শুক্রবার, ৬ নভেম্বর, ২০১৫ ০০:০০ টা

আধ্যাত্মিক রোগের চিকিৎসা

মুফতি আমজাদ হোসাইন

আধ্যাত্মিক রোগের চিকিৎসা

মানুষ শুধু তার বাহ্যিক অবয়বের নাম নয় বরং মানুষের আসল পরিচয় পেতে হলে দেখতে হবে তার অভ্যন্তর। যাকে কলব (অন্তর) বা রুহ (আত্মা) বলে আখ্যায়িত করা হয়। মানুষের দেহের বহির্ভাগ কখনো সুস্থ থাকে, কখনো অসুস্থ হয়ে পড়ে। রক্ত-মাংসে গড়া এই শরীরের সুস্থতা ঠিক রাখার জন্য প্রয়োজন অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান এবং আবহাওয়া ইত্যাদি। যদি কখনো শরীর অসুস্থ হয়ে পড়ে, এ অসুস্থতা দূর করার জন্য প্রয়োজন ডাক্তার, কাবিরাজ এবং হাকিমের। অনুরূপভাবে মানুষের অভ্যন্তর সুস্থ রাখার জন্য কিছু অতি জরুরি উপায়-উপকরণ অবলম্বন করা হয়। যার দ্বারা মানুষ স্বীয় খালিক (স্রষ্টা) ও মালিককে চিনতে পারে, তাঁর জিকির করতে পারে, নেয়ামতের শোকর আদায় করতে পারে, আল্লাহপাকের দেওয়া হায়াতে সর্বদা তাঁর হুকুমের অনুসরণ ও অনুকরণ করতে পারে, সব সুখ-দুঃখের মালিক আল্লাহপাককে মনে করতে পারে, বিপদাপদে ধৈর্য ধারণ করতে পারে, সব বিষয়ে আল্লাহর ওপর ভরসা রাখতে পারে, তাঁর রহমতের আশা করতে পারে, তাঁর আজাবের ভয় করতে পারে, তাঁর সন্তুষ্টির ফিকির করতে পারে এবং আন্তরিকতা ও ইখলাসের সঙ্গে তাঁর সব হুকুম পালন করতে পারে। এ সম্পর্কে পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হচ্ছে, ‘আমি কোরআনে এমন বিষয় নাজিল করেছি, যা মুমিনের জন্য (রোগের) সুচিকিৎসা এবং রহমত হয়’। (সূরা বনী ইসরাঈল : ৮২) আলোচ্য আয়াত দ্বারা বোঝা গেল, পবিত্র কোরআন শিরক, কুফর, কুচরিত্র ও আত্মিক রোগসমূহ থেকে মুক্ত করে এক আল্লাহর সঙ্গে বান্দাকে জুড়িয়ে দেয়, কথাটি সর্বজনস্বীকৃত সত্য। কোনো কোনো আলেম-ওলামাদের মতে, পবিত্র কোরআন যেমনিভাবে আধ্যাত্মিক রোগসমূহের এক মহৌষধ, অনুরূপভাবে বাহ্যিক রোগসমূহের অমোঘ ব্যবস্থাপত্র। হজরত আবু সাঈদ খুদরি (রা.) থেকে বর্ণিত। একবার সাহাবাদের একটি দল সফররত ছিলেন। কোনো এক গ্রামের এক সরদারকে বিচ্ছু দংশন করল, লোকেরা সাহাবিদের কাছে জিজ্ঞাসা করল যে, আপনারা এই রোগের চিকিৎসা করতে পারবেন কি? তখন সাহাবিরা সূরা ফাতেহা পাঠ করে রোগীকে ফুঁ দিলে রোগীকে সঙ্গে সঙ্গে আল্লাহপাক সূরা ফতেহার উসিলায় সুস্থ করে দেন। তবে শর্ত হলো আল্লাহর ওপর পূর্ণ একিন ও বিশ্বাস স্থাপন করে পবিত্র কোরআনের ওপর আমল করতে হবে। তাহলেই পবিত্র কোরআনের অলৌকিকতার বহিঃপ্রকাশ ঘটবে ইনশাআল্লাহ। অপর আয়াতে ইরশাদ হচ্ছে, ‘(হে নবী!) আপনি বলে দিন, এই কোরআন ইমানদারদের জন্য হিদায়াত এবং সুচিকিৎসা’। (সূরা হা-মীম সিজদাহ : ৪৪) এখন আমাদের বুঝতে হবে মানুষের আধ্যাত্মিক রোগ কি?  