শনিবার, ৭ নভেম্বর, ২০১৫ ০০:০০ টা

ঘুষরাজ্যের রাক্ষস-খোক্ষসদের তাণ্ডব!

গোলাম মাওলা রনি

ঘুষরাজ্যের রাক্ষস-খোক্ষসদের তাণ্ডব!

বাংলাদেশের ঘুষবাণিজ্যে হঠাৎ করেই চরম অস্থিরতা দেখা দিয়েছে। ঘুষ লেনদেনের চিরাচরিত নিয়মকানুন সব উল্টাপাল্টা হয়ে গেছে। এ বাণিজ্যের যে অলিখিত চেইন অব কমান্ড ছিল তাও ভেঙে পড়েছে। এখানকার বড় বড় মাছ ছোটদের গিলে খাচ্ছে। এমনিতেই সভ্য সমাজের লোকজন ঘুষখোর কিংবা ঘুষখোরীদের ইতিপূর্বে দানব এবং দানবী বলে ইজ্জত দেখাত। সাম্প্রতিককালে দানব-দানবীদের রাক্ষস-রাক্ষসী উপাধিতে উন্নীত করা হয়েছে। অন্যদিকে রাক্ষস-রাক্ষসীদের সহযোগী দালাল বা ফড়িয়াদের নতুন উপাধি হয়েছে খোক্ষস-খোক্ষসী।  সবচেয়ে ভয়াবহ ব্যাপার হলো- গল্প উপন্যাসের রাক্ষস-রাক্ষসী কিংবা খোক্ষস-খোক্ষসীদেরও কিছু ন্যায়নীতি এবং নিয়মকানুন ছিল। কিন্তু বঙ্গদেশের ঘুষবাণিজ্যের বর্তমান কুলাঙ্গাররা যেন কোনো নিয়মকানুনই মানছে না। ফলে পরলোকে চলে যাওয়া কুখ্যাত সব ঘুষখোর এবং খোরীরা তাদের উত্তরসূরিদের কাণ্ড-কারখানা দেখে রীতিমতো আতঙ্কিত হয়ে পড়ছে এবং কেয়ামতের দিনক্ষণ গণনা শুরু করে দিয়েছে।

