ত্রী তার বক্তব্যে সামগ্রিক আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপট এবং বিভিন্ন অর্জনের বিবরণ তুলে ধরেন। কিন্তু প্রকৃত অর্থে জাতীয় বাজেট হচ্ছে একটি অসাধারণ প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে একটি সুনির্দিষ্ট পথে যৌক্তিক নীতিমালা অবলম্বনে পরিবর্তন, উন্নয়ন এবং প্রগতির ধারাকে জাতীয় জীবনে স্বয়ংক্রিয়ভাবে অব্যাহত রাখার একটি সচেষ্ট প্রয়াস। বাজেট মানে বিশেষজ্ঞ জ্ঞানসমৃদ্ধ পরিকল্পনা, বাজেট মানে উদ্ভাবন, একটি মিশন, অনুকারের মাঝে সুচিন্তিত দিকদর্শন। বাজেট মানে জাতীয় জীবনে একটি কর্মচঞ্চল আবহ সৃষ্টি করা। একটি পরশ পাথর যার স্পর্শে এ দেশের প্রতিটি মানুষ নতুন কর্মউদ্দীপনায় উন্মুখ হয়ে উঠতে পারে, এটি একটি সঞ্জীবনী শক্তি যা সমাজের অন্তর্নিহিত শক্তিগুলোকে সঞ্চালিত করে কর্মস্পৃহার উন্বেষ ঘটায়। কর্মযজ্ঞ সৃষ্টি করে। অনেকগুলো ভালো খবর নিয়ে এবার সংসদে আসবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরকারের অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। ছাত্রজীবনে প্রগতিশীল ছাত্র রাজনীতি করতেন। মার্কস, এঙ্গেলস, লেনিন আর মাও সে তুংয়ের বাণী শোনাতেন। পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে প্রলেটারিয়েটের বিপ্লবের ইন্ধন জোগাতেন। জেনারেল এরশাদের সামরিক শাসনামলে অর্থ উপদেষ্টা ছিলেন। এবার শেখ হাসিনার অর্থমন্ত্রী হিসেবে সংসদে সপ্তম বাজেট পেশ করতে চলেছেন। তার জন্য অভিনন্দন।

সবচেয়ে খুশির খবর ৬৮ বছরের প্রতীক্ষার অবসান ঘটিয়ে ৬ মে ভারতের পার্লামেন্টে মুজিব-ইন্দিরা স্থলসীমানা চুক্তির বাস্তবায়নের জন্য বিল পাস হয়েছে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে বিলটি পাস হওয়ার পর টেলিফোনে অভিনন্দনও জানিয়েছেন। আর একটি ভালো খবর, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ৬ জুন বাংলাদেশ সফরে আসছেন। সম্ভাবনার পথে রয়েছে তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তি সম্পাদন। তার এই সফরে এক ধরনের স্থায়ী কাঠামো পাচ্ছে দুই দেশের সড়ক ও নৌবাণিজ্যের যোগাযোগ, বাংলাদেশ ও নেপাল-ভুটান পণ্য পরিবহনে যে বাধা ছিল তা দূর হতে চলেছে। একই সঙ্গে বিভিন্ন আঞ্চলিক কাঠামোর সঙ্গে সংযুক্ত হচ্ছে বাংলাদেশ। ইতিমধ্যে ভারত ও মিয়ানমারের সঙ্গে সমুদ্রসীমানা চিহ্নিত হয়েছে বাংলাদেশের অনুকূলে। পদ্মা সেতু নির্মাণে তিন হাজার দেশি-বিদেশি শ্রমিক কাজ করছে। বাণিজ্যিক রাজধানী চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীর তলদেশে নির্মিত হতে চলেছে বহুলেন বিশিষ্ট টানেল। পেছন ফিরে তাকালে এর সঙ্গে যোগ করা যায় শেখ হাসিনার শাসনামলে সম্পাদিত পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি এবং গঙ্গার পানিবণ্টন চুক্তি। নিঃসন্দেহে এসবই বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার অর্জন, যার জন্য ২৯ মে গণসংবর্ধনায় তাকে 'দেশরত্ন' উপাধিতে ভূষিত করা হয়েছে। এর জন্য তার অভিনন্দন প্রাপ্য।

