শিরোনাম
বৃহস্পতিবার, ২৯ অক্টোবর, ২০১৫ ০০:০০ টা

তৈলাক্ত বাঁশ : ঘটায় সর্বনাশ

সৈয়দ বোরহান কবীর

তৈলাক্ত বাঁশ : ঘটায় সর্বনাশ

ছোটবেলা থেকেই আমি গণিতে কাঁচা। অন্যসব বিষয়ে ভালো করলেও অঙ্কে আমার লেজে গোবরে অবস্থা। ক্লাস নাইনে ওঠার পর গণিতের জন্য মা একজন গৃহশিক্ষক নিযুক্ত করলেন। ক্যাডেট কলেজে পড়ি। ছুটিতে যে ক’দিন বাড়িতে থাকি গণিত স্যার এসে আমাকে পড়ান। সুধীর স্যার কেবল গণিতেই পণ্ডিত নন, এক অসাধারণ দার্শনিকও বটে। আমি গণিত কম বুঝি এ জন্য তিনি আমাকে দর্শন মিশিয়ে গণিত শেখাতেন। পাটিগণিতে একটি অঙ্ক ছিল, একটা তৈলাক্ত বাঁশে একজন সাত ফুট উঠে তৈলাক্তের কারণে আবার পাঁচ ফুট নিচে নেমে যায়। আসলে সে কত ফুট উঁচুতে ওঠে। পাটিগণিতের এই অঙ্কটা নিয়ে আমাকে বেজায় গলদগর্ম হতে হয়েছিল। এখন অঙ্কটার সঠিক সমাধান মনে নেই। কিন্তু সুধীর স্যার যে মোরাল বা নৈতিক শিক্ষা দিয়েছিলেন, তা আজও মনে গেঁথে আছে। স্যার বলেছিলেন, ‘অতিরিক্ত তৈল মর্দন বা চাটুকারিতা শুধু নিচেই পতিত করে, তৈলাক্ত বাঁশ ঘটায় সর্বনাশ।’

গত প্রায় এক মাসে চারপাশে সব দেখে-শুনে মনে হচ্ছে বাংলাদেশ যেন তৈলাক্ত বাঁশের চেয়েও পিচ্ছিল হয়ে গেছে। খাবারে অতিরিক্ত তেল যেমন থক থক করে ভেসে থাকে। খাবার দেখে গা ঘিন ঘিন করে। তেমনি বাংলাদেশ যেন তেলে ভাসছে। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী জাতিসংঘে জলবায়ু পরিবর্তন ও পরিবেশ সুরক্ষায় অনন্য অবদান রাখার জন্য ‘চ্যাম্পিয়ন অব দ্য আর্থ’ পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সৃষ্ট ঝুঁকি হ্রাস এবং পরিবেশ সুরক্ষার জন্য বিশ্বে এটি সর্বোচ্চ পুরস্কার। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই পুরস্কার পেয়েছেন নীতি ও নেতৃত্বের জন্য। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ এ বছর পাঁচজন এই পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। এরা হলেনÑ উৎসাহ ও উদ্যোগের জন্য ব্লাক মাসবা আপু, বিজ্ঞান ও উদ্ভাবনের জন্য দ্য ন্যাশনাল জিওগ্রাফি সোসাইটি। উদ্যোক্তার দূরদৃষ্টির জন্য নাটুরা বারসিল ও পল পলম্যান। ২০০৫ সাল থেকে প্রবর্তিত এই পুরস্কারের গর্ব প্রথম বাংলাদেশের জন্য বয়ে এনেছিলেন পরিবেশবিদ ড. আতিক রহমান। ২০০৮ সালে তিনি এই পদকে ভূষিত হন। অথচ প্রধানমন্ত্রী এই পুরস্কার প্রাপ্তির পর কেউ একবারও তার নামটিও উচ্চারণ করেননি। দুই সিটি করপোরেশন যৌথ উদ্যোগে সংসদ ভবন প্রাঙ্গণে এই পুরস্কার প্রাপ্তি উপলক্ষে প্রধানমন্ত্রীকে সংবর্ধনা দেয়। ওই সংবর্ধনা ছিল দুই মেয়রের চাটুকারিতার এক বীভৎস ও অশ্লীল প্রতিযোগিতা। যেখানে প্রথম পুরস্কারপ্রাপ্ত ড. আতিক রহমানকে মঞ্চে তোলা তো দূরের কথা, আমন্ত্রণ পর্যন্ত জানানো হয়নি। এসব বলে প্রধানমন্ত্রী অনবদ্য অর্জনকে খাটো করা আমার উদ্দেশ্য নয়। সেটি এই লেখার প্রতিপাদ্যও নয়। প্রধানমন্ত্রীর অর্জনকে চাটুকার ও তোষামোদকারীরা অতিরিক্ত তেলে কীভাবে ম্লান করছে তার উজ্জ্বল উদাহরণ সম্ভবত এসব ‘তেলেসমাতি’।

