রবিবার, ১৫ নভেম্বর, ২০১৫ ০০:০০ টা

রাজনীতির এক রাজকুমার চলে গেলেন বলে গেলেন না

কাজী সিরাজ

রাজনীতির এক রাজকুমার চলে গেলেন বলে গেলেন না

বেশ কিছু দিন পরিবারের ঘনিষ্ঠ কারও ফোন এলেই চমকে উঠতাম, বুকটা যেন দুরু দুরু কেঁপে উঠত এই ভেবে যে, এই বুঝি কোনো খারাপ সংবাদ এলো। শেষবার যখন তার সঙ্গে কথা হয়, বুঝতে পেরেছিলাম তিনি নিজেই যেন প্রহর গুনছিলেন। সাহস দিয়ে বলেছিলাম কিচ্ছু হবে না, সেরে উঠবেন ইনশাআল্লাহ। আলতো করে তার হাতটা ধরেছিলাম। তিনিও চাইছিলেন আমার হাতটা মুঠোয় পুরতে; কিন্তু পারলেন না।  দুই চোখের কোনায় মুক্তোকণার মতো দুই বিন্দু অশ্রু  চিকচিক করছে। মনে হয়েছে, বেঁচে থাকার এ যেন এক করুণ আকুতি। মৃদু মাথা নেড়ে বললেন, নারে সিরু, (এ নামেই তিনি আমাকে ডাকতেন) এবার আর বোধ হয় ফিরব না। কিন্তু ফিরেছিলেন। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন করুণা করেছিলেন। এর আগে আরও দুবার যেন যমের ঘর থেকে ফেরত এসেছিলেন তিনি। তাকে কিডনিদাতা ইকবাল, নজরুল, আরিফ, লিখনসহ পরিবারের ঘনিষ্ঠ যারা প্রায় সর্বদা তাকে ঘিরে ছিল, সবাই উৎকণ্ঠায় থাকত কখন কী জানি কী হয়! মুস্তফা ছিল তার সহকারী। ওর চেহারার দিকে তাকানোই যেত না। না, ওই আতঙ্কিত মুহূর্তগুলোতে কিছু হয়নি। সবার মধ্যে যখন একটা স্বস্তির ভাব, ঠিক তখন আকস্মিক বাজলো দুঃসংবাদটা। ২৭ আগস্ট সকাল ৮টার পর আমাদের ভাগ্নে কাজী নজরুল প্রথম ফোন করল। বিলাপের সুরে এমনভাবে কাঁদছিল, কোনো কথাই বোঝা যাচ্ছিল না। অনেক কষ্টে পরে বলল, ‘কাকা নাই’। আর কোনো কথা নেই। আমি ভেবেছিলাম, আমাদের আরেক ভাইয়ের কথা। তিনি কাজী হাবিবুর রহমান, আমাদের কালন ভাই। আমাদের পরিবারে তিনিই এখন সর্বজ্যেষ্ঠ মুরব্বি। বেশ কিছু দিন ধরে তার শরীরটাও ভালো যাচ্ছিল না। ছেলেরা অনেকটা জোর করে ঢাকায় নিয়ে আসে, একটু ভালো লাগলেই চলে যান গ্রামের বাড়ি চিওড়া কাজী বাড়িতে। আমি যখন তার নাম ধরে জিজ্ঞাসা করলাম, নজরুল কাঁদতে কাঁদতেই অতি কষ্টে জানাল, না, ‘জাফর কাকা’। এভাবেই পেলাম জাফর ভাইয়ের মৃত্যু সংবাদ। অথচ জানতাম তিনি অনেকটা সুস্থ হয়ে উঠেছেন। মাত্র কদিন আগে ২০ দলীয় জোটনেত্রী খালেদা জিয়ার সঙ্গে বৈঠকের পর প্রেস ব্রিফিংয়ে তার আÍপ্রত্যয়ী চেহারা দেখে বেশ আশা জেগেছিল। ২৭ আগস্ট সকালে তার যাওয়ার কথা ছিল আমাদের গ্রামের বাড়ি। তার দলের সবাইকে খবরও দিয়েছিলেন নিজে। গভীর রাতেও কয়েকজনকে ফোন করেছিলেন, বলেছিলেন, আমি আজ বাড়ি আসছি। হ্যাঁ, বাড়ি তিনি গিয়েছেন, আর সেটাই তার শেষ যাওয়া। যাদের ফোন করেছিলেন, খবর দিয়েছিলেন, তারা সবাই এসেছিলেন তার কাছে, জীবিত কাজী জাফর আহমদের কাছে নয়, ফ্রিজিং অ্যাম্বুলেন্সে চিরনিদ্রায় শায়িত কাজী জাফর আহমদের কাছে। এবার আর চিওড়া হাইস্কুল ময়দানে তার সুললিত কণ্ঠের তেজোদীপ্ত বক্তৃতা শুনতে আসেননি কেউ, এসেছিলেন এই বিশাল ময়দানে লাখো মানুষের সঙ্গে তার জানাজায় শরিক হতে। এসেছিলেন শেষ বিদায়ের অশ্র“জলে চিরচেনা চিওড়া হাইস্কুল ময়দানকে ভাসিয়ে দিতে।