দুঃখের বিষয় দেশরত্ন শেখ হাসিনা অদ্যাবধি এ দেশে গণতন্ত্রকে সঠিকভাবে প্রতিষ্ঠিত করতে পারেননি। আর এর অভাবেই আজ সাধারণ জনগণের জীবন বিপন্ন। জনজীবনে আজ শান্তি নেই। নেই জননিরাপত্তা। আর সে কারণেই আজ এতগুলো ভালো খবরের মাঝে পত্রপত্রিকায় শিরোনাম হয়েছে- গণকবর নিয়ে আতঙ্ক- 'মালয়েশিয়ার গভীর জঙ্গলে ১৩৯টি গণকবর, ২৮টি বন্দীশিবির। থাইল্যান্ডে শত শত গণকবরের সন্ধান পাওয়ার পর মালয়েশিয়ায় গণকবর ও বন্দীশিবিরের সন্ধান মেলায় আতঙ্কিত হয়ে পড়েছে এ দেশের সব বিবেকবান মানুষ। অথৈ সমুদ্রে ভাসছে হাজার হাজার সহায় সম্বলহীন দুর্ভাগা বাঙালি। স্বজনদের বিলাপে ভারি হয়ে উঠেছে পরিবেশ। গ্রামে গ্রামে চলছে প্রিয়জন নিখোঁজের আতঙ্ক। একই সঙ্গে শিরোনামে এসেছে- ডুবছে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান- অস্তিত্ব সংকটে বাংলাদেশ বিমান, বিটিসিএল, বস্ত্র ও পাট খাত, ডাকবিভাগ, বিদ্যুৎ খাত, বিটিভি, ওয়াসা, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকসহ বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠান। খেলাপি ঋণে জর্জরিত এসব প্রতিষ্ঠান। ব্যাংকের ঋণ জালিয়াতির মাধ্যমে গত এক বছরে প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা আত্দসাতের অভিযোগ রয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান অনুযায়ী সর্বশেষ ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ৫৩ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণের পরিমাণ ২০ হাজার কোটি টাকার ওপরে। লোকসান ব্যাধিতে আক্রান্ত বিমান এখন একটি চোরাচালানি সংস্থাতে রূপান্তরিত হয়েছে। গত ৩০ মে ১ কোটি ২০ লাখ টাকা মূল্যের সোনার বারসহ একটি বিমান জব্দ করেছে কাস্টমস গোয়েন্দা বিভাগ।

আজ বেকারত্ব ধারণ করেছে মারাত্দক আকার। সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী দেশের ছয় কোটিরও বেশি সক্ষম জনশক্তির এক-তৃতীয়াংশই বেকার। সরকারি হিসাবেই এর মধ্যে আনুমানিক ৫০ লাখের বেশি শিক্ষিত বেকার। ১৯৭৩ থেকে ৭৮ সাল পর্যন্ত প্রথম পাঁচসালা পরিকল্পনা বাস্তবায়নের মেয়াদে এই দেশে দারিদ্র্য ও বেকারত্ব নিরসনে প্রয়োজন ছিল ৫৪ লাখ মানব-বর্ষ কাজের সুযোগ সৃষ্টির। কিন্তু বিনিয়োগ ঘাটতির ফলে সে সময় যে অতিরিক্ত মানব-বর্ষ পরিমাণ কাজের সুযোগ তৈরি হয় তা ছিল মাত্র ৩০ লাখ মানব-বর্ষ। ফলে ১৯৮০ সালের শেষেও বেকার সমস্যা অপরিবর্তিত থেকে যায়। দ্বিতীয় পাঁচসালা পরিকল্পনা মেয়াদে (১৯৮০-৮৫) লক্ষ্য ছিল ৩৭ লাখ নতুন কর্মসুযোগ সৃষ্টি করা। কিন্তু সে সময়ও ৩২ লাখের বেশি কাজের সুযোগ সৃষ্টি হয়নি। এ ধারা আজও অব্যাহত রয়েছে, বিশেষ করে লোকসংখ্যা প্রায় দ্বিগুণ হয়ে যাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে। এর কারণ অভ্যন্তরীণ সম্পদ উৎপাদন খাতে ব্যবহৃত না হয়ে সচিবালয়ের অভ্যন্তরে আমলাদের পেছনে খরচ হচ্ছে। প্রকল্প সাহায্যের ক্ষেত্রে ওয়াদাকৃত ঋণ ও অনুদান অব্যবহৃত থেকে যাচ্ছে। উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন হচ্ছে না।