 

২৮ সেপ্টেম্বর এই পুরস্কার প্রাপ্তির পর অভিনন্দনের তেলে বাংলাদেশ ভেসে গেছে।

২৯ সেপ্টেম্বর থেকে আজ পর্যন্ত এই পুরস্কার নিয়ে পত্রিকায় বিজ্ঞাপনের মিছিল। মোটামুটি চার হাজার ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান প্রধানমন্ত্রীকে অভিনন্দন জানিয়ে বিজ্ঞাপন দিয়েছে। পত্রিকার পাতা বিজ্ঞাপনে সয়লাব। এসব বিজ্ঞাপন কি স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে দেওয়া হয়েছে নাকি অন্যরা দিচ্ছে আমরা না দিলে খারাপ খাতায় নাম চলে যাবে সেই আশঙ্কা থেকে দেওয়া হয়েছে? ব্যক্তিগতভাবে বা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো প্রদত্ত বিজ্ঞাপনের অর্থ ব্যয় নিয়ে আমার কোনো প্রশ্ন নেই। কিন্তু নীতি ও নৈতিকতা নিয়ে আমার অবশ্যই প্রশ্ন আছে। অন্তত দুটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান বিজ্ঞাপন দিয়েছে যারা ওয়ান-ইলেভেনের সময় শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে চাঁদাবাজির মামলা দায়েরের মতো অরুচিকর কাজ করেছিল। হাওয়া বদলে গেলে এরা আবার বলবে না তো জোর করে বিজ্ঞাপন দিতে বাধ্য করা হয়েছে?

সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান শতকোটি টাকার বিজ্ঞাপন দিয়েছে। এমন অনেক প্রতিষ্ঠান বিজ্ঞাপন দিয়েছে যারা লোকসান দিতে দিতে দেউলিয়া হওয়ার পথে। আমার খুব জানতে ইচ্ছে কেন এই বিজ্ঞাপনের জলোচ্ছাস? কাকে খুশি করার জন্য এই বিপুল অপচয়ের আয়োজন? জনগণের ট্যাক্সের টাকায় গদি মসৃণ রাখার এ কোন আয়োজন?

বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবারই প্রথম পুরস্কার জেতেননি। এর আগেও তিনি বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরামে বাংলাদেশকে আলোকিত করেছেন। পার্বত্য শান্তি চুক্তির জন্য ১৯৯৮ সালে তিনি ইউনেস্কোর ফেলিক্স হোফে-বোইনি শান্তি পদকে ভূষিত হন। এটাকে বলা হয় দ্বিতীয় নোবেল শান্তি পুরস্কার। ’৯৮-এর পত্রপত্রিকা ঘেঁটে দেখলাম, সাকুল্যে সে সময় বিজ্ঞাপন ছাপা হয়েছে ১২টি। একই বছর শেখ হাসিনা মাদার তেরেসা পদক পেয়েছিলেন তখনো তা নিয়ে উচ্ছাস হয়নি। ক্ষুধা ও দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সফল নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য ১৯৯৯ সালে শেখ হাসিনাকে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (ফাও) সেরেস পদকে ভূষিত করে। এই পুরস্কারটিও বিশ্বে অন্যতম মর‌্যাদাশীল একটি পুরস্কার হিসেবে চিহ্নিত। ওই পুরস্কার প্রাপ্তির পরও মেকি আনন্দের উৎসব হয়নি। ২০০৯ সালে শেখ হাসিনা এশিয়ার নোবেল খ্যাত ইন্দিরা গান্ধী পদকে ভূষিত হন। এরকম অনেক সম্মান তিনি জাতির জন্য নিয়ে এসেছেন। তবে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে শেখ হাসিনার সবচেয়ে বড় স্বীকৃতি হলো ‘জনগণের ক্ষমতায়ন ও উন্নয়ন’ শান্তি দর্শনের স্বীকৃতি। ২০১২ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে সর্বসম্মতভাবে শেখ হাসিনার বিশ্বশান্তির মডেল ‘জনগণের ক্ষমতায়ন ও উন্নয়ন’ গৃহীত হয়। জাতিসংঘের সব দেশ এই দর্শনকে বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠার সর্বোত্তম পথ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। সর্বসম্মত গৃহীত প্রস্তাবে বলা হয়, ‘শেখ হাসিনার বিশ্বশান্তির এই দর্শন (জনগণের ক্ষমতায়ন ও উন্নয়ন) সংঘাতপূর্ণ বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠার বড় অনুষঙ্গ।’ আজ যারা চাটুকারিতার বীভৎস প্রতিযোগিতায় নেমেছে তারা কি জানে, মধ্যপ্রাচ্যের সংঘাত নিরসনে ‘জনগণের ক্ষমতায়ন’ দর্শনকে ভিত্তিমূল হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। গত ১৩ অক্টোবর জাতিসংঘের মহাসচিব বান কি মুন সিরিয়ায় যুদ্ধবিরতির আহ্বান সংক্রান্ত বিবৃতিতে বলেছেন, ‘জাতিসংঘে গৃহীত শান্তির মডেল ‘জনগণের ক্ষমতায়ন ও উন্নয়নের আলোকে সিরিয়ায় শান্তি স্থাপনের কাজ করতে হবে।’ বিশ্বে যেখানেই শান্তির আলোচনা হচ্ছে সেখানেই পাদপ্রদীপে আসছে ‘জনগণের ক্ষমতায়ন’। শেখ হাসিনা বিশ্বে প্রথম এবং একমাত্র রাষ্ট্রনায়ক যিনি বিশ্বশান্তির জন্য একটি সুনির্দিষ্ট রূপরেখা দিয়েছেন, যা জাতিসংঘের সর্বসম্মত গৃহীত একটি দলিল। কিন্তু জাতিসংঘে এই দর্শন গৃহীত হওয়ার পর যুবলীগ ছাড়া কারও মধ্যে এটি নিয়ে তেমন আলোচনা, উচ্ছাস ও উত্তেজনা দেখা যায়নি। একমাত্র যুবলীগ ছাড়া এই দর্শন নিয়ে কেউ কোনো কথাও বলে না। এর অর্থ দাঁড়ায় আজ যারা বিজ্ঞাপন দিয়ে পত্রিকার পাতা ভরাচ্ছেন, লাখ লাখ টাকা খরচ করছেন, তারা শেখ হাসিনা বা আওয়ামী লীগের আদর্শ বা সাফল্যে উদ্বেলিত হয়ে এটা করছেন না, এরা করছেন স্রেফ চাটুকারিতার জন্য, তোষামোদীর জন্য। তোষামোদী করে দৃষ্টি আকর্ষণ এবং সেই সূত্রে কৃপা লাভই এদের উদ্দেশ্য। শেখ হাসিনা বা আওয়ামী লীগের দুঃসময়ে এদের পাওয়া যাবে?

