শনিবার, ২২ আগস্ট, ২০১৫ ০০:০০ টা

উচ্চশিক্ষা ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়

আরিফা রহমান রুমা

এইচএসসি পরীক্ষার ফলাফল বেরিয়েছে। পাসের হার গতবারের তুলনায় বেশ খারাপ। বিএনপি-জামায়াতের হরতাল-অবরোধের নামে জ্বালাও-পোড়াও তথা মনুষ্য সৃষ্ট দুর্যোগই এর জন্য দায়ী বলে সংশ্লিষ্ট মহল মনে করছেন। পাস করা শিক্ষার্থীর মোট সংখ্যা ৭ লাখ ৩৮ হাজার ৮৭২ জন। তারপরও থেমে থাকবে না ভর্তিযুদ্ধ। দেশে সরকারি এবং বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে মোট ১১৭টি। তার মধ্যে ৩৪টি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় এবং ৬৮টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় তাদের শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করে দিয়েছে। প্রায় সব শিক্ষার্থীর লক্ষ্য দেশের শীর্ষস্থানীয় কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়। বলাই বাহুল্য, দেশের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এই তালিকায় নেই বললেই চলে। অথচ বিশ্বের বিখ্যাত কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম বলতে গেলেই উঠে আসে হার্ভার্ড, এমআইটি বা ইয়েলের মতো প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম। ইউজিসির সর্বশেষ বার্ষিক প্রতিবেদন অনুযায়ী (৪০তম বার্ষিক প্রতিবেদন, ২০১৪-তে প্রকাশিত) ২০১৩ সালে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতক পর্যায়ে যেখানে ছাত্রছাত্রী ভর্তি হওয়ার সংখ্যা ৫৭ হাজার ২২৪ জন, সেখানে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে স্নাতক পর্যায়ে ভর্তি হওয়া ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা ছিল ৮২ হাজার ৫৮৮ জন। অর্থাৎ উচ্চমূল্যে ভর্তি হওয়া সত্ত্বেও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীর সংখ্যা মোট শিক্ষার্থীর শতকরা ৬১ ভাগ। এই ৬১ ভাগ শিক্ষার্থী যদি যথাযথ জ্ঞান ও দক্ষতা না নিয়ে কর্মজীবনে প্রবেশ করে, তবে তারা কেবল পেশির সংখ্যাই বাড়িয়ে চলবে, মননশীল মানবিকের সংখ্যা নয়। অথচ যথাযথ ব্যবস্থা নিলেই এসব তরুণের মেধার ঝলকানিতে বিশ্ব দরবারে ঝলসে উঠতে পারে বাংলাদেশের নাম। তাছাড়া বিদেশি শিক্ষার্থীরাও সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর তুলনায় প্রায় পাঁচগুণ বেশি ভর্তি হচ্ছে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে। এই খাত বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের অন্যতম একটি খাতেও পরিণত হতে পারে। পাশাপাশি মুদ্রাপাচার রোধেও রাখতে পারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। ইতিমধ্যেই আমাদের মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তানদের পার্শ্ববর্তী দেশে পড়তে যাওয়ার প্রবণতা অনেকটাই রোধ করতে পেরেছে আমাদের এ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। প্রায় ১৬ কোটি মানুষের এ দেশে যেখানে সবাইকে গুণগতমানের মৌলিক শিক্ষা দিতেই সরকারের হিমশিম খাওয়ার মতো অবস্থা, সেখানে উচ্চমাধ্যমিক পাস করা প্রত্যেক শিক্ষার্থীকে উচ্চশিক্ষার সুযোগ দেওয়া আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশের জন্য সত্যিই দুরূহ ব্যাপার। এর চেয়ে কম অনুকূল পরিস্থিতিতে ১৯৯২ সালে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদন দেওয়াকে দেশের সচেতন মহল তাই উষ্ণ অভ্যর্থনা জানিয়েছিল। কিন্তু এটা যে তৎকালীন সরকারের সস্তা জনপ্রিয়তা লাভের একটা অপচেষ্টা ছিল তা দেশবাসী প্রত্যক্ষ করে মাত্র অল্পদিনের ব্যবধানে। দেশে নিশ্চিতভাবেই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের চাহিদা ছিল, কিন্তু তাই বলে নিজস্ব ক্যাম্পাস ছাড়া ভাড়াবাড়িতে, স্থায়ী শিক্ষকের পরিবর্তে খণ্ডকালীন শিক্ষক দিয়ে পড়ানো, বাজার চলতি মাত্র কয়েকটি বিষয়, সহশিক্ষাক্রম কার্যাবলির ব্যবস্থা না থাকা- আর যাই হোক কোনোভাবেই তা বিশ্ববিদ্যালয়ের ধারণার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ ছিল না। ১৯৯২ সালের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইনের মতো দুর্বল একটি আইন দিয়ে