আজ থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়ার জঙ্গলে গণকবরে বাংলাদেশিদের নরকঙ্কাল। এ লজ্জা আমরা ঢাকি কী করে? এ দেশের ভয়াবহ পরিণতি কেন হলো? থাইল্যান্ড, দক্ষিণ কোরিয়া, চীন, তাইওয়ান, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া সবাই যখন তাদের দেশের মানুষকে আত্দমর্যাদার সঙ্গে বিশ্বের বুকে ঠাঁই করে দিল তখন যে বাংলাদেশ একদিন পৃথিবীর মানচিত্রে সবচেয়ে ধনী দেশ ছিল, ষাটের দশকেও এসব দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর সমপর্যায়ে ছিল, আজ সে দেশের এই করুণ চিত্র কেন? এর উত্তর মিলবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও মঞ্জুরি কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান, অধ্যাপক এ কে আজাদ চৌধুরীর ২৪ মে শিল্পকলা একাডেমিতে প্রদত্ত একটি বক্তব্যে। তিনি বলেছেন, কারও বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ উঠলেই তখন তার রাজনৈতিক রূপ দেওয়া হয়। বলা হয় এসব ষড়যন্ত্র। তখন মনে হয় দুর্নীতির অভিযোগে অভিযুক্ত রাজনীতিবিদরা ধোয়া তুলসী পাতা। এভাবে রাজনীতিকে খেয়ে ফেলছে দুর্নীতি।

কিছু দিন আগেও পত্রপত্রিকায় শিরোনাম হয়েছিল রাজনীতিবিদের কে কত শত হাজার গুণ ধনবান হয়েছেন। কিন্তু তা পত্রপত্রিকা পর্যন্তই। এর সঙ্গে আছে অর্থনীতির আমলাতান্ত্রিকতা। সেটাই হলো পরিকল্পিত অর্থনীতির সবচেয়ে বড় শত্রু। বিদেশের গণকবর থেকে যখন বাংলাদেশিদের নরকঙ্কাল উঠছে, সারা বিশ্ব যখন বিস্ময়ে হতবাক তখন বাংলাদেশের অর্থমন্ত্রী এ দেশের আমলাতন্ত্রের সৌধ নির্মাণের প্রত্যয় ব্যক্ত করবেন এবারের বাজেটে। নতুন বেতন স্কেল দিচ্ছেন তিনি। নতুন নতুন উৎসবভাতাও চালু করতে যাচ্ছেন এই সাবেক আমলা। নতুন স্কেল বাস্তবায়িত হবে এই বাজেট থেকে। তাতে বাজেটে অতিরিক্ত ১৩ হাজার কোটি টাকার ব্যয় বরাদ্দ হবে প্রথম বছরেই। এরপর পরবর্তী প্রতি বছর ১০ হাজার কোটি টাকা করে অতিরিক্ত ব্যয় হবে। তিনি বলেছিলেন, ব্রিগেডিয়ার এনাম কমিটির মতো একটি কমিটি করে সচিবালয়ের নিয়মবহিভর্ূতভাবে নিয়োগ ও পদোন্নতিপ্রাপ্ত অতিরিক্ত জনবল ছাঁটাই করে এই নতুন স্কেল চালু হবে। কিন্তু তা আর হচ্ছে না। গরিব জনগণের রক্ত চুষে যে ভ্যাট, কাস্টমস শুল্ক এবং অগ্রীম আয়কর আদায় করা হবে তার সিংহ ভাগই শেষ হয়ে থাকবে আমলা পোষণে। না হবে উন্নয়ন, না হবে গরিবের জন্য কর্মসংস্থান। এই হতদরিদ্র দেশের উন্নয়ন প্রক্রিয়াকে যদি এই কলুষিত রাজনীতি এবং আমলাতন্ত্রের নিগড় থেকে বাইরে না নিয়ে যাওয়া যায় তাহলে দেশে-বিদেশে এ দেশের ভাগ্যাহত মানুষের গণকবরের আর শেষ থাকবে না। অর্থমন্ত্রী যে বাজেট বক্তৃতা লিখছেন তাতে থাকবে স্বপ্নের ফানুস- জিডিপির ৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধির কথা বলবেন তিনি। বলবেন বঙ্গবন্ধুর শাসনামলে মাত্র ৮০০ কোটি টাকার বাজেট থেকে তিনি কেমন করে আজ ৯০ হাজার কোটি টাকার ধারদেনা সংবলিত তিন লাখ কোটি টাকার ঘাটতি বাজেট সংসদে উপস্থাপিত করছেন। যা বলবেন না তা হচ্ছে এই যে ওই সামান্য রাজস্ব আয় নিয়েই সেদিন জাতির পিতা রাষ্ট্র পরিচালনা করেছেন, মাসে মাত্র ২০০০ টাকা বেতন নিয়ে সারা বিশ্বে বাংলাদেশের মানুষকে মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। তিনি বলবেন না সে দিন এক ডলারের মূল্যমান ছিল চার টাকা। আজ তা দাঁড়িয়েছে ৮০ টাকায়। অর্থাৎ ভ্যালোরেম ডিউটি এখন এমনিতেই ২০ গুণ বেড়েছে। আন্তর্জাতিক বাজারে দ্রব্যমূল্য বেড়েছে শতগুণ। লোকসংখ্যা বেড়েছে দ্বিগুণ, আমদানি বেড়েছে সেই হারে। আর সবচেয়ে বেড়েছে ধার করে ঘি খাওয়ার নিচুমানের প্রবণতা। বাংলাদেশের রাইটার্স বিল্ডিংয়ে নোট লেখা আর অপচয়ের প্রতিযোগিতা হয়। বঙ্গবন্ধু ধার করে দেশ চালাননি। পরোক্ষ করের বোঝা দরিদ্র জনগণের ওপর চাপিয়ে দেননি। দেশবাসীকে মানসিকভাবে প্রস্তুত করেছিলেন কষ্ট স্বীকার করার জন্য। বলেছিলেন, 'আগামী দুই বছর কিছুই দিতে পারব না। আর আজ কি নেই 'হোয়াইট কলার' আমলা-মন্ত্রী-উপদেষ্টাদের। সাবেক একজন বিদেশমন্ত্রী প্রায় এ দেশের গরিবের অর্থে আকাশেই উড়ে বেড়াতেন।