কাজী জাফর আহমদ জম্মোছেন কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম থানাধীন চিওড়া কাজী বাড়িতে, ১৯৩৯ সালে। তিনি ছিলেন বাংলাদেশের রাজনীতির এক তারকা পুরুষ, নন্দিত রাজকুমার। সেই কিশোর বয়সে ছাত্রজীবন থেকে রাজনীতি শুরু করে আমৃত্যু ছিলেন রাজনীতির সঙ্গে। বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবনে তিনি দেশের প্রধানমন্ত্রী পর্যন্ত হয়েছিলেন। দেশ তাকে দিয়েছে যা, তিনি দেশকে দিয়েছেন তার চেয়ে বেশি। রাজনীতিতে আমার হাতেখড়ি তার হাতে। তিনি আমার ভাই, তিনি ছিলেন আমার নেতা। রাজনৈতিক মতপার্থক্য হয়েছে; কিন্তু সম্পর্কের অবনতি কখনো হয়নি। রাজনীতিতে তিনি দল পরিবর্তন করেছেন ঠিক; কিন্তু তার লক্ষ্য ও বিশ্বাস পরিবর্তন করেননি। দুঃখী মানুষের কল্যাণে কাজ করে গেছেন শেষ পর্যন্ত। কত শত তরুণকে তিনি জীবনে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সুযোগ করে দিয়েছেন, অনেকেই তা জানেন। ভেবেছিলাম তিনি আরও সময় পাবেন, তার স্বাস্থ্যবার্তা তেমন আভাসই দিচ্ছিল। কিন্তু আল্লাহ যা জানেন, মানুষ তো তা জানে না। যখন ডাক এলো, কিছু না বলেই তিনি চলে গেলেন চিরতরে। তার অভাব জাতি অনুভব করছে, করবে আগামী দিনেও।

দুই. ৬ নভেম্বর মরহুম জননেতা, বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী কাজী জাফর আহমদের প্রতি নাগরিক শ্রদ্ধা জানানো হলো। এমন শ্রদ্ধাঞ্জলি আরও আগেই প্রাপ্য ছিল প্রয়াত এ জাতীয় নেতার। তবুও ‘বেটার লেইট দ্যান নেভার’ বলে একটা কথা আছে। দেরিতে হলেও হলো তো! বাংলাদেশের সাবেক প্রেসিডেন্ট অধ্যাপক বদরুদ্দোজা চৌধুরীকে অবশ্যই ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাতে হয় এ জন্য যে, তিনি ‘কাজী জাফর নাগরিক শ্রদ্ধাঞ্জলি কমিটির’ সভাপতি হয়ে এ শ্রদ্ধা নিবেদন অনুষ্ঠানকে অনেক উচ্চতা দিয়েছেন। কাজী জাফর আহমদ অধ্যাপক বদরুদ্দোজা চৌধুরী থেকে ১০ বছরের ছোট। বয়স কম কি বেশি, একজন গুণী ও শ্রদ্ধাভাজন মানুষের ক্ষেত্রে তা বিবেচ্য নয়, মৃত্যুর পর তো নয়ই। যে জাতি গুণীজনের কদর করে না, সে জাতি বড় হতে পারে না। অধ্যাপক বদরুদ্দোজা চৌধুরীর মতো বড় মাপের একজন রাজনীতিবিদ এটা জানেন এবং মানেন বলেই কমিটির সভাপতি হতে সম্মতি দিয়েছেন এবং অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করে