এত বড় একটা পথের সূচনা করলে তা যে অচিরেই নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে এবং রাজনৈতিক-বাণিজ্যিক, ঘুষ-দুর্নীতিতে নিমজ্জিত হয়ে অপশক্তির হাতে চলে যাবে, তা তৎকালীন সরকার বা শিক্ষা-সংস্কৃতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গ না বোঝার ভান করেছেন কেবল রাজনৈতিকভাবে তাৎক্ষণিক একটি বাহবা পাওয়ার জন্য। তাদের এতটুকু বোঝার ক্ষমতাও ছিল না যে এই সাময়িক বাহবা থেকে প্রাপ্ত আত্দতৃপ্তি অচিরেই এ দেশের উচ্চশিক্ষার লিকলিকে বটবৃক্ষের গুণগতমানকে সমূলে উপড়ে ফেলতে পারে। আর হলোও তাই। ব্যবসায়ী মহল রীতিমতো ঝাঁপিয়ে পড়লেন এখানে বিনিয়োগ করতে। শিক্ষাকে সেবা নয় বিবেচনা করতে থাকে পণ্য হিসেবে। শুরু হয় পণ্য বিক্রির এক ভয়াবহ কুৎসিত প্রতিযোগিতা। ঝলমলে বিজ্ঞাপনে সয়লাব হয়ে যায় জাতীয় দৈনিকগুলো। ১৯৯৮ সালে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন সংশোধন করা হয়, কিন্তু তা বাস্তবায়ন হতে না হতেই ক্ষমতার পালাবদলের মুখে এই সংশোধিত আইন সংশোধনের প্রতিশোধ নেওয়া শুরু হলো যেন। ২০০১ সালের পর থেকে রাষ্ট্রযন্ত্রের অন্যান্য খাতের মতোই এ খাতেও দুর্নীতির 'মহোৎসব' শুরু হলো। 'যে যেভাবে পারো লুটেপুটে খাও' নীতির আওতায় লুটপাটের তাণ্ডবে পড়ে পথের ধুলোয় লুটোপুটি খেতে লাগল বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় নামক উচ্চশিক্ষার এক অত্যন্ত সম্ভাবনাময় খাতটি। অবকাঠামোগত সুযোগ-সুবিধার বাইরেও এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে জ্ঞানার্জনের একটি বড় বাধা সেখানে গবেষণার কোনো সুযোগ না থাকা। যার ফলে শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি শিক্ষকরাও তাদের মেধাকে শাণিত করে যুগোপযোগী করে নিজেদের গড়ে তোলার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। উচ্চতর শিক্ষার বিষয়গুলোকে জ্ঞানচর্চা, গবেষণা আর সুস্থ সাংস্কৃতিক চর্চার মধ্য দিয়ে অর্জন করতে হয়। এসবের উপস্থিতি অধিকাংশ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে নেই। এমতাবস্থায় শিক্ষা ব্যবস্থায় সুশাসন প্রতিষ্ঠা, মানসম্পন্ন শিক্ষা ও গবেষণা নিশ্চিত করে বিরাজমান অরাজকতা ও সংশ্লিষ্ট শ্রেণির উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা দূর করার লক্ষ্যে পাস করা হয় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন ২০১০। এ আইনের যথাযথ প্রয়োগে হার্ভার্ড, এমআইটি বা ইয়েলের মতো শ্রেষ্ঠ না হোক আমাদের দেশের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে মানসম্মত বিশ্ববিদ্যালয়ে অচিরেই রূপান্তরিত করা সম্ভব, এ ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট সবার সদিচ্ছা আর সততাও জরুরি। হাতেগোনা কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় কাঙ্ক্ষিত মানে পৌঁছতে পারলেও বাকিদের অবস্থা এখনো আগের মতোই। কঠোর নজরদারিতে এনে তাদের আইন মানতে বাধ্য করতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনকে 'উচ্চশিক্ষা কমিশন'-এ রূপান্তরিত করা গেলে এ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা আরও সহজ হয়ে উঠবে। শিক্ষা নিয়ে কোনো রকম অসৎ বাণিজ্য বরদাস্ত করার অর্থ দেশে কেবল জনবল বৃদ্ধিতে উৎসাহিত করা। সঠিক জ্ঞান ও অনুশীলনের দ্বারা এই জনবলকে জনসম্পদে রূপান্তরিত করতে পারলেই দ্রুততম সময়ের মধ্যে আমরা আমাদের অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নের কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছতে পারব।

ভর্তির যে সংকট অথবা শিক্ষার মানের যে সংকট উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে দেখা যায় প্রায় প্রতিবছর, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মান উন্নত হলে সেই সংকট অনেকটা কমে আসবে। বাংলাদেশকে মধ্যআয়ের দেশে রূপান্তরিত হতে হলে এই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর প্রতি বিশেষ নজর দেওয়া জরুরি। সংশ্লিষ্ট সব পক্ষকেই এ ব্যাপারে এখনই উদ্যোগী হওয়া প্রয়োজন।

লেখক : শিক্ষক, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়।

 

সর্বশেষ খবর