অর্থমন্ত্রীর কথা হলো ধারদেনা তো উন্নয়নের জন্য করা হয়। তিনি হয়তো জানেন না বাজেট ঘাটতির বৃদ্ধি এক পারসেন্ট হলে জিডিপির ক্ষয় হয় .০০২৯ পারসেন্ট। এই ঘাটতি ২০০৯-১০ অর্থবছরে ছিল ১৫ হাজার কোটি টাকা। এখন তা পৌঁছবে ৯০ হাজার কোটি টাকায়। মাথাপিছু ঋণের বোঝা ২০০৮-০৯ সালে ছিল ১৫০০ টাকা। এখন তা পৌঁছে যাচ্ছে ৪০০০ টাকা। এবার প্রবৃদ্ধির কথায় আসি। ২০১৩-১৪ অর্থবছরের এডিপি বরাদ্দ ছিল ৬৫,৮৭০ কোটি টাকা। অথচ ২০১৪ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত সাত মাসে এই খাতে ব্যয় হয়েছিল মাত্র ১৬,৭৪৮ কোটি টাকা। ২০১২-১৩ অর্থবছরে পদ্মা ব্রিজের জন্য ৬৮৫২ কোটি টাকা বিশেষ বরাদ্দ দেওয়া হয়। পরে বেতন-ভাতা এবং আরাম-আয়েশের ব্যয় নির্বাহ করার জন্য ওই টাকা ফেরত আনা হয়। ২০১৩-১৪ অর্থবছরে বাজেটের শতকরা ৫.১২ এবং ৪.২৬ ভাগ শিক্ষা এবং স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ ছিল। অর্থাৎ উন্নয়নের নামে সব অর্থই হাঁটি-হাঁটি খাই-খাইয়ের জন্য ব্যয় হয়। ব্রিটিশ উপনিবেশিক শাসনামলে যে ছিয়াত্তরের মন্বন্তর হয়েছিল তাতে ফসল হয়নি। খরায় মৃত্যু হয়েছিল লাখ লাখ মানুষের। তখন এ দেশের জেলা কালেক্টররা ভূমি রাজস্ব আদায় করে বিদেশি প্রভুদের মনোরঞ্জন করত। ব্রিটিশ রাজ এই দুর্ভিক্ষের মাঝেও গরিবের কাছ থেকে খাজনা আদায় করতে ছাড়েনি। বলেছিল, দুর্ভিক্ষ, খরা বুঝি না। রাজস্ব চাই। আজও লাখো শহীদের রক্তে সঞ্চিত এ দেশে একই মন-মানসিকতা বিরাজ করছে- 'রাজার হস্ত করে সমস্ত কাঙালের ধন চুরি।' দেশের পরিকল্পনামন্ত্রী পরামর্শ দিয়েছেন, উপজেলায় কর অফিস খুলতে। এর কোনো প্রয়োজন আছে কি? গ্রামাঞ্চলের গরিব মানুষ যে পণ্য সেবা ব্যবহার করে তার ওপরে তো অগ্রীম ১০ পারসেন্ট আয়কর কাস্টম হাউসেই দিচ্ছে। ওই প্রত্যক্ষ কর বড়লোক ধনীরা তাদের উৎপাদিত পণ্যের সঙ্গে যোগ করে দিয়ে পরোক্ষ কর হিসেবে চাপিয়ে দিচ্ছে ভোক্তাদের ওপর। কাজেই এত কষ্ট করে আবার কেন উপজেলায় অফিস খুলবেন? যারা প্রত্যক্ষ কর আদায় করে পণ্য আর সেবার ওপর, তাদের মতো মূর্খ পৃথিবীতে আর নেই। আর এই মূর্খের রাজত্বে সামাজিক ন্যায়বিচার ভূলুণ্ঠিত। দুঃখের বিষয়, যারা আজ অর্থবিভাগে বসে বাজেটের সাইজ নিরূপণ করছেন তারা কেউ কাস্টমস, ভ্যাট বা আয়কর বিষয়ে বিশেষজ্ঞ জ্ঞান রাখেন না। তারা জানেন না সঠিকভাবে এবং সমভাবে এসব কর রাজস্ব আয় অনুপাতে কার্যকর না হলে সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা ভেঙে পড়বে। পরিকল্পনামন্ত্রী ঠিকই বলেছেন- 'বাজেটের সব কম্পোনেন্টস' যেমন মাইক্রো থেকে ম্যাক্সো, রাজস্ব আয় এবং ব্যয়- সব কিছু বিচার-বিশ্লেষণ করেই বাজেট সাইজ ঠিক করতে হবে। কিন্তু বাজেটের মালিক এখন যারা রাজস্ব আয় করে তারা নয়, এর মালিক যারা ব্যয় করে তারা- অর্থ বিভাগ। এখন এর নামই হয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়। যারা রাজ কর্তৃত্বে রাজস্ব আদায় করে সেই রাজ কর্মকর্তারা এখানে হেনতেন। এখানে যারা ধার করে খাওয়ার অনুমতি দিয়েছে তারাই গুরুত্বপূর্ণ। তাই অনুমোদিত (আইএমএফ কর্তৃক) জিডিপির শতকরা ৫ ভাগ কীভাবে ঋণ নেওয়া যাবে তা ঠিক রেখেই বাকি সব কিছু করতে হবে। উপরের স্তরের মানুষগুলোর আরাম-আয়েশ ও এসডিসহ হাজার হাজার কর্মকর্তার গাড়ি বাড়ি ভোগবিলাস এসবের জোগাড় যন্ত্রণাই বাজেট। প্রতি সংসদ সদস্যের জন্য ২০ কোটি টাকা করে বরাদ্দ দেওয়ার জন্য বাজেট। ভারতে ২ কোটি টাকা করে ২৮টি রাজ্যের ৫৩৫ জন সংসদ সদস্যকে দেওয়া হয়। আমাদের এই ছোট দেশে ৭০০০ কোটি টাকা সংসদ সদস্যদের পকেটের মাধ্যমে বিতরণ হচ্ছে। অথচ এখানে নির্বাচিত উপজেলা পরিষদ আছে, যা ভারতে নেই। আর পরিষদের কথাই কী বলব। কিছুদিন আগে ঢাকা জেলা পরিষদ অনেকগুলো ভুয়া প্রতিষ্ঠানের নামে অর্থ বরাদ্দ দিয়েছিল। পরে দেখা গেল এই প্রতিষ্ঠানগুলোর একটিরও বাস্তবে অস্তিত্ব নেই। সবই খাই খাই বরাদ্দ।

