বৃহস্পতিবার, ৪ জুন, ২০১৫ ০০:০০ টা
প্রসঙ্গক্রমে

পরিবেশ ভাবনায় আমরা

অধ্যাপক মোহাম্মদ মাজহারুল হান্নান

পরিবেশ ভাবনায় আমরা

আমরা পৃথিবী নামক গ্রহের বাসিন্দা। কেননা এ পৃথিবীতে আমাদের বাসের উপযোগী পরিবেশ রয়েছে। পরিবেশ বলতে আমাদের আশপাশের সবকিছুকেই বোঝায়। এ পরিবেশে আছে মানুষ, পশু-পক্ষী অর্থাৎ সব ধরনের প্রাণি, মাটি, পানি, বায়ু, গাছপালা, বনজঙ্গল, চন্দ্র, সূর্য, মেঘমালা, পাহাড়, খাল-বিল, নদী, সাগর ইত্যাদি। আল্লাহর এসব সৃষ্টিই হলো প্রাকৃতিক পরিবেশ। আর মানুষের সৃষ্ট পরিবেশ হলো, তার প্রয়োজনে যা প্রতিনিয়ত গড়ে তুলছে- ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাট, যানবাহন, পুল-সাঁকো, কল-কারখানা, দিঘি, পুকুর, কুয়া, খেলার মাঠ, স্কুল-কলেজ, নগর-বন্দর প্রভৃতি। এ ছাড়াও রয়েছে সামাজিক পরিবেশ। সব মিলিয়ে বলা যায় আমরা পরিবেশ দিয়েই ঘেরা। পরিবেশ সংরক্ষণের কথা আগে শুরু হলেও ১৯৬২ সালে সর্বপ্রথম র্যাচেল কারাসন সুনির্দিষ্টভাবে পরিবেশের কথা তুলে ধরলেন তার সাইলেন্ট স্প্রিং বইতে। তিনি বললেন, বসন্ত নীরব হতে চলেছে। পাখি আর গাইবে না। তাই পাখির কলতানে মুখরিত হবে না বসন্তের দিনগুলো। কেননা বিষাক্ত কীটনাশক রাসায়নিক দ্রব্য ব্যবহারের ফলে ফসল তোলার পর খেতে পড়ে থাকা শস্য খেয়ে পাখি প্রাণ হারাবে। এমনিভাবে আরও কত বিপর্যয়ের মুখোমুখি হতে হবে। এ থেকেই জন্ম নিল এক নতুন ভাবনা। আর তা হলো পরিবেশ ভাবনা।

১৯৬২-তে লেখিকা র্যাচেল কারাসন যে ভাবনার সূত্রপাত করলেন সে ভাবনার সম্প্রসারণে ১৯৭২ সালে জাতিসংঘের ডাকে বিশ্বের ৯৩টি দেশের প্রতিনিধিরা স্টকহোমে বসলেন বিশ্ব পরিবেশ সম্মেলনে। দীর্ঘ আলোচনার পর ২৬টি ধারা সংবলিত ঘোষণাপত্র স্বাক্ষর করলেন অংশগ্রহণকারী দেশের প্রতিনিধিরা। স্টকহোমের এ ঘোষণাপত্রই হলো বিশ্ব পরিবেশের ম্যাগনাকার্টা। এর প্রথম ধারাতে বলা হয়েছে বিশুদ্ধ নির্মল পরিবেশ মানুষের জন্মগত অধিকার। দ্বিতীয় ধারায় রয়েছে প্রাকৃতিক সম্পদ অর্থাৎ বায়ু, পানি, মাটি, উদ্ভিদ ও প্রাণী সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তার কথা। এমনিভাবে বিভিন্ন ধারায় রয়েছে প্রাকৃতিক সম্পদের যথাযথ ব্যবহার, দূষণ নিয়ন্ত্রণ, জীবন মান উন্নয়নের জন্য অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোকে প্রয়োজনীয় আর্থিক ও কারিগরি সাহায্য প্রদান, অত্যাবশ্যক পণ্যের দাম স্থিতিশীল রাখা, উন্নয়ন কার্যক্রম ও পরিবেশ রক্ষায় দ্বন্দ্ব দূর করে যুক্তিসঙ্গত পরিকল্পনা গ্রহণ, সম্পদের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ, শিক্ষা ও গণমাধ্যমে পরিবেশের গুরুত্বারোপ করা, উন্নত পরিবেশ সৃষ্টিতে গবেষণা কার্যক্রম গ্রহণ, পরিবেশের উন্নয়নের আন্তঃরাষ্ট্রীয় পারস্পরিক সহযোগিতার ভিত্তিতে কাজ করা এবং মানব প্রজাতি ও পরিবেশকে রক্ষা করতে পারমাণবিক অস্ত্রসম্ভারসহ ধ্বংস লীলায় ব্যবহৃত সব অস্ত্র বিলুপ্ত করা। আর তারই ধারাবাহিকতায় মানুষকে পরিবেশ-সচেতন করে তুলতে 'একটি পৃথিবী' এ বক্তব্য সামনে রেখে ১৯৭৪ সাল থেকে প্রতি বছর ৫ জুন 'বিশ্ব পরিবেশ দিবস' পালনের যাত্রা শুরু হয়। পরবর্তী বছরগুলোতে বিশ্ব পরিবেশ দিবসের প্রতিপাদ্য বিষয়গুলোর মধ্যে ধ্বংস বিনা উন্নয়ন, মরুভূমিকরণের আশঙ্কা, শক্তির জন্য একটি গাছ, শিশু এবং পরিবেশ, একটি মাত্র বিশ্ব একে বাঁচান, একটি পৃথিবী-একটি পরিবার, আমরা বিশ্ব পরিবেশের জন্য ঐক্যবদ্ধ, পৃথিবীকে একটা সুযোগ দাও ইত্যাদি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