যতটুকু লিখেছি তার মধ্যে দুটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে সামনে এগুলে সম্মানিত পাঠকরা হয়তো অতৃপ্তিতে ভুগতে পারেন। এ জন্য প্রথমেই বলব গল্প-উপন্যাসের রাক্ষস-খোক্ষসদের নীতি ও নৈতিকতার টুকিটাকি সম্পর্কে। তারপর কোনো পরলোকের ঘুষখোররা কেয়ামতের আতঙ্কে ভুগছে সে ব্যাপারে সংক্ষেপে আলোচনা করে মূল প্রসঙ্গে চলে যাব। নানী ও দাদিদের কাছে রাক্ষসদের ব্যাপারে যেসব গল্প শুনেছি তাতে দুই ধরনের রাক্ষস দেখেছি। একশ্রেণির রাক্ষসরা ছিল দানব প্রকৃতির। এরা সাধারণত পুরুষ শ্রেণিভুক্ত এবং বাস করত রাক্ষস রাজ্যে। এরা মানুষরাজ্যে প্রবেশ করত রাতের অন্ধকারে এবং বেছে বেছে তাগড়া যুবক কিংবা জওয়ান প্রকৃতির সুদর্শন লোকজনকে ধরে নিয়ে যেত। তারা কোনো দিন অসহায়, দুর্বল, অসুন্দর এবং গরিব মানুষকে আক্রমণ করত না। তাদের এক নম্বর পছন্দ ছিল রাজা-বাদশাহ, উজির-নাজির প্রভৃতি প্রভাবশালী গোষ্ঠীর সন্তানরা যারা সাধারণত মন্দ মানুষ রূপে সমাজে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করে প্রতিনিয়ত জুলুম এবং অত্যাচার চালাত। রাক্ষসরা সাধারণত কোনো মেয়ে মানুষকে খেত না। তবে কোনো রাজার অসম্ভব সুন্দরী কন্যা অথবা স্ত্রীকে তারা অপহরণ করে নিয়ে যেত এবং সম্মানের সঙ্গে তাদের অভিনব উপায়ে বন্দী করে রাখত। গল্পের কোনো রাক্ষস তার কাছে বন্দিনী রাজকুমারী অথবা রাজরানীকে ধর্ষণ করেছে- অথবা হত্যা করেছে কিংবা নির্যাতন করেছে এমন কোনো কাহিনী আমরা শুনিনি। রাক্ষসদের আরও একটি নীতি ও আদর্শ আমার নজরে এসেছে। তারা মনুষ্যরাজ্যে বসে নরহত্যা করত না। তাদের শিকারকে ধরে নিয়ে যেত রাক্ষসরাজ্যে- কখনো একটি আবার কখনো কয়েকটি। তারা তাদের শিকারগুলোকে পালাক্রমে গলাধকরণ করত। একসঙ্গে সব শিকারকে বধ করত না। জমিয়ে রাখত এবং ক্ষুধার প্রয়োজনে বধ করত। তারা পেটপুরে খেত কিন্তু অপচয় করত না এবং শিকার বস্তুর প্রতি নির্যাতন কিংবা জুলুম করত না। রাক্ষসগুলো অতি যত্নসহকারে মানুষের রক্ত এবং মাংস খেত। চামড়া, নাড়িভুঁড়ি এবং মানুষের বর্জ্য তারা কি করত তা জানা না গেলেও তারা যে মানুষের হাড্ডিগুড্ডি চিবিয়ে খেত না তা ছিল শতভাগ সত্য। কারণ কোনো বীর পুরুষ রাক্ষসরাজ্যে ঢুকে প্রথমেই দেখতে পেত যে অনেক মানুষের হাড়গোড় সেখানে স্তূপিকৃত রয়েছে এবং সেই সূত্রেই বীরেরা রাক্ষসদের খুঁজে বের করত।

রাক্ষসদের বাদ দিয়ে এবার চলুন রাক্ষুসীদের নিয়ে কিছু বলি। মানুষ হত্যাকারী হিসেবে রাক্ষসদের থেকে রাক্ষুসীদের রয়েছে স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য। রাক্ষুসীরা সাধারণত রাক্ষসদের মতো রাক্ষসপুরীতে বসবাস করে না। তারা মানব সমাজে সুন্দরী নারীর বেশে কোনো রাজা-বাদশাহ বা আমির-ওমরাহর সোহাগী দ্বিতীয় স্ত্রী হিসেবে বসবাস করে। রাক্ষুসীরা ছলনাময়ী, প্রতারণায় অসাধারণ দক্ষ, মিথ্যাবাদিনী এবং ঠাণ্ডা মাথার নির্মম ও নিষ্ঠুর হত্যাকারী। তারা ক্যান্সারের মতো ধীরে ধীরে রাজ্য, রাজা এবং রাজধানীর প্রাণশক্তি শোষণ করে নেয় এবং সর্বশেষ সর্বনাশটি ঘটিয়ে আপন মূর্তি ধারণ করে উধাও হয়ে যায়। অর্থাৎ সর্বশেষ ধ্বংসযজ্ঞের পূর্ব পর্যন্ত রাক্ষুসীরা সুন্দরী নারীরূপ জাগতিক ছলাকলা এবং রঙ্গরসের মাধ্যমে সবাইকে মোহিত করে রাখে। সবকিছু নিঃশেষ করার পর তারা তাদের স্বামী রাজা-বাদশাদের কাছে নিজেদের রাক্ষুসী চরিত্র উন্মোচিত করে চম্পট মারে। রাক্ষুসীদের চরিত্রের সাধারণ বৈশিষ্ট্য হলো তারা রাতের আঁধারে তাদের রাক্ষুসী পেটের জ্বালা মেটানোর জন্য বের হয়। তারা এমন সময় বের হয় যখন রাজপুরীর সবাই ঘুমন্ত অবস্থায় থাকে এবং রাজ্যের প্রজাকুল, পশুপাখি, জন্তু জানোয়ার ইত্যাদি সুখনিদ্রায় মগ্ন থাকে।