’৭৫-পরবর্তী সময়ে আওয়ামী লীগের এবং শেখ হাসিনার রাজনীতি সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছিল ২০০৭ সালে ওয়ান-ইলেভেনের সময়। এ সময় শেখ হাসিনাকে গ্রেফতার করে অসম্মানজনকভাবে কোর্টে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। গ্রেফতারের পর শেখ হাসিনা প্রথম টেলিফোনটি করেছিলেন সাহারা খাতুনকে। সাহারা খাতুন ওয়ান-ইলেভেনে পুরোটা সময় শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে বানোয়াট মামলা নিয়ে দৌড়ঝাঁপ করেছেন। ২০০৮-এ আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে তাকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী করা হয়, পরে ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তার দক্ষতা নিয়ে হাজারো প্রশ্ন আছে কিন্তু সততা নিয়ে একটিও প্রশ্ন নেই। আজ মন্ত্রিসভায় তার চেয়েও অদক্ষ মন্ত্রীর তালিকা অনেক দীর্ঘ হবে। এসব অদক্ষ মন্ত্রী আবার নিজেদের আখের গোছাতে দক্ষ। আওয়ামী লীগের সরাসরি সদস্য না হয়েও ২০০৮-এ মন্ত্রী হয়েছিলেন ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ। তিনিই ছিলেন শেখ হাসিনার প্রধান আইনজীবীদের অন্যতম। গত মেয়াদে সরকারের আইনমন্ত্রী হিসেবে সুনাম কুড়িয়েছিলেন। এখন তিনি কোথায়? তাকে কেউ ডাকে না কেন?

ওয়ান-ইলেভেনে গ্রেফতার হওয়ার পর সাব জেলে শেখ হাসিনা অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। এ সময় তার চক্ষু চিকিৎসক ছিলেন ডা. সৈয়দ মোদাচ্ছের আলী। এ সময় তিনি চিকিৎসার জন্য শেখ হাসিনাকে দেশের বাইরে যাওয়ার অনুমতি দেওয়ার অনুরোধ করেন। এ জন্য তিনি অন্যসব চিকিৎসককে নিয়ে তৎকালীন প্রধান উপদেষ্টাকে এক স্মারকলিপি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু নির্দিষ্ট দিনে দেখা গেল এক ডা. সৈয়দ মোদাচ্ছের আলী ছাড়া আর কেউ নেই। কারও অপেক্ষা না করে একাই তিনি স্মারকলিপি নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকলেন প্রধান উপদেষ্টার (এখনকার প্রধানমন্ত্রীর কার‌্যালয়ে) কার‌্যালয়ের সামনে। একা একটি লোক, কি দুর্দান্ত সাহস! তিনি কোথায়?

এরকম অনেক উদাহরণ দেওয়া যায়। ওয়ান-ইলেভেনের দুঃসময়ের সহযাত্রীরা আজ কেউ কোণঠাসা, কেউ ছিটকে পড়েছেন। চারপাশ ঘিরে রেখেছেন চাটুকাররা। অতিথি পাখিরা।

শুধু ওয়ান-ইলেভেন কেন? ২০০১ সালের ১ অক্টোবরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের অভাবনীয় বিপর্যয় ঘটল। দল বিপর্যস্ত, শীর্ষ নেতাদের অনেকেই সরকারের সঙ্গে, হাওয়া ভবনের সঙ্গে গোপন সমঝোতায় গা ভাসালেন। এ সময় রক্তশূন্য আওয়ামী লীগে রক্ত সঞ্চালন করলেন নানক-আজম-ফারুকত্রয়ী। জাহাঙ্গীর কবির নানক, মির্জা আজম এবং ওমর ফারুক চৌধুরী। ২০০৬-এর তাদের নেতৃত্বে যুবলীগ এক মরণপণ আন্দোলন গড়ে তুলল। আজ অনেকেই প্রশ্ন করেন, জাহাঙ্গীর কবির নানক কোথায়? মির্জা আজম একটি মৃতপ্রায় মন্ত্রণালয়ে আধা মন্ত্রী হয়ে তাও মান ইজ্জত রক্ষা করতে পেরেছেন। আর ওমর ফারুক চৌধুরী পার্থিব প্রাপ্তির আশা ত্যাগ করে ‘দার্শনিক’-এর ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন।

২০০১ সালের পর থেকে বিএনপি-জামায়াতের সিন্ডিকেট বাণিজ্য এবং মৌলবাদীদের অর্থায়নের প্রামাণ্য দলিল প্রথম উপস্থাপন করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. আবুল বরকত। তিনিই প্রথম দেখিয়েছিলেন মৌলবাদীরা রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় ফুলেফেঁপে উঠছে। আবুল বরকত দেখিয়েছিলেন বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে হাওয়া ভবনের সিন্ডিকেট। আবুল বরকত এখন কোথায়? ক্ষমতার চারপাশের চাটুকারদের ধাক্কায় তিনিও ধরাশায়ী।