সৃষ্টির রহস্য এমনই যে পৃথিবীর সবকিছুতেই রয়েছে অপূর্ব সমন্বয় ও ছন্দ এবং চমৎকার ভারসাম্য, যা মানুষের বসবাসের অনুকূল ও উপযোগী অবস্থা গড়ে তুলেছে। সৃষ্টিকর্তা প্রতিটি জিনিসকে এমনভাবে তৈরি করেছেন যে, সবকিছুর প্রয়োজন রয়েছে যা একে অন্যের সম্পূরক ও পরিপূরক। গাছপালা ও পশু-পাখি থেকে আমরা আমাদের বিভিন্ন ধরনের খাদ্য-শস্য পাই, আবার বিভিন্ন জীব-জন্তুর জন্যও রয়েছে খাদ্যের ব্যবস্থা। যেমন- গরু-ছাগলের জন্য মাঠে মাঠে ঘাস, পাখির জন্য গাছের ফল ও পোঁকা-মাকড়, মাছের জন্য রয়েছে ছোট ছোট পোঁকা-মাকড় ইত্যাদি। মানুষ, জীব-জন্তু ও গাছপালার জন্য রয়েছে পানি, বাতাস, আলো। গাছ সব প্রাণীকে বেঁচে থাকার জন্য দিচ্ছে অফুরন্ত অক্সিজেন আর গাছের জন্য মানুষ দিচ্ছে কার্বন-ডাই-অক্সাইড। বাঁচার জন্য যা কিছু প্রয়োজন মানুষ পৃথিবীর এ অনুকূল পরিবেশ থেকে তা গ্রহণ করছে।

পৃথিবী ছাড়া চন্দ্র, মঙ্গল গ্রহ বা অন্য কোনো উপগ্রহে মানুষ বা কোনো প্রাণির বসবাসের এমনকি বাঁচার মতো অনুকূল পরিবেশ নেই। তাই তো আমাদের এ পৃথিবী সুন্দর ও আদর্শ পরিবেশের অধিকারী। যতদিন এ পরিবেশের ভারসাম্য থাকবে ততদিন পৃথিবী সুন্দর থাকবে এবং আমরা সুখে-শান্তিতে জীবন-যাপন করতে পারব।

পরিশেষে, সুখী-সুন্দর প্রগতিশীল জীবনের জন্য অত্যাবশ্যকীয়ভাবে অনুকূল পরিবেশ প্রয়োজন। যেহেতু আমরা পরিবেশের ওপর একান্তভাবে নির্ভরশীল তাই পরিবেশ সংরক্ষণ ছাড়া আমাদের কোনো বিকল্প নেই। আমাদের উন্নয়নের জন্য, প্রগতির জন্য, সমৃদ্ধির জন্য, শান্তির জন্য, সর্বোপরি অস্তিত্বের জন্য একটি মাত্র লক্ষ্য হবে- সুষ্ঠু পরিবেশ সংরক্ষণ। সরকারি ও বেসরকারি স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠানসমূহ সম্মিলিতভাবে সচেষ্ট হলে সুষ্ঠু পরিবেশ সংরক্ষণ সম্ভব। সে লক্ষ্যেই আমাদের কাজ করতে হবে। এ জন্য প্রয়োজন সচেতনতা। সচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে শিক্ষার গুরুত্ব সবচেয়ে বেশি। শিক্ষার আলোই মানুষকে সচেতন করে তুলতে পারে। শিক্ষিতজনই দেশ ও জাতির সমস্যা সমাধানের কথা ভাবতে পারে, পথ ও নির্দেশ করতে পারে। তাই শিক্ষার মাধ্যমেই পরিবেশ সংরক্ষণের কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জিত হবে- এ প্রত্যাশাই করি।

লেখক : সাবেক ট্রেজারার, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়।

 

সর্বশেষ খবর