আধ্যাত্মিক রোগ হলো, আল্লাহর স্মরণ থেকে গাফেল থাকা এবং তাঁর হুকুমের খেলাফ (পরিপন্থী) কোনো কাজ করা। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হচ্ছে, ‘তাদের অন্তরে (কুফর ও অবাধ্যতার) রোগ আছে। সুতরাং আল্লাহপাক তাদের রোগ আরও বৃদ্ধি করে দেন। বস্তুত তাদের জন্য নির্ধারিত রয়েছে ভয়াবহ আজাব তাদের মিথ্যাচারের দরুন’। (সূরা বাকারা : ১০) আলোচ্য আয়াতে কাফের ও মুনাফিকদের অন্তরে লুকায়িত কুফরকে রোগ বলা হয়েছে। রোগ সে অবস্থাকেই বলে, যে অবস্থায় মানুষ স্বাভাবিক অবস্থার বাইরে চলে যায় এবং তাদের স্বাভাবিক  কাজকর্মে বিঘ্ন সৃষ্টি হয়। যার শেষ পরিণাম ধ্বংস ও মৃত্যু। হজরত জুনায়েদ বুগদাদী (র.) বলেন, যেভাবে অসতর্কতার দরুন মানুষের শরীরে রোগব্যাধি সৃষ্টি হয়, অনুরূপ শয়তানের প্ররোচনার দ্বারা মানুষের অন্তরেও রোগ-ব্যাধির সৃষ্টি হয়। যা দৈহিক ও আধ্যাত্মিক উভয় দিক থেকেই ক্ষতিকর। দৈহিক ক্ষতি হলো যে, মুনাফিকরা সর্বদা এই ভয়ে থাকে না জানি কখন রসুল (সা.)-এর দরবারে তাদের মনের কথা প্রকাশ হয়ে পড়ে, দিনরাত এই চিন্তায় মগ্ন থাকাটাই একটি শারীরিক রোগ। আর আধ্যাত্মিক রোগ হলো, যিনি তার খালিক, মালিক ও রিজিকদাতা, তাঁর সবকিছুর কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন না করে অকৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন, শিরক, মুনাফিকী, হিংসা, বিদ্বেষ, অহংকার-গর্ব, লোভ-লালসা, কৃপণতা, পদের মোহ, সম্পদের মোহ, আত্মম্ভরিতাসহ ইত্যাদি মানবাত্মার সর্বাপেক্ষা কঠিন ও জটিল রোগ। শারীরিক ও আধ্যাত্মিক রোগের আরেকটি বড় পার্থক্য হলো যে, শরীরের রোগ তো চোখ দ্বারা দেখা যায়, হাত দ্বারা ধরা যায় এবং অন্যান্য ইন্দ্রিয় দ্বারা অনুভব করা যায়। এই রোগের চিকিৎসা বাহ্যিক যন্ত্রপাতির দ্বারা বুঝে তদনুযায়ী চিকিৎসার ব্যবস্থা করা যায় কিন্তু আধ্যাত্মিক রোগ চোখ দ্বারা দেখা যায় না, অন্যান্য ইন্দ্রিয় দ্বারা অনুভব করা যায় না, শুধু অন্তরের অনুভূতি দ্বারা বুঝে নিতে হয় এবং হক্কানি ওলামা ও পীর মাশায়েখের কাছে গেলে আধ্যাত্মিক রোগ ধরা পড়ে।  এই রোগের চিকিৎসা কোনো বাহ্যিক যন্ত্রপাতি দ্বারা করা যায় না। এই রোগের চিকিৎসা শুধু কোরআন-হাদিসে বর্ণিত নিয়মানুসারেই করতে হয়।

লেখক : মুহাদ্দিস, মুফাসসির ও খতিব, বারিধারা, ঢাকা।

সর্বশেষ খবর