রাক্ষুসীরা চুপিসারে প্রথমে রাজার আস্তাবলে ঢুকে। এরপর প্রতি রাতে একটি করে হাতি, ঘোড়া, গাধা প্রভৃতি খেয়ে ফেলে। আস্তাবল সাবাড় করে তারা রাজ অন্তঃপুরের বাসিন্দাদের খাওয়া শুরু করে এবং শেষমেশ লোকালয়ে ঢুকে। রাক্ষস থেকে রাক্ষুসীদের তাণ্ডব বর্ণময়। তারা রক্ত-মাংস, নাড়িভুঁড়ি, হাড্ডি-গুড্ডি সব কিছু খেয়ে ফেলে। ফলে তাদের তাণ্ডবের কোনো প্রমাণ পাওয়া যায় না। রাক্ষসের কোনো সহযোগী লাগে না। কারণ তারা শক্তিশালী, সাহসী, নির্মম ও যোদ্ধা প্রকৃতির। সব কাজ তারা একাই করে। অন্যদিকে রাক্ষুসীদের থাকে অনেক সহযোগী যারা তাদের শিকারের সংখ্যা, পরিমাণ এবং সহজলভ্যতা সম্পর্কে আগাম তথ্য প্রদান করে থাকে। এরাই মূলত খোক্ষস বা খোক্ষসীরূপে রূপকথার সৌন্দর্য বৃদ্ধি করে। রাক্ষুসীদের আরেকটি বৈশিষ্ট্য হলো- তারা সবকিছু খেয়ে ফেলার পর খোক্ষস-খোক্ষসীদের দিকে হাত বাড়ায় কিন্তু কেন জানি তাদের স্বামী নির্বোধ এবং বোকা রাজাটিকে খায় না।

রাক্ষস ও রাক্ষুসীদের জীবন বা প্রাণভোমরা সম্পর্কে রূপকথার কাহিনীতে চমৎকার এবং ইঙ্গিতপূর্ণ তথ্য সন্নিবেশিত হয়েছে। এদের প্রাণ সব সময় অন্যের হাতে থাকে। অর্থাৎ রাক্ষস-রাক্ষসীদের দেহ তাদের প্রাণ ধারণ করতে পারে না। তাদের জীবনীশক্তি লুকায়িত থাকে বিরাট এক দীঘির গভীর পানির নিচে রক্ষিত একটি বাক্সের ভিতরে বন্দী চমৎকার এক টিয়া পাখির মধ্যে। গল্পের নায়ককে যদি রাক্ষসটি বধ করতে হয় তবে তাকে অপেক্ষা করতে হবে চমৎকার একটি সময়ের জন্য যখন কিনা রাক্ষস-রাক্ষুসীরা শিকারের খোঁজে ব্যস্ত থাকবে এবং অবস্থান করবে সেই দীঘি থেকে বহু যোজন যোজন দূরে। নায়ককে এরপর কষ্ট করে দীঘির জলে ঝাঁপ দিতে হবে এবং তন্নতন্ন করে খুঁজতে হবে সেই বাক্সটি। সবার শেষে বাক্স খুলে বের করে আনতে হবে সত্য ও সুন্দরতর বেশধারী টিয়া পাখিটিকে এবং অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে গলাটিপে ধরতে হবে। ইতিমধ্যে রাক্ষস টের পেয়ে যাবে এবং পৌঁছে যাবে দীঘির কিনারে। মহাবীর রাজকুমার তার আগেই পাখিটিকে মেরে ফেলবে। ফলে সাঙ্গ হবে রাক্ষস কিংবা রাক্ষুসীর ভবলীলা। রাক্ষস-খোক্ষস সম্পর্কে আমার আজকের বক্তব্য এতটুকুই- চলুন, এবার দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তরের দিকে অগ্রসর হই। পড়তে পড়তে আপনারা হয়তো ভুলেই গেছেন দ্বিতীয় প্রশ্নের প্রেক্ষাপট সম্পর্কে। প্রশ্নটি ছিল এরূপ- কেন পরলোকে পাড়ি দেওয়া সিনিয়র ঘুষখোররা আতঙ্কিত হয়ে পড়েছে এবং কেয়ামতের আশঙ্কা করছে? যারা ইহলোকের সঙ্গে সঙ্গে পরলোক সম্পর্কে বিশ্বাস রাখেন তারা নিশ্চয়ই জানেন যে, প্রত্যেকটি মৃত মানুষের দেহ মর্ত্যলোকে থাকে। দেহগুলো পচেগলে পানি-মাটি এবং বাতাসের সঙ্গে একাকার হয়ে যায়। কেবল কিছু দেহ আল্লাহপাক তার আপন কুদরতে সংরক্ষিত করেন। অন্যদিকে ভালো আত্মা এবং মন্দ আত্মা পৃথক দুটি স্থানে অবস্থানে থেকে হয় স্বর্গসুখ লাভ করে, নয়তো নরক যন্ত্রণা ভোগ করে। আত্মাগুলো দুনিয়ার মানুষের কর্মকাণ্ড বিশেষ করে তাদের অনুসারী এবং আওলাদ-আওতাদদের কর্মকাণ্ড দেখতে পারে এবং আল্লাহর দরবারে নিজেদের প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করতে পারে।