শেষ পর্যন্ত উপস্থিত থেকেছেন। কাজী জাফর আহমদের অগণিত ভক্ত-অনুরাগী-অনুসারী নিশ্চয়ই এতে কৃতার্থবোধ করেছেন। অধ্যাপক চৌধুরী কাজী জাফর আহমদকে মরণোত্তর যে সম্মান দিলেন, বিশ্বাস করি তিনিও জাতির কাছ থেকে তেমন সম্মান পাবেন। দুঃখের ব্যাপার হচ্ছে, দেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী হিসেবে রাষ্ট্রীয় সম্মানপ্রাপ্তি থেকে তাকে বঞ্চিত করেছে বর্তমান লীগ সরকার। সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজায় তার জানাজার আয়োজনের জন্য অনুমতি নিতে গিয়েছিলাম আমরা তিনজন- আমি, কাজী নজরুল ও কাজী শাখাওয়াত লিখন। স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী আমাদের সঙ্গে কথা বলার সৌজন্য দেখালে আমরা খুশি হতাম। তার সঙ্গে রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে কিছু করা হবে কিনা জানতে পারতাম। অনুরোধ করতে পারতাম যাতে তা নিশ্চিত করা হয়। কিন্তু তা হয়নি। তবু ধন্যবাদ জানাই চিফ হুইপ আ স ম ফিরোজকে, তিনি স্পিকারের পিএসের রুমে এসে জানাজা করা যাবে বলে জানিয়েছেন দয়া করে। জানাজায় তিনি নিজে উপস্থিত থাকবেন বলেছিলেন। তাকে দোষ দিই না, বুঝতে পারি, কাজী জাফর আহমদকে রাষ্ট্রীয় সম্মান দেওয়ার ব্যাপারে ক্ষমতাসীন সরকারের নেতিবাচক সিদ্ধান্তের কারণেই তিনি থাকেননি। সরকারের তরফ থেকে এমন স্পর্শকাতর ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক বিবেচনা কোনো অবস্থাতেই কাম্য নয়। এতে একদিকে যেমন প্রয়াত রাজনীতিবিদ ছোট হন না, ছোট হন যিনি বা যারা এ আচরণ করেন তিনি বা তারা; অপরদিকে অবজ্ঞা প্রদর্শনকারীর জন্য ভবিষ্যতে তার চেয়ে আরও বেশি অবহেলা-অপমান অপেক্ষা করতে পারে। এর আগে, সাম্প্রতিককালেই এমন আরেকটি নিন্দনীয় দৃষ্টান্ত এই ক্ষমতাসীনরা রেখেছেন প্রথিতযশা সাংবাদিক মরহুম এবিএম মূসার ক্ষেত্রে। অথচ বঙ্গবন্ধুর অত্যন্ত কাছের মানুষ ছিলেন তিনি এবং বাংলাদেশের প্রথম সংসদে তিনি আওয়ামী লীগ দলীয় এমপি ছিলেন। কী এমন ক্ষতি হতো সংসদ প্লাজায় তার জানাজার ব্যবস্থা করলে? সংসদ প্লাজায় প্রয়াত সংসদ সদস্যদের জানাজা একটা রেওয়াজ। সংসদের উদ্যোগেই তা করা হয়। জানাজা এবং সংসদে প্রয়াত সদস্যদের ওপর শোক প্রস্তাব গ্রহণে দলীয় পরিচয় বা ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে রাজনৈতিক মতপার্থক্যের বিষয় আগে কখনো বিবেচিত হয়নি। মূসা ভাইকে তার প্রাপ্য সম্মান থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে একজন আওয়ামী লীগার হয়েও শেষদিকে আওয়ামী শাসনের ন্যায্য সমালোচনা করার কারণে। সরকারের আচরণটা মোটেই যথার্থ হয়নি। রাষ্ট্রীয় সম্মান-মর্যাদা দেওয়া হয়নি বলে কাজী জাফর আহমদ, এবিএম মূসা জনগণের ভালোবাসা থেকে কিন্তু বঞ্চিত হননি। জনগণের অফুরন্ত ভালোবাসার ভেলায় ভাসতে ভাসতেই তারা শায়িত হয়েছেন চিরনিদ্রায়।