বাজেটের আরও মজার ব্যাপার হলো, অর্থমন্ত্রী তার প্রথম বক্তৃতাটি করেন ব্যয় বরাদ্দের ওপর। অর্থাৎ সংসদ প্রথমে ব্যয় অনুমোদন করবে। তারপর টাকা দেবে গৌরিসেন। তাই রাজস্ব আয়ের ওপর বক্তৃতাটি দ্বিতীয় পর্যায়ে পাঠ করা হয়। নির্ধারিত ব্যয় বিশেষ করে অনুৎপাদনশীল ব্যয় ঠিকই নির্বাহ হবে আয়ের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হোক আর না হোক, একেবারেই ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের চিত্র। প্রয়োজনে টাকা ছাপা হবে তবু একটি পয়সাও কম খরচ হবে না। রাজস্ব ঘাটতির মূল কারণ ও সরকারি প্রতিষ্ঠানসমূহ। ফাইনান্সিয়াল এঙ্প্রেসের ২২ মের প্রতিবেদন অনুযায়ী শুধু পেট্রোবাংলার কাছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের ভ্যাট এবং সম্পূরক শুল্ক বাবদ পাওনা রয়েছে ১৩,২০০ কোটি টাকা এবং এর ওপর ৯০০০ কোটি টাকা সুদ বাবদ ধরলে মোট ২২,৩০০ কোটি টাকা। একইভাবে বাংলাদেশ বিমানসহ প্রায় সব রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানের কাছে শুল্ক কর বাবদ যে পাওনা আছে তা দিয়ে পুরো বাজেট ঘাটতি পূরণ করা যায়। বাংলাদেশ অর্থনীতিবিদ সমিতির একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এ দেশে ৫০ হাজার ধনী ব্যক্তি আছে যাদের এক কোটি টাকা করে কর দেওয়ার সক্ষমতা আছে। এই সমিতির মতে পাঁচ থেকে সাত লাখ কোটি টাকা এ দেশে কালো টাকা আছে। এ বিষয়টি পর্যালোচনা করার জন্য একটি কমিশন গঠন তাদের প্রস্তাবে আছে। শেষ করার আগে বিশ্ব ব্যবস্থা সম্বন্ধে কিছু কথা। বাংলাদেশ এর থেকে বিচ্ছিন্ন নয়। স্বল্প সময়ের মধ্যেই 'নিউ এনার্জি এজ' শুরু হতে যাচ্ছে। একটি সময় আসছে যা বিশ্বময় ক্ষমতা এবং ঐশ্বর্যের পরিবর্তন ঘটাবে। তখন উন্নয়নের জন্য 'ক্লিন রিনিউয়েবল এনার্জি'ই হবে অবলম্বন। প্রয়োজন হবে সোলার, হাইড্রোজেন, নিউক্লিয়ার এবং উইন্ড এনার্জি। রাষ্ট্রের উত্থান-পতন হবে এই এনার্জি উদ্ভাবনকে কেন্দ্র করে। মনে রাখতে হবে এনার্জি একটি জাতীয় নিরাপত্তার বিষয়। এখন যেভাবে জোড়াতালি দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন হচ্ছে, আগামীতে তা হবে অসম্ভব। পেট্রোলিয়ামভিত্তিক 'কুইক রেন্টাল' তেলের অভাবে শেষ হয়ে যাবে। এ কথা মনে রেখেই ত্বরিত গতিতে রিনিউয়েবল এনার্জি সৃষ্টির জন্য এখন থেকেই বাজেট বরাদ্দ ও গ্রামগঞ্জে প্রশিক্ষণ শুরু করা উচিত। একই সঙ্গে ঘটাতে হবে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির প্রসার। শিক্ষা ব্যবস্থাকে করতে হবে উদ্ভাবনমুখী।