 

 

ঊর্ধ্বলোকের ঘুষখোর আত্মাগুলো কেয়ামত পর্যন্ত একটি নির্দিষ্ট সাজা ভোগের মাধ্যমে সময়গুলো অতিক্রান্ত করছে এবং কেয়ামতের চিন্তায় অস্থিরতায় ভুগছে, কারণ কেয়ামত সংঘটিত হলে প্রথমত হাশর, পুলসিরাত, মিজান এবং সবশেষে জাহান্নামের ভয়াবহ সাজা ভোগ করতে হবে যা কিনা তাদের বর্তমান সাজার চেয়ে বহুগুণ প্রলয়ঙ্করী এবং বেদনাদায়ক হবে। বর্তমানের ঘুষখোররা যেভাবে ঘুষ দুর্নীতি করছে এবং সেই দুর্নীতিলব্ধ অর্থ দ্বারা যে তাণ্ডব চালাচ্ছে তাতে লক্ষ কোটি মজলুমের অন্তরে গগনবিদারী কান্নার রোল পয়দা হয়ে যাচ্ছে। তাদের অভিশাপে পৃথিবী বিষাক্ত হয়ে পড়ছে। অভিশাপের বিষবাষ্পে পৃথিবীর মাটি ফেটে যাচ্ছে- আসমান ভারী হয়ে ভেঙে পড়তে যাচ্ছে এবং কেয়ামতের পূর্ব লক্ষণ স্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে। ঘুষ লেনদেনের অতীতের সব রেকর্ড ভেঙে গেছে। ঘুষখোরদের দাপট সব দানবীয় শক্তির সীমা অতিক্রম করে নতুন কীর্তি স্থাপন করেছে। তাদের নিকৃষ্ট পাপাচার, জঘন্য মানসিকতা এবং সীমাহীন দম্ভ এ ভূখণ্ডে নতুন জাহেলিয়াত পয়দা করে ফেলেছে। তারা রাক্ষস কিংবা রাক্ষুসীদের মতো মানুষের রক্ত-মাংস-হাড্ডিগুড্ডি পর্যন্ত খেয়ে ফেলে। সমাজের টিয়ারূপী-তথাকথিত সাধুবেশী ভণ্ডরা এ ঘুষখোরদের প্রাণভোমরা রক্ষক হয়ে তাদের এমনভাবে বাঁচিয়ে রেখেছে যে, জমিনের সাধারণ মানুষ ওদের টিকিটি স্পর্শ করার ক্ষমতা রাখে না। আগে আমাদের সমাজের মেয়েরা তেমন ঘুষটুস খেত না, ইদানীং তারা তাদের পুরুষ সহকর্মীদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ওসব কুকর্ম করে বেড়াচ্ছে। আগে ঘুষ দিলে কাজ হতো কিন্তু ইদানীং ঘুষ প্রদানকারীদের আর সেই সুদিন নেই। অর্থাৎ ঘুষ দিলেও কাজ হয় না। পরিস্থিতি এমনই জঘন্য হয়ে পড়েছে যে, চার/পাঁচজনের কাছ থেকে ইচ্ছামতো ঘুষ নিয়ে কাজ দেওয়া হয় ৬ষ্ঠ জনকে। বঞ্চিতরা ঘুষের টাকা ফেরত চাইতে গিয়ে ছ্যাঁকা-গুতার শিকার হন- অনেকে আবার জীবনটাই হারিয়ে বসেন। এ নিয়ে প্রতিবাদ করার উপায় নেই এবং প্রতিকার পাওয়ারও জায়গা নেই।