এবার একটা কৈফিয়তের পালা। কাজী জাফর আহমদের নাগরিক শ্রদ্ধাঞ্জলি অনুষ্ঠানে অনেক লোকের সমাগম হয়েছিল। অধিকাংশই পরিচিত। অনেকে অনুযোগ করেছেন আমাকে দেখেননি কেন? ৯ নভেম্বর ফেনী থেকে সমীর কর, টাঙ্গাইল থেকে তারা, ১১ নভেম্বর চট্টগ্রাম থেকে নুরুল হুদা, অনিত ও দীলিপ দা, কুমিল্লা থেকে খোকন, খুলনার চন্দনসহ অনেকের প্রশ্নবাণে জর্জরিত হয়েছি, সেদিন আমাকে মঞ্চে দেখা যায়নি কেন? ঢাকা জেলা ন্যাপের সাবেক সভাপতি শামসুল হক ভাইও একই প্রশ্ন করেছিলেন। ১০ নভেম্বর আবার ফোন করে বললেন, সিঙ্গাপুর থেকে আমাদের আরেক শ্রদ্ধেয় বড়ভাই গোলাম কবিরও ব্যাপারটা জানতে চেয়েছেন। গোলাম কবির জাফর ভাইয়ের বন্ধু স্থানীয় রাজনৈতিক সহকর্মী। জাফর ভাইয়ের মৃত্যুর দিন সকাল থেকে রাত অবধি লাশের সঙ্গে ছিলেন। মওলানা ভাসানীর পৃষ্ঠপোষকতায় ১৯৭৩ সালে প্রকাশিত আলোড়ন সৃষ্টিকারী জাতীয় পত্রিকা দৈনিক বঙ্গবার্তার তিনি ছিলেন অর্থদাতা। এ জন্য তাকে মুজিব আমলে নিগৃহীত হতে হয়েছে। জাফর ভাইয়ের সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত এবং এককালীন রাজনৈতিক সম্পর্ক, মুক্তিযুদ্ধকালীন নানা অম্ল মধুর স্মৃতির কথা যারা জানেন, তারা হয়তো আশা করেছিলেন আমি মঞ্চে থাকব এবং জাফর ভাইকে নিয়ে স্মৃতিময় অতীতের কিছু কথা শোনাব। কিন্তু সেটা হয়নি। অনুষ্ঠানের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত কিন্তু আমি ছিলাম। একটা কথা বলার সুযোগ এ লেখায় নিতে চাই যে, অধ্যাপক বদরুদ্দোজা চৌধুরীকে নাগরিক কমিটির সভাপতি করার প্রস্তাবটা আমিই দিয়েছিলাম। ভাসানী অনুসারী পরিষদের মহাসচিব শেখ রফিকুল ইসলাম বাবলু কয়েকবার ঢাকা-চট্টগ্রাম-ঢাকা দৌড়াদৌড়ি করে (তিনি চট্টগ্রামে ব্যবসা করেন) জামাল হায়দার ভাইকে নিয়ে তা নিশ্চিত করেছেন। কেন এমন হলো জবাবে প্রশ্নকর্তাদের বলেছি, শুনেছি, আমার মঞ্চে থাকা বা অনুষ্ঠানের সঙ্গে প্রকাশ্যে সংশ্লিষ্টতা এবং বক্তব্য রাখার ব্যাপারে অধুনা হঠাৎ বিএনপি বনে যাওয়া জনৈক সাংবাদিক নাকি প্রকাশ্যে আপত্তি জানিয়ে বলেছেন, ‘তাতে খালেদা জিয়া অসন্তুষ্ট হবেন।’ কাজী জাফর আহমদের নাগরিক শ্রদ্ধাঞ্জলি অনুষ্ঠানে কারও অনুষ্ঠান পরিচালনা করা, মঞ্চে থাকা বা বক্তব্য রাখার সঙ্গে খালেদা জিয়ার সন্তুষ্টি-অসন্তুষ্টির সম্পর্ক বুঝলাম না। তাছাড়া এরা খালেদা জিয়ার আপন লোকদের চেয়েও এত আপন হলেন কী করে, কবে থেকে? এরা পারেনও! খালেদা জিয়া একদিন হয়তো অনুভব করবেন, এ রকম ‘আপন’ লোক কিছু আশপাশে থাকলে ক্ষতির জন্য ‘পর’-এর দরকার হয় না।