আগামীতে উদ্ভাবনই হবে অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি। আমেরিকার প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ জিডিপি উদ্ভাবননির্ভর শিল্প-কারখানা থেকে আসে। বর্তমানে তথ্যপ্রযুক্তিই শ্রম উৎপাদনশীলতাকে সঞ্চালিত করে। প্রায় তিন বিলিয়ন মানুষ এখন ইন্টারনেটের সঙ্গে যুক্ত। ইউরোপ এবং আমেরিকায় যতগুলো বিজনেস স্কুল এবং বিজ্ঞান ও প্রকৌশল স্কুল আছে চীনে আছে তার পাঁচ থেকে দশগুণ। অথচ আমরা আজও আছি বারোমাসে তেরো পার্বণ নিয়ে। এখানে বিজ্ঞানী, প্রকৌশলী, উদ্ভাবক, প্রযুক্তিবিদ সবাই নিমিত্ত মাত্র। এখানে উপনিবেশিক আদলে আজও 'জেনারালিস্টদের' স্বর্গরাজ্য। বিজ্ঞান শিক্ষা অধঃপাতে যাচ্ছে। শিক্ষার অঙ্গনে মেধার প্রতিযোগিতার প্রয়োজন শেষ হচ্ছে। এটা এ দেশের জন্য আশার কথা নয়। সময় এসেছে যখন দেশরত্ন শেখ হাসিনাকে ঘরে ঘরে চরকা দিতে হবে যেমন করে মহাত্দা গান্ধী চরকার কাপড় বুনোন শিখিয়েছিলেন। শেখাতে হবে কেমন করে তারা পরনের কাপড় তৈরি করবে। কেমন করে ঘরে বসে চটি জুতা তৈরি করবে, বাচ্চাদের ফ্রক তৈরি করবে, পুতুল তৈরি করবে। কেমন করে সৌরবিদ্যুৎ তৈরি করবে, গোরব দিয়ে বিদ্যুৎ তৈরি করে রান্নাবান্না করবে। ঘরে ঘরে শৌচাগার তৈরি করে স্বাস্থ্য সুরক্ষা করবে। সবজি, পিয়াজ, রসুন, মরিচ ঘরেই উৎপাদন করবে। আপনি নিজে দেখিয়ে দেন, সবাই তা অনুকরণ করবে।