আগেকার দিনে কেবল সরকারি অফিস-আদালতে ঘুষ লেনদেন হতো, কিন্তু ইদানীং সরকারি কর্মকর্তাদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেসরকারি খাত আন্তর্জাতিক সংস্থা এমনকি অলাভজনক দাতব্য প্রতিষ্ঠানগুলোতেও ঘুষ দুর্নীতি চলছে। ২০১৫ সালে এসে সব ঘুষের রেট রাতারাতি দ্বিগুণ এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে দশগুণ পর্যন্ত বেড়ে গেছে। ঘুষখোররা দিনের আলোতে প্রকাশ্যে ঘুষ লেনদেন করছে। তারপর সেই টাকার একাংশ দেশে ও বিদেশে স্থাবর সম্পত্তি ক্রয়ে খরচ করছে। কিছু অংশ দিয়ে নিজের ও পরিবারের ভোগবিলাসের সামগ্রী ক্রয় করছে। বাকি টাকা দিয়ে অনৈতিক আনন্দ-ফুর্তি, মদ, জুয়া এবং তারই মতো ঊর্ধ্বতন কোনো ঘুষখোরকে তোহফা প্রদান করছে। ফলে সম্পত্তির বাজার, নিত্যব্যবহার্য পণ্যের বাজার এবং অন্ধকার জগতের প্রতিটি বস্তুর বাজারে ভারসাম্যহীনতা দেখা দিয়েছে।

বাংলাদেশের অর্থনীতির বিরাট একটি অংশ আজ ঘুষখোরদের দখলে। দেশের রমরমা এবং চিত্তাকর্ষ অনেক কিছুই ঘুষজাত দ্রব্যসামগ্রী দ্বারা প্রস্তুত। মার্কেটগুলোতে যেসব নিত্যব্যবহার্য বিলাস সামগ্রী রয়েছে কিংবা দেশের শহর-নগর বন্দরে যেসব সুরম্য অট্টালিকা রয়েছে সেগুলোর ভোক্তা বা ক্রেতাদের মধ্যে কে ঘুষখোর কিংবা দুর্নীতিবাজ নয় তা বের করার জন্য অনুবীক্ষণ যন্ত্র দরকার পড়বে। আজ দেশের ঘুষখোরদের মধ্যে কোনো জাত-বিজাত নেই। মুচি-চামার, নাপিত, মেথর, ধোপা থেকে শুরু করে আমির ওমরাহ সবাই ঘুষ নামক অমৃত পান করা মাত্রই একই জাতিতে রূপান্তরিত হয়ে পড়ে।

ঘুষ ও দুর্নীতির কালো টাকার মালিকদের তাণ্ডবে সৎ মানুষেরা সুকর্ম করার উৎসাহ হারিয়ে ফেলছে। সমাজ থেকে মান-সম্মান, মায়া-মমতা, শ্রদ্ধা-ভালোবাসা এবং সাহায্য-সহযোগিতামূলক মানবীয় গুণাবলি উধাও হতে চলেছে। অর্থাৎ অত্যাচার, অবিচার এবং জুলুমই যেন সবকিছুর নিয়ামক হয়ে পড়েছে। ইতিপূর্বে চুরি-ডাকাতি কিংবা ছিনতাইয়ের মাধ্যমে অর্থ ছিনিয়ে নেওয়ার রীতিটিও যেন রহিত হয়ে পড়েছে। চোর-ডাকাত এবং ছিনতাইকারীরা বিত্তবান হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নিজেদের ক্ষমতাবান বানিয়ে ফেলে এবং রাক্ষস সম্প্রদায়ের সদস্য হয়ে যায়। তারপর অতীতের মতো ঝুঁকিপূর্ণ পদ্ধতিতে অর্থ উপার্জন না করে অত্যাচার, অবিচার এবং জুলুমের মাধ্যমে তা হাসিল করে নেয়। ফলে আধুনিককালের ঘুষখোর এবং দুর্নীতিবাজের সংখ্যা, ধর্ম, বর্ণ এবং সম্প্রদায় বহুমাত্রিকতায় এতটাই সমৃদ্ধ হয়ে পড়েছে যে একমাত্র আল্লাহর গজব ছাড়া অন্য কোনো শক্তি তাদের ভয় দেখানো কিংবা এদের গতিরোধের ক্ষমতা রাখে না।

ঘুষরাজ্যের ক্ষমতাধর বাসিন্দারা এখন আর নিজেদের মানুষ বলে পরিচয় দেয় না। উল্টো নিজেদের মানুষ হিসেবে ভাবতেও তারা লজ্জাবোধ করে। তারা নিজেদের রাক্ষস কিংবা রাক্ষুসী পরিচয়ে পরিচিত করার জন্য অভিনব সব ভাষা এবং শব্দমালা ব্যবহার করে। একটু রেগে গেলেই তারা বলতে থাকে ‘এই! আমাকে চিনিস! জানিস আমি কে? একদম চিবিয়ে খেয়ে ফেলব!’ তাদের কাথাবার্তা শুনে পরলোকের সিনিয়র ঘুষখোররা আতঙ্কে কাঁপতে কাঁপতে বলতে থাকে- ‘ইস আমাদের বেজন্মা আওলাদ ও আওতাদদের হলোটা কী? আমাদের আমলে আমরা তো ঘুষ-ঘাষের একটা নিয়মনীতি মেনে চলতাম এবং কুকর্ম করতে গিয়ে নিকৃষ্ট পশু এবং শয়তানকে উস্তাদ বানাতাম। ওরা তো দেখছি নৃশংসতা ও নির্মমতায় রাক্ষসদেরও ছাড়িয়ে যাচ্ছে আর কুকর্মে সব পশু এবং শয়তানকে শত মাইল পেছনে ফেলে দিয়েছে।  এগুলো তো কেয়ামতের আলামত। ওদের কারণে তো খোদায়ী গজব জমিনের জন্য অপরিহার্য হয়ে পড়েছে। ফলে একদিকে যেমন শস্য-শ্যামল বসুমতী হুমকির মধ্যে পড়েছে তেমনি আমরাও অধিকতর আজাবের কবলে পড়ার আশঙ্কায় অস্থির হয়ে পড়েছি। ইয়া আল্লাহ! তুমি আমাদের উত্তরসূরি নব্য রাক্ষস-খোক্ষসদের ওপর বিরক্ত হয়ে তোমার সুশোভিত বসুন্ধরা ধ্বংস করোও না- বরং আদ ও সামুদ জাতির মতো কিংবা লুত নবীর কওমের মতো বাংলার জমিন থেকে ঘুষখোর ও দুর্নীতিবাজদের সমূলে বিনাশ করে দাও।  ওদের কারণে যেন আমাদের পাপ এবং সাজার পরিমাণ বৃদ্ধিপ্রাপ্ত না হয় সে ব্যাপারে তোমার সাহায্য প্রার্থনা করছি।

লেখক : কলামিস্ট।

 

 

সর্বশেষ খবর