আল্লাহ তাদের হেদায়েত দিন। কাউকে বিব্রত করতে চাইনি বলেই মঞ্চের বাইরে ছিলাম। আশা করি এই ব্যক্তিগত কৈফিয়ৎ অভিযোগকারীদের অভিযোগ থেকে আমাকে মুক্তি দেবে। অনুষ্ঠানে প্রচুর লোকসমাগম ছিল। ইঞ্জিনিয়ারিং ইনস্টিটিউশনের বাইরেও শত শত মানুষ দাঁড়িয়ে বক্তব্য শুনেছে। কাজী জাফর আহমদ জাতীয় পার্টির একাংশের চেয়ারম্যান ছিলেন। তার দলের লোকেরা স্বাভাবিকভাবেই শ্রদ্ধাঞ্জলি অনুষ্ঠানটি সফল করার জন্য কাজ করবেন। তবে বিশেষভাবে এ জন্য ধন্যবাদ পেতে পারেন ভাসানী অনুসারী পরিষদের নেতা-কর্মীরা। সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক শেখ রফিকুল ইসলাম বাবলু এবং সিনিয়র যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আমিনুল ইসলাম সেলিম যে পরিশ্রম করেছেন তা অতুলনীয়। সাংবাদিক মাহফুজউল্লাহর সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. এমাজউদ্দীন আহমদ, বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, নজরুল ইসলাম খান, জাতীয় পার্টির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ফজলে রাব্বি, মহাসচিব মোস্তফা জামাল হায়দার, পরিবেশ বিজ্ঞানী ড. সৈয়দ শফিউল্লাহ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. জসিম উদ্দিন আহমদ, সমাজবিজ্ঞানী ড. মিজানুর রহমান শেলী, অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক মাহবুবউল্লাহ, বিএনপি নেতা অ্যাডভোকেট নিতাই রায় চৌধুরী, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমান, আহসান হাবিব লিংকন এবং কাজী জাফর আহমদের বড় মেয়ে কাজী জয়া। অনুষ্ঠানে বক্তারা কাজী জাফর আহমদের বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক অতীতের কথা বলেছেন, তার স্বপ্ন ও আকাক্সক্ষার কথা বলেছেন। বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোটে জামায়াতে ইসলামীর অন্তর্ভুক্তিতে কাজী জাফর আহমদের ভ‚মিকা যে ভুল ছিল, শেষদিকে ঘনিষ্ঠজনদের কাছে প্রকাশিত তার অন্তর্জ্বালার কথা বলেছেন অধ্যাপক ড. জসীম উদ্দিন আহমদ। ভুল হলে তা স্বীকার করায় কোনো রাজনীতিকের লজ্জাবোধ করা উচিত নয়, কাজী জাফর আহমদ ভুল স্বীকার করে সেই সত্যই রাজনীতিবিদদের সামনে তুলে ধরেছেন। অসুস্থ অবস্থায় দেশের অবনতিশীল রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে তিনি অস্থির, চঞ্চল ছিলেন। চাইতেন রাজনীতির গুণগত পরিবর্তন। গণতন্ত্রের পালে আবার উদ্দাম হাওয়া লাগুক, এ ছিল তার একান্ত কামনা। সারা জীবনের সাধনাও ছিল তাই। তার জীবনে