এরকম অনেক নাম বলা যায়, যারা দুঃসময়ে পাশে ছিলেন। আজ নির্বাসনে। রাজনীতি এমনই। এটি নিয়ে আমার কোনো দুঃখ বা বিস্ময় নেই। কিন্তু আমার যন্ত্রণা অন্যত্র, তাদের প্রতিস্থাপিত কোনো রাজনীতিবিদের দ্বারা হতো তাহলে এত কথা লেখার দরকার হতো না। কিন্তু কোনো রাজনীতিবিদই এখন ক্ষমতাকেন্দ্রের চারপাশে নেই। থাকলে টাঙ্গাইল উপনির্বাচনে এই লজ্জাজনক ঘটনা ঘটত না। লতিফ সিদ্দিকীর শূন্য আসনে উপনির্বাচন হবে। একটি আসনে আওয়ামী লীগ হারলেই কী জিতলেই কী? সংসদ তো পুরোটাই আওয়ামী লীগের। এরকম একটি উপনির্বাচনে কাদের সিদ্দিকী বীরউত্তম প্রতিদ্বদ্বিতা করলে সমস্যা কোথায়? মুক্তিযুদ্ধ এবং ’৭৫-এর ১৫ আগস্টের পর এই যোদ্ধার ভূমিকার জন্যই তাকে বাংলাদেশে মাথায় করে রাখা উচিত। অথচ তার মনোনয়ন নিয়ে যে লুকোচুরি খেলা হলো তা হাস্যকর। কারা এটা করছে? তারা কি বঙ্গবন্ধু, শেখ হাসিনা এবং আওয়ামী লীগের আদর্শ অনুসারী? নাকি সুযোগ সন্ধানী চাটুকার?

সরকার পরিচালনা করছে এখন আমলারা। অনেক সিনিয়র মন্ত্রী সরকারের অনেক সিদ্ধান্ত জানেন টেলিভিশনে বা সংবাদপত্রে। বড় বড় মন্ত্রণালয়ের প্রভাবশালী মন্ত্রীরা কাজ করতে পারছেন না সচিবের দৌরাত্ন্যে মন্ত্রণালয় স্থবির, অচলপ্রায়। সচিব কথায় কথায় শুনিয়ে দেন তিনি ‘প্রধানমন্ত্রীর লোক’। মন্ত্রণালয়ের স্বাভাবিক কাজকর্ম স্থবির করে দেওয়ার পরও কারও চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ হয়েছে। যখন যে ব্যাচ প্রধানমন্ত্রীর কার‌্যালয়ের কর্তৃত্ব নেয়, তখন সেই ব্যাচের শিকড় গজায়। এক সময় ৮১ ব্যাচের অনেক বিএনপি-জামায়াতপন্থিরা চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পেয়েছেন। এখন পাচ্ছেন ৮২ ব্যাচ। একে একে তাদের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ হচ্ছে। কাজের দক্ষতার জন্য নয়, বন্ধুত্বের কারণে। বন্ধুত্ব, আত্নীয়তার জোরে দ্রুত জামায়াতপন্থি আমলা হয়ে যান বীর মুক্তিযোদ্ধা, বিএনপির সময়ে সুখে থাকা কর্মকর্তা মুহূর্তে হয়ে যান নির‌্যাতিত। এই আমলারাই পে-স্কেলের সুপারিশ নিজেদের ইচ্ছামতো কাটাছেঁড়া করে এক সুন্দর উদ্যোগে জল ঢেলে দেন। এত চমৎকার একটি পে-স্কেল আমলাদের হাতের ছোঁয়ায় গণবিরোধী হয়ে যায়। এই আমলারা কি দুঃসময়ে পাশে থাকবেন? তারা কি কখনো ছিলেন?

শেখ হাসিনা আধুনিক বাংলাদেশের রূপকার। এটা তার চরম শত্র“রাও স্বীকার করবেন। তার পরিশ্রম এবং ত্যাগের জন্যই তিনি এই সাফল্য অর্জন করেছেন। তার সবচেয়ে বড় শক্তি হলো সংগঠন। যেটা শেখ হাসিনা সবসময় বলেন ‘আওয়ামী লীগের জন্যই আজকে আমি। আমার শিকড় হলো আমার সংগঠন।’ কিন্তু আওয়ামী লীগে ঘুণ পোকা ধরেছে। তৃণমূলের ত্যাগী নেতা-কর্মীরা চাটুকার, সুযোগ সন্ধানীদের দাপটে ছিটকে পড়েছেন। জামায়াত-বিএনপির লোকরা হাইব্রিড আর সুবিধাভোগীদের ছত্রছায়ায় ‘আওয়ামী সৈনিকে’ রূপান্তরিত হয়েছেন। ত্যাগী কর্মীরা স্বেচ্ছায় নির্বাসন দণ্ড নিয়েছেন। এসব দেখেশুনে মনে হয় জওহর লাল নেহরুর সেই বিখ্যাত উক্তি, ‘সংগঠন এবং সমালোচনা এই দুটি একজন নেতার সবচেয়ে বড় শক্তি। এই দুটি শক্তি হারালে নেতা তার নিজস্ব স্বকীয়তা হারিয়ে ফেলেন।’ সমালোচনা এবং সংগঠনের মাধ্যমেই আজ শেখ হাসিনা বিশ্বনেতা হয়েছেন। সমালোচনার আগুনে পুড়েই তিনি খাঁটি হয়েছেন। আর সংগঠন তাকে আগলে রেখেছে। আজ তার এই দুটি হাতকেই অকেজো করা হচ্ছে।

বাংলাদেশে এখন অবিসংবাদিত নেতা হলেন শেখ হাসিনা। তিনি পরিশ্রমী, সৎ এবং প্রাণশক্তিতে ভরপুর একজন মানুষ। যেমনটা লেনিন বলেছেন ‘দূরদৃষ্টি’ একজন নেতার সবচেয়ে বড় যোগ্যতা তেমনি দূরদৃষ্টিসম্পন্ন নেতা হলেন শেখ হাসিনা। তিনি আজ এ পর‌্যায়ে এসেছেন নির্লোভ, ত্যাগী, সর্বস্ব উজাড় করে দেওয়া কর্মী এবং জনগণের সমর্থনে, ভালোবাসায়। গ্রামের নিঃস্ব দরিদ্র মানুষটি তার জন্য রোজা রেখেছেন। নূর হোসেনের মতো যুবকরা তার আদর্শের জন্য বুলেটকে আলিঙ্গন করেছেন। সারাজীবন দেখেছি এরা শেখ হাসিনার কাছে আলাদা মর‌্যাদা পান। শেখ হাসিনা তাদের খোঁজখবর নেন। কিন্তু ইদানীং ক্রমশ এই দৃশ্যপট পাল্টে যাচ্ছে। চাটুকার সুযোগ সন্ধানীরা গণভবন থেকে তৃণমূল পর্যন্ত দখল করে ফেলেছে। তৃণমূলের আদর্শের আগুনে প্রজ্বলিত কর্মীরা কোণঠাসা হতে হতে হাবুডুবু খাচ্ছে। আর তাদের আর্তচিৎকারকে চাপা দিতে চারপাশের তোষামোদকারীরা এসব বিজ্ঞাপন, চাটুকারিতার বিলবোর্ডের ঢাকঢোল পেটাচ্ছেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আপনাকে যারা নিঃস্বার্থভাবে ভালোবাসে, যারা আপনার জন্য নিজের জীবনকে তুচ্ছ করে সবকিছু ছেড়ে ছুটে যায় আপনার ডাকে, তাদের দীর্ঘশ্বাস কি আপনি শুনতে পান? আপনি কি শুনতে পান সেই গানটা ‘বন্ধু তোমার পথের সাথীকে মনে রেখো’...

লেখক : নির্বাহী  পরিচালক, পরিপ্রেক্ষিত

ই-মেইল :  [email protected]

সর্বশেষ খবর