বন্ধ করুন অপচয়, অপব্যয়, তেলে মাথা তেল দেওয়া। দৃষ্টান্ত দিচ্ছি। চলতি অর্থবছরে রাষ্ট্রীয় উদারতায় যখন কিছু সরকারি খাত 'অযৌক্তিক ভর্তুকি ভোগ করছে তখন সরকার আবার অর্থবছরের শেষ পর্বে ৫.২৩ পারসেন্ট ভর্তুকি বৃদ্ধি করেছে। এই বৃদ্ধি হয়েছে তখন যখন বিশ্ববাজারে পেট্রলের দাম অর্ধেকে নেমেছে। সারের দামও কমেছে একইভাবে। পেট্রোলিয়াম করপোরেশন ২২ হাজার কোটি টাকা ভ্যাট ও এসডি বাবদ পরিশোধ করেনি। এরপরও এই অর্থবছরে এই করপোরেশন মোট ভর্তুকির এক-চতুর্থাংশ ভোগ করেছে। এখন বর্ধিত ভর্তুকির সিংহভাগ এই করপোরেশন ভোগ করবে। রপ্তানি ভর্তুকিও এ বছরে ২৮.৫ বিলিয়ন টাকা থেকে ৩৩ মিলিয়নে পৌঁছে গেছে। যে খাতে ভর্তুকি কমেছে তা হলো খাদ্য খাত।

পরিশেষে একটি প্রস্তাব। একটি রাজস্ব সংস্কার, কমিশন গঠন করুন। এর প্রধান হবেন সাবেক কাস্টমস, ভ্যাট এবং কর কর্মকর্তাদের মধ্যে একজন। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে একটি রাজস্ব মন্ত্রণালয়ে রূপান্তরিত করুন এবং মন্ত্রী থেকে নিম্নের সব পদ রাজস্ব কর্মকর্তাদের দ্বারা পূরণ করুন। অন্যথায় রাজস্ব আয় যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হবে তেমনি সামাজিক ন্যায় হবে ভূলুণ্ঠিত। এই কর ব্যবস্থার সঙ্গে জড়িত রয়েছে এ দেশের আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থা, বিশ্ববাণিজ্য এবং বিশ্বব্যবস্থা। তাই এ বিষয়ে যাদের বিশেষজ্ঞ জ্ঞান আছে তাদের হাতেই সরকারের এই সর্বোচ্চ গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বটি ছেড়ে দিন।

লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য, সাবেক সদস্য, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড, বিশ্ব কাস্টমস সংস্থার প্রথম স্থায়ী প্রতিনিধি, সাবেক মহাপরিচালক, বিআইএম।

 

সর্বশেষ খবর