রাজনীতিই ছিল প্রথম, রাজনীতিই ছিল শেষ। মানুষের চোখের তারায় তিনি ছড়িয়ে দিতে চেয়েছেন উন্নত ও সমৃদ্ধ জীবনের স্বপ্ন। দেশে উগ্র সাম্প্রদায়িকতা, জঙ্গিবাদ নিয়ে উৎকণ্ঠা ছিল তার। বলতেন, একে অপরকে দোষারোপ করে এ ভয়ঙ্কর বিপদ থেকে জাতিকে রক্ষা করা যাবে না। এ জন্য প্রয়োজন দল মত নির্বিশেষে জাতীয় ঐক্য। তিনি ধর্মানুরাগ-ধর্মাচার আর ধর্মান্ধতাকে আলাদা চোখে দেখতেন; ধর্মীয় চেতনা ও ইসলামী মূল্যবোধকে সম্মান করতেন; কিন্তু ধর্মের নামে উগ্রবাদ ও জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে ছিলেন সোচ্চার। দ্রুত একটি অংশগ্রহণমূলক জাতীয় নির্বাচন দেশের বর্তমান শ্বাসরুদ্ধকর রাজনৈতিক পরিস্থিতির অবসান ঘটাবে বলে বিশ্বাস ছিল তার। অধ্যাপক বদরুদ্দোজা চৌধুরীও তার অনুভবের কথা বলেছেন তার ভাষণে। উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার কথা বলেছেন, করণীয়ও নির্দেশ করেছেন। তিনি সরকারের উদ্দেশে বলেছেন, ‘মানুষের মধ্যে, জনগণের মধ্যে ফিরে আসুন। আকাশ থেকে মাটিতে নেমে আসুন। দেশ রক্ষার কথা বলুন, জাতীয় সরকার গঠন করুন। মাটিতে আপনাদের নামতেই হবে। এখনই সমস্যার সমাধান করা না গেলে আরও কঠিন পরিস্থিতিতে পড়তে হবে। সেটা জাতির জন্য মঙ্গলজনক হবে না। মানুষের জন্য রাজনীতি করার যে সংস্কৃতি, এখন তা নেই। সে সংস্কৃতির অধঃপতন ঘটেছে। দেশে আজ নির্বাচিত সরকার নেই উলে­খ করে তিনি বলেন, ‘তারা বলেছিল নিয়ম রক্ষার নির্বাচনের পর নতুন নির্বাচন দেবে। নিজেদের সে কথা তারা রাখেনি। সে নির্বাচন শুদ্ধ করার কোনো চেষ্টাও করেনি। তাই এখন একের পর এক অন্যায় হচ্ছে, গণতন্ত্রকে হত্যা করা হচ্ছে। কাজী জাফর বেঁচে থাকলে এসবের বিরুদ্ধে লড়ে যেতেন।’ হ্যাঁ, কাজী জাফর আহমদকে যারা চেনেন, তারা জানেন, কাজী জাফর আহমদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যই ছিল এমন যে, ‘অন্যায়ের কাছে নত নাহি হবে শির/ভয়ে কাঁপে কাপুরুষ, লড়ে যায় বীর।’ প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার মধ্য দিয়ে তার রাজনৈতিক পথচলা শুরু। তিনি পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের এককালীন সাধারণ সম্পাদক, সেই আইয়ুবি রাজত্বে। তিনি ছাত্রজীবন ও ছাত্ররাজনীতি শেষে শ্রমিক আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হন এবং দীর্ঘদিন বাংলা শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি ছিলেন। তার নেতৃত্বে টঙ্গীসহ সারা দেশে সুতাকল শ্রমিকদের আপসহীন সাহসী লড়াই একই সঙ্গে মালিক ও সরকারের নাভিশ্বাস তুলেছিল। তার নেতৃত্বে টঙ্গীর আন্দোলন এদেশের শ্রমিক আন্দোলনের ইতিহাসের অন্তর্গত বিষয়। তিনি এদেশে চীনপন্থি বাম আন্দোলনের অন্যতম প্রধান উদ্গাতা। আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট শিবির রাশিয়া ও চীন- দুই শিবিরে বিভক্ত হয়ে যাওয়ার পর মাও সেতুং ও চীন পার্টির লাইনকে সঠিক বলে তিনিই প্রথম সাহসী উচ্চারণ করেছিলেন। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম এ সংগঠক কাজী জাফর আহমদ, হায়দার আকবর খান রনো, রাশেদ খান মেনন, আবদুল মান্নান ভ‚ঁইয়া, মোস্তফা জামাল হায়দার, আবদুল্লাহ-আল নোমানসহ বাংলাদেশের এককালের বামপন্থি প্রগতিশীল আন্দোলনের অনেক নেতার নেতা ছিলেন। মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বাধীন ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির তিনি সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। ছিলেন ইউপিপির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ও সভাপতি। কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের পূর্ববাংলা সমন্বয় কমিটির তিনি ছিলেন প্রধান নেতা। লেনিনবাদী কমিউনিস্ট পার্টিরও তিনি অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা নেতা ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধকালে তার সম্পাদনায় আগরতলা থেকে প্রকাশিত হয়েছিল সাপ্তাহিক ‘স্বাধীন বাংলা’।

আমি ছিলাম ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক। অত্যন্ত বেদনাদায়ক বিষয় হচ্ছে- কাজী জাফর আহমদের নাগরিক শ্রদ্ধাঞ্জলি অনুষ্ঠানে রাশেদ খান মেনন এবং হায়দার আকবর খান রনো আসেননি। রাশেদ খান মেনন আসেননি মন্ত্রিত্বের চাকরি চলে যাবে বলে। কেননা সরকারের কাজী জাফর আহমদের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি নেতিবাচক। হায়দার আকবর খান রনো আসেননি নাকি তার পার্টিগত (সিপিবি) অবস্থানের কারণে। রাজনৈতিক মতপার্থক্যের কারণে মৃত্যুর পর কারও জানাজা, দাফন বা স্মরণসভায় হাজির হতে আপত্তি তোলা খুবই ছোট মনের পরিচায়ক। এতে রাজনীতির প্রশ্ন অবান্তর। কাজী জাফর আহমদ তাদের এককালীন নেতা ছিলেন, রাজনৈতিক অবস্থানে তাদের চেয়ে বড় ছিলেন, বড়ই থাকবেন। তারা ছোট ছিলেন, আরও ছোট হলেন। যে রাজনীতি স্রেফ মতপার্থক্যের কারণে মৃত্যুর পরও কারও প্রতি হিংসা-বিদ্বেষের ভাব ছড়ায়, ধিক সে রাজনীতিকে।  কাজী জাফর আহমদের ওপর এটা কোনো পূর্ণাঙ্গ লেখা নয়। তাকে নিয়ে লেখার আছে অনেক। তার অগণিত অনুরাগীর প্রত্যাশা পূরণের চেষ্টা ইনশাআল্লাহ করব।

                লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট

ই-মেইল :  [email protected]

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর